কবিতার স্বতন্ত্র এক স্বরের অধিকারী কবি সৈয়দ তারিক। যার যাপন, প্রকাশ ও অস্তিত্বে কবিতা মিশে আছে। আছে সুফি ভাবধারা। ভ্রমণপ্রিয় এই কবি ঘুরে বেরিয়েছেন দেশের নানা প্রান্তে। এটাই একজন কবির কাছে আরাধ্য যে, তিনি নিজের কবিতাই লিখছেন। তিনি আশির দশকের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিত্বশীল কবি। “১৯৯৬ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ছুরি হাতে অশ্ব ছুটে যায়’ র ১৩ বছর পর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘মগ্ন তখন মোরাকাবায়’ প্রকাশ পায়। এই দুই কাব্যগন্থের কবিতার মাঝে ব্যাপক বাঁকবদল ঘটেছে। যা ইতিবাচক। তিনি প্রথম কাব্যগ্রন্থে মারফিন, আত্মহননের কথা বলেছেন। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে সুফিবাদের ছোঁয়া রয়েছে। সেখানে তিনি সে ধরনের শব্দ পরিহার করেছেন। “সৈয়দ তারিকের কবিতা ভিন্ন প্রকরনের কবিতা, যেখানে বলা চলে কবি ঋজু এবং স্বাধীন। কবিকে “কিংবদন্তি” র পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা.…
জীবনানন্দ
জীবনানন্দের বাড়ি ভরপেট খাওয়া-দাওয়া সেরে
অতিথিরা তুলেছে ঢেকুর।
খাবারের স্বাদ তারা ভুলতে পারে নি কিছুতেই;
এমন কি বংশানুক্রমে
তাদের সন্ততিগণ হাতের তালুতে আজও ঘ্রাণ পায় তার।
সকলেই জেনে গেছে কী তার রেসিপি ছিলো, তাই
এখন অনেক ঘরে নিত্যকার শাকে,
ভাজিতে, ডালে ও মাংসে অবিকল সে-রকম স্বাদ;
তিন বেলা খায় তারা এবং অতিথি ডেকে পাতে তুলে দেয়।
ধন্য জীবন বাবু, চমৎকার বাবুর্চি ছিলেন :
বাঙালির মাছ-ভাত জীবনানন্দ নামে ডাকা সম্ভব।
অনুষঙ্গ
কড়িকাঠে দোলে পাকানো দড়ি
মটকানো ঘাড়
ঠাণ্ডা শরীর
রেললাইন ডাকে
খণ্ড শরীর
রক্তের স্রোত
চর্বিমাখা
নাইট্রাজিপাম
ধারালো ছুরি
দাউ দাউ জ্বলা
আগুন আগুন
মরফিন
আহ্ মরফিন
আহ্ মরফিন
আহ্ নিমজ্জন
ভূতুড়ে চাঁদের ছড়ানো কাফন
গোরস্থানের অন্ধকার
শীতল ঘুম
নদীর অতল গভীর জল
রেললাইন ডাকে
কড়িকাঠে দড়ি
রেললাইন ডাকে
স্টেনলেস ছুরি
রেললাইন ডাকে
সিডেটিভ বড়ি
শাদা জ্যোৎস্নায়
ছড়ানো কাফন
ভূতুড়ে চাঁদের
হিংস্র ইশারা
রেললাইন ডাকে
হেরোইন ঘুম
রেললাইন ডাকে
এনড্রিন ঘুম
রেললাইন ডাকে
সায়ানাইড ঘুম
রেল-রেললাইন
রেল-রেললাইন
রেল-রেললাইন।
শয়তানের পদাবলি
আমার কলম নিয়ে শয়তান পদাবলি লেখে
দেখে বেশ আনন্দ পেলাম,
‘কিন্তু বাছা’, বলি তাকে, ‘মনে করে চুকিয়ো কালির পুরো দাম।’
এ-কথা শুনে সে হো হো হেসে উঠে টেপে এক চোখ,
তারপর শূন্যে মিলে যায় :
আমার স্বাক্ষর দেখি কাগজের পাতায় পাতায়।
লাল খরগোশ
লাল খরগোশ
তোমাকে বললো :
তুমি আর আমি
ধিক ধিতাং।
লাল খরগোশ
আমাকে বললো :
তুমি আর আমি
ধিক ধিতাং।
দুচোখে দুচোখ
তুমি আর আমি
লাল খরগোশ
ধিক ধিতাং।
মৃতদেহ
তার মৃতদেহ ছিল পড়ে
তার মৃতদেহ পড়েছিল।
আমি এবার সামনে দাঁড়াব
না না আমাকে দাঁড়াতে দাও
না না আমাকে আমাকে আমাকে
তার তার মৃতদেহ পড়ে থাকে।
তবু কেউ তো সামনে দাঁড়াবেই
আর রক্তের ধারা বয়
ফের কেউ তো কদম বাড়াবেই
লীলা নেহাৎ সরল নয়।
যদি থাকে তাতে সন্দেহ
দেখ পড়ে আছে মৃতদেহ…
মগ্ন তখন মোরাকাবায়
ক
আমি ছিলাম মগ্ন আঁধারের বস্তুপিণ্ড;
তুমি আমাকে তুলে আনলে আলোয়
আর সঞ্চার করলে প্রাণ :
প্রভু, তোমাকে প্রণাম।
আমি ছিলাম আমাতে লিপ্ত অহর্ণিশ,
অথচ আমার ছিলাম না আমি;
আমাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছ তুমি :
প্রভু, তোমাকে প্রণাম।
চিরকাল আকুলতা ছিল প্রেমের জন্য,
অথচ কেটেছে দিন নিষ্করুণ অপ্রেমে;
প্রণয়ের যৌবরাজ্যে আজ আমার অভিষেক :
প্রভু, তোমাকে প্রণাম।
খ
পুড়ে যায় রোম নীরোর বাঁশির শব্দ বাতাসে ভাসে,
সীমাহীন দূরে শুধু চেয়ে রয় আকাশে অরুন্ধতী;
কতটা পুড়লে বিশুদ্ধ হয় বলতে কি তুমি পারো?
ও আগুন, তুমি প্রসন্ন হও ইব্রাহিমের প্রতি।
কোষের দেয়াল পুড়ে পুড়ে যায় কেন্দ্রীণ ওঠে কেঁপে,
স্নায়ুর শিকলে পড়ে টান, বুঝি নামছে জীবনে যতি;
কতটা পুড়লে বিশুদ্ধ হয় বলতে কি তুমি পারো?
ও আগুন, তুমি প্রসন্ন হও ইব্রাহিমের প্রতি।
গ
নারীকে নয়, ভালো নারীত্বকে বাসি,
মর্মশ্বাস তার অপূর্ব;
নারীর প্রেম নয়, প্রেমের প্রেমে মজে
নিজেকে মনে হয় কী উর্বর!
আমার কৃষ্ণজি নিবিড় ভালোবেসে
জড়িয়ে ধরে যেই রাধাকে,
আমার আধখানা গভীর শিহরণে
মিলনে টানে আর আধাকে।
তুমি অলকায় নাই
রমনা পার্কে ফুটেছে এখন প্রথম কদম ফুল
প্রথম নেমেছে ঢল;
চোখে-জমে-ওঠা মেঘ গলে গিয়ে
ঝরল দু ফোটা জল।
জুড়িয়ে গিয়েছে পেয়ালার কফি
সিগারেট পুড়ে ছাই,
আষাঢ়ের আজ প্রথম দিবস–
তুমি অলকায় নাই।
অপর
এটা আমি নই, এটা সৈয়দ তারিক,
আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখি;
সে হাঁটে নগরে আর নগরের অনেক আড়ালে
আমি তার বয়ে যাওয়া দেখি।
সৈয়দ তারিক এটা নয়—
শূন্যতা ধরেছে আকার;
আমি তার হয়ে ওঠা দেখি
নিভে যাওয়া দেখি আমি তার।
পরিচালক
আমাকে নামিয়ে দিয়ে নাম ভূমিকায়
ঠোঁটে ঠোঁট মিলছে যখন
ঘোষণা করেন তিনি : কাট্।
আমিও ভুলেই যাই _ প্রায়শই ভুলে থাকি _ আছি অভিনয়ে;
ভুলি : পরিচালনায় রয়েছেন তিনি;
নায়িকার হাত ধরে চোখে চোখ রেখে মনে হয় :
জন্মান্তর হতে তাকে আমি চিনি।
তারও চোখে জ্বলে প্রেম, তারও ঠোঁটে অবিকল হাসি;
ভুলে যায় সংলাপ পাঠ;
মেঘের ওপার হতে গম্ভীর বজ্রের স্বরে
চেঁচিয়ে ওঠেন তিনি : কাট্।
চিরঞ্জীব
জানি, জানি হবে দারুণ ফতোয়া জারি :
কাফের কতল করো;
শুনেছে আদেশ নবিজির অনুসারী :
মরার আগেই মরো।
আমি তো কবেই কাফন পরেছি শরীরে
আমি তো কবেই হয়ে গেছি পুড়ে ছাই,
আমি তো কবেই জেনে গেছি অন্তরে :
আমার মৃত্যু নাই।