ঢাকায় প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শন করে ব্রেডফোর্ড সিনেম্যাটোগ্রাফি কোম্পানি। ১৮৯৮ সালের ১৭ই এপ্রিল তারিখে। এই চলচ্চিত্র প্রদর্শনী নিয়ে সাপ্তাহিক ‘ঢাকা প্রকাশ’-এ সংবাদ প্রকাশিত হয়। ‘অত্রত্য ক্রাউন থিয়েটারে অদ্য রাত্রি হইতে এক অদ্ভত দৃশ্য প্রদর্শিত হইবে। ব্রেডফোর্ড সিনেমাটোগ্রাফ কোম্পানী এরূপ সজীব চিত্র প্রদর্শন করিবেন যাহা দেখিয়া বিস্ময় জন্মিবার সম্ভাবনা।’
সত্যি এটা ছিল ঢাকাবাসীর জন্য এক অভূতপূর্ব বিস্ময়। এজন্যই তাদের কাছে ‘ঢাকা প্রকাশ’ চলচ্চিত্রকে ‘সজীব চিত্র’, ‘বিস্ময়’ ও ‘ক্রীড়া’ বলে পরিচিত করায়। অন্য একটা সূত্রে জানা যায়, ১৮৯৮ সালের বছরখানেক আগেও কোলকাতার স্টার থিয়েটার ঢাকায় এসে বায়োস্কোপ দেখিয়েছিল। কোলকাতার স্টার থিয়েটারের ঢাকায় এসে নাটক প্রদর্শনীর ঘটনা আরো পুরাতন। এসব নাটক প্রদর্শনীতে নবাব আহসানউল্লাহ বাহাদুর-এর পৃষ্ঠপোষকতা ছিল।
বায়োস্কোপ কি? বায়োস্কোপ হলো আমাদের সিনেমার আদিরূপ। এর আগে ছিল ফটোগ্রাফ ও ছায়াবাজী। ফটোগ্রাফ মানে স্টিল ছবি। আর ছায়াবাজীতে স্টিলছবিকেই একটু নাড়াচাড়া করানো হতো। মানুষেরা একটা বাক্সের ভেতর তা উঁকি দিয়ে দেখতো। একটি লোক ঘুঙুরের তালে তালে সুর করে গাইতো আর ঐ স্টিল ফটোগ্রাফের বর্ণনা করতো। বেশিরভাগ লোকে একে বায়োস্কোপ বলে চেনে। মুলত এর নাম পিপশো।
বায়োস্কোপ হলো প্রথম জীবন্ত চিত্র, চলচ্চিত্র। এজন্যই প্রথম বায়োস্কোপ দর্শকের কাছে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। মানুষের জীবন্ত চিত্র আসলেই তো বিস্ময়কর। ব্রেডফোর্ড সিনেম্যাটোগ্রাফি কোম্পানি ক্রাউন থিয়েটারে প্রথম যে বায়োস্কোপ দেখিয়েছিল, সেখানে ছিল গ্রীক তুরস্কের যুদ্ধের দৃশ্য, তুরস্কের মুসলমান সৈন্যরা কিভাবে গ্রীকদের হত্যা করছে, শ্রীমতি ভারতেশ্বরীর ডায়মন্ড জুবিলীর মিছিল, কুমারী ডিয়নের ৩০০ ফুট উঁচু থেকে পানিতে পড়ার দৃশ্য, রুশ জারের অভিষেক, পাগলা নাপিতের ভয়াবহ ক্ষুর চালানোর ক্যারিশমাতি, ফ্রান্সের ব্যস্ত রাস্তায় মানুষের চলাচল ইত্যাদি।
উপমহাদেশে প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনী থেকে খুব বেশী পিছিয়ে নেই ঢাকা। লুমায়েরী ভ্রাতৃদ্বয় ১৮৯৫ সালের ২৮ শে ডিসেম্বর প্যারিসে প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শন করেন। এই ভারত উপমহাদেশে প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয় তার কয়েকমাস পর ১৮৯৬ সালের ৭ই জুলাই। বোম্বাইয়ের ওয়াটশন হোটেলে প্রথম প্রদর্শিত হয় ‘এ্যারাইভাল অব এ ট্রেন’, ‘দ্যা সি বাথ’, ‘এ ডেমলিশন’ নামের সব চলচ্চিত্র। লুমায়েরী ভ্রাতৃদ্বয়ই এসব চলচ্চিত্র দেখান। বোম্বে প্রদর্শনীর পর কোলকাতায় একই বছর ১৮৯৬ সালেই চলচ্চিত্র প্রদর্শন করেন স্টিফেন্স নামের এক ভদ্রলোক।
এই স্টিফেন্সই ছিলেন আমাদের চলচ্চিত্রের পথিকৃত হীরালাল সেনের প্রেরণা। যদিও স্টিফেন্স হীরালাল সেনকে সাহায্য করেনি। হীরালাল ছিলেন বাঙালি, আমাদের মানিকগঞ্জের ছেলে। বাঙালি হীরালাল সেনকে সে ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দী ভেবে অনেকদিন ঘুরানোর পরও বায়োস্কোপের কায়দা কানুন বুঝিয়ে দেননি। কিন্তু হীরালাল সেন দমবার পাত্র ছিলেন না। পত্রপত্রিকা ঘেটে বিষয়টি বোঝেন। তারপর মায়ের কাছে থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি নিয়ে আসেন। হীরালাল সেনকে সাহায্য্ করেন ফাদার ল্যাঁফো।
বাঙালী হীরালাল সেন এক সিনেমা পাগল মানুষ। আমাদের চলচ্চিত্রের পাওনীয়র। হীরালাল সেনের বাড়ি মানিকগঞ্জের বগাজুরি গ্রামে। হীরালাল সেনের বাবা চন্দ্রমোহন ছিলেন আইনজীবি। ঢাকার পরে কোলকাতা হাইকোর্টে প্রাকটিস শুরু করেন। সেই সুবাদে কোলকাতাতে থাকতেন। প্রথম থেকেই মাথায় ছিল ফটোগ্রাফির পোকা। ছাত্রাবস্থায় ক্যামেরা যোগাড় করে ফটোগ্রাফি চর্চা শুরু করেন। কোলকাতায় ‘এইচ এল সেন এ্যান্ড ব্রাদার্স’ নামে একটা স্টুডিও খুলে বসেন। ‘এ্যান্ড ব্রাদার্স’ মানে তার দুই ভাই। তার সহযোগী। মতিলাল সেন আর দেবকীলাল সেন।
অদ্ভুত বায়োস্কোপের যাদু তাকে পেয়ে বসে। সে থেকেই বানিজ্যিক ভিত্তিতে হীরালাল সেন ছবি দেখানো শুরু করেন। হীরালাল সেনের কোম্পানীর নাম ছিল ‘দি রয়েল বায়োস্কোপ কোম্পানী’। এই কোম্পানী ভোলার এসডিও’র বাংলোতে, ভাওয়ালের রাজা রাজেন্দ্র নারায়ন রায়ের বাড়িতে এবং জগন্নাথ কলেজে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিল। এসব প্রদর্শনীর প্রচারণা ছিল এরকম;
জীবন্ত চিত্র! জীবন্ত চিত্র!! জীবন্ত চিত্র!!!
পাশ্চাত্য জগতের শিক্ষিত হস্তে পরিচালিত।
প্রবেশ মূল্য নির্ধারিত ছিল
প্রথম শ্রেণী: ১ টাকা
দ্বিতীয় শ্রেণী- ৮ আনা,
তৃতীয় শ্রেনী- ৪ আনা
চতুর্থ শ্রেণী- ৩ আনা।
স্ত্রীলোকদের জন্য গ্যালারী টিকেট ৮ আনা।
হীরালাল সেন কেবল চলচ্চিত্র প্রদর্শনেই আটকে থাকেন নি। চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য প্রেক্ষাগৃহ নির্মান করেন। তার হাতেই শুরু হয় উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র। ১৯০০ সালে ইংল্যান্ড থেকে ক্যামেরা আনার পর কোলকাতার ক্লাসিক থিয়েটারের মালিক অমরদত্তের সাথে যোগাযোগ করেন। তখনকার জনপ্রিয় মঞ্চ নাটক ছিল ‘সীতারাম’। সীতারামের নির্বাচিত অংশই বেছে নেন তার প্রথম চলচ্চিত্রের জন্য। সীতারামের কাহিনী দিয়েই হীরালাল সেন ও বাঙালি চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু। ১৯০০ থেকে ১৯১২ সালের মধ্যে ১২টি কাহিনী চিত্র, ১০টি তথ্য চিত্র ও ৩ টি বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাণ করেন হীরালাল সেন।
এরপর ১৯১৩ সালে মুক্তি পায় ভারতের প্রথম পুর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র দাদা ভাই ফালকে পরিচালিত ‘রাজা হরিশ চন্দ্র’। আর ১৯১৮ সালে কোলকাতায় মুক্তি পায় প্রথম বাংলা পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র রুস্তমজী দুতিয়াল পরিচালিত বিলমঙ্গল। এ সবকিছুই চলচ্চিত্রের নির্বাক যুগের গল্প।
এসব নির্বাক চলচ্চিত্র ঢাকাতেও দেখানো হয়। চলচ্চিত্র দেখানোর জন্য ব্যবহার করা হয় ডায়মন্ড জুবিলী থিয়েটার (পরবর্তীতে লায়ন থিয়েটার) ও ক্রাউন থিয়েটার হল। ব্রেডফোর্ড কোম্পানীর প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনীও এই ক্রাউন থিয়েটারেই করা হয়েছিল। দর্শক চাহিদা বাড়তে থাকলে শুধুমাত্র চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য প্রথম একটি প্রদর্শনী হল ‘পিকচার হাউজ’ নির্মান করা হয়। যা পরবর্তীতে শাবিস্তান নামে পরিচিত হয়। এই পিকচার হাউজ বা শাবিস্তানই আমাদের প্রথম প্রেক্ষাগৃহ। আমাদের প্রথম রূপালী পর্দার জগত।
নির্বাক যুগে ঢাকা কি কেবল চলচ্চিত্রই প্রদর্শন করেছে? সেরকম ভাবার কোন কারণ নেই। ঢাকা সেসময়ে চলচ্চিত্র নির্মাণেও হাত দিয়েছে। সারা বিশ্ব যখন এক নতুন শিল্প মাধ্যম নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে। মেধাবি তরুণেরা সৃজনশীলতায় মেতে উঠেছে। তখন ঢাকার নবাব পরিবারের সংস্কৃতিমনা কিছু তরুণও চলচ্চিত্র নির্মোনের উদ্যোগ নেয়। তারা গঠন করে আমাদের অঞ্চলের প্রথম প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘ঢাকা ইস্টবেঙ্গল সিনেমাটোগ্রাফ সোসাইটি’। এটা ১৯২৭-২৮ সালের দিকে, যখন ঢাকার পেশাদারি থিয়েটার চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর সাথে টিকতে পারছে না, এমন একটা সময়। ঢাকা ইস্টবেঙ্গল সিনেমাটোগ্রাফ সোসাইটি প্রথম পূর্ণাঙ্গ নির্বাক চলচ্চিত্র ‘শেষ চুম্বন’ বা ‘দ্য লাস্ট কিস’ নির্মান করেন। লাস্ট কিসের আগে ‘সুকুমারী’ নামের একটা নিরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিল তারা। যাকে বলে নেট প্রাকটিস। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন অম্বুজ গুপ্ত। অম্বুজ গুপ্ত ছিলেন জগন্নাথ কলেজের শরীর চর্চার প্রশিক্ষক ও নাট্য পরিচালক। নায়ক ছিল খাজা আদেল ও খাজা নসুরুল্লাহ। নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেন সুন্দর চেহারার তরুন আব্দুস সোবাহান। এ চলচ্চিত্র কোন প্রেক্ষাগৃহে দেখানো হয়নি। নবাব মঞ্জিলেই এর প্রদর্শন হয়েছে।
এর পরপরই তারা দ্য লাস্ট কিস নির্মানের কাজে নেমে পড়েন। ‘দ্য লাস্ট কিস’ এর পরিচালকও ছিলেন অম্বুজ গুপ্ত। চিত্রগ্রাহক খাজা আজাদ। এ ছবিতে আর পুরুষকে নারী বানানো হয় না। ‘দ্য লাস্ট কিস’এর নায়িকা ছিল লোলিটা। আরেক অভিনেত্রী ছিল চারুবালা। লোলিটা ও চারুবালাকে আনা হয় পতিতালয় থেকে। নায়ক ছিলেন খাজা আজমল। এক বছর লাগে এর শুটিং করতে। ১২ রিলের এ চলচ্চিত্রটি নির্মানে ব্য্য় হয় ১২ হাজার টাকা। গল্পটি ছিল দুটো পরিবারের দ্বন্দ্ব। নায়ক নায়িকাকে যাত্রা দেখতে নিয়ে যায়। পথে জমিদারের লোকেরা নায়িকাকে অপহরন করেন। পরে জমিদারের ঘরে নায়িকাকে পাওয়া যায়। শেষ দৃশ্যে নায়ক নায়িকা দুজনেই মারা যায়। এই নির্বাক চলচ্চিত্রটি বাংলা, উর্দু ও ইংরেজী সাবটাইটেল করে ১৯৩১ সালে মুকুল হলে (পরবর্তীতে আজাদ হল) মুক্তি দেয়া হয়।
এই নির্বাক যুগের ইতি টানে ১৯৫৬ সালে মুক্তি পাওয়া আব্দুল জব্বার খানের পরিচালনায় প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’। মুখ ও মুখোশের মাধ্যমে বাংলা ফিচার ফিল্মএর যাত্রা শুরু হয়। ৬০ দশকের নবজাগরণের হাওয়া লাগে চলচ্চিত্রেও। এ হাওয়া তরঙ্গ তোলে। তরঙ্গে তরঙ্গে ফুলেফেপে ওঠে আমাদের বাংলা সিনেমার উদ্যম তারুন্য কাল, সোনালী যুগ। এরপর বাংলা সিনেমা আর যুবক বা পরিনত হতে পারে না। আবার দীর্ঘ শৈশবেই হামাগুড়ি দিতে থাকে। বিশ্ব চলচ্চিত্র আসরে দাঁড়ানোর মত দু’একটা ঝলক, দু’একজন মেধাবী নির্মাতার কিছু প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয় এই শৈশবকাল কাটানোর। প্রয়োজন নতুন চিন্তার ঢেউ। চলচ্চিত্র আন্দোলন। এরজন্য পারিপার্শ্বিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিও গুরুত্বপূর্ণ। সেটাকেও প্রস্তুত করতে হবে একই সাথে।
[তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস/অনুপম হায়াৎ]