ঋণ স্বীকার
উড়ে যেতে যেতে এই গ্রামে কুর্নিশ করে যায় মেঘ— তার নিচে সুপারির বাকলে ঘেরা বাড়ি— এখানে, ছোট ছোট ঘরের পাশে কেয়া আর কেওড়ার বন— মেঘের বিপরীতে বনটিয়ে উড়ে যায় যদি, আমি তার পিছে পিছে চলি—
ও মেঘ, জল আগুন আর শব্দ কীভাবে এক দেহে রাখো— আমাকে কি সেই বিদ্যা দেবে— দেখো, এই গেঁয়ো গোলপাতার ঘরে বাস করে যারা, তারা সব বাঘ— আমি তো তাদের সাথে চলি, কথা কই— তাদেরই তরুণ কোনো মেয়ে প্রিয় বাঘিনী আমার—
আমাকে মুগ্ধ করে তোমার এই উড়ে উড়ে চলা— চোখ নেই, তবু, যেদিকে পাহাড়, শুধু সেদিকেই যাও— প্রিয়তম বাঘিনীর কাছে যেভাবে আমিও যাই রোজ— তোমার কাছেই তো শেখা সব— যদিও, এতকাল সেই ঋণ করিনি স্বীকার—
আমাদের ঘুম
কাস্তে আর কোদাল নিয়ে মাঠে যাই। ধানি জমিতে চারাদের বেড়ে ওঠার বীজমন্ত্র পুঁতে দিয়ে আসি নরোম কাদার ভেতর। আমাদের নিত্যকার প্রার্থনা এই। খেতের পবিত্র হাওয়া আর রোদ আমাদের আয়ুবর্ধক ওষুধ।
এক সুন্দর মুখ আর অসুন্দর তিরস্কার নিয়ে এখনো হাজির হন বায়োলজির ম্যাম। পড়া হয়নি বলে একে একে আমরা বেরিয়ে যেতে থাকি ক্লাসরুম থেকে— যেন দাগি আসামি। অথচ, গেঁয়ো ফসলের পাতা আর রোদের সালোক-সংশ্লেষণ দেখে দেখে দিন কাটে আজ। আল টপকে অকস্মাৎ পালিয়ে গেলে কোনো বেজি, বাস্তুসংস্থান নড়েচড়ে ওঠে মাথার ভেতরে।
আমাদের মগজে নেই ক্যালকুলাস, কার্তেসীয় গুণজ— তবু, দিনশেষে ফসলের হিস্যা নিয়ে ফিরি ঘরে। তারপর, ঘুমিয়ে পড়ি ক্লান্তির ভেতর।
আমাদের ঘুম ফসলের সমানুপাতিক।
রাজা
খুব ভোরে বেরিয়ে পড়েন বাবা— মাথার ফেটিতে ঠিকরে পড়ে আনকোরা রাঙা রোদ্দুর— দূর থেকে মনে হয়, সোনার মুকুট পরে হেঁটে যাচ্ছেন তিনি— যেন কোনো গরিব দেশের ঋণগ্রস্ত রাজা—
যতটুকু পাই আহার ও স্নেহ— তোমার কর্মীষ্ঠ হাত দিয়েই তো আসে— এই বন-উপকূলের দরিদ্র সংসারে, বাবা, আদতেই তুমি মহানুভব রাজা—
যখন শাণ দেওয়া কাস্তের গলা অথবা জীবন্ত ছুরিমাছ সহসা ঝলসে ওঠে তোমার ওই ধান কাটা আর জাল টানা হাতে— তুমি নিজেই তখন হয়ে ওঠো তোমারই প্রধান সেনাপতি— মনে হয়, কী সীমাহীন দৃঢ়তা নিয়ে শক্ত করে ধরে আছো খোলা তলোয়ার—
একদিন, খুব গোপনে তোমার পিছু পিছু যাব বনের ভেতর— অপার বিস্ময়ে দেখব, গাছ-প্রজারা তোমাকে দেখে কুর্নিশ করে কি না— আর ‘ওই তো আসছে রাজা’ এই কথা বলে সরে সরে দাঁড়ায় কি না বুনো পথ ছেড়ে—
শাহজাদি
তুই গুণীনের মেয়ে— আমার নদীর ঘাটে কেন এসে এভাবে দাঁড়াস— চুলের ফুলনাদিতে গুঁজে রাঙা রাজবলা ফুল কেন টেনে ধরিস বেতের আঁকড়ির মতো—
দক্ষিণ রায়ের নামে তোর বাপ যেভাবে চালান দেয় বাঘ দ্বীপ থেকে দ্বীপে— কোনো এক কৃষ্ণচতুর্দশীর রাতে অন্য কোনো বনে রাগের মাথায় আমাকেও চালান দেয় যদি— তুই তবে কার কথা ভেবে নিজেকে সাজাবি রোজ ছৈলার ফুলে— আমি যদি আর বৈঠা বেয়ে বেয়ে জলের ঘোড়ায় চড়ে না যাই জঙ্গলে— যে আমার শহুরে প্রেমিকা, তার কাছে কী জবাব দিবি—
ও গুণীনের মেয়ে, বনের শাহজাদি— ভালো যদি বাসিস, এই গেঁয়ো খালপাড়ে তুই আর আসিসনে যেন…
নির্জনতা
এমন নির্জনতা ভালো লাগে— গেয়ো রোদ্দুরে মাথার ওপর ছাতা ধরে আছে বুনো গাছ— তার ছায়ায় পিতার স্পর্শের স্বাদ লেগে আছে—
যে আমার জলের ঘোড়া— এই ছিপছিপে ডিঙি— তার পিঠে চড়ে খানিক থেমে যাই গাছের স্নেহে— খাঁড়ির কিনার ঘেষে এক রাজকীয় গুঁইসাপ হেঁটে যায় ধীরে— সে খোঁজে বুনো হাঁস অথবা কচ্ছপের ডিম— আমিও যেমন খুঁজি আধলা ইটের মতো দাঁতাল কাঁকড়া— এই গুঁইসাপ, তার লিকলিকে জিভ, বানরের খুনসুটি দেখে শুরু হয় আমাদের দিন—
উঠোনের মাচায় এক ফিঙে এসে বসে— বনের গভীর থেকে সে যখন লোকালয়ে আসে, লোকালয় ছেড়ে আমরা তখন বাদার গর্ভে ঢুকে পড়ি— আমাদের নির্জনতা ভালো লাগে বেশি—