কাজী নাসির মামুনের প্রথম কবিতার বই লখিন্দরের গান। প্রথম বই দিয়েই তিনি নিজস্বতার স্বাক্ষর রেখেছেন। লখিন্দরের গানের পর তার কবিতার বই আরও তিন। অশ্রুপার্বণ তার দুর্দান্ত এলেজি। কনটেম্পোরারি সময়ে যখন শোকগাথা কবিতায় আর নাই বলতে গেলে, তখন তিনি যেন প্রাণ দিয়েছেন, বাংলা কবিতায় আবার সার্থক এলেজি রচনা করছেন। কিন্তু তার মূল্য কত, ভাইয়ের প্রাণের সমান? কবিতায় তিনি নিজেকে ভেঙেছেন, রোজ। আলাদা হতে হতে দূরে চলে যাওয়া না, তিনি নিজেকে আবিস্কার করেন পরিপার্শ্বেই। তার কবিতায় ‘সম্পর্ক’ কাজ করে বড় নিয়ামক হিসেবে, তাড়িত করে প্রকৃতি কিন্তু তিনি প্রকৃতির বন্দনায় নিজেকে সমর্পণ করেন না, প্রকৃতি থেকে অনুপ্রেরণা নেন। তার কাছে মানুষ সবার আগে, যদিও জীবন পেলে ফের, পাতা হতে চান- যে পাতা বিচ্ছিন্ন হয় না। এই অবিচ্ছিন্ন থাকার বোধ থেকেই তিনি সম্ভবত লিখে ফেলেন একটা আস্ত কবিতার বই, রোহিঙ্গা গণহত্যা নিয়ে; কবিতার সাথে, শিল্পের সাথে কোন কম্প্রোমাইজ না করেই রচিত হয় এক অনন্য কাব্যিক ডকুমেন্ট, রোহিঙ্গা পুস্তকে আত্মহত্যা লেখা নেই। আর মধ্যবিত্তের নাগরিক চেতনা নিয়ে তার কবিতার বই ‘কাক তার ভোরের কোকিল’। গদ্যের বই করেন নি, যদিও গত তিন দশকের কবিতা নিয়ে সবচে বেশি লেখা সম্ভবত কাজী নাসির মামুনই লিখেছেন। এর একটা ভিন্ন মানেও দাঁড়াও, গত তিন দশকের বাংলা কবিতার একজন নিবিড় নিষ্ঠ পাঠক তিনি।
কাজী নাসির মামুনের মুখোমুখি হয়েছিল কিংবদন্তি, মুক্তাগাছায়, কবির বাসায়। সাক্ষাৎকারের জন্য কিছু প্রশ্ন নিয়ে গেলেও আলাপ গড়িয়েছে সেসবের বাইরেও। পরিকল্পনা মাফিক হাসান জামিল হাজির ছিলেন না, কিন্তু তিনিও কিছু লিখিত প্রশ্ন পাঠান। তার লেখালেখি, জীবন-জীবনবোধ, প্রকৃতি, রাজনীতি, লেখালেখির চ্যালেঞ্জ, সামনের দিনের পরিকল্পনা ইত্যাদি নিয়ে প্রাণবন্ত আলাপ করেন শুভ্র সরকার আর সৌহার্য্য ওসমানের সাথে। তারই পরিমার্জিত রূপ ছাপা হলো।
শুভ্র: কখন, কেন মনে হলো আপনার কবিতা লেখতে হবে?
মামুন: কবিতা আসলে কল্পনার ব্যাপার, পরিকল্পনার না। এ ব্যাপারে উল্লেখ-এ একটা গদ্য লিখেছিলাম। ‘কবিতা: কল্পনার অনুশীলন‘- এই শিরোনামে। আর কল্পনা তো আকস্মিক ব্যাপার। যেমন মানুষের জন্মের কথাই ধরো, নয়-দশ মাসের একটা পরিসর থাকে বলে মানবশিশুর জন্মের সঙ্গে আমরা অনেক পরিকল্পনা জুড়ে দেই। কিন্তু সঙ্গম আমার কাছে আকস্মিকই মনে হয়। যা কি-না পার্থিব জন্ম বা সৃষ্টির প্রথম পদক্ষেপ। কথাটা অবশ্য আক্ষরিক সত্য হিসেবে কই নাই। বললাম একটা দার্শনিক ভাব আনার জন্য। হা হা হা।
শুভ্র: তার মানে আকস্মিকভাবেই কবিতায় আসছেন?
মামুন: হ্যা, আকস্মিকভাবেই। আমি স্কুল জীবন থেকেই নাটক লিখতাম। মঞ্চে অভিনয়ও করেছি। ১৯৯৭ সালে ঢাকার গাইড হাউজ মঞ্চে আমার একটা নাটক মঞ্চস্থ হয়। ‘অচিনপুরের অগ্নিগাথা’। মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে ওটা লিখছিলাম। নাটকটা নামিয়েছিলো নতুন প্রজন্ম নাট্যদল। পরে ওই দলটি আর টিকে নাই। নাট্যকার হওয়ার ইচ্ছেও উবে যায় আমার।
ওসমান: সেলিম আল দীনের সঙ্গে আপনার পরিচয়ের কথা শুনছিলাম?
মামুন: হ্যা। পরিচয় ছিলো ক্লাস নাইন থেকে। তখন আমি ঘাটাইল গণ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র। ‘মৌ থিয়েটার‘ ছিলো গ্রাম থিয়েটারের অঙ্গ সংগঠন। মৌ থিয়েটারের পরিচালক ছিলেন মোহন ভাই। তো তিনি আমারে নিয়া তার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন একবার। সেইটা কিন্তু একটা দারুণ ভালোলাগার ব্যাপার ছিলো। তবে সম্পর্কটা কোনো গভীর জায়গায় পৌঁছায় নাই। যোগাযোগ চালাইয়া যাইতে পারি নাই। পরে আরও দেখা হইছে। সম্ভবত ২০০৬ সালে একবার গালিবের সঙ্গে তার বাসায় যাই। তখন সবার আড়ালে একটা কথা বলছিলেন তিনি: রবীন্দ্রনাথকে দেখে বিস্মিত হইও কিন্তু ভয় পাইও না। বলেই আমার কাঁধের ওপর মৃদু চাপড় দিয়েছিলেন। ভীষণ রবীন্দ্র ভক্ত ছিলেন তিনি।
শুভ্র: কবিতায় আসার ব্যাপারটাতো বললেন না?
মামুন: ও হ্যা। ১৯৯৩-৯৪ এর ঘটনা হবে। তখন আমি অনার্সে পড়ি। ময়মনসিংহের কৃষি ভার্সিটিতে পড়তেন নুরু ভাই ও জুয়েল ভাই। তারা ছিলেন জাগরণ কালের সার্বক্ষণিক বন্ধু। খুবই কবিতাপ্রেমী। আমার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ। মাঝে মধ্যে শহীদবাগে আমার ম্যাসে আসতেন। একসঙ্গে কয়েকবার সিদ্ধি সেবনও করেছি। হা হা তারা আমাকে আল মাহমুদ পড়ান। এর আগে পল্টনের ফুটপাথ থেকে জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ কবিতা কিনে আনছিলাম। অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়—- ওহ, কি দারুণ অনুভ‚তি আমার! কি অসম্ভব ভালোলাগা! মালিবাগের এক বুকস্টল থেকে জয় গোস্বামীর কবিতা সমগ্রের প্রথম খন্ডটি কিনে ফেলি। অন্য রকম কবিতা। ডাইরিতে নিজেও লিখতে শুরু করলাম। তবে নাটকের প্রতি মোহ তখনও টিকে ছিলো। ৯৭ এর পর যা প্রায় বিলুপ্ত হয়। ও, ৯৬ এ ‘শৈলী’তে ম্যানহোল নামে একটা গল্প ছাপা হয়েছিলো। তরুণ লেখক সংখ্যায়। সম্পাদক ছিলেন কায়সুল হক। তার আগে ‘রহস্য পত্রিকা’য় ছাপা হয়েছিলো ‘পা’ নামে একটা গল্প। ওটার জন্য তিনশ টাকাও পেয়েছিলাম। বেশ থ্রিল অনুভব হয়েছিলো।
ওসমান: তাইলে প্রথমে নাটকের সঙ্গেই ছিলেন? তারপর গল্প? আপনার প্রথম কবিতা?
মামুন: তা তো অবশ্যই, নাটক দিয়াই শুরু। প্রথম কোন কবিতা লিখছিলাম বলতে পারবো না। ক্লাস ফাইভ বা সিক্সে থাকতেও প্রায় প্রতি সপ্তাহে নতুন খাতা কিনে দু একটা কবিতা লিখে ওই খাতা ফেলে দিতাম। আবার নতুন খাতা কিনতাম। কিন্তু কবিতার সঙ্গ তখনও চালাইয়া যাইতে পারি নাই। পরে তো নাটকে জুড়া লাগাইলাম নিজেরে। সেইটাও টিকলো না। কবিতায় লেগে থাকলাম। এই আর কি। প্রথম কবিতা? না, প্রথম শিল্পসম্মত কবিতার কথা কিছুটা কওয়া যায়। শহীদবাগের ম্যাসে আবুল কালাম নামে একজন ম্যাসমেট ছিলেন। নোয়াখালির কোন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন একসময়। তিনি তা-ই বলছেন। তার ভাষ্য মতে তিনি ছিলেন নি:সন্তান। সংসদ ভবনের সামনে একবার এক ছেলেকে কুড়িয়ে পান। নিজের ছেলের মতো মানুষ করেন বাচ্চাটিকে। অনেক বছর পর ছেলেটি বড় হলে তার বাবা-মা তাকে খুঁজে পায়। নিজেদের কাছে নিয়ে যায় ছেলেটিকে। এই দু:খ এবং আরও কিছু ব্যক্তিগত বেদনার কথা কালাম ভাই আমাকে শোনান। একবার হইলো কি, আমার হাতে কোনো টাকা নাই। মাস বাকি পড়ে আছে। আব্বার কাছে একই মাসে দু’বার টাকা চাওয়ার সাহস হলো না। কালাম ভাই জানালেন তার জীবনের কোনো ঘটনা নিয়া কবিতা লিখে দিলে এক্ষুণি পঞ্চাশ টাকা দিবেন। তক্ষুণি বসে পড়লাম। আধঘণ্টায় কবিতাটা নাইমা গেলো: আঘাতে আঘাতে মানুষ দস্যু হয়ে যায়.. । কবিতার নাম: কুকুরীর জন্য সংবেদনা। ‘লখিন্দরের গান’ কাব্যগ্রন্থে আছে।
শুভ্র: প্রেমের গলিত লালার ওপর অমিও সৌরভ রেখে/ মানুষ মানুষকে ছেড়ে যায় দ্ব্যর্থহীন..
মামুন: হ্যা। ওইটা মাঝের লাইন। এইখানে কিন্তু ‘দ্ব্যর্থহীন’ শব্দটা ভুল। হওয়া উচিত ‘দ্বিধাহীন’। কিন্তু যেভাবে এসেছে ওভাবেই রেখে দিয়েছি।
শুভ্র: বাংলা কবিতার ধারায় আপনার কবিতা আপনার নিজের কাছে কেমন লাগে? বা যদি বলি এই সময়ে এসে নতুন কী কী সংযোজন করেছেন বলে মনে হয় আপনার কবিতায়?
নিজের কবিতা নিজের কাছে ভালো লাগতেই হবে। নইলে লেখার আগ্রহ থাকবে? হয়তো পরিতৃপ্তির চরমে যায় না অনেক সময়। তবে সময়টা এমনই। নিজের কবিতা ছাড়া কিছু ভালো লাগে না বা অন্য কবিতা ভালো লাগার কথা আমরা বলতে চাই না। সমসাময়িক হলে তো নয়-ই। চ্যানেল আইয়ের একটা অনলাইন সাক্ষাতকারে তোমারেও দেখলাম জবাব এড়াইয়া গেছো। কার কার কবিতা ভালো লাগে সরাসরি বলতে পারো নাই। তো এরকমই হয় আমাদের দেশে। আমি কি কি সংযোজন করেছি তা অবশ্য পাঠকরাই ভালো বলতে পারবে। নিজে পাঠক হিসেবে বলতে পারি ‘লখিন্দরের গান’ হলো ঐতিহ্যের নবরূপায়ন। সাংস্কৃতিক মিথষ্ক্রিয়া। তোমাকে ফোটাই দাদাজান পাখি, এখানে তাবৎ শুরু। দাদার মৃত্যু মৃত্যু নয়, নিজের ভিতরে আমি দাদারে ফোটাই। এইভাবে একটা ট্র্যাডিশন বা হ্যারিটেজ টিকে থাকে। বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতির ওপর বৈশ্বিক অভিঘাত নিয়ে এই গ্রন্থে কাজ করেছি আমি। ধরো, বললাম: ধানগাছ চিরদিন থাকে না। কেন? এই জন্য যে, আমি দেখলাম, মাছের খামারে নি:শেষ হয়ে যাচ্ছে ধানের জমিন। লিখলাম,
বৈদেশে অর্থের
বাতিল হুকুম। মান্য করি, ধন্য করি
বিনয় নিংড়ে বলি সব নাও, দাও সব যতি।
এখানেও বিশ্ব ব্যাংকের শোষণের প্রসঙ্গ আছে। উন্নয়নের নামে বিশ্ব ব্যাংকের সব শর্ত আমরা মেনে নিই। এত বিনয় আমাদের। মূলত উন্নয়নের যতি টানা হয় এইভাবে। বিশ্ব রাজনীতি আমাদের ঘায়েল করে। তো, এতটা ঘনিষ্ঠভাবে বাংলাদেশকে দেখতে চাইছি আমি। বৈশ্বিক বা সময়ের অভিঘাতগুলো ধরাইয়া দিয়া কিছুটা ক্রিটিক্যালি দেখতে চাইছি।
ওসমান: তাইলে এই ব্যাপারগুলো শুধু ব্যক্তির ওপর কোনো প্রভাব না?
শুভ্র: সমাজের সবাই ভুগতেছে এইরকম আর কি?
মামুন: আসলেই তাই। সমাজ বা রাষ্ট্রের সবাই। বিশেষত কৃষক বা নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী। আর নিজের রাষ্ট্র বলো আর বিশ্ব রাজনীতির কথাই বলো, সব জায়গায় বিশাল ড্রামা কাজ করে। আমরা সবাই বুঝি কিন্তু এড়াইতে পারি না। এর কারণ পুঁজিবাদ। ‘লখিন্দরের গান’ কাব্যগ্রন্থের দীর্ঘ কবিতাগুলো সেই ড্রামা নিয়া কাজ করছে বইলা মনে করি। জীবন তো আর এত পেলব বা লিরিক্যাল হইতে পারে না। ফলে একটা মহাকাব্যিক দ্যোতনা দিছি বলা যায়।
ওসমান: ‘অশ্রুপার্বণ’ নিয়া কী বলবেন? ওইটা তো ব্যক্তিগতই নাকি? ছোট ভাইয়ের মৃত্যু নিয়া লেখা?
মামুন: হ্যা। ২০০৭ এর ঘটনা। তখন ঢাকার প্রেসক্লাবে আমাকে আর জাহানারা পারভীনকে কবিতাসংক্রান্তি সম্মাননা দেওয়া হয়। আমিনুর রহমান সুলতান ভাইকে দেওয়া হয় লিটলম্যাগ সম্পাদক হিসেবে। তো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন ওই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। মোবাইলে খবর পাইলাম আমার ছোট ভাই ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি। তো কবি মাদল হাসান আমাকে সঙ্গ দিলো। কিন্তু গিয়া দেখি সে মারা গেছে। তো এই বেদনা নিয়েই অশ্রুপার্বণ। সম্ভবত বাংলা সাহিত্যের দীর্ঘতম এলিজির মধ্যে এইটাও একটা। এইটা আসলে নশ্বরতার উপলব্ধি। ধার্মিকতার না, আধ্যাত্মিক ঘরানার। তবে খুব তরতাজা অনুভূতি।
ওসমান: মৃত্যু নিয়া তাইলে আপনার উপলব্ধিটা কী?
মামুন: এইসব আসলে দার্শনিক প্রশ্ন। শেষ বয়সের প্রশ্ন। এত তাড়াতাড়ি শেষ হইতে চাই না। হা হা হা। তবে আমি যেইটা মনে করি, জীবন হইলো যাপনের। মৃত্যু হইলো উদযাপনের। যাপিত জীবনের মধ্যে আমরা উদযাপনের মহিমা দিতে চাই। তাই কবিতা লিখি। গান গাই। ছবি আঁকি। এসবের ভিতর দিয়া নিজের অস্তিত্বরে জানান দেওয়া।
শুভ্র: অন্য বইগুলো নিয়া কিছু বলবেন? কাক তার ভোরের কোকিল ?
মামুন: না। নিজের বই নিয়া এত কথা ভাল্লাগে না। এইভাবে বললে মানুষ আসলে ট্রাস্ট করে না। অন্যকিছু ভাবে।
শুভ্র: মানুষ কী ভাবলো সেইটা আমার বিষয় না। আপনের এই দুইটা বই কিন্তু আমারে খুবই টানে। লখিন্দরের গান আর অশ্রুপার্বণ। আমিতো বাংলা কবিতায় এই দুইটা বইরে খুবই উল্লেখযোগ্য মনে করি। আপনের মনে আছে কি না, বেগুনবাড়ির মেলায় গেছিলেন। আমি সাথে ছিলাম। আইসা একটা দুর্দান্ত কবিতা লিখলেন, মেলা। বিশাল বড় কবিতা। তো কেমনে সম্ভব হইলো?
শুভ্র: এইটা আসলে যাপনের ঘনিষ্ঠতা। তুমিতো জানোই আমরা এই এলাকার আনাচে কানাচে চইষা বেড়াই। আমার কবিতায় সম্ভবত সেই ভ্রমণের ছাপ আছে। জীবনঘনিষ্ঠভাবে দেখতে চাই সবকিছু। তার ফলশ্রুতি বা বিশ্বস্ত অনুভবই সম্ভবত ওই কবিতাটা। মেলা থেকে আসার পর। শুধু দৃশ্যের বর্ণনা না, উপলব্ধি। মেলা নিয়া একটা আইডিয়ার জগৎ। তুমি ব্যাপারটা ভালো ধরছো। কাক তার ভোরের কোকিল, এটার মধ্যেও কিছু ভালো কবিতা আছে বলে আমি মনে করি। মধ্যবিত্তের চোখ দিয়ে ঢাকার নগর জীবনকে দেখা।
শুভ্র: ও, মামুন ভাই, এইবার একটু স্মৃতিতে যাই। শৈশব নিয়া কিছু কন।
মামুন: অন্য সময় বলমুনে। কবিতার মধ্য দিয়া বলতে চাই এখন। (‘লখিন্দরের গান‘ থেকে শিশু যাকে প্রাণে জড়ায় আমি তা-ই চক দিয়ে লিখি কবিতাটি পড়ে শোনালেন। শেষাংশ এখানে প্রাসঙ্গিক বলে সংযুক্ত হলো)
হে জলের কুঞ্চন,
ঢেউয়ের ভাঁজে ভাঁজে কোথায় লুকিয়েছো
আমার শৈশব অন্তহীন ডুবগুলো?
যেন শৈশব অসম্ভব জলদেবী
যৌন বালতিতে হাত ডোবালো।
আমি ভাবলাম, বাসনার মেয়ে মানুষ হাতের তালুতে নিয়ে
বিশ্বভুবন ঘুরিয়ে দেখাই।
চিলতে রোদের মতো হৃৎপিন্ড ছড়িয়ে দিলে
নারীরা উত্তাপ পায় না।
দুর্বিনীত আগুনের কাছে সহজেই গলে যেতে পারে।
আর যেন আঁজলায় তুলে নেবে
খুব জলো, ব্যক্তিবিবর্জিত
চূড়ান্ত কাঙাল কোনো হরিনাথ।
শুভ্র: জামিল, হাসান জামিল আর কি, কিছু প্রশ্ন পাঠাইছিলো। যেমন, আপনার প্রথম বই থেকে রোহিঙ্গাপুস্তক পর্যন্ত জার্নিটাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন? কবি হিসেবে আপনার কবিতায় কি কি পরিবর্তন এসেছে বা নিজের মধ্যে কি বদল হয়েছে?
মামুন: আসলে এই ব্যাখ্যার কাজটা যখন কবির নিজেকেই করতে হয় তখন বিষয়টা বিব্রতকর ঠেকে। আগেই বলছি। আর কিছুটা ব্যাখ্যাও আসলে দেওয়া হইছে।। প্রথমত ভ্রমণবিলাসী মন নিয়া চারণ কবির মতো চষে বেড়াইছি ঐতিহ্যের নবরূপায়নে। সেখানে আসছে বৈশ্বিক অভিঘাত। আমার দৃষ্টি তখন ক্রিটিক্যাল। তারপর নশ্বরতার উপলব্ধি। মধ্যবিত্তের নাগরিক চেতনা, বোধ ও বিবেচনা। এবং শেষটায় রোহিঙ্গা ইস্যুর মতো আন্তর্জাতিক বিষয়ের মধ্য দিয়ে মানবিক বিপর্যয়কে নানা এঙ্গেলে প্রশ্ন করতে চাইছি। চাণক্য বলছেন, এমন কী আছে যা কবির দৃষ্টি এড়ায়? সবদিকেই একটু ক্রিটিক্যালি দৃষ্টি দেওয়া আর কি। খুব পেলব সময়ের ভিতর দিয়া আমরা যাইতেছি মনে হয় না। এমন কিছু করা দরকার যা মানুষকে বিদ্ধ করে।
শুভ্র: জামিলের আরেকটা প্রশ্ন। এই সময়টায় বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় লেখালেখির চ্যালেঞ্জ কি? লেখকের দায়ের জায়গাটা কেমন করে দেখেন? আপনি নিজেই বা ব্যাপারগুলা কেমন করে ডিল করেন?
মামুন: খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমার জন্য খোলামেলা জবাব দেওয়াটা কষ্টসাধ্য। তবু বলি, সত্যিকারের পোয়েট বা রাইটারের সঙ্গে পাওয়ারের একটা দ্বাদ্বিক অবস্থান থাকে। সেইটা তারা হজম করেন। সমাজের সঙ্গেও সেই দ্বদ্ব দেখা যায়। সবসময় সেই দ্বদ্ব এড়াইয়া চলার নিরীহ চেষ্টা নিয়া বড় লেখক হওয়া যায় না। বড় কবিও না, বুদ্ধিজীবীও না। আমাদের দেশে প্রায় সবাই এইরকম নিরীহ টাইপের। নিজের সঙ্গে নানান ট্যাগ লাগার ভয়ে কাওয়ার্ড হইয়া থাকে। আমিও ব্যতিক্রম না। পাকিস্তান আমলে স্বাধীনতার প্রশ্নে আমাদের লেখকরা অনেক বেশি সাহসী ছিলেন। কত তরতাজা কবিতা যে আমরা প্রোডিউস করছি! মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা একটা দেশ পাইছি। বিশাল পাওয়া। কিন্তু যে-পর্যায়ে গেলে একটা দেশ রাষ্ট্র হয়, বা রাষ্ট্র মেচিউর্ড হয়, সেই জায়গায় পৌঁছতে আমাদের আরও সময় লাগবে। সেইটা শুধু সরকার বা রাজনীতিবিদদের দায়, তা আমি মনে করি না। নাগরিকরা নিজেদের দায় বুঝতে পারলে রাষ্ট্র পরিপক্ক হয়। নিজের ওপর নিজের দাবি মিটানোর একটা ব্যাপার তো আছে, নাকি? আর রাষ্ট্র ধারণা নিয়াও একটু গোলমেলে ব্যাপার আছে। সেইটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
ওসমান: সরকারি চাকরি করতে গিয়া লেখালেখিতে কোনো চাপ বা এরকম কিছু ?
মামুন: বৈরী চাপের কথা কইতেছো তো? না, তেমন কিছু এখনো অনুভব করি নাই। তবে আমাদের সার্ভিস রুল অধিকাংশই ঔপনিবেশিক আমলের। কেবল আনুগত্য শিখায়। প্রশ্ন করতে শিখায় না। এইখানে প্রচল ধারণা হইলো, বস ইজ অলোয়েজ রাইট। ফলে সৃষ্টিশীলতার খুব বেশি পরিচর্যা সম্ভব না এসব জায়গায়। আমি সমাজ নিয়া ক্রিটিক্যাল। এইটা আমার জন্য সেইফ সাইড। রাষ্ট্র বড়ো জটিল ক্রিয়া-কলাপ। আমাদের সাহিত্য নিয়া বুঝাইতে গেলে একটা জিনিস তোমাদের পইড়া শোনানো দরকার (আফ্রিকার ছোটগল্প সংকলনের অনুবাদ থেকে চিনুয়া আচেবের ভ‚মিকার সামান্য অংশ পড়ে শোনালেন:
দক্ষিণ আফ্রিকায় আমার এক সহকর্মীর কথা মনে পড়ে। ষাটের দশকের কোনো এক সময়ে তিনি বলেছিলেন, তাঁদের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নভেল লেখার শৌখিনতা মানায় না।)
আমাদের সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এমনটি মনে হয় আমার। সাহিত্য পাঠের জন্য যে-মেচিউরিটি দরকার, সেই আবহের মধ্যে আমরা আছি কি না, সেইটা একটা প্রশ্ন।
শুভ্র: (জামিলের প্রশ্ন) গত কিছু বছর ধরে ভাষার প্রসঙ্গটা বাংলাদেশের সাহিত্যে একটা বড় জায়গা নিয়েছে। প্রমিত অপ্রমিতের বাইরেও একটা কমন ভাষার কথা বলা হচ্ছে, অনেকটা বাংলাদেশি ভাষা বলে একটা জিনিস সেখান থেকে আপনার সাহিত্যিক ভাষা তো পশ্চিম বাংলা শাসিত ভাষার মতোই অনেকাংশে বা সেই সিলসিলারই। তো এইসব আলাপের জায়গা থেকে একজন সচেতন সাহিত্যিক হিসাবে আপনি কিভাবে দেখেন?
মামুন: সাহিত্য শুধু ভাষার কসরত, এমনটা আমি মনে করি না। একবার যুগান্তরে গদ্য লিখছিলাম: কবিতায় চিন্তার পরিচর্যা। ভাষা তো ভাবের বাহন। আর আমরা যে সাংস্কৃতিক আবহে থাকি তা এমনিতেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে আলাদা। মুক্তিযুদ্ধ এমনিতেই আমাদের সংস্কৃতিকে আমূল রূপান্তর ঘটাইছে। সেই হেরিটেজ পশ্চিমবঙ্গ বহন করে না। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির প্রভাব বা বলতে পারো বাঙালি মুসলমান হিসেবে আমাদের ভাষার গড়ন এমনিতেই আলাদা হইয়া যায়। এইটার জন্য খুব সচেতন প্রয়াস দরকার আছে আমি মনে করি না। ফলে জামিলের ওই কথাটা খুব মোটা দাগে মানা যাবে না যে, আমি ওই সিলসিলা বহন করি। দাদা জান পাখি, বৈদেশ, দরূদ সিম্ফনি, বা ধরো, যখন বলতেছি: হরপ্রসাদ শাস্ত্রীয় গুরু, মরদেহে মেহমান কিংবা যখন বলি: কেরামান কাতেবিন, দ্রাবিড় কিতাবে লিখো প্রত্ন ইতিহাস তখন এই ভাষার আবহটা, অনেস্টলি বলো তো, পশ্চিমবঙ্গীয় মনে হয়? নিশ্চই না। আর প্রমিত অপ্রমিত যা-ই হোক, আসল কথা হলো চিন্তাটা পৌঁছে দেওয়া। যে-ভাষায় পৌঁছে দেওয়াটা বেশি উপযুক্ত মনে হবে, লেখক সেই ভাষা নিবে। তবে ভাষার রাজনীতি আছে, এইটা আমি স্বীকার করি। সামনের দিনগুলোতে এইসব আমার বিবেচনায় থাকবে।
শুভ্র: (জামিলের প্রশ্ন) বাংলাদেশের অঢেল কবিতা বা উপন্যাসের পাশে প্রায় সমপরিমাণ রাজনৈতিক তেলঢালা প্রকাশনা, এর বাইরে সিরিয়াস চিন্তার বই বা ক্রিটিক নাই। ফলে সাহিত্য একটা তব্দামারা ব্যাপার হইয়াই থাকে কেমন যেন। সেই সার্বিক অসামঞ্জস্য, এইটারে কিভাবে দেখেন?
মামুন: খুব খারাপভাবে দেখি। এর আগের কিছু প্রশ্নের জবাবে এর উত্তর আছে। আসলে সিরিয়াস চিন্তার জন্য সাহস লাগে। কাওয়ার্ড সারভাইব করে যাপনে, তেলাতেলিতে। আর সাহসীরা সারভাইব করে চিন্তায়। হুমায়ূন আজাদের মধ্যে সেই সম্ভাবনা ছিলো। কিন্তু তিনি ছিলেন অসহিষ্ণু। তার এপ্রোচ ছিলো মারমুখী। আর ছিলো পশ্চিমা সভ্যতার প্রতি আনুগত্য। তিনি ট্রাস্ট তৈরি করতে পারেন নাই। মৃদুল মাহবুবের সঙ্গে আজ এইটা নিয়া কথা হইতেছিলো। একজন চিন্তক তো এমন কিছু করবেন, যাতে নিজের চিন্তার সঙ্গে না মিললেও মানুষ তারে ট্রাস্ট করতে শিখে। পশ্চিমবঙ্গ বা বলা যায় গোটা ভারতেই বিকল্প চিন্তার কিছু বুদ্ধিজীবী দাঁড়াইছে বলে মনে হয়। সাবঅলটার্ন ইতিহাস চর্চায়ও তারা অনেক আগাইছে। সাম্প্রতিককালে হস্তমৈথুনের ওপর দীপেশ চক্রবর্তীর একটা লেখা পইড়া স্তম্ভিত হইছি। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ওপর দীপেশ চক্রবর্তীর লেখা পড়লাম। কত নির্মোহ সেই লেখা। পার্থ চট্টোপাধ্যায়, আশিস নন্দী, গৌতম ভদ্র এদের লেখা পড়ে চিন্তার নতুন ডাইমেনশন পাই। ভাল্লাগে। অরুন্ধতী রায় বা রোমেলা থাপারের কথা বাদই দিলাম। যাই হোক, মানুষের জাতীয়তাবোধকে আমি শ্রদ্ধা করি কিন্তু জাতীয়তাবাদকে না। চিন্তার কোনো দেশ-কাল নাই। এইযে এতক্ষণ প্যাঁচাল পারতেছি, তোমরা চুপ হইয়া আছো। এইভাবে একলা আলাপে মজা পাই না। হা হা হা।
ওসমান: প্রশ্নগুলো তো জামিলের। সে তো এইখানে উপস্থিত নাই।
শুভ্র: বাংলাদেশে তাইলে কোনো চিন্তক দেখেন না?
মামুন: চিন্তক নাই সেইটা বলা যাবে না। তবে সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশে যারা ভাবনা চিন্তা করেন তাদেরকে এত ভার্সেটাইল হইতে দেখি না।
শুভ্র: জামিলের শেষ প্রশ্নটা কইরা ফেলি, প্রায় তিন দশক লেখেন দেদার গদ্য লিখেছেন ছোট বড় কাগজে। কিন্তু কবিতার বইয়ের বাইরে আপনার বই নাই। কেন এটা? লেখালেখি নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?
মামুন: জামিল ঠিকই বলছে। অনেক গদ্য লিখছি আমি। নব্বই, শূন্য, দ্বিতীয় দশক মিলে অনেক গদ্য হবে। এমন কি সামনের দশকে যারা লিখতে আসতেছে সম্ভবত তাদের কিছু কবিতার ওপরও লোক-এ একটা গদ্য লিখে দিছি। প্রকাশক পাওয়া গেলে গদ্যের বই করা যাইতে পারে। লেখাগুলো কম্পাইল করার একটা আলস্যও আছে আমার। ব্যাপার হইলো কি, আমাদের দেশে সবাই জীবনানন্দ হইতে চায়। বুদ্ধদেব বসু হইতে চায় না। কবিখ্যাতির জন্য ক্রিটিক হওয়াটারে ক্ষতিকর মনে করে। ইউরোপে সম্ভবত এই ধারণা নাই। এলিয়ট একই সঙ্গে কবি এবং ক্রিটিক। ওদের কম লিখলেও চলে। আমাদের অনেক লিখতে হয়। তবু পাঠক মিলে না। আর প্রকাশকের দ্বারস্থ হওয়ার একটা ক্লান্তিও আছে। ফলে গদ্যের বইয়ের দিকে নজর দেওয়া হয় নাই। তবে সামনে উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা আছে।
শুভ্র: আপনি তো শীতকাতর মানুষ, যদ্দুর জানি। শীতে আপনি এক প্রকার আড়ষ্টতার মধ্যে যাপন করেন। তবে আপনার প্রিয় ঋতু কোনটি? যে হাওয়ায় আপনি ফুরফুরে আমেজ পান?
মামুন: আমার ভাল্লাগে খাঁ খাঁ করা রোদ্দুরের সময়টা। ঠিক খড়াপীড়িত সময়টা না। লম্বা দিনের পৃথিবী। হঠাৎ হাওয়া বইতেছে। পাতা ঝরতেছে। সঙ্গে সামান্য ধুলা। যে-সময়টাতে আমরা ঘুরতে যাইতাম…নরুন্দি, বটতলা, কাঠবওলা, শিবগঞ্জ। দূরে একটা চায়ের দোকান । ধরো, হয়তো সাইকেল চালিয়ে আসতেছে কেউ। টুংটাং বেল বাজতেছে। দূরে নি:শব্দ মসজিদ। মন্দিরের পুরানা দেয়াল। এইসব। ওপরে চিল অথবা বাজপাখি উড়তেছে। আর ভ্যান রিক্সায় আমরা উদাস চলতেছি। গ্রামের সবুজে রোদ কামড়ে ধরছে, এইরকম সময়টা।
ওসমান: ঠিক কোন সময়ের কথা কইতেছেন? কোনো পছন্দসই ঋতুর কথা তো কইলেন না।
মামুন: ফেব্রয়ারির পর যে-কোনো সময় হইতে পারে। শীত শুরুর আগ পর্যন্ত। আমি সঙ্গপ্রিয় লোক। কিছু বিশেষ সময় ছাড়া একাকীত্ব টানে না। তাই ভাল্লাগে লঘু ভ্রমণ। শীতের কুঁকড়ানো আর বর্ষার আড়ষ্টতা আমারে একদম টানে না।
ওসমান: আরেকটা প্রশ্ন খুবই করতে ইচ্ছা হইতেছে। এইযে এখানে আমরা যারা লেখতেছি তাদের সঙ্গে আপনার সম্পর্কটারে কিভাবে ওন করেন।
মামুন: সামাজিকভাবে সবাইকে ওন করা যায়। কিন্তু লেখক বা কবি হিসেবে সবাইকে ওন করতে গেলে আমার কথার কোনো ট্রাস্ট তৈরি হবে? হবে না। ওন করতে গেলে বিবেচনা লাগবে। আর আমার ওন করার ওপর কারও কবিত্ব নির্ভর করে না। মহাকালে হয়তো আমিই ছিটকে গেলাম। অন্য কেউ দাঁড়ায়া গেলো। সেইটা অন্য বিষয়। কিন্তু এতদিন লেখালেখি করে একটা কমন সেন্স তো তৈরি হইছে। সেইটা কাজে লাগাইতে হবো তো আমার। ধরো, মুখলেছ স্যার কবিতা লেখেন, তাকে আমি এপ্রিশিয়েট করতে পারি। কিন্তু ওন করতে পারি না। তার কবিতায় সময়ের সেই প্রতিশ্রুতি নাই। ‘কিংবদন্তি’ ছাড়াও এখান থেকে আরও কাগজ বের হয়। সেটা শুভ লক্ষণ। কিন্তু ওন করতে গেলে সেই কাগজেরও তো কতটা অঙ্গীকার আছে সেইটা দেখতে চাবো আমি। নইলে যেনতেন ভালো কিছু বলে দিলে আমার কথার ট্রাস্ট থাকবে না। লেখকের ব্যক্তিত্ব ওই ট্রাস্ট তৈরি করার সঙ্গে জড়াইয়া যায়। আবার ধরো, আবুল হাসানের মতো কবিকে যদি কবি হিসেবে ওন করতে না পারি সেইটা আমার ব্যর্থতা। কাজেই ওন করা বা না করার মধ্য দিয়াও আমার কথার ট্রাস্ট তৈরি হয়। কবি বা লেখকের মনন তৈরিতে এইটা একটা বিরাট ব্যাপার। এখানে অনেকেই লিখতেছে। এইটা খুব ভালোলাগে আমার। কিন্তু তাদের অনেকেরই মনন তৈরি হয় নাই। দুই চারশ বই বিক্রি হলেই সেই মনন তৈরি হইছে, এমন বলা যাবে না। লেখক বা কবি সত্তা এতো ঠুনকো ব্যাপার না।
শুভ্র: ব্যক্তি সম্পর্কের এই ব্যাপারগুলো নিয়া আর কথা বলতে চাই না। রাজ্জাক ভাই নিয়া কিছু কন।
ওসমান: ঠিক। রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের সবার সম্পর্ক ছিলো। তবে আপনি অনেক বেশি সময় দিয়েছেন তার সঙ্গে।
মামুন: এইটা একটা ভালো প্রসঙ্গ। আমার কাছে সম্পর্ক হইলো সেইটা, জাগতিক চাওয়া পাওয়ার বাইরে যেখানে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ভালোবাসা টিকা থাকে। রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গ আমার জীবনের একটা টার্নিং পয়েন্ট এনে দিছে। আমার পরম্পরা চিনতে পারছি। লিডার হিসেবে বঙ্গবন্ধুর শক্তির জায়গাটা তিনি আমারে চিনাইছেন। মিথ বিষয়ে তার জ্ঞান আমাকে অনেক কিছু দিছে। ফ্রয়েড নিয়াও তার ভাবনার গভীরতা ছিলো। তবে রাজ্জাক ভাই কিন্তু খুব বেশি বই পড়তেন না। তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। একটা সহজাত প্রজ্ঞা ছিলো তার। ওইটা আমারে আকর্ষণ করতো। আর সম্পর্কটা কিরকম জানো? সারা জনম একসঙ্গে আছো। দেখবা একদিন আবিস্কার করছো, তুমি তার ভিতরে পৌঁছো নাই। রাজ্জাক ভাইয়ের ভিতরে পৌঁছতে পারছিলাম আমি। তিনি আমাকে সেটা জানাইছেন। আর রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কের যে-মহত্ত¡, সেইটা আমি পালন করতে চাই না। লালন করতে চাই। আজীবন। তোমাদের কারও সঙ্গেই সম্পর্কের ব্যাপারে ভাবতে পারি না যে, পৌঁছে গেছি। একটা সন্দেহ রইয়াই যায়। তোমাদেরও আমার বেলায় সেই সন্দেহ থাকতে পারে। এতে কইরা সামাজিক সম্পর্ক কিন্তু নষ্ট হয় না দেখবা। যদি হয়, দেখবা, যার দ্বারা হইছে তার মানসিক অবস্থা অত বড় না। ও, আরেকটা কথা বলতে চাইতেছি, কবির সঙ্গে কবির, লেখকের সঙ্গে লেখকের সম্পর্ক খুব বিশ্বস্তার সম্পর্ক না। ওখানে ঈর্ষা কাজ করে। দ্বদ্ব থাকে। খ্যাতির মোহে কবিরা সেইটা বজায় রাখতে চায়। একটা বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে, যারা লিখতেছি তারা সবাই মিলেই একটা কমিউনিটি। পরস্পরের সম্মান রক্ষা করা আমাদের শিক্ষার দায়। ওন করা বা না করা কারও দায় না।
শুভ্র: অনেক ভালো কথা বলছেন। ধরেন আমাদের এই কমিউনিটি থেকে যদি একজনের কথা স্মরণ করতে বলি, এই মুহূর্তে কার কথা বলবেন?
মামুন: আশিক আকবর। তার অনেক আচরণ হয়তো তোমার ভালো লাগবে না, তার রাজনীতির বিষয় তোমারে টানতে না পারে, হয়তো সে তোমারে ওন করে না, তবু তার লেখক সত্তা আছে। তার কবির মনন আছে। আরেকটা জিনিস আছে, জীবনকে দেখবার নিজস্ব চোখ। কবির জায়গায় তাকে আমি ওন করি।
শুভ্র: আচ্ছা মামুন ভাই, আরেকবার জীবন পেলে আপনি কী হতে চাইতেন?
মামুন: এই প্রশ্নটা বড়ো গদবাঁধা মনে হয় আমার কাছে। মিলান কুন্দেরা এক সাক্ষাতকারে বলছেন, জীবন একটা ফাঁদ। আমরা নিজের ইচ্ছায় জন্ম নেই না। আবার নিজের ইচ্ছায় পৃথিবী ছেড়েও যেতে পারি না। আমার কাছে জীবন একটা আশীর্বাদ। যাকে বলে নেয়ামত। আমি কৃমি হই নাই, গোবরে পোকা হই নাই। গাছ হই নাই। শূকর গরু কিছু হই নাই। মানুষ হইছি। এই বোধ আমারে সুখ দেয়। আরেকবার জীবন পাবার কোনো সম্ভাবনাও নাই। তবে পাতার বৈচিত্র আমাকে খুব টানে। দেখবা পাতা খুব সঙ্গপ্রিয়। সে কখনো একা হয় না। সকলের মধ্যেই সে নিবিড়। জীবনবৃক্ষের তুমি একটা পাতা। আমি একটা পাতা। তাই ভাবি, যদি পাতা হইতে পারতাম! সবুজ একটা পাতা। উঠার আগে একটা কবিতা শোনো। পাতার কথা আছে। (‘অশ্রুপার্বণ‘ গ্রন্থ থেকে নিচের কবিতাটা পড়ে শোনালেন তারপর)
নৈশকালীন
রাতের নৈ:শব্দ্যে
ব্যাঙ ডাকে
টিনের চালে ঝিরিঝিরি বর্ষার সিগন্যাল
আকাশ ভাঙলে পরে
প্রথম যৌবন-ভাঙা সঙ্গমের মতো
সাঁতরাবো,
গুমোট মেঘের মতো শুয়ে আছো কেন?
পেলব সমুদ্র হও।
শরীর মন্থনে জল পড়ে;
পাতা, তুমি কেন নড়বে না আজ?