কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার ছিলেন আপদমস্তক কবি। সত্তুর দশকের মধ্য থেকে মূলত বিকাশযাত্রা এবং আশির দশকে তাঁর ঈর্ষণীয় পরিপূর্ণতা।বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় নিয়মিত লিখেছেন। বাবা কবি হওয়ার কারণেই শৈশব থেকেই কবিতার সাথে নিত্য পথচলা। ১৯৯৫ সালে আহমেদুর রশীদের সম্পাদনায় “শুদ্ধস্বর” র পঞ্চম সংখ্যায় কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারের উপর ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়েছিলো। তাকে আত্মবিধ্বংসী কবিও বলা যায়। তবে যারা আত্মবিধ্বংসী তারা আত্মজিজ্ঞাসুও। এই অকাল প্রয়াত কবি কিশওয়াল ইবনে দিলওয়ার – এর জীবদ্দশায়ই তাঁর পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ ( সুষম দৃষ্টিতে, প্রথম প্রকাশ- সেপ্টেম্বর ১৯৭৯ ইং, সংঘর্ষ: আলো – অন্ধকার, প্রথম প্রকাশ – ফেব্রুয়ারী ১৯৮৯ইং, ছায়া শরীরীয় গান, প্রথম প্রকাশ- ১৯৯৭ইং, পাখীর রাজার কাছে, প্রথম প্রকাশ- অক্টোবর ২০০১ইং, চিবোয় প্রকৃতি, প্রথম প্রকাশ- ২০০২ইং, প্রবন্ধত্রয়ী, প্রথম প্রকাশ – ডিসেম্বর ১৯৮৯ইং)। একটি প্রবন্ধগ্রন্থ এবং দুইশত চৌত্রিশটি অপ্রকাশিত কবিতা নিয়ে রচনা সমগ্র বের হয়। ফলে কিশওয়াল- রচনা একত্র পাঠের সুযোগ হওয়ায় নতুন করে পাঠকীয় জিজ্ঞাসা তৈরী হয়েছে অথবা গ্রহণ – বর্জন স্পৃহা ঘনবদ্ধ হয়েছে বিবিধ প্রযত্নে। কিশওয়ার এর রচনা সমগ্রে তাঁর কোন গল্প সংকলিত হয়নি। “রানুর অন্তিম পাঠ” শিরোনামক গল্পটি বাংলা কথা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। কবি কিশওয়ার পৌঁছেছিলেন অজানায়, এ সাক্ষ্য নির্দ্ধিধায় দেয়া যেতে পারে। শুধু কবিতায়ই নয়, ব্যক্তিজীবনেও দীর্ঘদিন ভুগেছেন সিজোফ্রেনিয়ায়। এবং তা আমৃত্যু লালনও করেছেন। পরিশেষে বলতে চাই, তিনি মৌলিক কবি। তিনি কবি।
আমার মন্দিরা
কে আমায় ভালোবাসা দেবে
উষ্ণ উষ্ণ অঙ্গ ঢেলে দেবে
বাঁশরী বাজবে সারারাত
মিলন সংস্কারহীন সহজ গমন
আদিম অন্ধকার আলো।
পাশে ফিরে শোয় মৃত্যু মগ্ন
শূন্যতার স্বরূপ শীতল,
গতিপথে অতিকায় সূক্ষ্মতা
আমার মন্দিরা সর্বত্র বাজায়।
পারা না পারা
আমি জোয়ার ভাটার কালে;
নদী উচ্ছন্নে গেছে বলে
চিৎকার দিতে পারি
হ্যাঁ পারি, আমি পারি, আমি পারি।
আমি মনের মতো ছবি আঁকতে পারি
আমি কথামালা সাজিয়ে সাজিয়ে
একটি কবিতা লিখতে পারি
হ্যাঁ পারি, আমি পারি।
আমি গবেষণাগারে
একজন মানুষকে নিয়ে
পশু এবং ঈশ্বরকে নিয়ে,
বই – বৃক্ষ – স্বর্গ – নরক নিয়ে
থিসিস্ লিখতে পারি
হ্যাঁ পারি, আমি পারি।
কিন্তু যখন মৃত্যু আসে আমি তাকে রোধ
করতে পারি না,
আমি মানুষ – সর্বাঙ্গ সুন্দর হতে পারি না।
তাই আমি পারা আর না পারার মাঝে
অভিধানে ‘পারি’ লিখতে পারি
অথাব- ‘পারি না’।
এক খণ্ড মেঘ উড়ে আসে
আমার শূন্য ঘরে আলো আঁধারির খেলা
মূল্যহীন আমার কাছে প্রেমের পয়গাম
সময় আমার নেই অঢেল সময়
শূন্যতার মাঝে আমি খুঁজে পাই
আমার অসময়।
প্রেম যেন ভার্সিটির ব্যালকনিতে
এক ঝলক রোদ;
অসীম শূন্যতা তবুও আমি ঘুমিয়ে পড়ি
প্রেমের জন্য রোদের মাঝে।
এক খণ্ড মেঘ উড়ে উড়ে আসে
বৈশাখের বির্বণ বিকেলে
তবুও সে প্রেমের কাছে শূন্যতা
হারিয়ে যায়
আমার প্রেমিক সত্তা, প্রেমিকার কাছে।
ভার ধার
মরে গেলে, অবস্থাজনিত সুখ
সকল বেদনা হরণ করে
খাই খাই স্বভাব লুপ্ত হয়
শরীরের ভার ধার কিছুই থাকে না।
সত্তাস্থিতি, অবিচল আলো হয়ে থাকে
সগৌরবে মাথা উঁচু করে
অনন্ত অসীম শূন্যতা।
জীবিতের কেউ কেউ কিছু শংকিত হয়
অন্যেরা তামাশা করে
স্বাভাবিক রীতি নীতি মেনে চলে
বিচলিত বোধ, ক্ষণকাল তাতে প্রহরান্ত ঢেউ।
যতিহীন, সঞ্চরণশীল
ফিরে আসি নিশ্চিত চিহ্নে
মেনে নিয়ে সহনীয় পাথরের ভার
গোলাপের পরিচয় যথাযথ বাগানে ফুটেছে
গন্ধে তারা মনানন্দ পায়
যারা যারা গোলাপ প্রেমিক
ধাঙ্গড় অজ্ঞান হয় সহ্যাতীত আতরের ঘ্রাণে
তাই তার ভাগাড়ের দুর্গন্ধে পক্ষপাত আছে
নিজস্ব বলয়ে ফিরি
বিনাশী স্বভাব শুধু ডাকে
একটি গতির দিকে ধাবমান থাকি
যে গতির যতি নেই
ক্রমাগত সঞ্চরণশীল।
অবিচল মূর্তি
তোমাকে চিহ্নিত করে
মানুষ প্রশান্ত হলো,
আমার স্বপ্নের ফল দাও
অবিচল মূর্তি করো নক্ষত্র সমান।
শূন্যতার চক্রযানে আলোর জোয়ার বয়
আমি তাতে স্নান করি অনন্ত কাল।
যদি সুশীতল হয় আলিঙ্গন
আমি পাবো মুক্তির নিঃশ্বাস,
মুক্তির পরিতৃপ্তি পেলে
ভস্ম থেকে পুনর্বার জন্মাই।
তাপ
মৃতের শরীর
পুরোপুরি হিমশীতল নয়
তার একটা তাপমাত্রা আছে
আলো বিকিরণ আছে
মাটিতে মিশে গিয়ে
শেকড় বাকড় মেলে
হাওয়ার আভার মতো পরিপুষ্ট হয়
এবং চিরজীবন্ত থাকে অবিনশ্বরতায়।
আমি আমাতেই
আকাশে ঘনঘটা আর ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি
এবং বুক কাঁপানো বিজলী,
আমি আমাতেই ঈশ্বরকে পুষে রেখেছি
জন্ম লগ্ন থেকে-
আকাশে ঘনঘটা এবং ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি।
বন্ধু, তোমার বুকে কী ক্ষত আছে?
তবে এসো আমার কাছে
আমি ক্ষত ঢেকে দেবো ঝকঝকে রোমাল দিয়ে
আকাশে ঘনঘটা এবং ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি।
জনতা, দেশে কী যুদ্ধ ডংকা বেজেছে?
যদি বেজে থাকে আমাকে বলো
আমি সেটা প্রতিহত করবো কবিতার মতন
সুন্দর কিছু পিপাসা দিয়ে
আকাশে ঘনঘটা এবং ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি।
দিব্য দৃষ্টি
সিংহের কেশরের মতো শাদা মেঘ
ঘিরে রেখেছে আকাশের চাঁদ
সেই তরল সৌন্দর্যের প্রতিরূপ
পৃথিবীর পবিত্র নারীরা।
জমাট কালো জলে ডুবে যায়
তোমার শরীর কখনো কখনো,
কম্পমান বিদ্যুৎতের চিত্রল সাপ
তোমার অবয়ব বেয়ে
নিঃশব্দে সাঁতরায়
অনন্তকাল আছো হে অবিনাশী
ভাসমান শূন্যের বিমান
বিশ্বের শেষ পতনে তোমার অবসান
গ্রহে গ্রহে প্রাণনাশ করে
আজীবন করে প্রভূত জীবন
আমার অন্তর্গত বিন্দুপাত ঘটে
সকল আলোর উৎসমূলে,
অতল অন্ধকারে
এই দিব্য দৃষ্টি যায় খুলে।
অস্তিত্বের শ্লোক
আমাকে হত্যা করো
প্রভুর আদেশে।
হত্যার সময়
বধ্যভূমিতে
প্রভু, মৃত্যুদন্ডে করে অভিনয়।
ঘাতক।
দর্শক।
আর নিহতের
কর্তিত মস্তক,
শূন্যে হয় জল-অনল
আলোকালো সন্ত-পাপী
অস্তিত্ব ধারক।
আমাকে হত্যা করো
প্রত্যাদেশে
প্রভুকে হত্যা করো
আমার আদেশে
আমি প্রভু
প্রভু আমি
প্রেমের-পালক।
হৃদয়ে তোমাকে পেলে
প্রেম;
প্রাণ দিতে প্রাণ নিতে
আর প্রাণহীন হতে
শূন্যে আরো শূন্যে হই
সকল সময়।