পিপুল
পিপুল গাছের ডালে উঠে গেছে চাঁদ
মেঘ নেই কাছে ত্রস্ত হরিণ আছে
মসের বাগানে রাখা ক্যানোপির ফাঁদ
যেন বুবি-ট্র্যাপ মুদে গেছে খুব কাছে
রুকসাক ফেলে পাহাড়ের দিকে গেলে
চেনা যাবে ছায়া এই সংগত ট্যুর
পিপুলের ডাল ধরে সুবাতাস খেলে
কস্তুরী ঘ্রাণ আনে দূর বহু দূর
যেন আগুয়ান মেঘ বস্তুত তুলো –
ভেসে চলে এই বিদীর্ণ অবকাশে
থিতিয়ে আসার পর কার দিকে ধুলো
ওড়ে পিপুলের উপশাখাদের পাশে
তবু চাঁদ তার ডালে লুকিয়েছে আলো
আজ সব থেকে ভালো ট্রাভেলার জানে
ব্যাহত বাতাস হায় কতোটা পৌঁছালো
উপনিবেশিক যত শব্দের মানে
ট্রিগার হ্যাপি
এত কেন ঘোড়া দাবড়াচ্ছো হে তর্কবাগীশ?
তোমার দিকেই চেয়ে আছে যখন আগ্নেয়াস্ত্র সুন্দর!
ওই টোটাবন্দুক হাতে যারা শিকার করছে খরগোশ,
ঘন-ঘন নিশানা পাল্টাচ্ছে; তারা ছড়াচ্ছে কপট ত্রাস।
স্যাংচুয়ারিতে নির্মম শুরু হচ্ছে মৃগয়াপর্ব।
কিছু দেখলেই লোকে বলছে – ফায়ার!
নিবিষ্ট ঘূর্ণির কাছে
তাকে দেখা গেল না আর
কোন মানমন্দির থেকে।
জন্মান্ধ টেলিস্কোপের ভুল ভাঙল।
দূর গ্রহাণুপুঞ্জ আর নক্ষত্রের মাঝে
মিশে আছে যেই মুখ,
সে কি কসমিক বেদনা,
না কোন ভ্রান্তি অপার?
এক দিশেহারা উল্কার পিছে ছুটে
হারিয়েছি তার মুখ। ধ্রুবতা।
স্পন্দ্যমান ওই আলোকরেখার পর
যতদূর বিস্তৃত হৈম অন্ধকার —
সেইখানে জ্বলে বৈদুর্য্য, অয়োস্কান্ত,
ধিকিধিকি জ্যোতির্বিজ্ঞান।
কোনও একদিন নিবিষ্ট ঘূর্ণির কাছে
জানতে চেয়েছি,
জগতের সব রহস্য কেন অতল।
সব রঙ রক্ত অরোরা?
হারিয়ে যাওয়া মানুষের মুখ
কী কারণে অমন নক্ষত্রসংকাশ!
পাতাল শহরের ম্যাপ
অরণ্যগহীন।
এইখানে এলে বৃক্ষের নাম ভুলে যাই,
ভুলি বায়ুবেগ, উত্তুঙ্গ জিরাফের হাড় —
করতলে রাখি রত্নপাহাড়, ধুলোর জীবনী।
কারা যেন ছিড়ে ফেলেছে আজ
পাতাল-শহরের ম্যাপ!
অবসন্ন পড়ে আছে ঘুমের সরণি।
কোজাগর চাঁদ জেগে আছে এইসব
বলিষ্ঠ বৃক্ষের পাশে —
জিরাফের উচ্চতা থেকে লাফিয়ে নামছে
ওয়াইল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফার,
স্প্রিংয়ের রমণী।
হাওয়ালেখ
১.
নিরর্থের দিকে যাও। চিনে নাও, তোমার সমাধিতে
কারা এসে ঠুকে যায় হাওয়ার ফলক।
২.
ঘোর লাগে প্রপেলারে। কার গায়ে জেগে থাকে
ওই মেরুন রাত্রিবাস? দ্যাখো মানুষপুতুল,
লৌহকারখানা থেকে উঠে আসে কেমন
সুগ্রীব বিমানের ঝাঁক! আমাদের আশ্চর্য
অ্যারোড্রোমগুলো ডানা ভাঙার আর্তনাদে
ভরে ওঠে। মানুষ জেনে গেছে পতনের শব্দ
মূলত জাগতিক সংকেত এক পুনরায়
জেগে ওঠার। ফলে বাতাসের গান বাজে,
তরঙ্গ লিখে রাখে আয়নোস্ফিয়ার।
৩.
ফুটেছে হাওয়ার ফুল। নীল আমব্রেলা।
অসুখের দিকে রাত্রি সরে গেছে।
গ্রন্থ-মলাটের নিচে বয়ে গেছে রক্তাল্পতা।
আমরা তো দেখিনি আজও প্রসূন-সভ্যতা,
আইসিস, দেখিনি নতমুখী ফুল। গ্রন্থ’সরণির
পাশে কী করে শুয়ে থাকে নশ্বরতা!
হায় মুদ্রারাক্ষসের দল, তোমাদের কাছে
জমা রাখি আয়ুর ভ্রমর, সুখ্যাতি,
আত্মখুনের বারতা।
৪.
এ’ বৈধব্যে পুড়ে যাক মেঘ। হাওয়ার বারতা।
তুমি প্রাচীন পুস্তক নিয়ে কথা বল, যার ভাষা অস্পষ্ট।
প্যাপিরাস হে, দিকে-দিকে কার এত গোপন
সংকেত আসে! বিদূষিকার লণ্ঠনে লেগে থাকে নির্জ্ঞান,
প্রবুদ্ধ শহরের আলো। মহাচৈতন্যের মাঝখানে নিশ্চেতন
যেই দেবদারু গাছ আছে, অনুবাদে তারাও সক্ষম।
তারা জানে পৃথিবীর প্রাচীন পুস্তক সব মেলে ধরা আছে
বিদূষিকার দিকে। যার তৃতীয় নয়নে বিদ্ধ তীর।
যার করপুটে অতীতের লিখনরীতি হাসে।
৫.
শেষমেষ গ্যাসোলিনই সত্য, গতিনির্ভর এই পৃথিবীতে
আর রাষ্ট্রনায়কেরা পিস্তলেরো। ফলে বুদ্ধি ব্যতীত আর
হারাবার কিছু নেই। আজ পৃথিবীর ম্যাপ নিয়ে
মেতে আছে কারা? উজবুক না কোন রাজর্ষী? কার নাম
লেখা আছে গ্যালিলির সমুদ্রতটে? সে সত্য সযতনে
লুকিয়ে রাখে আজ লৌহ, আকরিকের পাখি।
৬.
নেমে যাই ধীরে, এই অষ্পষ্ট গানের মাঝে।
দেখি ফুটে আছে ধূম্রস্বর, লহরী। গাগরি ছলকে ওঠে,
গমকে গমকে। ভাঙে ক্রম, শ্রুতিবিশ্ব। পদপ্রান্তে
নেমে আসে সমুদ্র সোপান। অবরোহ গান বাজে
ইথারে-ইথারে, আজ গীতনির্যাস। পুষ্পরথ চেপে
কারা চলে যায় দূরে? তারা জানে প্রস্থান আসলে
হাওয়ার কারসাজি। হাহাকার মূলত বনমর্মর।
৭.
উড়ে যাও ধ্বস্ত কাগজের প্লেন; এই বিজন ফরেস্ট,
এই ব্যাকুল সাব-আরবান দৃশ্য পেরিয়ে। যত দূর দেখ
আজ চিৎপ্রকর্ষ, শঙ্কার বিপরীতে জেগে থাকা রোদ।
ছায়ার কাঠামো, বিটপ আর ছিন্ন পত্রালী। কর্পূরের মত
উবে যাওয়া উড্ডয়নপথ, তারও তো বিয়োগচিহ্ন থাকে,
যার দিকে চেয়ে ন্যুব্জ হয় কাগজের প্লেন, তার ব্যথাতুর
ডানা গুটিয়ে আসে।
৮.
কে থাকে আগুনপাহাড়ে – সে’ প্রশ্নের মীমাংসা হয়নি আজও।
শুধু দূর দিকে চেয়ে মনোলিথখানি মৃদু হেসেছে। বাতাসে উড়েছে
ভলক্যানোর ছাই, ভস্মাধার পরিপূর্ণ হয়েছে। জেগে উঠেছে
আকরিকের পাখি, যার আগুনে-ডানায় চেপে উভচরেরা
মৃত্যুর সীমানা পেরিয়েছে। অনতিদূরেই ধসে পরেছে পাথরের সেতু।
ফলে চিরপ্রশ্ন হয়ে দূরে আগুনপাহাড় শুধু দাঁড়িয়ে থেকেছে।
দাঁড়িয়ে থেকেছে।
৯.
ওঠো আজ, অনাবিষ্কারে চলো। স্তূপাকার পড়ে আছে যেখানে
জংধরা জাহাজের শব। উদ্গার শেষে ফিরে আসা যুদ্ধাস্ত্রের
গায়ে লেগে আছে আজও বহু যুদ্ধের তাপ, বহু স্খলনের চিহ্ন।
আর যত ওই ধাতব আকাশ, যতটা আলকালির সমুদ্র;
তুমি লিখে রাখো খাতায়, চিরকূটে। সেই সব মুছে যাবে।
স্ফুলিঙ্গ রবে শুধু, অগ্নিকুণ্ড রবে। যত কামারশালার গান,
হাপরের শব্দ চিরকাল রয়ে যাবে হৃদয়ে আমার।
১০.
কিংখাবে রাখো প্রেম। বিরহ তোমার।
আজ রণক্ষেত্রের দিকে উড়ে যায়
চূর্ণ-চকিত গান যত, তারা জানে ধাতু নিগ্রহ।
জানে হাপরের ছল কতোটা ধরে রাখে
যুযুৎসা আমার। যদি হননের রাত আসে,
যদি ক্রূর হাসে আকরিকের ফলা;
তবে স্থানু হও, আর নতজানু হও।
বৃশ্চিকসূর্যের নিচে আজও কারা গান গায়
এমন পেগান?
রাবারপাতায় লেখা এলিজি
রাবারপাতা ঝরল বলেই শুনতে পেলাম হঠাৎ –
বিকেল কোথায় গড়িয়ে গেল, শৈলনদীর প্রপাত
বেয়ে অস্ফুট এক শব্দ এল, সঙ্গোপনী সুর,
তাতে জাগল আবার বনভূমি, অনেকটা পথ দূর।
সন্ধ্যের আগেই য়্যুকালিপের বাকল খুলে দেখি –
গাছের ভেতর অপার্থিব এক সুগন্ধি আছে কি?
রাবার বনের মধ্যে তখন অনুচ্চ সরসর,
যেন চপল কিছু কাঠবিড়ালি আজ পলায়নপর।
যার ছটফটানি আছে লেখা বনস্থলীর পাতায় –
স্মৃতির মতন জমিয়ে রাখা অদৃশ্য এক খাতায়।
যত লোধ্ররেণু যায় উড়ে ঐ বিকেল বেলার কাছে
যেন বন-বনানীর মধ্যখানে শান্তি রাখা আছে।
নির্জনতার ওপাশ থেকেই তখন বুনো ফুলের –
প্রায়ান্ধকারে গন্ধ আসে শূর্পনখার চুলের।
হাঁটতে-হাঁটতে ভাবছি যখন রাক্ষুসিদের রূপ,
তখন রক্তে মাখামাখি আকাশ। পৃথিবী নিশ্চুপ।
মন্টেজুমা
ধসেই গেল মস্ত প্রাসাদ আজটেকার,
হিস্পানীয় ব্যান্ডানাময় দস্যুটার।
লুটতরাজে করল এমন সর্বনাশী,
কাটল মাথা যোদ্ধা দলের, দাস ও দাসী।
সঙ্গে নিল রক্তরুবির মূর্তিখানি,
ঝিকমিকিয়ে ওঠার আগেই দৈববাণী –
নাজেল হল ইউরোপিয়ান ধর্ম মতে,
ইভানজেলি মর্মকথার নর্ম হতে।
রুবির চোখে চোখ পড়তেই আস্তে থামি,
টোটেম-গুরু আজকে এমন মুক্তিকামী!
বস্তু ছেড়ে যাচ্ছেন উড়ে অবস্তুতে,
একেশ্বরী ধর্মাচারের এ’ খুঁতখুঁতে –
স্বভাবটিতে যারপরনাই আনন্দিত
হলেন গুরু সূর্য তখন অস্তমিত।
বাগানখানি মন্টেজুমার যেই ফুরাল,
কোত্থেকে যে আকাশ-পাতাল তীব্র আলো –
ছড়িয়ে গেল দৃষ্টিসীমায় অভ্রভেদী,
উঠল কেঁপে সিংহাসনের পাষাণবেদী।
সেই আলোতে মন্টেজুমার ঘুম ভাঙাল –
বন্ধুবেশী শত্রু-জাহাজ নিকষ কালো।
রাতের শুরু পরিত্রানের নেই হদিশ,
ছোট্ট পাখি রাজার কাছেই অহর্নিশ –
গান শুনিয়ে বলল – ‘এরাই দখলদার;
যা দিন গেছে ফিরবে না আর আজটেকার।’
বন্দিশ-২
নিহিলতা ভেঙে উঠে আসবার মত
জলযানটির গুঞ্জন ধরে রাখি
পার হয়ে এসে ঝঞ্ঝা-মুখর নদী
তোমার কাছেই আঁকতে দিয়েছি ক্ষত
সে ক্ষত এমন বর্ধনশীল ভাবে
ছড়িয়ে পড়েছে শরীর কিম্বা মনে
দূরে ঠেলে দিয়ে নদীটির কথকতা
বাষ্পরুদ্ধ জলযানখানি কাঁপে
যদি কম্পন ভুলেই ভেবেছ তারে
দূরপাল্লার ভ্রমণের ফাঁকে-ফাঁকে
ট্যুর প্ল্যান লিখে লাভ হবেনা তো আর
পাওয়া যাবে তারে ভাবনার বিস্তারে
ভাবতে-ভাবতে দিন তো গিয়েছে চলে
নিষ্কাম ভাবে কামনায় গনগনে
চুল্লির আঁচে সেঁকে নেয়া গেল প্রেম
মানবিক বোধ পারমাণবিক ছলে
পরমাণু জানে ভেঙে যাওয়া কত ভাল
ভেঙে যাওয়া জানে বিষণ্ণতার দিন
দু’টি পথ যেন দুই দিকে গেছে বেঁকে
পথের প্রান্তে বিস্ফোরণের আলো
সেই আলোতেই ঘটিয়েছি মধুরেণ
জলযানটির পেটের ভেতরে বসে
নৌপথে ঘোরা নাবিকের মত করে
আমাকেও লোকে ভুলতে বসেছে যেন
সামরিক কবিতা
তোমাকে শেখাল ঘৃণা
রাষ্ট্র ধারণা
ভাষার মোড়কে রাখা জাতীয়তাবাদ
আমাকে দেখাল কী না
ক্ষুধার তাড়না
কৃষিকাজে ধরে রাখা শস্য আবাদ
তোমাকে শেখান বুলি
অন্ধ চোখগুলি
দেখে নিয়ে হল এতো ছন্দকাতর
আমাকে শোনাল যারা
কোমল গান্ধারা
ভাষাহীনতারই দিকে পলায়নপর
তোমাকে বোঝাল সেনা
কিচ্ছু চলবে না
লাঠি বুটজুতো – সে তো শাসনেরই প্রাণ
আমাকে জানাল দেনা
কেবল ব্যাঙ্কে না
খাকি বাদে বাকি – ‘ব্লাডি সিভিলিয়ান’
তোমাকে দেখান সারা
ওই যে শুকতারা
ওঠে আর ডুবে যায় মনেরই ভেতর
আমাকে শোনাল কারা
ছিন্নমস্তারা
গত রাতে করেছিল নিজ লহু পান
মিরর মিরর
ফিরেছি পারদের দেশে,
খুনোখুনি আর ক্লিন্ন পৃথিবীর
যুদ্ধোত্তর সব ট্রেঞ্চ ভালবেসে।
মানুষের চামড়ায় মোড়ানো
শোক বই পড়ে জেনেছি –
জগতে তুমিই সুন্দর,
বাকী সব উৎকট, মিথ্যে।
ওই কীটদুষ্ট গাছের ছায়ায়
পড়ে আছে যত ইচ্ছেচালিত যান
অশ্বশক্তির অপচয় রোধ করে –
তারা জানেনি খর-গ্র্যাভিটির টানে
কী উলম্ব চলেছে জগত
আজ রসাতলের দিকে!
ওই সুতীব্র ভোর্টেক্স বেয়ে
নেমে যেতে-যেতে ভাবি
জগতে তুমিই সুন্দর, বিম্বিত –
ধ্বংসের পরাবৃত্তে।