দীর্ঘ কবিতা যা দীর্ঘ কলেবরের ভেতর দিয়ে প্রতীয়মান হয়।একেক জনের কাছে তা একেক রকম অর্থ ধারণ করে।ইঙ্গিত করে।নির্মোহ বিচারে কবিতা আসলে কবিতাই।যদিও দীর্ঘ কবিতার কোন নিদিষ্টতা নাই। কত বড় হবে, কত লাইনের ভেতর থাকবে এই রকম কোন ধরাবাধাঁ নাই। ভিন্ন ভিন্নভাবে আর্টের স্বরূপকে একমাত্র দীর্ঘ কবিতাই ধারণ করতে পারে।
পরিতোষ হালদার
অলিখিত তুই ও ছায়া
এক.
নিজেকে অলিখিত মনে হয় তাই গুছিয়ে রাখি। কোন দায় নেই অথচ একবার এসে বল― একটা পিয়ানো বিগত জন্মের ঠুংঠাং। সব দিকে শূন্যের রং, রঙের ভেতরে তুই, তোর ভেতর রোদ। রোদে পাখি, পাখিতে উড়াল, উড়ালে নীল, নীলের ভেতর আমি। যে আমি পাঁচটি ছায়া ও সাতটি নিমগাছ। বর্ণ ছুঁয়ে যেতে যেতে শীত নামে। মৃতরা আসে, তারা গান গায়। তাদের হাতে একেকটি পোট্রেট, যাতে জীবিত জন্মের ছবি। রোলকলের মতো তুই, কেবল হাজিরা দিস প্রেজেন্ট… প্রেজেন্ট… । তবুও লজিকদেহ যেন চাঁদ থেকে চন্দ্রের দিকে ছুড়েমারা ঢিল, কান্নায় মোড়ানো একটুকরো পাথর। আমি একমাত্র ইতিহাস বই, আমাকে রঙের কাছে নিয়ে চল।
কথা ছিল, পাহাড় দিবি― দিলিনা। আমি জল ও অশ্রুর কাছে, কেবল অশ্রুজলের কাছে, চাঁদ ও চন্দ্রের কাছে, নতুবা চন্দ্রচাঁদের কাছে হেরে গেছি। আমারও নির্বাক ছিল, ডাকবাক্সে মতো প্রেম ছিল। মোহ ভেঙে গেলে তীর ও মোক্ষের মাঝে মৌনি লুকিয়ে থাকে। যেকোন রঙের মতো, লালের কাছাকাছি যে কেনো বর্ণই বুক। যে কোন পাখি তার মাংস নিয়ে উড়ে, আমি তার সুবর্ণগ্রাম। টেরাকোটা পার হলে থেকে যায় স্পর্শরেখা। কোন কোন পাপের কাছে পাপিয়ারা স্মৃতি খোঁজে। কিছু নক্ষত্র আসে, পাঠশালা ঘুরে ঘুরে তারাই হয়ে ওঠে চিঠি। আমিও লিখে রাখি প্রেম, তোর হাতে লেখা অক্ষরমালা। কার চোখে চোখ রেখে তুইও পঞ্চম স্মৃতি। যদি ফিরে আসো তবে ছায়া, না এলেও ছায়া। দৃশ্যগুলো প্রথমে দৃশ্য তারপর সাদাসাদা তারপর আবার দৃশ্য। যেন আধেয় যেন প্রকৃতি। আমি দৃশ্যের বাইরে আছি, ভেতরে আছি। আমাকে অতিক্রম করে যায় অবয়ব। দূরও মাঠ, মাঠের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা রোদ, রোদের ভেতর রাক্ষস, যে কিনা ছিন্নকাল― আরকটা রোদ… একটা এস্রাস…। আমাকে দেখ, কিছু শব্দ দেখতে পাবি। তারা অবিকল তুই, বড় বড় চোখ, বড় আগ্রাসন। ডাকলে তারা যাবে না, না ডাকলে পাখি। তুই কি পাখি হবি। শব্দ হবি। কোন বাইনোকুলার। মধ্যদিনের ছায়া তোকে কাঁদায়। তোর কাছে জল আছে― জন্ম আছে… আমি আছি…। আমি মানে একটা সমুদ্র, তোর মতো তুইতুই, একটা ফুলস্টপ।
দুই.
যেন ভোর, যেন দাঁড়িয়ে আছি, তিন তিনটি অনন্তকাল ও পাথর। তাকে মুক্তি দে, সে আত্মহননে যাক। যারা দশদিকে আছে তারা ভালোবাসতে জানে, তারা অন্ধকার। যা দেখি আকাশ, আকাশের ভেতর আকাশ, তার ভেতর আকাশ…। তোকে ছুঁয়ে দিলে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি যায়। যার ডানায় মৃত্যুর উড়াল আঁকা। এই যে হুবাহু বদল, তার বদলে এই যে ভালোবাসাবাসি, তার বদলে যতটা বিরহ তার সবটাই নদী ও পাহার। কোথাও স্পর্শ আছে, তাকে ডাকলে ভরাট হয়ে আসে গোল। ভাগ করে দেখ, চারপাশে শূন্য ওড়ে। যদিও বর্ণের গান তবু বহু ক্ষেত্রে আমিই অক্ষ। একবার দেখ, বার বার তোর নামের সরলরেখা। অথচ শব্দ ও প্রতিশব্দের ঝর, কোন কোন চিৎকার চিত্ত দোলায়। আমি ভিক্ষুকের মতো চাঁদ আঁকি অথচ জোছনা তোর। আমি তিন বর্ণে বিরহ লেখে দুই বর্ণে মোহ হয়ে থাকি। তবু পাখি যায়, পাখিপাখি মাংস হয়ে যায়। আত্মহনন শেষে মৃত পাখিরাও আসে, তারা ভাসে, ভেসে যায়…। আমি ওইসব মৃতদের দেখেছি, জীবিতদের ডেকে নিয়ে উৎসব করে। জঙ্গলবিদ্যা শিখায়… মৃত্যুবিজ্ঞান শিখায়…। গণিতের চেয়ে শূন্য গোল বলে আজও চিল উড়ে, ডানায় আজও গণিত ভাসে। ও শূন্যমান, একবার ভেল্কি দেখা, একবার তোর চোখে দূর ফুটুক; অন্যবার ছায়া ফেলে যাক দূর। সেই যে আগুন, সেও কি পুড়ে গেছে নাকি। আমি সাতবার প্রদক্ষিন করে পাঁচবার তুই হতে গেলে তিনবার বাঁধা পাই। আমি দুজন তুই আর তুই অজস্র আগুন। আরেকবার আয় আকাতরে সংসার-সংসার খেলি। মদ ও ফুলের আত্মীয়তা এলে জল আসে, নক্ষত্র আসে, যার মানুষের প্রতি কোন আগ্রহ নাই অথচ, মানুষ শুধু ছুটছে… । শুনেছি তুই একটা যন্ত্র, একটা পাথর, বকপাখি, নাকি এলিয়েন, নাকি কতোগুলো সেকেন্ডের সমারহ। পাপ ছুড়ে দে, আমি শূন্য বানিয়ে দি। তাকিয়ে দেখি― কিছু রেডিও হঠাৎ উড়াল দিয়ে গেল, কিছু চকলেট ঠাস ঠাস করে ফাটতে শুরু হলো। মনে হলো তুই একটা মৃতদেহ, একাধিক দৃশ্য, একটুকরো স্পেস।
তিন.
হতে পারে যেখানে আছিস সেটা চলে যাওয়া ও আসার বাইরে কোথায়। হতে পারে সেখানে উত্তাপ ও প্রজাপতি আছে। তোর কাছে সন্দেহ-
কোন ইশারা… কোন দিশা হারা…। যদি আকাঙ্খা ছড়িয়ে দিস, তার থেকে নিয়ে নেব হিম। এবার স্নান কর তারপর দৌড়ে পালিয়া যা। ভয় কিসের আত্মহত্যা তোর বন্ধুর মতো, ছুরি ও পিস্তলের মতো একা ও গোপনের মতো কিচিরমিচির। তুই হিংস্রপ্রবণ, অদ্বৈত ও অত্যাচারী। অক্ষরে ক্রিয়া ঢুকিয়ে দিয়ে নিজের সাথে হাসাহাসি করিস। তোর সবগুলো নাম কেমন হৈহৈ রৈরৈ। পাখিও ভয়ানক হতে পারে কিন্তু সে গান গায়। সে গান গায় কিন্তু শিকার করে, সে শিকার করে কিন্তু প্রসব করে, বাচ্চা বড় করে তারপর কেউ কাউকে চেনেনা। ওই পাখিটা তুই, ভয়ানকভাবে তুই। আমাকে যত নামে ডাক না কেন আমি সারা দেব। কারণ যার বেশি বেশি নাম সে বেশি মিথ্যুক। তুই কি হিম নাকি আলাদা কিছু। আমাকে ডাক দেয় কোন ধ্বনি, যে নিয়ত প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে দেয়। শব্দ আজ রাক্ষসের মতো কারণ রাক্ষস কি নিরির ভাবে মানুষকে অভিধান পড়ায়। এবার নিজের মতো করে ইহ এঁকে নে তারপর ভেসে যা। এতটা পথ পেরিয়ে এতটাই দিকচিহ্ন তোর। ভিন্ন নামে ডেকে, ভিন্ন ভিন্ন চিত্র এঁকে তারপর হেমন্ত উড়িয়ে দে…। একবার তাকিয়ে দেখ, যেখানে যাকিছু আছে সব দৃশ্য, সবাই একসাথে হাসে, একসাথে গান গায় আর একসাথে একা হয়ে থাকে। কতটা চাইতে পার, তার থেকে দিতে পারি কম কেননা কোথাও রোদ উঠবে তাই সমস্ত ফড়িং চুপ হয়ে আছে। এই যে দাঁড়িয়ে আছি, হেমন্ত অব্দি তার ছায়া পড়ে। কেমন করে তারা একা হয়ে যায়, পাখি যায়, ডানায় সুদূর লেপ্টে থাকে। অথচ মৌনি তুই, তোর প্রতিটি ছোঁয়া নিরাবব্বই ফুল হয়ে ঝুলে থাকে গাছে। আমাকে রঙ্গ দে…। একঝাঁক দলছুট দে… আমার বাঁধন ছিল, রক্ত মাংসের বিরহ শেষে আমিও হেটে গেছি।
উত্তরের খোঁজে একবার হারিয়ে যা, একবার ফিরে এসে বল― নতুন কোন বিরহই শেষ উত্তর। তারপর অনেক তারা একসাথে খসে পড়ে অনেক তারার গায়ে। যেতে যেতে হিম হয়ে আছি, তীব্র দে আমি হয়ে উঠি ধারা। কোন কোন শব্দ ছিন্ন করে, আমি বিছিয়ে যাই। নিজেকে গোছাতে গিয়ে দেখি ধ্বনির মাঝে লীন হয়ে আছি। বসন্ত ডাকে, কবে তার উল্লাসে ভেঙে ছিল ছায়া। আমি পাপ ও পাপিয়ার কাছে জমা রাখি সমগ্র প্রণয়। অন্ধকারে পা দিতেই দেখি কারা যেন আলো হয়ে আসে। চোখে জল, গলায় জলের স্বর। আমি নিজেকে ছড়িয়ে হারিয়ে যেতে চাই। আমি মৃত্যুর মতো একা হয়ে উঠি…
কাজী নাসির মামুন
নরুন্দি স্টেশন
মর্মের স্বপক্ষে জীবনের রন্ধ্র ধরে
বসে থাকি আজ; রাত বাড়ে।
ঝড়ো বাতাসের গায়ে
আচমকা পাখির ঝাপট!
কে? কে? যেন হিম তর্ক এসে
হঠাৎ ভাঙছে এই নিঃসঙ্গ প্রহর।
বৃষ্টি পড়ে; বৃষ্টি আকাশের প্রেমপত্র;
রিমঝিম শব্দের অঝোর বাক্যে
তাকে সারারাত পাঠ করে
কয়েকটি প্রবল উৎফুল্ল ব্যাঙঃ
ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর..
গ্যাঙ গ্যাঙ.. গ্যাগো গ্যাগো।
নশ্বরতা একটা হাসির
গোলাপ, সবার মধ্যে দোলে।
ঝরে পড়বার আগে ফুল
কখনো একান্ত হয় নিজে নিজে?
ব্যাকুল প্রশ্নের এই ধারাপাত
দুরন্ত ঈগল হয়ে ভেতরে তাকায়।
ভয় পাই! ভয়!
সময় খারাপ হলে হৃদয় একটা বিলবোর্ড।
বিষণ্ণ অক্ষরে বিজ্ঞাপন জেগে ওঠে
নিজের ভেতরঃ
দূরত্ব সাধনা যার, সে-ই টেকে;
স্পর্শ মানে মৃত্যু।
মর্ম-পাতা
গোপন থাকে না তবু; সম্পর্কের
শিরাল সঞ্চয়ে মনে পড়ে
ব্যক্ত সবুজের দিকে সব মুখগুলো।
একবার মিহির হারুন
নরুন্দি যাওয়ার পথে
সূর্য-পোড়া বাতাসে হেলান দিয়ে
একান্ত আমার মধ্যে গলে পড়ছিল।
সে তখন রোদ। রোদ হলো
সূর্যের গলিত
শরীর, পৃথিবী বুকে ধরে রাখে।
ভালোবাসা হলো
অভিন্ন আত্মার দিকে
নিজের অস্তিত্ব ভুলে যাওয়া।
সেদিন নিজের মধ্যে একটা পৃথিবী
অন্তরঙ্গ জানালায় কাত হলে
দেখলাম, কাশফুলে সাদা মন দুলে
উঠছে আমার; নদী আছড়ে পড়ছে
কিনারে কিনারে; জলস্রোত
ভাসিয়ে নিয়েছে সব ভুবন চিলের হাহাকার।
দহন-ধর্মের দিকে আমরা সবাই এক হলে
পৃথিবীর সব রোদ
নদীর আঁচলে মুখ ঢেকে
একদিন নরুন্দি স্টেশনে যায়।
দু’পাশে অনন্তগামী সবুজ সংগ্রাম
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে, আমরা আসছি।
মাঝে পথ; ঠিক পথ নয়,
পিচঢালা একটা ঘোড়ার পিঠ
সুদূর পশ্চিমে কেউ গড়িয়ে দিয়েছে।
অস্তগামী সূর্যের আগুন লাল চোখে তেড়ে আসেঃ
পথ শুধু দৌড়ায়; দিগন্ত-রঙে
ভেসে যায় গ্রাাম আর গ্রাম!
আমরা কয়েকজন
লোহার হৃদয়-গলা কাজল রেখায়
দুঃখের সমান্তরাল রেললাইন
মেয়েটির দুই ভ্রুর মধ্যে এঁকে দিই।
নরুন্দি স্টেশন! আহা,
মায়ার তরঙ্গে উঠে আসা
নিঃসঙ্গ বিকেল-
আমাদের সবার বান্ধবী;
ছায়ার ঝালরে সেজে থাকে।
আজ রোদ আছে, ছায়া নিভৃত ঘরের
নিজস্ব বাসরে কাতরায়; শুধু নরুন্দি দেখি না।
আনিফ রুবেদ
এই গোরস্থানের প্রাচীর আমি ভাঙিনি
নীরব এক ভবিষৎ, কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে। দূর হৃবিশ্বে মহাকালের মায়ায়। হৃথিবীর বুকে আমি যেতে চাই। কিন্তু রাতদিন পার্থিব পাহারা আমার থেকে আমাকে আলাদা করে রাখে। আমার থেকে আমাকে আলাদা করে রাখার এ মানে আমি বুঝি না।
এই ধান ভুঁই পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। পৃথিবীর ভেতর মানুষের আয়ু পোঁতা আছে। এখানে শালিকের পা নরমমমতা, বৃক্ষগুলো গজিয়ে থাকে মায়ের মতো। মানুষ চালাক প্রাণী, চালক হলো পৃথিবীর। এক মানুষ চালক হলো আর এক মানুষের। নির্মমতার বলিহাঁস আমি দেখেছি, আমিও তেমনই এক নির্মমতার শান্ত বলিহাঁস। পৃথিবী ভাঙবেই নিজ চালাকির ভারে।
আমার ভেতরে যন্ত্রণা খেলা করে। সপ্তাহের বারগুলো, মাসের বারগুলো, বছরের বারগুলো, যুগের বারগুলো অন্ধকার মনে হয়। কোনো এক মহাকালের বারে, বারগুলোতে আলো কি আছে? এই চিন্তার মাছি খেয়ে যাচ্ছে এই নরম মনন।
একবার শব্দ করে ওঠো নীরব। ভবিষ্যৎ আলো নেই, যে আলো দেখে পার হয়ে যাব সব পথ, শব্দ শুনে হেঁটে চলে যেতে চাই, যেখানে সমুদ্রভরা শান্তির আর স্বস্তির জল। কান পেতে আছি হৃথিবী সঙ্গীতের সুরের পানে।
এই পৃথিবীর ভেতরই কোনো একদিন—বহু বছর আগে— আগুন লেগেছিল খুব। মানুষের চিৎকারে খুলে পড়ে যাচ্ছিল আকাশের তারা। আগুনহীন কোনো এক আসনে বসে পৃথিবীরই নিরো মনের সুখে বাজিয়েছিল চমৎকার বাঁশি। এখনো অজস্র বাঁশি বাজে নির্মম অজস্র হাতে হাতে।
তারপর, এই পৃথিবীর ভেতরই কোনো একদিন— বহুবছর আগে—ক্ষুধা লেগেছিল সেই এক মানুষ নিরোর। সেদিন নিরো বাঁশি বিক্রি করে গোয়ালার নিকট হতে কিনেছিল দুধ। গোপন কথা খুব ইতিহাসে নাই। গোপন কথা ইতিহাসে ঠাঁই পায় না কোনোদিন।
এই গোরস্থানের প্রাচীর আমি ভাঙ্গিনি। শুধু মৃত্যুর মুখখানা দেখতে চেয়েছি, কিভাবে মানুষের রূপ মুখস্ত করে রাখে এসব মরণেরা। আমি জগতের ভেতর বেঁচে থেকে মৃত্যু শিখতে চেয়েছি। শিখতে চেয়েছি— মানুষেরা কেন বেঁচে থাকে এক বুক মরণের দায় বুকে নিয়ে?
মুগ্ধরঙের পৃথিবী। এই পৃথিবীতে পাখি ছিল। এখন নেই। কারণ, আমরা পিস্তল বুঝেছি।
মুগ্ধরঙের এই পৃথিবী। এখানে নদী ছিল মানুষের পিঠের দাঁড়ির মত। এখন নেই। কারণ, আমরা সিমেন্ট বুঝেছি।
মুগ্ধরঙের এই পৃথিবী। এখানে বাতাস ছিল নিঃশ্বাসের মত। এখন নেই। কারণ, আমরা কারখানা বুঝেছি।
মুগ্ধরঙের এই পৃথিবী। এখানে কোমল আর কোমলমতি শান্তি ছিল। এখন নেই। কারণ, আমরা বারুদ শিখেছি।
মুগ্ধরঙের এই পৃথিবী। এখানে মানুষ ছিল। এখন নেই। কারণ, আমরা হ্যাঁনুষ নই, নানুষ হয়েছি।
মুগ্ধরঙের এই পৃথিবী। এখানে আলো ছিল। এখন নেই। কারণ, আমরা দেওয়াল বুঝেছি।
মুগ্ধরঙের এই পৃথিবী। এখানে একটা পৃথিবী ছিল। এখন নেই। কারণ, আমরা অপৃথিবী শিখেছি।
তোমার লালচোখ কতপথ ঘুরে এসে এই আমার কাছে বাসা নিলে। অঙ্গার এখন আমি— অজস্র চাপে, তাপে আর অনন্ত বিস্ময়ের মহানন্ত বিষে। অথচ দেখ, কত সহজে কাঁঠাল পাতার তাজ গড়ে রাণী সাজে, রাজা সাজে আর কুড়িয়ে পাওয়া বন্দুকের খালি বাক্সে শুয়ে থাকা পুুতুলগুলোকে বলে প্রজা। জীবনের ভেতর দিয়ে তপ্ত চাকা আর সময়ের ধারাল চাকু চলছে মহল্লার মাস্তানের মত। আর্মির বুটের মত।
সকল মেয়েমী এখন বাদ দিতে হবে। সকল ছেলেমী এখন বাদ দিতে হবে। নারকেল গাছের মাথায় বসে আছে যে বাঁদর, তার দিকে পাথর ছুঁড়ে চালাকি করে নারকেল নিতে হবে জাহাজ বোঝায়। সিন্দাবাদের গল্প পড়া শেষ এখন কাজে লাগাতে হবে।
অহেতুক রেগে ওঠো নিজের আঙুলের ওপর। ‘পৃথিবীর মাটি ধারাল’ বলে ফেল পায়ে একটু ফোস্কা পড়লেই। চল, আমরা হরিণের চোখে ঘাস বুনে দিই, আর কাকতাড়–য়াকে বলি— ‘বন্ধু হে, এত বড় মাঠের ধান একাই খেয়ো না, কিছুটা খেয়ে যাক কাকেরা, শালিকেরা।
নাঈম ফিরোজ
অবযাত্রা
দু হাজার বছর আগে একদিন ঘুমভস্মে আমিও ময়ূররঙ ক্ষুদ্র কিফায়ার বিষয় অবগত হতে—
অতুল পাপ পাশে রেখে মায়ের মৃত্যুর দিকে তেড়েফুঁড়ে যেতাম।
এরপরে কী আলাদা আলাদা রঙ লঘীয়ান ঘোড়ার চোখে—
বিদুষী সে মায়ের লাল স্তন স্পষ্টত হারিয়ে যায়!
কাঠের জীবন থেকে কীলক টুপ করে ঝরে শবাসনের শব্দের ভেতর।
এবং এগুলোতো স্বপ্নবউ জানে—
তার অই পিঠের আবশ্যিক ক্রোমিয়াম
গাছের পিতৃবৎ দাক্ষিণ্য ঘুড়ির উচ্চতায় মিলিয়ে
কত বিকাল হু হু করে বাদামের দল উড়িয়েছে গলা—
জঘন্যতম ব্যথার বপন থেকে নিয়মের কংকাল বেড়ে উঠবে সারা প্রেস্ক্রিপশনে তার!
জংঘার নাম নিয়ে চিরস্মরণীয় রাজনীতি করে গেছে হামের টিকা—
মানুষ-বিচরণশূন্য দালানে কত রক্তপায়ী কুইন!
কোথাওঅলারা থাকে তার পাশে মিনমিনে বয়সের আহ্লাদ ঘুরিয়ে
যেন পানামার পানে দীপান্বিত কোন দলিল তারা ছুঁড়ে দিতে পারে—
কাগজের কোনে শিলা পড়ে আছে, অথচ বৃষ্টি লাজুক
আহা স্ট্রবেরির আশায় এসব ক্ষুদেবালিকারা এসে জমছে
তাদের বিনিময় হয় কী?
গরিব, হাতল ধরে দেদীপ্যমান দুঃখসুনসান যা পারে বেয়ে বেয়ে চলে যায়
সব শবের আহত হবার কথা নয়—
তাই সব শবের শব্দ নিয়ে যাবে মৌন-মিলাদ?
জিবরীল কোথাও এসবের মানে খোঁজেন
জানাপ্রিয় জনপ্রিয়তার অন্তিম ঠিকানায়—
তবে তাতারের ক্ষিপ্রতায়—
অই মায়ের মা তল্লাট উহ্য রেখে সমান্তরাল ভেসে যাবার বায়না ধরেন
অধীত নীল ডালিমের কাছে।
সাম্যভার কিছুটা হেলিয়ে দিয়ে অবিচল পুবে
তারাপাখি নিয়ে বেইলমেন্টের বিধান চাওয়া হয়
কেউ তা দিতে পারে অলাভজনক—
পুস্তক পাঠিয়ে দিয়ে কেউ হীনম্মন্যতার বানান ভুল করে।
এসব কল্পনা ভেবে কিছু মানুষ—
বিকেলের সুরে কোনো টাইপ করা পাঞ্জাবি পরে হেদায়াতের জন্য তীর্থকৃতির পথ বেছে নেয়।
তবুও আড়াই হাজার বছরে পাল্টায়নি কিছু, প্রবণতা, বাকবিভুতি, কষ্টকল্পনা বা তার চুলের গন্ধ, কুইন নন!
তবুও কিছু সন্দেহ নক্ষত্রের মতো ভুলে যাওয়া ভালো
অথবা তাদের না দেখার ভান করা যেতে পারে
কিন্তু যৌনতার বন?—
কাটা পড়ে যাওয়া শালগাছের বা অদূর কিছু মাছের কথাই ধরা যেতে পারে এতদুদ্দেশ্যে
বা ভালো মানের চ্যাবনপ্রাশ?—
স্বপ্নালু স্ত্রী-স্থানীয় যে মানুষের সংখ্যা তাদের তো মতভিন্নতার বালাম খুলে রাখার কথা, রাখেনি তো!
তাহলে জড়তার কোনো ব্যাখ্যাত হবার নেই তেমন
যেমন বাহাসের জন্য নোট নেয়না সোশ্যালিস্ট
পরিযায়ী পুবের অন্যত্রযাত্রীরা—
গ্রহগান কী অম্লান সাধতে সাধাতে পারতো
সেইসব দিন অযুত আফিমপণ যে কেউ গুনে নিয়ে যেতো—
জন্ডিসের কম্পমান তারুণ্য থেকে জাহাজের যত টিকেট ব্ল্যাকে চলে গিয়ে থাকে তারও সামান্য কম
বেদনাহত কাল দশাসই ছাড়িয়ে যেতাম না হয়
কিন্তু প্রসঙ্গ তখনো মায়ের—
কিম্বা যেসব কজন কজন করে বিপুল জনতার রুপ নিয়ে ভনেছিলো সারল্যভরা প্রেমের প্রপোজ
কিছুটা তো স্ট্রবেরিরই দিকে সহ্যাতীত তাদের বায়াস পরিণত ছিলো
কেলভিন স্কেলে—
অসুয়ার এসব যমক না পারতো না নভেল লিখে স্কুলে ঝুলিয়ে রাখতো প্রধান শিক্ষকের চোখের সীমানায়
স্থিতিস্থাপক ক্রুরতার পাড়ে—
এসব ইতিহাস ও প্রামাণ্য অস্থিতি কানগহবরে মদিরার মতোন জলবর্ণ বিম্বের কবিতা শুধু
স্যালাইন এর তৃষা ভিজছে, কওমের কোথায় তলাচ্ছে
রাজনীতিগত সিদ্ধান্তের সাথে—
সেই কুইনের কী রঁদেভু?
অথচ ভোগরেখা ধরে এসব দীপান্বিত দলিল চলে যাচ্ছে
যেখানে উপর বলয়ে তামসিকতা-উন্মন ঈশ্বর
অবশ ফলহীন ও গরিমার উচ্চতায়—
মায়ের নিশ্বাস
ফুল আর রক্ত হয়ে ঝরে।
শুভ্র সরকার
অনাদৃত পালকসমূহ
এই মৃত্তিকা ছেঁড়া রাতে
মা, আমাদের ঘরে কী
স্বপ্ন ঠোকর দিয়ে যায়?
যেমন প্রবহমান অনন্ত আকাশ
সম্মানিত মেঘ লয়ে
মা, এখনো কী ছোপানো ঘনভার মায়াচিত্রে
মুছো কী নিয়তি নগ্ন
নিজেকে রেখে অস্তিত্বে?
এখানে উন্মুখতার ভেতর
একটি ঘাস জন্মের মৃত্যু দেখছি
দৃষ্টির কাছাকাছি বহুমুখী ঘূর্ণনকে অবদমন করছি
আর কয়েকশত মাকড়সার পরিবার পদ্ধতির
আত্মরতির সন্ধ্যাটাকে ছিঁড়ে এনেছি
আমি ক্লান্ত ভীষণ
এই ঋণ কল্পনার আখ্যানে
ভারী বৃষ্টির পরে হাওয়ার যে চিহ্ন বয়
তা মূলত পরিতাপ
শোনা যায়- দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে নাকি
এভাবে একাকিত্ব জানান দেয়
এখানে দাঁড়ানো একটি শালিক পাখির
নামের পাশে
তার এক দুই পায়ের নামতা ফুটছে
তবে কী পাখিটা কবিতা বুঝে ফেলেছে আজকাল?
ভাষা এক পরম পারাপার
কথার অবোধ দোল
গলায় গান হয়- কফিনে পেরেক কাঁপে
ফুল ঝরে যাওয়ার মতন করে
কতদূর ভরা সবুজ
বন মধুপুর
আর বনময় ভাঙা ডালপালার যত
নকশা করা কঙ্কাল
প্রেম সে- তো হৃদয়ের ভর
ধূসর ধূপগন্ধের আগুনের রূপ
সংকুচিত হওয়ার ভিতর
কোন গুঞ্জনরত মাতাল
যতটা দাবী করো, পুরনো হয়ে
ছিঁড়ে যাবার আগেও
একটি জামার দায়ভার
ততটা কী বলতে পারছো
এই মানুষ মৌসুমে যে যার
যার মতন আছে ঠিকঠাক
বলতে পারছো কী- যে অন্ধকার ব্যাতীত
আমাদের আর কোন আশাবাদ নেই
তবে কোন শূন্যতায় পর্যটক হয়ে ঘুরছে
পাপ আর পূন্য আমার
ও হাওয়া তোমার প্রতি থাকছে কেবল
আমার কান্নার জলের বিশুষ্ক যোগফল
কীভাবে নিজের সাথে চিন্তা করছি
অলৌকিক বিকেল
শুভ হোক বলার মতো আমার তেমন কোন
প্লাস্টিকের ফুলও নেই
কোথায় কখন দেখেছি একটা মেশিনারিজ দোকানের পাশে
সাইনবোর্ডে লেখা, ‘কৃষকের আধুনিক পাঠশালা’
কী দারুণ স্পর্শের ঠাঁই
একে অপরের সাথে
পিতলের অনুরন নেমে যাবে যেন পৃথিবীতে
এ ধানের পাকা হাত ছড়িয়ে
গৃহস্থালির অনাহূত ক্ষয়
আর আলো ছায়ার দুয়ার নিয়ে
থাকো যেভাবে,তাতে বান্ধব বোধ হয়
যেন আজ রাত ছাপা হবে উৎসবে!
আছো কোন হেমন্তে
এইরূপ সময় সমূহ সম্ভবনা
ওঠেনিকো তোমার বিদায় সংসারে
আমি জানি,নিশ্চুপ পারবে তুমি দাঁড়াতে
দশদিকের ভেঙে পড়া নিয়েও
এই অরণ্যভূমি তাকিয়ে দেখার
নীলে, আমি ও অন্যান্য
মোহময় হচ্ছি আরও
একটি বিকেলের আলিঙ্গনে
হিজল জোবায়ের
বসতি
চিরহরিৎ এক বন, সেখানে আমরা ছিলাম কিছুদিন হলো। পঞ্চগড়ের পাহাড়ের পর আমাদের বসতিভিটা। সে বন রৌদ্রে শুকায়, বৃষ্টিতে ভেজে, ঘাস আর মাটির গন্ধ বাতাসে ভাসে। আমার বাবা গোত্রপিতা, সেহেতু সে প্রসবযন্ত্রণায় হেসে ওঠে হাতেগোনা দুয়েকজন মাকে বাচ্চাসহ এখানে দাওয়াত করে; তারা মরুভূমি ছাড়িয়ে আসে— জলপাইঘেরা, বানর-অধ্যুষিত উপত্যকা পেরিয়ে। তাদের মুখের ভিতর বালু— দাঁতে লেগে কিচকিচ করে। তারা আমার দিকে মুহুর্মুহু ছুড়ে মারে তীব্র-তীক্ষ্ণ শ্লেষ ও জিজ্ঞাসা, ফুঁসতে থাকে দূরবর্তী সমুদ্রের মতো।
জনশ্রুতি আছে, এরাই একবার আমার বাবা, তাকে অনুসরণহীন শ্লোক ও ধাঁধার জঙ্গলে নির্বাসন দিয়েছিলো, বলেছিলো— সুর, পাথর এবং ধাতু থেকে জন্মাবে যা; দেহভাণ্ড ব্রহ্মাণ্ড, নাই সূর্য নাই চন্দ্র— সারি সারি ধাঁধা, সারি সারি আলোর মেশিন!
অভিজ্ঞ সব কাঠমিস্ত্রীদের বসতি ছাড়িয়ে সে বন; সতত নীরব। বন থেকে বের হবার পথ, সেও খোদ মীমাংসিত মীমাংসাহীন গোলকধাঁধায়। শোনা যায় বনের গভীরে কোথায় নাকি এক পাতার কুটির, সবুজ দেয়ালে আয়না ঝোলানো তাতে। বার্ধক্যে উপনীত হলে ব্যাধি আর জরা নিয়ে আয়নামহল আপনা থেকেই এসে ধরা দেয়। ধুলায় ভর করে আসে আলো; আলো লেগে কাঁপে— দ্বিমাত্রিক, হাওয়াসঞ্চালিত আয়নামহল। বায়ু উৎপাদনযন্ত্রের সেই বন অজস্রাজস্র তামার খনিতে ভরা।
গত ফাল্গুনই ছিল মুক্তির, তামার খনি থেকে। সেই থেকে এ অব্দি ধাতু নিয়েই মেতে আছে বাবা। তার পায়ের কাছে তৃণমূল কেমন বিন্যস্ত, খামচে ধরেছে মাটি!
সূর্য থেকে দূরে, ছায়া গুটিয়ে ফিরে গ্যাছে মেঘ। নীরবতা। নীরবতা ভাঙে; দূরবর্তী শ্লোগানের মতো দাওয়াতপ্রাপ্ত যারা আমাকে একই প্রশ্ন করে।
আমি আরেক প্রসঙ্গ টানি— আলো-ছায়ার প্রত্যাবর্তন প্রসঙ্গ, অনাবাদি জমিতে শস্যের আবাদ, মাতৃভূমি আর বীরদের কথা, সুলতানাদের বাড়ি কিংবা নির্মিতব্য বাগানবাড়ির নকশা; তারা চায় না, জানায়— সেইটুকু জ্ঞান, যা তুমি জানোনি; হাস্যের দ্বারা দুঃখ, ক্রন্দনের দ্বারা উল্লাস এভাবে মানুষ অস্ত্র ও ফুল বিকিকিনি করে।
ইশারার মতো দুলতে থাকে পাতা।
পরিসরহীন কত অপ্রকাশ প্রকাশিত হল!
আমি চুপ করে যাই। আয়তক্ষেত্রসদৃশ বাড়ি থেকে বাইরে, কেবল পশ্চিমে তাকিয়ে থাকি। গুল্মের ঝাড় ফুঁড়ে ঝাঁঝালো গন্ধ আসে। উঁচু পাথরে বসা তক্ষক পোষা লোকটা; হনহনিয়ে হেঁটে যাচ্ছে— দাবানলে জ্বলা সারি সারি উজ্জ্বল গাছগুলোর দিকে, আগুন আর উত্তাপ এ দুটোই তাকে হাঁটিয়ে নিচ্ছে, গিলছে, আবার উগরে দিচ্ছে। পিছনে শুধু তক্ষক; ডাকছে— বারবার, সুউচ্চ রাবার গাছের মাথায়।
মধ্যআকাশ থেকে স্বচ্ছ পিলারের মতো নেমে আসছে সূর্যরশ্মি, উষ্ণতা দিচ্ছে সবুজ ফলের থোকায় থোকায়।
শব্দ শোনা যায়। রেলস্টেশন। রেলগাড়ি যেন মানুষ নয় বগি-ভর্তি করে নিয়ে যাচ্ছে যাবতীয় কোলাহল; সম্ভবত উত্তরবঙ্গের দিকে, পঞ্চগড়ের পাহাড়ের দিকে।
ধোঁয়ায় ভরে ওঠে সমস্ত আকাশ, ঝাড় ও জঙ্গল। একার ভারে নুয়ে পড়ি আমি, অনেক শিকড়ে প্যাচিয়ে প্যাচিয়ে জন্ম নিতে চাই অনুর্বর মাটির ভিতর থেকে; অতএব উপরে তাকাই, আলোর বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে সূর্য! আমি চুপ করে যাই, যেহেতু অভিশাপ ডাকছে গতিকে; গতিই বয়ে আনে সময়, শব্দ-আলোক-হাওয়া; শব্দের আড়ালে আমরা মিশে যাই, আমি ও আমার আম্মা, আমি ও আমার আব্বা!
জাগে স্মৃতি! জলে বন্দী তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়তে চায় জল থেকে ডাঙায়, শরীর থেকে শূন্যতায়। আমি চুপ করে যাই, স্মৃতি হাতড়াই— সারি সারি গাছ, সারি সারি পাতার মিনার। উঁচু উঁচু স্তম্ভের নিচে আমি একা, ক্ষুদ্র; ঝিম মেরে দেখি পানির ওপর ঝিরিঝিরি পাতার পতন— শীতে না জানি ভয়ে আমার ছায়াটা কাঁপছে, পারলে এখনই লুকিয়ে পড়ে ঝরে পড়া কোনো পাতার আড়ালে, নির্মিতব্য বাগান বাড়ির নকশায় গা ঢাকা দিয়ে কোনোমতে পালিয়ে বাঁচি। এদিকে শরীর পচে কাদা, পাললিক!
তারোপরে সেদিন আলখাল্লার মতন শরীর নিয়ে এক দরবেশ এসে বলে গ্যালো— বাসা-বাড়ি বদলাও, যে-মতো এসেছো সে-মতো যাবে না। আমি যে কোথায় যাই, সামান্য নুড়ি— বিদ্যুৎ জমানো মেঘ— এসবের বাইরে যাওয়াই যাচ্ছে না
শাহ্ মাইদুল ইসলাম
নাভি
মুষলধারে রোদ নামছে
আমার গোপন ইপ্সার সমুদ্র
সমুদ্রে এসে দাঁড়াই
সারা সমুদ্রে সপুষ্পক হাসি—
কিছুই দেখছি না— দেখার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি
উঠোন
বারান্দা
স্বর্ণ-
কুঠুরী
উঠোনে
বারান্দায়
স্বর্ণ-
কুঠুরীতে, সারা ও সুনসান—
সারা ও সুনসান মিলে,
বাগানবিলাস রঙের অদম্য সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছি
তার দরোজায় সর্বশরীর কাঁটা হচ্ছে
ঐ নাভি—
কুন্ডলী; চোখের অন্তর্ভেদী চোখ
দেখে, যেই
অন্ধ লাগার ঝোঁক;
নগ্ন— তুমিই ছিলে তোমার নগ্নতা
আবৃত— তুমিই ছিলে তোমার আবরণ
তখনি পরীর মতন
দেখার অন্ধতা বজায় রাখি
শিমের লতা বাতাসে
গাঢ় বেগুনি গায়ের রঙ, উজ্জ্বল সবুজ কুঁড়ি—
তিরতির কাঁপছে…
আমি ভাবছি সোনালী এই সমুদ্র
নীল হাঁসভর্তি—
এই জীবনে আমি প্রবেশ করেছি
অকথ্য আঁকড়ে ধরেছি
উন্মুখ জোয়ারের নিস্তব্ধতায়
অফুরন্ত সোনা—
ওৎ
পেতে
আছে;
অতিশয়োশক্তির মতো—
যে নন্দিতা বেঁকে গেছে
যে গাছের কোন আটখানা নাম নেই
যে স্ত্রী মশা চিরদিকের জন্য পাগল হয়ে গেছে
অসীমের জেলখানা
বাস্তুভিটার পয়মন্ত সাপ
গলায় ঠান্ডা বসে যাওয়া ট্রাকের ভেঁপু
রাতের হাপর
কীটের অবশেষ
এবং—
গাঁদাফুলের সাথে সাদৃশ্য
যে নাচের ভঙ্গিমা করে
যে বুকে ভর দিয়ে হাঁটে
ডাঙ্গার কুকুর
জলের প্রাণি…
নিঃসাড়ে কেটে চলেছি
সাঁতার; মিহিন জলের গুড়ো—
ছড়ে যাচ্ছে বাতাসে
উবে যাচ্ছে বাতাসে
যতদূর
দূরবহু…
আমার সহ্যশক্তি ঘোরে কাতর
কিছুই অনুভব করছি না— হাড়হিম অনুভব করছি
আমার
আর
দ্বিতীয়
গন্তব্য নেই
আমার
কোনো
দ্বিতীয়
গন্তব্য নেই; ভাবি সংস্পর্শেই মরি—
জড়িয়ে রই ফানাফিল্লাহ
আমার রাত্রিদিন দিন কাটে
বিপর্যস্ত চোখের শরীরে
তুমি,
বাস করো মহৎ বৃক্ষের
গম্ভীর খোড়লে
তুমিই দানব বৃক্ষ—সাত্ত্বিক খোড়ল—নষ্ট অহমিকা
দাঁড়িয়ে সকাল সন্ধ্যাসকাল
দুপুর রাতদুপুর
বুটিদার হাসি হাসছো
ছোপছোপ হাসি হাসছো
সান্ধ্যহাসি…
আচানক
ঘাই
মারছে
অন্ধ হওয়ার নারী
তুমি কতো বেশি নিঁখুত!
রাসেল রায়হান
এক দিন এগিয়ে থাকা লোকটি
জন্ম থেকে ভীতু আমি, তাই কত কিছু বলা হয়নি তোমাকে। আঞ্চলিক পত্রিকায় প্রুফ রিডিংয়ের কাজ করি। বাবা একজনের ঘড়ি চুরি করে পরীক্ষার ফিস দিয়েছিলেন, সেই গল্প আমি জানি—তখন থেকেই আমার এত ভয়। আর এত দূর থেকে বলাটা ঠিক ভালোও দেখায় না। তুমি অত দূরে থাকো যে আসতে পারো না, তোমার ঘ্রাণ আসে শুধু। অহমে উড়ন্ত একটি বিমান যেমন পাতালের ছুটন্ত খরগোশটিকে ক্ষুদ্র ভাবে, জানে না, খরগোশটির চোখেও সে ক্ষুদ্রতর; তেমনই টের পাই, তুমিও ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছ আর ক্ষুদ্রতর হচ্ছ, কাঁটাতারের ওপাশে।
ওপাশের আজান শুনে বুঝতে পারি, প্রার্থনার সময় হয়েছে। নতুন ভবন উঠছে ওপাশে, শুনেছি নতুন সরকারি অফিস হচ্ছে, সেখানে কারা জানি থালা পিটিয়ে রোজ লালনের গান গায়। আমি ভাবি, যদি এমন একটি গান আমার হয়ে কেউ লিখত, আমিও চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গাইতাম।
তোমাকে যা বলতে চাই, তা মোটামুটি এ রকম: ‘কেউ কেউ এমন থাকবেই, উত্সবের ভোরে তোমায় কল্পনা করে করে চকচকে মোরগের গলায় চালাবে নিরীহ ছুরি। নিরুপদ্রব জীবন আমার আর ভালো লাগবে না। ময়দানে হেরে যাওয়া ঘোড়াটির খুরের আঘাতে মৃত্যু কামনা করব তখন। মৃত্যু কামনা করব তোমার নম্র চুমুতে।’
এতটা কঠিন কথা বলা হয়তো ঠিক হবে না। বরং অন্য কিছু বলা যাক: ‘চোখের সামনে খোলো ত্রস্ত করতল, কোনো এক ম্যাজিকে আয়ু হাজার বছর করে দিই তোমার।’
নিদেনপক্ষে বলব: ‘ভালোবাসি, মৌরিতান।’
একেকদিন তুমি ঘুরতে আসো—কাঁটাতারের ওপাশে—না দেখার ভান করে দেখি, না শোনার ভান করে শুনি, টের পেতে না দিয়ে ঘ্রাণ নিই, কাঁদি—কোনো এক ব্যর্থ ব্যাধ একটি পাখির জন্য এভাবে কেঁদেছিল। তুমি তখন সূর্য আড়াল করে দাঁড়াও। শাড়ি উড়তে থাকে। বিস্ফোরণের মতো ফুটতে থাকে দু-একটি বোগেনভেলিয়া। আমার জানালার পাশে একটি কাঠবিড়ালীর ত্রস্ত আস্ফাালনে পায়ের কাছে ঝরে পড়ে এক-দুটি বাদাম। মনে পড়ে, এভাবেই ইসরায়েল বোমা ফেলছে ফিলিসিত্মনে, সৌদি মেরে ফেলেছে ইয়েমেনের ত্রিশজন শিশু। শুনেছি, তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছ, ওখান থেকেও মাঝে মাঝে গুলি ছুটে আসে। তারপর ব্যক্তিগত কম্পিউটার থেকে মুছে যায় একেকটি ফাইল। ফেসবুকের বন্ধুতালিকা থেকে কেটে যেতে থাকে একেকজন। নতুন নতুন নাম মুছে যায় ইরেজারে। সবাই বলাবলি করে, তোমরা ইরেজার খুব ভালো বানাও। আমরা বানাই পেনসিল।
আঞ্চলিক পত্রিকায় প্রুফ রিডারের চাকরি করি। আমার কাছে আজ মানে গতকাল। এক দিন এগিয়ে থাকি। যেমন ঠিক সোমবার অফিসের ঘিঞ্জি রুমে বসে লিখতে হয়, ‘গতকাল সোমবার’। লক্ষ করে দেখি, যেদিন তুমি আসো, মূলত সেটা তার আগের দিন। চাকরির শুরুর দিকে বিষয়টিকে আমার মিথ মনে হতো। এক দিন এগিয়ে থাকা একটি মানুষের আকুতি কি কেউ বুঝতে পারবে আদৌ? এসব ভেবেও ঠিক বলা হয়ে ওঠে না।
সমূহ সঞ্চয় ভেঙে একদিন একটি বাচ্চা পাখি কিনি—আফ্রিকান গ্রে। ছোলা কচলে খাওয়াই, কথা শেখাই। সেসব কথা—যা তোমাকে বলতে চেয়েছি। ভাবি, অন্তত কেউ একজন কথাগুলো শুনুক। বাচ্চা পাখিটি মনোযোগ দিয়ে শোনে। আর একদিন শিখেও ফেলে : ‘ভালোবাসি, মৌরিতান…মৃত্যু কামনা করব তোমার নম্র চুমুতে…আয়ু হাজার বছর করে দিই তোমার…।’
ধীরে আসে মঙ্গলবার, আমার কাছে যেটি মূলত বুধবার। অফিস থেকে বিকেলে ফিরে আসি। আর খাঁচার কাছে গিয়ে দেখি দরজা খোলা, পাখি নেই। কাঠবাদামগাছ থেকে চিত্কার আসে: ‘ভালোবাসি, মৌরিতান।’ ছুটে যাই বাইরে। প্রথমেই চোখ পড়ে কাঠবিড়ালীর ওপর—অল্প দূর থেকে পাখিটিকে দেখছে। তারপর এগোতে থাকে সেদিকে। আফ্রিকান গ্রে উড়ে যায় ওপাশে। কাঁটাতারের দিকে। পার হয়ে শহরে—তোমার শহরে। তখনো শুনতে পাই চিত্কার—শহরে শহরে উড়ে বেড়াচ্ছে, ‘ভালোবাসি, মৌরিতান…আয়ু হাজার বছর করে দিই…ভালোবাসি, মৌরিতান…।’
জন্ম থেকে ভীতু আমি, বলা হয়ে ওঠে না তোমাকে কিছু। তবু শান্তি, ওপাশে শহরময় চিরন্তন সংগীতের মতো ঘুরে বেড়াবে আমার কথাগুলো— সুতীক্ষ্ণ বল্লমের মতো যা একদিন ঠিক বিঁধবে তোমার বুকে।
জয়ন্ত বিশ্বাস
যে রথে সারথি ছিলো না
(১)
প্রান্তরের নৈঋত কোনায় ক্ষয়িষ্ণু যৌবন বাজি রেখে নৈমিত্তিক জুয়ার আসর বসে। সেদিকে মাঝে মাঝে বাইসনের মত তুমুল বেগে ধেয়ে আসে আবির। তার পাশে তোমাদের ঝাঁ-চকচকে পারিবারিক গোরস্থান। সেখানে সকাল বিকাল হো হো করতে থাকে ইটের ধারালো পেলবতা। প্রাতঃভ্রমণে গিয়ে নিয়মিত দেখি; আবার বুড়ো মানুষের মত পা টেনে টেনে তাঁবুতে ফিরে এসে ঘুমিয়ে যাই।
(২)
শেষরাতে সেখানে কুকুরের গোষ্ঠী দেবতার মত হল্লা করে-পায়চারি করে তীব্র গরিমায় বুঁদ হয়ে। সময়মত গেলে কুড়িয়ে আনা যায় মানুষের পরিত্যক্ত এক-দুইটা আঙ্গুল।
(৩)
সেই বিষণ্ন প্রান্তরে মাঝে মাঝে উড়ে আসে খড়ের ঘোড়ায় টানা একটা রথ। সেই রথে কোন সারথি নেই। তাতে পা তুলে বসে থাকে একটা মানুষ। অবিকল আমার মত দেখতে আরেকজন মানুষ। যে চুলো থেকে এসেছিলো, হাওয়া খাওয়া শেষে আবার সেখানেই ফিরে যায়। হয়তো সে-ও পা টেনে টেনে তার আস্তানায় ফিরে জন্মের ঘুম ঘুমায়; ঠিক ভ্রূনের ভঙ্গিমায়।
হয়তো সে ঘুমায় না-
ভিসুভিয়াসের মত জেগে থাকে।
মাঝে মাঝে আমাদের চোখাচোখি হয়। শূন্য চোখে সে তাকায়- আমিও।
কিন্তু আমাদের মধ্যে কোন বাক্যালাপ হয় না।
(৪)
কেন জানি সবচাইতে জংলা জায়গাতেই আমার তাঁবুটা ভালো খাটে। তাই আমি শহরতলী এড়িয়ে বিভিন্ন শপিংমলের আন্ডারগ্রাউন্ডে ছুটি কাটাতে যাই। সেক্ষেত্রে ঘুমটাও বেশ জুতসই হয়।
(৫)
আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলতে ওই তাঁবুটা বাদেও একটা তোতাপাখি ছিলো। চোখ গরম করে তাকানো আর ক্ষুধা পেলে আমাকে বাপ-মা তুলে গালি দেওয়া ছাড়া সেটার আর কাজকর্ম ছিলো না। মেজাজ খারাপ হলে আমিও হুমকি দিতাম- একদিন খপ করে ধরে রোস্ট বানিয়ে খেয়ে ফ্যালার।
মজার ব্যাপার, হতচ্ছাড়া তোতাটা একদিন জুটলো গিয়ে হুবহু আমার মত দেখতে ওই রথওয়ালার সাথে। ভাবলাম, আপদ গেছে যাক; দু’দিন পরে তো ঘুরেফিরে আমার কাছেই ফেরত আসবে।
পুরো মাস গেলো। তারপরে একদিন তোতাটা মাঠ পার হয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফিরে এলো। উড়ে না আসার সঙ্গত কারন ছিলো। তার দুইটা ডানাই ছিলো গোড়া থেকে কাটা। শরীরেও জায়গায় জায়গায় শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত। আমি বরাবরের মতই তাঁবুর ভিতরে ঝিম মেরে পড়েছিলাম। তোতাটা ঢুকেই ক্যারক্যার করে শান্ত পরিবেশটা মাথায় তুললো। তারপর আমাকে আঁচড়ে ঠুকরে একাকার করে ক্ষান্ত দিলো। কিছুক্ষন পরে আমার কানে কানে ফিসফিস করে জানালো – সে ওই লোকটার কাছেই ভালো আছে; ফিরে যাবে।
আমিও সেটাকে রাস্তা মাপতে বলে পাশ ফিরে
ঘুমিয়ে পড়লাম।
তোতাটার সাথে ওই আমার শেষ দেখা।
(৬)
বহু বছর কেটে গেলো। অহমের রিক্ততা আমার ভিতরে বাড়তে বাড়তে এভারেস্ট ছুঁয়ে ফেলার উপক্রম হলো। বিরক্ত হয়ে একদিন রথের মালিককে আমার তাঁবুতে দাওয়াত দিলাম। দুইজন আকণ্ঠ সুরা গিলে রাতভর দেবতাদের মত, (অর্থাৎ ওই কুকুরদের অনুকরণে) হল্লা করলাম, নাচানাচি করলাম। ভোরের দিকে ঘুমে কাদা হয়ে থাকা লোকটাকে গলা টিপে মেরে ফেললাম।
এভাবেই আমি ওই অপয়া রথটার মালিক হয়েছিলাম, যেটার কোন সারথি ছিলো না।
(৭)
রুটিন পাল্টায় নি। মাঝে মাঝেই ওই প্রান্তরের কোনায় এসে হাওয়া খাই। খড়ের ঘোড়াগুলোকে রাশ টেনে থামানোর দুর্মতি মাঝে মাঝে হয় না, এমন নয়। স্বাভাবিকভাবেই সেগুলো আমার কথায়, অনুরোধে কর্ণপাত করে না।
পাখির মত চোখ করে মাঠের উল্টোপাশে দেখি, খুঁজি। কেউ যদি আসে। হয়তো হুবহু আমার মত দেখতে একজন আসবে। গুটি গুটি পায়ে এসে ওই জংলা জায়গাটাতেই ডেরা ফেলবে।
হয়তো তার ঘাড়েও থাকবে একটা বিচ্ছিরি তাঁবু।
হয়তো তার শার্টের বিষণ্ন হাতায় বসে থাকবে
একটা তোতাপাখি।
হয়তো সেই লোকেরও কয়লার মত নিভে যাওয়া কয়েকজন প্রেমিকা আছে। তাদের মধ্যে কারও একটা সুন্দর পারিবারিক গোরস্থান থাকলেও থাকতে পারে।
যেখানে ইঁটগুলো চব্বিশ ঘন্টা হো হো করে করুণার হাসি হাসতে থাকবে।
আমার ক্ষুধা যদিও বাড়ছে, কিন্তু ঘুমের খুব সমস্যা।
রাতে ভালো ঘুম হয় না।
দিপংকর মারডুক
পিতা ও পুত্র, পরস্পরে
যে জলকণা রেখেছি স্পর্শদূরে
আজ তার সরল শতক ফেরায়
কি বলি প্রশ্রয়
পিতা ও পুত্র, পরস্পর
যাই তবে শোষণ—রঙিন
কোনো সুফলের মিশ্রিত ধানক্ষেতে।
দেখি
পার হয় নিরন্ন হাওয়া
দিকে দিকে শূন্যমালা যা
এই-যে দিয়েছি গোধুলি রক্ত
অক্ষমের প্রলোভন।
ডাকছে, ডাকছে যত সব দূরত্বইচ্ছা
ছায়া কী বাহন? এখন নেই
কলরোল
রাজহাঁসের সহজিয়া একজোট।
অথচ—
শিউলিফুল স্নান নেবে কোথায়?
প্রবল ছিলো যা-যা দ্যুতি
কোকিলের সমস্ত অক্ষর ভেঙে—
কেন তবে হয় যুবকের ভয়;
এই কী চাইতে
পাড়ার শব্দময়! মনে রেখে
পাথরের মফস্বলে আমাদের বোন।
তবুও বৃষ্টি হয়
নিচু কোনো ক্ষত্রিয় সমাহারে,
পিতা যাকে হেমন্তশোক বলে
এখন যা-কিছু আছে দুধের তারল্যে
স্বচ্ছ—
ভাঙে সব উপত্যকা
নীরবের
ধ্রুব হতে সেই বিষাদের
পিতা, শাদা রঙে
ব্যাকুল, আমার সম্বন্ধের দিকে;
জানি না নির্দেশ,
বিশালের উপদ্রব ফেলে গাঢ় শস্যের বন
পাঠাই কেবল মহুরিনদীর তীর
পশ্চিমের সেই উপনয়নে,
যেখানে ছিলাম অন্ধ
ঋতুর মতো রহস্যবোধ—
এখন দিতে পারি ডুমুরের সংকেত
স্রোত নিয়ে আমি ও মৃত্যু কাছাকাছি,
আছে সযত্ন ইতিহাস
পিতাপুঞ্জ সম্পর্কের চেয়ে তুমুল আহ্লাদে।
ফোঁটাও ফোঁটাও ছাতিমের পথ
ফেনা গহ্বরে আসে
পতন
প্রাণবন্ত আমি বা আমারই পতন।
দিও তবে লতাগুল্ম
পিতার বাহুপাশে মরিচফুলের পরখ
কেবলই প্রস্তুত হই
সুরা পানের সমগ্র ঈর্ষায়—
তবে হে, সবুজ ফল
চির উৎকণ্ঠায় বুঝি মর্মের চঞ্চল
কোন্ সে জন? রাখি না পিতার
উর্ধ্বে
অহেতু অশোকের ডাল হতে
ফিরে যাই গরু বাঁধা আলপথে।
এখন করি নূন্যতম—পিতার সাঁতার
সমতল শহরে আসে রাত
ক্রন্দনের যত সব অতিরিক্ত শিয়াল,
ও মার্বেল পাথর, দ্যাখাও
দুপুরের শাপলা দুর্ঘটনা
তবুও দু-চার হেমন্ত মুছে রাখি
আমারই পিতার জন্মসূত্রের কারখানা—
শিমুল জাবালি
ঘর-পাখিগুচ্ছ, যখন ওরা মিলেমিশে বারোয়ারি মন্দাকিনি
চলুন ফিরেফিরে যাই, দ্বিতীয় সেই অধ্যায়—উপযোগিতার নিকটে
ঘনিষ্ঠতার ভিরে যে চুমুক ফিরে আসে অন্তঃস্থ বাতাসে
পৃথিবীর হাতগুলো খণ্ড-খণ্ডাংশ হয়ে পুত্রদের রং-রূপ নিয়ে
উম্মামতার ঘ্রাণ মেলে ধরে শিশিরে—
যা কিছু কণাময় উম্মতপ্রজন্ম—চিকন রূপে ভেসে আসে দেহ—
তোমারই ভিতর—বসন্ত উজানে পলক রোহিত তাই;
এসবের পিতা আমি নই, ধুকে ধুকে কোণঠাসা—
ওইদিকে চলবার পথ নাই! ক্যাবল বায়ুশূন্য প্রাণ—
স্রোত মরে গেছে, জোরাডানায়… যেভাবে আহরণরত
পালাগান দানা বাধে—সমুদ্রের ধারে—অগণিত মরা বালুর কোলে-পিঠে
সময়রোহিত শষ্যকীর্তন করেও ক্ষান্ত হয়নি
বিবাহবন্ধন-প্রেম-শ্রোত-জোয়ার এবং রোদ্রের ভাটা—কেউই না
যেসব আয়োজন খসে যাচ্ছে—সন্তানের কাছে
আলোছায়াগুণে পরস্পর পরস্পর থেকে দূরে—
গন্ধ মেখে অশ্রুস্রাব গড়িয়ে যে হাওয়াই শূন্যের
সৃষ্টি হয়, দেহগুণে পাঁচ আঙুলের সুষমা বাসনে।
সে ফলের ভিতর অতিবাহিত স্নান পুত্রের শরীর বেয়ে
নেমে আসে জল—নীচের দিকে—রাগমথিত নিম্নাংশে।
আদর—যেহেতু কিঙ্কর—জলাশয় ভরা ত্রিকোণী কীট
হাতে স্পঞ্জ—দেহে অগণিত তারা—জোতিচিহ্নের।
এ নদীরূপ জলাশয়—চুলের বেণি ধরে ঠোঁটে নেয়ে
আসে ক্লান্তি—যে সূর্যরশ্নি যাগায় বিষ্ময়!
নতুন গাছের ডালে—ঝিলিক চিলিক নামান্তে
ওদিকে পুত্রেপুত্রে কেঁপে আসে—আদমরা সুর
যে কোনও গুণে—দুর্দমনীয় জোৎস্নায় ভেসেভেসে আসে।
অস্ত্র লক্ষ্যের লক্ষ্য পায় সে—
কানা চোখের সরীসৃপ তা-ই দেখে
দ্রুত লয়ে এগিয়ে দেয় নশ্বর টিকা—আলবৎ ঘৃণা
যতটুকু দিয়ে টিয়ে রয়
সহসাই টানবে বুকের মদিনায়
বাবার নাড়ি ফুলে ওঠার আগে
ক্যামনভাবে নাইতে নামে—নামে
তাকে কোলে নাও—
এভাবে আমাদেরও
সাদা—ক্লীসে মেঘ আর ঘন গন্ধসহ
ঘাসের ঘটনার কোন জটিলতা নাই—
কেউ কিংবা কারো ঘর ঝাঁপিয়ে আসে—ধনুক থেকে
বায়ুস্রোতে উজ্জ্বল যাযক ধা-তা-না ধ্বনিসহ হাততালিতে জানতে চায়
পুকুর রচনার কৌশল—আরেকদিক গহীনে পরমকাঁটা—
আলোর দিকে নৃষংশ চুমুশব্দে চিলিকচিলিক মারে।
আরেকটু গেলে…
পাহাড়ি বাগানে বিদেশি ক্যামেলিয়া চোখে চোখ ফুটিয়ে রাখে দ্বন্ধ!
ক্যাবল ভৃত্তব্রাক্ষ্মণ সাগুদানার ন্যায় গলেগলে যায়—
যখন নীলভরা কপাট সমরখন্দের দিনে—নগ্নপদো সেপাই
সোরগোলে চিল্লাই ওঠে ‘ধরো জড়িয়ে, খুলে নাও বাবার আদর’।
তখন নীলাগুণের নীলগাই বসন্ত তরু কিংবা খেলনার যুগ হয়ে প্রতিভূ হয়
আরেক পিতার—অন্যমত—অন্যপুত্রের।
পথহারা পদ্মরোগ—যেখানে অমৃত কিঙ্কর সুরের নহর—
আহা! হা-হুতাশ, ক্যামন চক্ষুতাল নেশা—চুইয়ে চুইয়ে যায়
না জানা দেহের দিকে—দুধের কাছাকাছি
এ হিসাব-লুব্ধক পথ এগোয়নি বারোয়ারি টেম্পলে
প্রথম প্রেমের গতিতে—পুত্রের সাঁতার উম্মাততায় এগোলেও
ঢেউয়ে ঢেউয়ে খসে পড়ে পিতার হৃৎপিণ্ড!
সম্পর্ক চুইয়ে আসে—হাতের দিকে জোড়া আঙুলের ভ্রমে—
সুর ও সম্পর্কে নীলের বারুদে
জীবনসম দোতানা তাড়ানোরকালে
উন্মুক্ত যৌনচাষিদের রাতে
তারপর—
গতি-অগতির আরামে—ঈষৎ সজোরে ঠাপের আগে
হাতে উঠে আসে কীটের মাল—গন্ধ নিয়ে ফেলে দেয়
আহা! এ ক্যামন দণ্ডিত পিতা
ক্ষমা রেখো পুত্রজান—নারীকীট বাপের মুক্তি মিলুক
এ রুদ্ধধার কতো শৃঙ্খল—কতো রূপবান
কতো হাহাকার—কতো শূন্য—শুধু দৃশ্যত ধ্বংস
হটকারি ধ্বংস
পথে ও আলপথে
যে দিক দীশাহীন
সে দিকও ধ্বংস
ওই যে খোকার পোকলা দাঁত—খিলখিলে হাসি
ঠোঁট লেলিয়ে—বাবার দিকে নিশ্বাস রাখে—দীর্ঘ
এ আরেক ধ্বংস
শুধুই ধ্বংস
পোড়াচুলে গেঁথে আছে—যত বসন্ত
তত অচ্যুত ঘৃণা—ফসলের দুধভাত
এসবও ধ্বংস
আদরের ধ্বংস
বংশের ধ্বংস
পিতাদের মনিকাঞ্চন—ওইখানে ধ্বংসের বাড়িতে
ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়—না জানা দূরত্বে
ফোকলা দাঁতে তাবৎ খোকা হাসে—হেসেই বড় হয়—
তারপর বাপ হয়ে আবারও ধ্বংস হয়
এ কোন নাপিত—খুরের আগায় বসে থাকে হৃদয়—কেনো জানে না
চৌদ্ধবংশের ঠিকুটি টিনের ট্রাংকে কী করে থাকে—অবহেলায়—
কার অনুমিত
কার অজুহাতে
ঋতু যায় ঋতু আসে—সময় আটকে গেছে অসময়ে
মানত ক্যাবল কাঁদে—মায়ের দিকে তেড়ে আসে—দুধ দাও আরেকবার
নবরত্ন গলে যাক উত্তাপে—হাহাকারে
ওলানের ভাঁজে আটকে যাক নাক
খুলে দাও ভ্রমণ— পীড়াদায়ক পিতার কুন্ডলীসহ
ওম ওম গন্ধ ছড়িয়ে পড়ুক স্নিগ্ধ মন্দাকিনিতে
পৃথিবী ঊষ্ণময়— লোহা গলেটলে তুমিও কারবার!
লাল লাল রাগে ঝড়ে পড়ো চৈতন্যের বুকে
প্রেম ধারণায় রাগধারা ম্লান করে দাও— চুষে-টুষে
ওইখানে বা এখানে বা সেখানে সমস্ত পাখি বুদবুদ আকারে
ভেসে বেড়ায় জলের ওপর—আমরা তাদেরই উত্তরধারা—উন্মুক্ত বংশ
আমাদের ঘর বন্ধক রাখা কিস্তিতে
এসো বাবা—
এখানে শাড়িপড়া ঘ্রাণ আছে—মাদকতা আছে
উজানে উজানে জাগবে প্রেম
বুকের ভিতর গজাবে অতিরিক্ত পশম!
রাশা নোয়েল
কতিপয় সরলতা
সরলতা, একা থাকতে দাও৷ গুম্ফার রাত্রির মতো এখনই
দ্রুত নেমে এসো না৷ আমার সময় আছে
ত্রুটি যা ছিলো—সেসব জুয়ায়ই প্রকৃত সুন্দর৷ ক্ষীণ আলোর
সাথে যোগাযোগ আজ বহুদিন হোলো না৷ আলস্য বিক্রি
করে স্মৃতির সাথে এখনও চলছি ক্ষত নিয়ে, মেরামতে
পড়ে আছে, হে অনাদি
পরস্ত্রীর মুখোমুখি এখন কালক্রমে ডানাধীন রাখো কাকে
পঙক্তির ভালোবাসতো কতিপয় শব্দকে, আজ এরা নিবিড় হোলো
সলিলসমাধি ঘটে গেছে, আক্রান্ত তুমি এখন এসেছ—
যখন আমাদেরই উঠবার সময়, আমরা কি আর
বসে থাকতে পারি? সুচতুরভাবে দুটি পক্ষে ভিড়ে গেলে
এখন এসব বিপথগামী সুপরিকল্পিত পথে
দ্রুত চলে যাওয়া ছাড়া তেমন কাজ নেই৷
যুক্তিতর্কের কাছাকাছি পৌঁছবার প্রয়াস দেখে মনে হয়
তুমি প্রচণ্ড স্বাধীন। আমরা
বয়ঃসন্ধিতে যখন পৌঁছেছি, তখন তুমি রীতিমতো
প্রথাবিরোধী। তোমার হাতের লেখা আমাদের কাছে
অতি পবিত্র। অস্মিতার ভারে এতকাল যতখানি করেছি ফলাহার
শাকাশী প্রাণির কোষে যেসব নরোম লুকিয়ে আছে, তাকেও কিছুটা খাও
সরলতা, এবার একটু একা থাকতে দাও।
অরুচি শরীরে, আসন্ন স্নিগ্ধের গান শুনে মনে হয়
আরো কিছুটা বাঁচি, কত কাজ বাকি আছে
কত নারীর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি মায়ের মতো
কত পুরুষের কাছে আমার সাবালক যৌবন বড়ের মতো এগিয়ে দিয়েছি, কত শিশুর
সাথে তাদের ভাষায় করেছি যোগাযোগ- এ আর কবে লিখি বলো
মুষড়ে পড়া হয়না বহুকাল, জীবনের ধ্বনি শুনে
সিগারেট খেতে খেতে ভাবি- এখনই মরে যাওয়া হবে প্রচণ্ড গিমিক
সফলতার খোঁজে কিছু তো হোলো না, সংজ্ঞা ভুলেছি, তাও
—সরলতা পিছু কেন ছাড়ছো না? একটু একা থাকতে দাও
কবিতার কাছাকাছি গিয়ে দেখি অসংখ্য মানুষ
অসংখ্য পরিচিত মুখ, কেউ কেউ
গান গায়, এদের আমি চিনি৷ কারো কারো সাথে
ইতোপূর্বে দেখাও হয়েছে হয়তো। কারো সাথে
ভীষণ অভিমান৷ হে অনাঘ্রাতা
এসো, রোয়াকে বোসো৷ বলো দুটি কথা
ভালোবাসার সমস্ত সম্ভাবনা খারিজ করে দাও আপাতত
আমাদের বিষণ্ণ আর্দ্র দিনে তাপমাত্রা হয়ে থাকো, সরলতা।
উষ্ণতাও দিতে পারো স্বাভাবিক৷ প্রাণের স্পন্দন
চোখে টের পাওয়া গেলে বলে দিতে পারো তুমি সুখী
কবিতার কাছাকাছি আরো থাকি, আরো দেখি অসংখ্য প্রকৃতি
প্রিয়ত, এই তো সুনীল দিন। মহত্তম ধর্মের পথে
আমাদের জাগ্রত ক্লান্তিকর বাণী চালিয়ে দাও নাস্তিক রেডিওতে
সকলেই জানেন যত্রতত্র বসে থাকা আমাদের অতি প্রিয় কাজ
ভিউকার্ডে সমাজের বাইবেল পড়ে ফেলে এখন আমরা
এগোচ্ছি স্নিগ্ধতার দিকে
আমাদের দৌঁড়ে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারছে না
নিরাকার ব্রহ্মাও৷ এসো, আমাদের হারিয়ে দাও
জয়ী হওয়ার বিমর্ষ লক্ষ্য নিয়ে আমরা আততায়ী প্রেম পুষে রেখেছি গল্পের মতো৷ পাঠ্যবইয়ে এসবের কোনো
হদিস পাবে না আজ৷ আমাদের রাজনীতি চুরি হয়ে গেছে
পেশাদার কাব্যচর্চার বিনিময়ে অঢেল টাকা ইনকাম করা এখন প্রিটি নরমাল৷
কবিতার কাছাকাছি গিয়ে দেখি অসংখ্য চোর
সর্বশেষ সংবাদ পাওয়ামাত্র যখন এদিকে হোলো ভোর
আমরা অলরেডি রাস্তায়৷ ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন
উপলক্ষ্যে অত্র অঞ্চলে যেসব প্রেমিকের অভ্যুদয় ঘটেছে
তাদের কেউই আজ বাড়ি ফিরবে না৷
আজ আমাদের অতি প্রিয় অস্তিত্বের দেখা পেয়েছি—
প্রিয়তমা রাষ্ট্র, তোমাকে চুদি।