কবি মজিদ মাহমুদের কবিতা পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে – জীবনের চলমানতা, খণ্ডচিত্রের তৃপ্ত বৈচিত্র্য, মিশ্রিত প্রকাশ – রীতির চাতুর্য, বাক্ প্রতিমার বিন্যাস ও কাব্যশৈলীর স্বচ্ছন্দ উত্তরণ তার আয়ত্তাধীন। মজিদ মাহমুদের কবিতা নিবিড় চেতনা থেকে হৃদয়ের রেখাচিত্রে এক সরলরেখার দাগ টানা। মানুষের নিগূঢ় বাস্তবতাকে শিল্প দর্শনে তুলে আনা এই কবির কবিতার কোথাও কোথাও তৈরি করেছে শব্দ বিন্যাসের কী সুন্দর আত্মকথন। যেখানে তিনি দেখতে পেরেছেন “প্রাণকে লোভনীয় এক টুকরো মাংসের মতো”। কেবল এ যেন ভাব – ব্যঞ্জনার উপলব্ধি, যা তিনি নিঁখুতভাবেই করতে পেরেছেন। মজিদ মাহমুদ আশির একটা নিজস্ব স্বকীয়তা ধারণ করে গ্রামীণ লোকশিল্পকে তার কবিতায় অভিনবত্ব দিয়েছেন। তার কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয়েছে মজিদ মাহমুদ কবিতার কাছে সত্যিই দায়বদ্ধ। এক কথায় কবিতাই তার গম্ভীর ও গাঢ় উচ্চারণ।
এবাদত
মাহফুজা তোমার শরীর আমার তছবির দানা
আমি নেড়েচেড়ে দেখি আর আমার এবাদত হয়ে যায়
তুমি ছাড়া আর কোনো প্রার্থনায়
আমার শরীর এমন একাগ্রতায় হয় না নত
তোমার আগুনে আমি নিঃশেষ হই
যাতে তুমি হও সুখী
তোমার সান্নিধ্যে এলে জেগে ওঠে প্রবল ঈশ্বর
তুমি তখন ঢাল হয়ে তাঁর তির্যক রোশানি ঠেকাও
তোমার ছোঁয়া পেলে আমার আজাব কমে আসে সত্তরগুণ
আমি রোজ মকশো করি তোমার নামের বিশুদ্ধ বানান
কোথায় পড়েছে জানি তাসদিদ জজম
আমার বিগলিত তেলওয়াত শোনে ইনসান
তোমার নামে কোরবানি আমার সন্তান
যূপকাঠে মাথা রেখে কাঁপবে না নব্য-ইসমাইল
মাহফুজা তোমার শরীর আমার তছবির দানা
আমি নেড়েচেড়ে দেখি আর আমার এবাদত হয়ে যায়।
অর্জুন
অর্জুন গাছ জড়িয়ে ধরলে ব্লাড-পেশার কমে
অর্জুনের ছাল হৃদরোগের মহৌষধ
এমন একটা গাছকে আমি বিয়ে করতে চাই
বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেলে
রক্তের চঞ্চলতা বেড়ে গেলে
যে আমাকে আলিঙ্গন করবে
বল্কলের পোশাক খুলে বলবে
আমার রস শুষে নাও
তোমার হৃদপিণ্ড সচল করো
আমি সপ্রাণ-গাছ তবু ব্যথা নেই
অভিযোগ নেই
আমি সারাদিন সূর্যের আগুনে রান্না করি
রাত এলে অন্ধকারে একা দাঁড়িয়ে থাকি
পাখিটি
আমিও চাইতাম পাখিটি উড়ে যাক
আমার ঘরের পাশে সারাদিন যেন না শুনি তার সুমধুর ডাক
তাই ঘরের দরোজায় দাঁড়িয়ে তাকে দিয়েছি হাততালি
সত্যিই কি আমি চেয়েছিলাম—তাকে হারিয়ে ফেলি
অবাক বিস্ময়ে দেখি তার দ্বিধাহীন উড়াল
এখন পাখিটি নেই; পড়ে আছে শূন্য ডাল
আমারও হয়তো ছিল কিছুটা ভুল
তাই দোষারোপ করি না তাকে—গুনে দিই মাশুল
তবে কিছুটা ভুলের আছে প্রয়োজন
যদি পেতে চাই গানের ভেতর নীরবতার আস্বাদন।
ঈশ্বরের নাম
ঈশ্বরকে যখন আমরা ঈশ্বর নামে ডাকি
তখন ঈশ্বর গুটিয়ে যান নিজের সত্তায়
আমাদের দিকে না তাকিয়ে
তিনি তার ইজেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন
শিশুদের হাতের সাথে একটি প্রজাপতি
কিংবা একটি আপেলের রঙ নিয়ে থাকেন ব্যস্ত
একজন কবিকে তুমি যদি কবি নামে ডাকো
প্রাথমিক উদ্দীপনায় হয়তো দেবে সাড়া
কিন্তু যখন সে জানবে তার কবিতাগুলো অনধিত
তখন অবজ্ঞায় ফিরিয়ে নেবে মুখ
বলবে এসব লোকের কাছে কবিতার কি মানে
বরং তার কবিতা থেকে একটি পংক্তি
যদি নির্ভুল করে থাক পাঠ
তাহলে কবির হৃদয় প্লাবনে হবে সিক্ত
ঠিক প্রভুও ফুলের নামে পাখির নামে
নদী ও সমুদ্রের নামে ভাস্বর
তবে মানুষের নাম তার সব থেকে অপছন্দ
কারণ একটি ফুল চিরকাল ফুল
যেমন গোলাপ বেলি চামেলি জুঁই; কিন্তু মানুষ!
গোত্রের বাইরে সে পরিচিত হতে চায়-
রহিম গনেশ বুশ।
স্নানঘর
তোমার স্নানঘরে আমি কখনো ঢুকিনি
স্নানঘর তোমার পবিত্র উপাসনালয়
যেখানে তুমি নিজের শরীরে বোলাও হাত
ময়লা ধুয়ে ফেল
জঙ্ঘার গভীরে দাও পানির স্পর্শ
প্রাত্যহিক ক্লান্তির পরে তুমি যখন অবসন্ন হও
যখন তোমার মন বিতৃষ্ণায় হয়ে ওঠে কাতর
তুমি তখন স্নানঘরে যাও
তোমার শাড়ি ও সেমিজ বক্ষবন্ধনী
তখন কেউ আর তোমার নয়
সারাদিন বুকের সাথে আগলে রাখলেও
স্নানঘরে তুমি তাদের ছুঁড়ে ফেল
কখনো পদদলিত করো-
ময়লাগুলো ঝেড়ে ফেল জলজ ফোয়ারায়
অথচ তারাই তোমাকে করেছিল রৌদ্রে রক্ষা
বিছানায় যাওয়ার আগে ছিল প্রিয়তম সঙ্গী
মানুষ আদতে স্বমেহনপ্রবণ
জলের যোনি থেকে তোমার যাত্রার শুরু
স্নানঘর হয়তো সেই স্মৃতির পুনরাবৃত্তি
স্নানঘর আদি-মাতা, জলের কাছে সমর্পন
যারা একদিন রাজাদের হাম্মাম খানায় সখিদের সাথে
তারাও তোমার সাঙ্গে স্নানঘরে নৃত্য ও সঙ্গীতে মাতে!
নদী
সুউচ্চ পর্বতের শিখর থেকে গড়িয়ে পড়ার আগে
তুমি পাদদেশে নদী বিছিয়ে দিয়েছিলে মাহফুজা
আজ সবাই শুনছে সেই জলপ্রপাতের শব্দ
নদীর তীর ঘেঁষে জেগে উঠছে অসংখ্য বসতি
ডিমের ভেতর থেকে চঞ্চুতে কষ্ট নিয়ে পাখি উড়ে যাচ্ছে
কিন্তু কেউ দেখছে না পানির নিচে বিছিয়ে দেয়া
তোমার কোমল করতল আমাকে মাছের মতো
ভাসিয়ে রেখেছে
হাওয়া
চাওয়া ছিল হাওয়া বদল করি
হাওয়ার সাথে খেলতে যেতাম
হাওয়ার সাথে সারাজীবন আড়ি
শরীর যখন ভাঙত জ্বরে
কাঁপত নিরবধি
টলমল পারব না তো পেরিয়ে যেতে নদী
শুকিয়ে যেত চোখের তারা
বেড়ে যেত পিলে
মশক হয়তো কামড়ে দিছে তেতো ওষুধ গিলে
শয়ন নিয়ে ভালোই ছিলাম মায়ের পীড়াপীড়ি
হাওয়া বদল করি আমি হাওয়া বদল করি
হাওয়া ছেড়ে যায় যে আমি আবার হাওয়ার বাড়ি
আমি নাকি মানুষ ছিলাম মায়ের হাতের পরে
মা যে আমার আগেই গেছে হাওয়ার বাপের ঘরে
যারা আমায় দুগ্ধ দিছে
কিংবা ওষ্ঠখানি
হাওয়া আমায় ছিনিয়ে নেবে দস্যি ছিনালিনি
একটি হাওয়া দুটি হাওয়া হাওয়ার বাড়াবাড়ি
ভাবখানা তার একটি আদম পুরোটা চায় তারই
বায়ুর সাথে বশত করি পানির সাথে ঘর
যারা আমায় মাংস দিছে তারা তো নয় পর
আমি কোথাও যাচ্ছি কিনা
কোথা থেকে ফিরি
সূর্য বসে পাহাড় থেকে পথ করে দেয় তারি
কিসের উপর হাঁটি আমি কার শরীরে মাখি
হাওয়া আমায় পুষতে দিছে
অধরা এক পাখি
পিতার নামে চলি হয়তো মায়ের নামও জানি
হাওয়া আমায় নিচ্ছে ঘরে দিন দুপুরে টানি
হাওয়া বদল মানেই কিন্তু হাওয়া বদল নয়
হাওয়া যতই অগ্নিপবন-
এ তল্লাটে আছি আমি হাওয়ার পরিচয়।
প্রমিথিউস
আমরা ছিলাম কবিতাতান্ত্রিক পরিবারের সন্তান
জলের যোনি থেকে উৎপন্ন হলেও
ক্যাসিওপিয়া আমার মা
ভূমিতে বিচরণশীল প্রাণীদের মধ্যে মানুষকেই
প্রথম বেছে নিয়েছিলাম
তখন হিমযুগ
পৃথিবীতে দারুণ শীত
মানুষ মাংসের ব্যবহার শেখে নি
সোনা মাছ তেরচা মাছ আর কাঁচা মাছ মাংস দিয়ে
উদোর আর নাভিমূল পুরিয়েছে
মানুষ আজ যাকে সভ্যতা জানে
তার নাম আগুন
আমরা বাহাত্তর হাজার কোটি আলোকবর্ষ পেরিয়ে
যে অগ্নিতে সংস্থাপিত ঈশ্বর
যে আগুনে পুড়েছিল তুর
আমরা আমাদের সন্তানকে সেই আগুন চুরির
কৌশল শিখিয়েছিলাম
তিমির তেল থেকে নারী এস্কিমো এখনও যেভাবে
ধরে রাখে পিলসুজ
শরীরে শরীর ঘষে যে আগুন
সেসব তো অনেক পরের ঘটনা
আমরা মানুষের মধ্যে ঈশ্বর
ঈশ্বরের মধ্যে শয়তান
এবং শয়তানের মধ্যে যুক্তির
অবতারণা করেছি
হে বিশ্বকর্মা স্বয়ম্ভু‚ সেদিনের কথা স্মরণ করো
অলিম্পাস থেকে নেমে আসছেন জিউস
হংসীর উপর দেবতার আপতনকেও
আমরা লিপিবদ্ধ করেছি
তারপর একটি আন্ডাকে দু’ভাগ করে নিয়ে এসেছি
যুদ্ধের মোহন শরীর
মাংসের জন্য মানুষের যুদ্ধ
মাছের জন্য মানুষের যুদ্ধ
তার শরীরে আঁশগন্ধ ছিল
আমরা শব্দকে কালো সুতা দিয়ে
তসবির দানার মতো গেঁথে তুলেছি
শব্দ মানে শব্দ-ব্রহ্ম সৃজন এবং ছেদন
যার একটি বৃহৎ রশি মানুষকে বাঁধতে বাঁধতে
গুহাঙ্কিত চিত্রলিপির মধ্যে পতিত হয়েছে
যখন বৃষ্টি ছিল
রামগিরি পর্বত ছিল
নির্বাসনদণ্ড ছিল
কেবল ছিল না যক্ষের সর্বভুক বেদনার রূপ
আমরা জানতাম পাখির বিষ্ঠাপতনের শব্দ
মানুষকে আহ্লাদিত করে না
মাংস এবং গুহ্যের অধিক কিছু আবিষ্কার
করেছেন কবি।
চিত্রশিল্পী
যে কোনো চিত্রশিল্পীকে আমি অপছন্দ করি
ভিঞ্চি, পিকাসো, গগ এবং ফিদা হোসেনও রয়েছেন
এসব তালিকায়— মৃতদের শরীর থেকে মুখগুলো
বের করে এনে লেপ্টে দেন ক্যানভাসে
বেচারা কোথাও যেতে পারে না, এমনকি
ঘাড় ঘুরাতেও পারে না, অপরিবর্তনীয় মুখগুলো
ক্রীতদাসের মতো হাসি বা কান্নায়
একই ভঙ্গিমায় নির্লিপ্ত চিরকাল
চাকরি
আমার নাম-টাম জিজ্ঞেস করলে তো বলতে পারব না
একই পড়া বারবার মুখস্ত করেও পরীক্ষায় ভুল করে আসি
ভাইভাতে বাবার নাম জিজ্ঞেস করলেও বুঝে উঠতে কষ্ট হয়
স্ত্রীকে প্রেমিকার নামে ডেকে কতবার প্যাদানি খেয়েছি
এখন আবার জিজ্ঞেস করছ তোমার রব কাহা
তোমার নবী কাহা
আমি তো কোনো চাকরির জন্য দরখাস্ত করিনি