প্রায় তেরো বছর হলো ময়ূখ রাতে ঘুমাতে পারে না। প্রথম প্রথম এক, দুই, তিন থেকে দুই হাজার, তিন হাজার, চার হাজার পর্যন্ত গুনতে গুনতে তার রাত কেটে যেতো। এসব পুরাতন থেরাপি নিতে নিতে সে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে গেছে। বিরক্তি নিয়ে খুব ভোরে উঠে জানালা খুলতেই ময়ূখ দেখতে পেলো ভীষণ সুন্দরী এক বৃদ্ধা পতত্রীর সাথে বাগানে নাচছে। মাঝি নাও ছাইরা দে, ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে… এ গানের ফিউশান নাচ। পতত্রী ছোটবেলা থেকেই ভালো নাচে কিন্তু ওই বৃদ্ধার নাচ এতোটা মন্ত্রমুগ্ধ ছিল যে ময়ূখ দৌঁড়ে ঘরের বাইরে পা দিতেই ধপ্পাস করে পড়ে গেলো! পড়ে যাওয়ার সাথে সাথেই তার মনে পড়লো আজকে বর্ষাকালের প্রথম দিন। এবং বর্ষাকাল মানে সবার জীবনে কদমফুল থাকলেও তার জীবনে আছাড়ফুল থাকবেই। আর এই আছাড় খাওয়ার পেছনেই হয়তো সেরা ফুটবলার হবার যোগ সাঁকো আছে! পড়ে গিয়ে এসব যখন ভাবছিল তখন সে দেখল পতত্রী যে বৃদ্ধার সাথে নাচছিল সে আসলে একটা পাগল মহিলা, যার প্রধান কাজই হলো সারাক্ষণ নাচা! পতত্রী তাকে বৃদ্ধা,পাগল মহিলার কথা বলেছিল এবং সেসব কথা শোনার পর তার মনে হয়েছিল এদেশের অধিকাংশ মায়েরাই সেরা এবং সুন্দর।
ময়ূখ বুঝতে পারে না একটা মানুষের কত দুঃখ, সুখ বা ধৈর্য্য থাকলে জীবন থেকে বিভ্রান্ত হওয়া মানুষদের সঠিক পথ দেখায়! পতত্রীর অদ্ভুত মেন্টাল থেরাপি নিয়ে অনেক মানুষ সুস্থ্য হচ্ছে। কয়েকদিন আগে এক বাচ্চা থেরাপি নিতে এসেছিল। স্নিগ্ধ চেহারার বাচ্চাটি প্রথম দাঁত পড়ে যাবার শোক উদযাপন করতে পারেনি তাই বিভ্রান্ত হয়ে সারাক্ষণ চুপচাপ থাকে আর অবাক হয়ে ইঁদুর খোঁজে। বাচ্চাটার মা-বাবা ইঁদুর খোঁজার কারণ জানতেই পতত্রীর কাছে তাকে নিয়ে এসেছিল। এই কাহিনী শোনার পরই পতত্রী এক ইঁদুর ব্যবসায়ীকে ধরে এনে বাচ্চাটির হাতে পঁচে যাওয়া মরা ইঁদুর দেয়। আর তখনই বাচ্চাটি আনন্দে কাঁদতে থাকে। কি এক বিশ্রি শৈশব নিয়ে এখনকার বাচ্চারা বেড়ে উঠছে! এসব কারণেই ময়ূখের ভয় হয় হারিয়ে যাওয়া বা হারিয়ের ফেলার অনিশ্চিত ভয়! ভাবতে ভাবতে সে ঘাসের ওপর বসে পড়ে, মোলায়েম ঘাস আর সারসের ডাক তার কাছে একই মুখের অবয়ব মনে হতে থাকে…
এমন বর্ষায় পতত্রী বুঝতে পারে ময়ূখ অদ্ভুতভাবে বদলে যাচ্ছে। পাঁচ ফিট তিন ইঞ্চির মানুষটাকে বদলে যেতে দেখে তার অনুভূতি গুলোও হঠাৎ বদলে যেতে থাকে। তখন সে বুঝতে পারে না আসলেই তার কোন অস্তিত্ব আছে নাকি ভীতু কাকের মতো কোথাও ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছে! এমন অস্বস্তি নিয়ে জানলার পর্দা সরিয়ে পতত্রী বসে থাকে অতীতের কিছু বাক্স নিয়ে। সে ভাবে সে ময়ূখকে ভুলে যাচ্ছে দেয়ালে টাঙানো ছবির মতো আর ময়ূখ অদৃশ্য হচ্ছে ধূলো জমা রাস্তা পায়ে নিয়ে!
হয়তো, অনেক দৃশ্য, অনেক কাহিনী যাকে নিয়ে শুরু হয় তাকে মানুষ হারিয়ে ফেলে। পুনরায় ফিরে আসতে পারে কেবল নির্ভুল স্মৃতি।
হয়তো, অনেক দৃশ্য, অনেক কাহিনী যাকে নিয়ে শুরু হয় তাকে মানুষ হারিয়ে ফেলে। পুনরায় ফিরে আসতে পারে কেবল নির্ভুল স্মৃতি।
নবান্ন উৎসবে যখন পুরো গ্রাম আনন্দে মেতে উঠেছিল তখন ময়ূখ ঠিক বুঝতে পারছিল না সে মৃত নাকি জীবিত। এই দোটানা মুহূর্তে পতত্রী তাকে আবিষ্কার করেছিল একটি গাছের ডালে ঝুলে থাকা অবস্থায়। সেদিন পতত্রী তাকে কিছু বলেনি কারণ বাড়ি ফেরার তাড়া নিয়ে সে ময়ূখকে একটি কাগজের নৌকা দিয়ে বলেছিল এবার জীবিত থাকার ভান করলে তুমি মরেও যেতে পারো।
এরপর থেকে ময়ূখ ভান করেনি। কিন্তু পতত্রী দ্বিতীয় বার যখন তাকে আবিষ্কার করেছিল তখন সে তার মা’র কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনে শুনে কান্না করছিল। পতত্রী এর আগেও দেখেছে কিছু মানুষ জন্মগতভাবে এই দেশটাকে অদ্ভুতভাবে ভালোবাসে। পতত্রী বা ময়ূখ কেউই মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি কিন্তু যুদ্ধের সময়কার গল্প শুনলে তাদের দুজনেরই গা শিউরে ওঠে, সজোরে কান্না আসে! পতত্রী এর উওর খুঁজে পায় নি। এমন নানা প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই। এমনকি পতত্রী জীবনের তেইশ বছর কি করে কাটালো সেটা ভেবেও সে অবাক হয়!
এখন পতত্রী যে জানালা খুলে বসে আছে সেখান থেকে পাহাড় দেখা যায়,তার পাশেই ছোট সুন্দর গ্রাম। ময়ূখ প্রতিদিন ওই গ্রামে গিয়ে তিনঘন্টা চুপচাপ বসে থাকতো। সে বলতো গ্রামের ভেতর থাকলে নাকি তার নিজেকে মাটি মনে হয়! সেখানে বসে থাকলে সে অনুভব করতে পারে তার ভেতর গাছ পালা বেড়ে উঠছে। পতত্রী যে ঘটনাটি এখনো ভুলতে পারেনি সেটা হলো ময়ূখের প্রথম দাঁত পড়ে যাওয়া দিনের ঘটনা। তার পড়ে যাওয়া দাঁত মুখ থেকে বের করে সে অবাক হয়ে দেখছিল আর ভীষণ চিন্তিত হয়ে তাদের জিজ্ঞেস করেছিল ইঁদুর কোথায়! এই প্রশ্ন করার পর ময়ূখ প্রায় তিন বছর কারো সাথে কথা বলেনি, সারাক্ষণ বসে বসে ইঁদুর খুঁজতো। কারণ তাদের ঝকঝকে তিন তলা স্কাই ব্লুয়ের বাড়িতে কোন ইঁদুর ছিল না। সেদিনই পতত্রী প্রতিজ্ঞা করেছিল যে, সে মানসিক রোগীদের ডাক্তার হবে, অস্বাভাবিক চিন্তা ভাবনার যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু ত্রিপল পিএইচডি ধারী, সেরা ফুটবলার ময়ূখ নামক মানুষটাকে সে বুঝতে পারে না। বিষয়গুলো সহজ সমাধানের পথে থাকলেও তাদের ভেতর অতৃপ্ত শূণ্যতার অংক অসমাপ্ত হতে থাকে…
আষাঢ় মাস শুরু হয়েছে দেখে পুস্তিকা দেবী অবাক হয় এই ভেবে যে পতত্রী আর ময়ূখ বড় হচ্ছে। যোগনাথ আর পুস্তিকা দেবী অনেক বছর আগের বর্ষাকালে যখন তাদের আশ্রম থেকে নিয়ে এসেছিল তখন পতত্রীর বয়স ছিল তিন বছর আর ময়ূখের বয়স ১০মাস। পাখি আর মেঘের মতো দুই মেয়ে পেয়ে সময় পেলেই পুস্তিকা দেবী তাদের গল্প শোনাতো।
আষাঢ় মাস শুরু হয়েছে দেখে পুস্তিকা দেবী অবাক হয় এই ভেবে যে পতত্রী আর ময়ূখ বড় হচ্ছে। যোগনাথ আর পুস্তিকা দেবী অনেক বছর আগের বর্ষাকালে যখন তাদের আশ্রম থেকে নিয়ে এসেছিল তখন পতত্রীর বয়স ছিল তিন বছর আর ময়ূখের বয়স ১০মাস। পাখি আর মেঘের মতো দুই মেয়ে পেয়ে সময় পেলেই পুস্তিকা দেবী তাদের গল্প শোনাতো। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার গল্প। মুক্তিযুদ্ধের সময় পুস্তিকা দেবীর বয়স ছিল পাঁচ বছর। সে দেখেছে মানুষের লোভ, মানুষের সাথে মানুষের যুদ্ধ। যুদ্ধ শেষে নয় মাস পর কঙ্কাল সাড় হয়ে পুস্তিকা দেবী স্বাধীন দেশে পা রেখেছিল আবারো। কিন্তু পুস্তিকা দেবী রাস্তায় পড়ে থাকা, পঁচে যাওয়া লাশের ভেতর ইঁদুর, শকুনের ভীড় দেখে পাগল প্রায় হয়েছিল। যোগনাথ তার মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন না নিলে পতত্রী বা ময়ূখ কাউকেই সে গল্প শোনাতে পারতো না।
পতত্রী এখন সফল ডাক্তার আর ময়ূখ সফল ফুটবলার। ময়ূখের ফুটবলার হবার পেছনে পুস্তিকা দেবীর অবদান অনেক বেশি। নিজের মতো আগলে ধরে দুই মেয়েকে সবদিক থেকেই সেরা করে তুলেছে। রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও মানুষের সাথে মানুষের এতো সত্য, সুন্দর সম্পর্ক হতে পারে সেটা পতত্রী আর ময়ূখকে না দেখলে সে বুঝতে পারতো না। যোগনাথ মারা যাবার পর থেকেই ময়ূখ পাল্টে গেছে, পতত্রী তার মানসিক অবস্থা পরিবর্তন করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আশ্রমের অনেক বাচ্চাদের দায়িত্ব তাদের নিতে হবে। কিন্তু পুস্তিকা দেবী বুঝতে পারছে না তার দুই মেয়ে কিভাবে সব ভুলে যাচ্ছে! পাঁচ ফিট তিন ইঞ্চির মানুষ দুইজন সব ভুলে কিভাবে নির্লিপ্ত হয়ে যাচ্ছে?