ঘূর্ণায়মান পৃথিবী, বহমান সময়। জাগ্রত বর্তমানে চলমান কর্ম বহুমুখী, ভবিষ্যৎ ঘুমিয়ে আগামীকালে। রাত পোহালেই ভবিষ্যৎ হয় বর্তমান আর গতকালের খাতায় স্থান নিয়ে বর্তমান হয় অতীত। চলতে গেলে বর্তমানকে মূখ্য রাখলেও ভবিষ্যৎ যেমন পরিকল্পনায় রাখতে হয় তেমনি সভ্যতার ক্রমবিকাশ ধারায় অতীতকেও স্মরণে আনতে হয়, জানতে হয়। তবে বহুমুখী কর্মের সার্বিকতা নিয়ে অতীত কখনওই বর্তমানের মত পুরোপুরি ধরা দেয় না। কালের আবর্তে ইতিহাসের পাতায় স্থান নেয়া অতীতাংশকেই নানা আঙ্গিকের উপস্থাপনায় আমাদের যৎসামান্য জানার সুযোগ হয়। দেশের ক্ষুদ্র জনপদ কিংবদন্তির মুক্তাগাছা নিয়ে এই লেখার প্রয়াস সেখানেই নিহিত।
মুক্তাগাছা দেশের একটি পরিচিত উপজেলাই কেবল নয়। বৃহত্তর ময়মনসিংহ কিংবা তৎকালীন পূর্ব বাংলার ইতিহাসের নানা পটভূমিতে এই জনপদের বিশেষ অবস্থান রয়েছে। জমিদারদের অবস্থান, প্রভাব, প্রতিপত্তি, শাসন, শোষণ, রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি, প্রাকৃতিক লীলাভূমি সব মিলিয়ে মুক্তাগাছা বেশ বর্ণাঢ্য জনপদ। মুক্তাগাছাকে জানতে গেলে অনায়াসে এসে যাবে ময়মনসিংহের কথা। বাদ যাবে না তৎকালীন পূর্ববাংলার কথাও। ক্ষুদ্র পরিসরের এই লেখা আংশিক হিসেবেই সীমাবদ্ধ রাখছি। পশ্চিমে মধুপুরের শালগড় আর উত্তর ও পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদ। দুই ধরণের মাটির গড়ন থেকে এটা অনুমান করা যায় যে দূর অতীতে হয়তো এই অঞ্চলের একাংশ লৌহিত্যসাগর খ্যাত ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে বিলীন ছিল। আরেকাংশ হয়তো মধুপুরের গভীর অরণ্যেরই অংশ ছিল। সময়ের পালাবদলে মানুষের বাসযোগ্য জনপদে পরিনত হয়।
দশম শতাব্দী থেকেই পাল ও সেন বংশের শাসকদের আবির্ভাব ঘটে। তখন তারা বাংলার বিভিন্ন অংশের মত বর্তমান মুক্তাগাছা অঞ্চলও শাসন করে চলেন। দশম শতাব্দীর শুরুর দিক থেকে প্রায় ১২০ বছর কাল ধরে পাল রাজাগণ এ অংশ শাসন করেন। তখন মধুপুরের পালরাজা ভগদত্তের ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজধানী ছিল বারতীর্থ। বর্তমান শোলাকুড়ির কাছে যেখানে রাজা ভগদত্তের আামল থেকে অধ্যাবদি প্রতি বছর বৈশাখ মাসে নিয়মিত ‘বারতীর্থ মেলা’ বসে আসছে, বারতীর্থ দিঘিতে পূণ্যস্থান হয়, বারতীর্থাশ্রমের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে সেখানেই ছিল রাজা ভগদত্তের রাজধানী বারতীর্থ। এই রাজা ভগদত্ত এবং তার বংশধররাই পাল আমলে সুবিশাল ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বিভক্ত ময়মনসিংহের পশ্চিমাংশ শাসন করতেন। সেক্ষেত্রে মুক্তাগাছাও ছিল তাদের শাসনাধীন। পালবংশের পর সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা আদিশূর বা বীরসেনের হাত ধরে ক্রমান্বয়ে বাংলার অন্যান্য অংশের মত সেন বংশের শাসকদের হাতে চলে যায় এ অঞ্চল।
সেন বংশীয় শাসক বিজয়সেনের পুত্র বল্লালসেন শাসনের সুবিধার্থে তাঁর শাসনাধীন বিশাল বাঙ্গদেশকে রাঢ়, বাগড়ি, বারেন্দ্র, মিথিলা ও বঙ্গ এই পাঁচভাগে বিভক্ত করেন। পশ্চিমে করতোয়া নদী আর পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদ এর মধ্যবর্তী অংশ ছিল বঙ্গ বিভাগ। সেক্ষেত্রে মুক্তাগাছা ছিল বঙ্গ বিভাগের অন্তর্গত। আর পূর্ব ময়মনসিংহ ছিল কামরুপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজীর বাংলা বিজয় পর্যন্ত এ অঞ্চলে বল্লাল সেনের শাসন চলে। ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে হুসেন শাহ সিংহাসন অধিকার করেন। তখন এই অঞ্চল তার অধীনে চলে যায়। টাঙ্গাইলের আটিয়ায় হুসেনশাহ ১৫১৬ সালের দিকে আটিয়া জামে মসজিদ নির্মাণ করেন। হুসেনপুর ও হুসেনশাহি পরগণা মূলত হুসেনশাহর নামে নামকরণ করা হয়। এরপর নছরৎশাহ শাসন করেন এ অঞ্চল। মোগল সম্রাট আকবরের সময় রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে টোডরমল এই অঞ্চলকে বিভিন্নভাগে বিভক্ত করেন। তখন বর্তমান মুক্তাগাছা অঞ্চল হয় আলাপসিং বা আলেপশাহী পরগণা।
১৭০০ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতায় আসেন মুর্শিদ কুলী খান। মুর্শিদ কুলী খানের মৃত্যুর পর ১৭২৭ সালে তাঁর জামাতা সুজাউদ্দিন খান বাংলার সিংহাসনে বসেন। তখন থেকে সুবেদারি ও জমিদারি ধারাবাহিকভাবে বংশগত হয়ে যায়। তার আমলেই মুক্তাগাছা ও গৌরীপুরের জমিদারদের দুই প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ আলাপসাহি ও মোমেনসাহি পরগণার জমিদারী লাভের পথ খুঁজে পান। সে সময়ে মুর্শিদ কুলী খান নবাবের উচ্চপদস্থ পদে বিশ্বস্ত হিন্দু লোকদের নিয়োগ দিতে শুরু করেন। সেই সুবাদেই শ্রীকৃষ্ণ আচার্য্য ও শ্রী কৃষ্ণ চৌধুরী মুর্শিদ কুলী খানের দরবারে উচ্চ পদ লাভ করেন। পরবর্তীতে তারা দুজন যথাক্রমে মুক্তাগাছা ও গৌরীপুরের জমিদারী লাভ করেন। উদয়ন আচার্য্যরে প্রথম স্ত্রীর দ্বিতীয় পুত্র ছিলেন শ্রী কৃষ্ণ আচার্য্য। বীরভূমের দেবগ্রামে তার জন্ম। এই শ্রী কৃষ্ণ আচার্য্যই মুক্তাগাছা জমিদারীর প্রতিষ্ঠাতা। সুজাউদ্দিনের মৃত্যুর পর নবাবী নিয়ে আলিবর্দী খাঁ ও সরফরাজ খাঁর মধ্যে দ্ব›দ্ব দেখা দেয়। আলীবর্দী খাঁ ঘোরিয়ার যুদ্ধে সরফরাজ খাঁকে পরাজতি ও হত্যা করে বাংলার নবাবী হস্তগত করেন। শ্রীকৃষ্ণ আচার্য্য তখন আলীবর্দী খাঁর পক্ষভূক্ত থেকে তাঁকে নানাভাবে সহযোগিতা করেন।
আালাপসিংহ পরগনা মসনদ-ই-আলা ঈশা খাঁর বাইশ পরগনার অন্তর্ভূক্ত ছিল। ১৭২১ সালে মুর্শিদ কুলী খাঁর বন্দোবস্তের সময় এই পরগনাটি ঘোড়াঘাট চাকলার অন্তর্ভূক্ত হয়। সেই সময় এই পরগনাটির দশ আনার মালিকানা ছিল লোকিয়া গ্রামের বিনোদনাথ চন্দ্রের আর ছয় আনা অংশের মালিক ছিল বর্তমান ফুলবাড়িয়ার পুটিজানার রামচন্দ্র রায় ও ভবানী রায়। সেই সময়ে জমিদারদের রাজস্ব আদায়ের এক অদ্ভূত পদ্ধতির প্রচলন ছিল। কোন জমিদার রাজস্ব দিতে ব্যর্থ হলে তাকে বৈকুন্ঠ বাস করতে হতো। বৈকুণ্ঠ ছিল মূলত একটি নোংড়া গর্ত যেখানে মলমূত্র ও ময়লা আবর্জনা ফেলে রাখা হতো। কেউ রাজস্ব দিতে ব্যর্থ হলে তাকে সেই গর্তে নিক্ষেপ করা হত। রাজস্ব না দেয়া পর্যন্ত তাকে অনাহারে এই গর্তেই থাকতে হত। সে কারণে অনেক জমিদারই তাদের জমিদারি ইস্তফা দেন। আলাপসিংহ ছিল পশ্চাতপদ একটি পরগনা। শ্রী কৃষ্ণ আচার্য্য এই আলাপসিংহের জমিদারি পেতে উদযোগী হন। এই জমিদারির রাজস্ব কত হতে পারে তা তদন্ত করার জন্য কানুন গো গঙ্গারাম রায়কে সরেজমিনে পাঠান নবাব। যাতে সহজে পরগনার জমিদারি পেতে পারেন সেই অভিপ্রায়ে সুচতুর শ্রীকৃষ্ণ পরগণাটির রাজস্ব কম দেখানোর জন্য কানুনগো গঙ্গারাম রায়কে কৌশলে বাগে আনেন। সে মোতাবেক গঙ্গারাম রিপোর্ট করেন। এতে শ্রীকৃষ্ণ আচার্য্য অনেকটা সহজেই আলাপসিংহ পরগনার জমিদারি পেয়ে যান। বগুড়ার ঝাকড়ে থেকেই এ পরগণার জমিদারী পরিচালিত হতে থাকে। পলাশীর যুদ্ধে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসন শুরু হয়।
জমিদারদের উদাসীনতা, অতি বিলাশিতা, ইংরেজদের লুটপাট ইত্যাদি কারনে ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে ১১৭৬ বঙ্গাব্দে বাংলা জুড়ে ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। যা ইতিহাসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে খ্যাত। এ সময় নিরন্ন মানুষের অংশ গ্রহনে বাংলায় সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ইংরেজ শাসনকে বেশ নাড়া দেয়। দরিদ্র লোকজন খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যে সন্ন্যাসীদের সাথে যোগ দেয়। ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে প্রায় পঞ্চাশ হাজার সন্ন্যাসী বিভিন্ন স্থানে ধনিক শ্রেণির কাছ থেকে খাদ্য শস্য, ধন সম্পদ লুটে নিতে থাকে। এদের দমনে ওয়ারেন হেস্টিংস ইংরেজ সেনা ক্যাপ্টেন থমসনকে সৈন্য বহর দিয়ে পাঠান। সন্ন্যাসীদের আক্রমণে ইংরেজ বাহিনী পরাস্ত হয় এবং ক্যাপ্টেন থমসন নিহত হন। ১৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দে হেস্টিংস সন্ন্যাসীদের দমনে ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড, ক্যাপ্টেন স্টিওয়ার্ট ও ক্যাপ্টেন জন্সকে পাঠান। তাদের ত্রিমুখী আক্রমনে সন্ন্যাসীরা পিছু হটে তৎকালীন ময়মনসিংহের মধুপুর গড় ও জামালপুর শহরের কাছে সন্ন্যাসীগঞ্জে আশ্রয় নেয়। কিছুদিন লুকিয়ে থেকে সন্ন্যাসীরা পুরোদমে কার্যক্রম শুরু করে।
১৭৮১ সালের দিকে সন্ন্যাসীরা মুক্তাগাছা ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকায় প্রবেশ করে জমিদার এবং ধনাঢ্যদের সম্পদ কেড়ে নিতে থাকে। ১৭৮২ সালের ৪ জুলাই শেরপুর, ময়মনসিংহ, জাফরশাহী ও আলাপসিংহের জমিদারদের আবেদনের প্রেক্ষিতে রেভিনিউ বোর্ড হেনরী লজকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ময়মনসিংহে পাঠান। হেনরী লজ বেগুনবাড়িতে স্থাপিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কুঠিতে উঠেন। সেখানে অভিযোগকারী জমিদার এবং সন্ন্যাসীদের বৈঠক আহবান করলে সন্ন্যাসীরা হাজির হননি। এর এক বছর পর হেনরী লজ তার সাথে থাকা সৈন্যদের সঙ্গে ঢাকা থেকে পাঠানো ৫০ জন সিপাহী ও জমিদারদের লাঠিয়ালদের সমন্বয়ে গঠিত বাহিনী নিয়ে সন্ন্যাসীদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। সন্ন্যাসীরা পিছু হটে আত্মগোপনে চলে যান। পরবর্তীতে সন্ন্যাসী এবং ঠগদের দমনে জামালপুরের কাছে সন্ন্যাসীগঞ্জে সেনানিবাস স্থাপিত হয়। ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলা স্থাপিত হয়। ডবিøও রটন জেলার কালেক্টরের দায়িত্ব নেন। ১৭৯০ সালের দিকে সন্ন্যাসীদের দমনে সমর্থ হয় ইংরেজরা। মধুপুর বনের বিভিন্ন স্থানে সন্ন্যাসীদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আস্থানার ধ্বংসাবশেষ রয়ে গেছে আজও।
শ্রী কৃষ্ণ আচার্য্যরে জমিদারী পরগণা আলাপসিংহ গাছ-পালা ঘেরা, উর্বর কৃষি ভূমি, নদ-নদী সব মিলে খুবই সুন্দর ছিল। নৌপথে এখান থেকে ঢাকা, বগুড়া, দিনাজপুর, রাজশাহীসহ প্রায় সর্বত্রই যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল। এই এলাকাটি নিতান্তই দরিদ্র লোকের বসবাস ছিল। প্রধান পেশা কৃষিকাজ। পলাশীর যুদ্ধের পর শ্রী কৃষ্ণ আচার্য্যরে পুত্ররা নিজেদের জমিদারী পরগণায় আসেন। আলাপসিং পরগণার বিনোদবাড়ি নামক স্থানে বসত গড়েন এবং স্থানটির নতুন নাম রাখেন মুক্তাগাছা। ক্রমেই এখানকার জমিদারদের জমিদারীর বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। জমিদারীর পাশাপাশি শিক্ষা বিস্তার, সাহিত্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতাসহ নানা কারণেই বাংলা ছাড়িতে পুরো ভারতবর্ষে তারা আলোচিত হন। এখানকার জমিদার শশীকান্ত আচার্য তৎকালে পূর্ববাংলায় সবচেয়ে ধনাঢ্য জমিদারে পরিনত হন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠায় আর্থিক সহায়তার ভূমিকা রাখার পাশাপাশি ময়মনসিংহ জেলা প্রতিষ্ঠা, রেলওয়ে জংশন, আনন্দমোহন কলেজ, ১৮৭৫ সালের অক্টোবরে মুক্তাগাছা মিউনিসিপালিটি (পৌরসভা) স্থাপন, মুক্তাগাছা থানা ফাঁড়ি স্থাপন, অমরাবতি নাট্যমন্দির, সূর্যকান্ত হাসপাতাল, মুক্তাগাছায় দাতব্য হাসপাতাল, ময়মনসিংহে জলের কল, টাউন হল প্রতিষ্ঠাসহ বহু ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান স্থাপনে এখানকার জমিদাররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ভারতীয় আইন পরিষদে নির্বাচিত সদস্য থাকতেন এখানকার জমিদাররা। কংগ্রেসের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন এখানকার উচ্চশিক্ষিত এবং রাজনৈতিক সচেতন জমিদারদের কেউ কেউ। তাদের আমন্ত্রণে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসও আসেন মুক্তাগাছায়। সেসময় সাহিত্য, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতায় মুক্তাগাছার খ্যাতি বিস্তৃত হয় সর্বময়।
উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, স্বভাব কবি গোবিন্দ দাস, মহাকবি কায়কোবাদ, প্রমথেশ বড়ুয়া সহ সাহিত্য সাংস্কৃতিক অঙ্গনের আলোচিত অনেকের স্মৃতি জরিত এই মুক্তাগাছার সাথে। বাংলা ১৩১২ সানের বৈশাখ মাসে এখানকার জমিদারদের অন্যতম পৃষ্ঠপোষকতায় ময়মনসিংহ সারস্বত সমিতির আয়োজনে ময়মনসিংহ শহরে কৃষি-শিল্প প্রদর্শনীর সাথে সাহিত্য প্রদর্শনী হয়। সেখানে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ২০ জন লেখকের ৪৭টি হাতে লেখা বই ও ৭৬ জন লেখকের ১০১টি মুদ্রিত বই প্রদর্শিত হয়। মুদ্রিত বইয়ের লেখকদের মধ্যে ১৫জন ছিলেন মুক্তাগাছা, ফুলবাড়িয়া, ত্রিশাল মিলে সদর ময়মনসিংহ অঞ্চলের। ১৮৮৪ সালে ময়মনসিংহ শহরে ‘সাহিত্য সমিতি’ নামে প্রতিষ্ঠিত পাঠাগারটি কয়েক বছরের মধ্যে বিলুপ্ত হলে মুক্তাগাছার জমিদার সূর্য্যকান্ত আচার্যের নামে বৃহৎ পাঠাগার স্থাপিত হয়। মুক্তাগাছা জমিদারদের বাড়ির ভেতরেও পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। সাংস্কৃতি চর্চায় প্রতিষ্ঠিত হয় আলোচিত ভূপেন্দ্র রঙ্গপীঠ।
১৯৪৮ সালে হিন্দু-মুসলিম দ্বিজাতি তত্তের ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তান পৃথক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলে পূর্ববাংলা পাকিস্তানের অংশে পড়ে। তখন এদিককার প্রতাপশালী হিন্দুরা ওইদিকে আর ঐদিককার প্রতাপশালী মুসলমানরা এদিকে স্থানান্তরিত হতে থাকেন। মুক্তাগাছার জমিদাররা স্বঅবস্থানে এখানেই থেকে যাবার মানসিকতায় জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির কালে তাদের জামিদারী রাখার জন্য আদালতে মামলা করেন। পরবর্তীতে মামলায় হেরে গেলে ১৯৫৪ সালের পরে একটিমাত্র পরিবার থেকে বাকিরা ভারতে চলে যান। এর আগে ৫২’র ভাষা আন্দোলনের সময় আরকে হাই স্কুলের ছাত্ররা সক্রিয় অংশ নেন ভাষা সংগ্রামে। সেখানে জমিদারদের দুই সন্তানও অংশ নেন।
২৩ বছরের পাকিস্তানী শাসন আমলে মুক্তাগাছার রাজনৈতিক অঙ্গন বেশ সরগরম থাকলেও। অনেকটাই ভাটা পড়ে শিল্প, সাহিত্য, সাংস্কৃতিক চর্চায়। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে কাংখিত স্বাধীনতা অর্জিত হলে নতুন আঙ্গিকে এখানে সাহিত্য সাংস্কৃতিক চর্চা শুরু হয়। নবারুন সংসদ, মুক্তাগাছা পৌর সাধারণ পাঠাগার প্রতিষ্ঠাসহ শিল্প সাহিত্য ও ক্রিড়া চর্চায় মুক্তাগাছা শহরে এবং শহরের বাইরে বিভিন্ন গ্রামে ছোট বড় ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের এই সময়ে চলচ্চিত্র, টিভি নাটক, মঞ্চ নাটক, সংগীত, শিল্পকলাসহ সংস্কৃতির নানা আঙ্গিকে মুক্তাগাছার অনেক সন্তানই সৃজনশীল কর্মের ছাপ ফেলে স্বগৌরবে এগিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিবছরই একুশে বই মেলায় এখানকার একাধিক লেখকের বই প্রকাশ হচ্ছে।
এখানকার কবি, সাহিত্যিকরা নিজ নিজ লেখনি দ্বারা সাহিত্যাঙ্গনে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করে চলেছেন। মুক্তাগাছার কবি, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মীরা দেশ, বিদেশের নানা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে যেমন যাচ্ছেন তেমনি এখানকার কবি, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মীদের অবস্থান বিবেচনায় দেশ বিদেশের খ্যাতিমান অনেক কবি, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরাও সময়ে সময়ে এখানে আসছেন। ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০খ্রি. ভারতের সমকালীন খ্যাতিমান কবি ও সাংস্কৃতিক কর্মী ড. অমিতাভ কাঞ্জিলালের নেতৃত্বে ২৬ সদস্যের একটি সাংস্কৃতিক টিম মুক্তাগাছায় এসে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেন। সেখানে আগত কবিকে কিংবদন্তি’র পক্ষ থেকে সম্মননা প্রদান করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তাগাছা থেকে কিংবদন্তি, মেইন রোড, ঘুড্ডি, দেবদারু, মেরুদন্ড, অতঃপর, কথা, শীর্ষবিন্দুসহ সাহিত্যের বেশ কিছু ছোট কাগজ প্রকাশিত হচ্ছে যেগুলো সাহিত্য চর্চায় বেশ ভূমিকা রাখছে। সব মিলে সার্বিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে মুক্তাগাছা।