কাজল শাহনেওয়াজ কবি ও গল্পকার। আশির দশকের শুরু থেকেই কুয়াশার ঘনীভূত ভিড় ঠেলে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বলা যায় আশির অন্যরকম কবিতার এক অবিকল্প বিচ্ছিন্ন যাত্রার তিনি আরেক মাত্রা। কখনো নিজেই দাঁড়িয়েছেন নিজের বিরুদ্ধে। কনসাশনের চূড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি রচনা করেছেন কবিতা ও গল্প। কবি কাজল শাহনেওয়াজ কবিতাকে ভয়ানক ভাবে বদলে দিতেন সেই পূর্ণ বিকাশ ছিলো তার। তার কবিতায় যে পাহাড়ি অনুষঙ্গ, তা মনে করি জীবনের গভীর গভীরতায় আপোষে হাতড়ানো যেন। এখানেই বোধকরি তার কেরামতি, মুনশিয়ানা। এরপর শুধু বেড়ে ওঠা- একটা নিঃসঙ্গ তালগাছের মতো উঁচু হয়ে আরো উঁচুতে। জীবনের উচ্চ ও নীচ, সফল ও অসফল, সামান্য ও অসামান্য- সবকিছুতেই অপরিসীম আকর্ষন নিয়ে বসবাস করছেন ঢাকায়। কবিতায় কল্পনায় ও গদ্যে বাস্তবতা দিয়ে শুরু করেছিলেন লেখালেখি। বর্তমানে বাংলার ভূমি – ইতিহাস – রাজনীতি প্রধান আগ্রহ। কাজ করছেন গ্রাম ও নগর এই দুই জগতেই।
একদিন আনারস
নির্জন জায়গা দেখে আমি একদিন আনারস ক্ষেতে ঢুকে
চুপ করে একটা আনারস হয়ে গেলাম
অনেকগুলি চোখ দিয়ে এক সাথে অনেক কিছু দেখবো বলে।
অনেকগুলি বেদনাকে আমি দেখতে পাচ্ছি অনেকগুলি সম্ভাবনা
দেখছি এগারোটার সূর্য একদিকে টগবগ করে ফুটছে
দেখছি একদিকে বাতাস বইছে ফুলের রেণু নিয়ে
একদিকে শালের অরণ্য। এক দিকে শব্দ। শো শো। কিসের যেন।
সাবলীল বেদনা যখন সৃষ্টিশীল হয়েছিল
নিশ্চয়ই অনেক কিছু মিলে এমন একটা
মহান একাকীতার জন্ম হয়েছিল
বহুদিকে তাকাতে তাকাতে আমি কেবল একের কথাই ভাবলাম।
মনে হয় আমার অনেকগুলি চোখ হলেও একটাই মাত্র চোখ
অনেকগুলি সংবেদন হলেও একটাই মাত্র অনুভব।
দেখি উপরের সাথে নিচের কোন মিল নেই।
কাছের সাথে দূরের কোনো তূলনা হয় না।
দিনের থেকে রাত পুরাটাই আলাদা।
অনেকগুলি চোখ দিয়ে আনারসের মত দেখলে
অনেক রকম ভাবনাকে রূপ নিতে দেখা যায়।
অনেক রকম দেখা যায়। অনেক কিছু দেখা যায়
পশু পালনের দিন
আমারতো ছিলো না পাহাড়ে চড়ার বিদ্যা
তখন আমি নৌকা বাইতে পারতাম
নিজের জন্য একটি খাল খনন করতে করতে
দিন যেতো
আমি বৈঠা তুলে মাঝে মাঝে গান গাইতাম
কয়লা দিয়ে ভুতের ছবি এঁকে বশীকরণ চর্চা করতাম
রাতের বেলা পথে নামতাম পরীর পাখা কুড়াতে।
একদিন আমি উটের পিঠে চড়তে শিখবো বলে ঠিক করি।
উটের জন্য চাই মরুভূমি যেমন গরুর গাড়ির জন্য হারিকেন।
পড়শির বাড়িতে নাই বাবলার গাছ।
হরিণ পালতে দেখি কেওড়া গাছের প্রয়োজন।
কুমিরের জন্য দরকার চোখের পানি।
তিলে ঘুঘুর জন্য এক বিঘা জংগল।
সাপের জন্য তীব্র যৌন ফুল।
ঘুঙুরে রোচেনা মন তবু বুক ভরা ছোট্ট একটা পা খুঁজি
কিছুতেই দেবে না জানি তবু তার আঙ্গুল কখানি খুলে নিতে
রহস্য থেকে নামি, পকেটে রেঞ্চ, হাতে সৌখিন আঙ্গুলদানি।
প্রান্তরের ডাকবাংলায় খুঁজি শিশিরের নিশিথ
হঠাৎ হঠাৎ পাহাড়ি বরফের ডাক, চিলের চিৎকার
কিন্তু কোথায় প্রকৃতির মুখ চেপে ধরার ক্লোরোফর্ম ভেজানো কাপড়
যাতে শে না চেঁচায়?
শক্ত পাকস্থলি কই যাতে পাথরের গিঁট আর ফুলের তীক্ষ্ণ কামড় হজম করতে পারে?
ক্ষুধার চেয়ে গোল, ক্রোধের চেয়েও আন্তরিক
আনন্দের চেয়েও স্বচ্ছ, ভিখারিনির চেয়েও কপালহারা
কি সে কল্পনা ঘোর গাঢ় জ্যামিতি?
জীবনের কালো উচ্চারণ নিহিত কোন প্রতিতূলনায়?
পাহাড় থেকে যা সহজ উঁচু পাহাড় থেকে তা সহজেই দেখা যায়।
আমি আজো পাহাড়ে চড়িনি
নৌকা বেয়ে বেয়ে
চলে যাই – যেখানে নৌকা নাই সেখানে।
যেখানে আমি নাই সেখানে গিয়ে ঘুরে আসি।
হে সর্বশক্তি
আমরা যেন আগামি কাল থেকে পাশবিক গোস্ত খাইতে পারি
কোন রকম জেনেটিক সমস্যা ছাড়া
কয়েকটা দিন ভুরি ভুরি
গপাগপ মাংশের টুকরাগুলি যেন গিলতে পারি
আমাদের সেই দাতহীন মুখ দাও প্রভু
অনেক গোস্ত আমাদের সামনে
আগুনে পুড়েছে
সেই ওল্ড টেষ্টামেন্টের আমল থেকে
সবচেয়ে সুন্দরী বাছুরের রান পুড়ে, হে প্রভু
তোমার সাথে সাথে আমরাও যে খাইতে শিখেছি
আমাদের বাৎসরিক গণমাংশের প্রদর্শনী
সফল হোক
কলিজাকে টুকরা টুকরা করে
রেন্ধে খাই
সবচেয়ে নরোম –
পাছার কাছাকাছি পুট-এর বাবু পেশী
কেন এতো সুস্বাদু?
মাংশের ভাজে ভাজে চর্বির পরত
কেন এত লোল ঝড়ায়?
জীবনের জানিবার শেষ নাহি যেন
যেকোন দামে উন্নত মানের গোস্ত
আমাদের রক্তের চাহিদা
ছুরি কাচি রক্ত
দা কুড়াল লগি বৈঠা
চাপাতি চাপাতি খেলা
এইবার সুলভে পাচ্ছে যারা
তারা যেন
আগামি বছরও এই সুবিধা পায়
আমাদের মাংশ ঠিক রাখো প্রভু
আমাদের রক্ত দেখতে দাও
কলিজা কচকচ করে কাটি
ফুসফুস ফসফস করে ফাটাই
গুর্দা গুরগুর করে চুড়াই
চাপাতি দিয়া হাড্ডিকে হাড্ডা হাড্ডা করি
রান কাটি চপাচপ
পাজর কাটি পাজাপপ
ঘাড় কাটি ঘ্যাচ্চর ঘজং
চামড়া খসাই ভুড়ি ফাসাই
পায়ের ক্ষুর নিয়া পর্যন্ত
রাজনীতি করি
সবশেষে
গরু পুরুষের গর্বের গ্যাজ
ঘ্যাজঘ্যাজ
পেটের ভিতর চালান করে দেই
আমাদের পেটকে সালাম মোবারক!
পেট মোবারক!!
ঈদ মোবারক!!
বুলডোজার টায়ারডোজার রানাপ্লাজা
বুলডোজার,
টায়ারডোজার, ক্যাটারপিলার
ফর্কলিফটার,
ক্রেন, ডাম্পার,
এক্সকেভেটর
ভারী যন্ত্রপাতির
থাবা
যখন দালানটা ভাঙ্গছে, তখন যা হবার তা হয়ে গেছে
ভাঙ্গা হাড়, পা, চোয়াল, দাত, পায়ের গিড়া, বুকের পাজর
নাকের নথ, পায়ের নুপুর দালানের ভাজে ভাজে
শ্বাস বন্ধ বন্ধ করে… অন্ধকারের মধ্যে হাতড়াতে হাতড়াতে
ব্যথার মধ্যে, তৃষ্ণায় গলার ঢেকুর পর্যন্ত শক্ত ধুলা
দালানের শক্ত পিলারগুলি এত নিষ্ঠুর ক্যান
আত্মীয়স্বজনরা কই গেল, ওরা বইসা আছে কেন?
মালিক কই? সরকার কিছু দেখেনা?
মানুষগুলা এইভাবে আড়াল থেকে বাইরে আসলো
তোমরা সস্তায় চাইছিলা বইলাই তো এই
দামি দামি মেশিন চালানোর জন্য গরিব মানুষগুলারে
গ্রাম থেইকা ডাইকা আইনা আমরা কাজে লাগাইছিলাম
তোমরা সস্তায় চাও বইলা আমরা আমাদের
মাস্তানদের দিয়া কোনরকমে একটা একটা কইরা কংক্রিটের খোয়ার বানাইছি
আমাদের ইঞ্জিনিয়ার সস্তায় ছাড়পত্র দিছে,
আমাদের এম.পি তার মিছিলের প্রয়োজনে পুকুরকে বানাইছে শ্রমঘন কারখানা
আমাদের ইউএনও তার ওসিকে নিয়া নিরাপত্তা দিছে
তোমরা সস্তায় চাও বলে তোমাদের পোষাকগুলি
সুদুর কুষ্টিয়া থেকে শাহিনা আসছিল বুকের সস্তানকে দেশে রাইখা
ওয়ালমার্ট প্রাইমার্ক মনসুন দ্য চিলড্রেনস প্লেস নামের ট্যাগগুলা সেলাই করার জন্য
তারপর তোমাদের জন্য ১০০ ঘন্টা আলো-বাতাস-পানিবিহীন নরকে
একটা পরোপকারি জীবন উৎসর্গকারী হিসাবে পরিচিত হয়ে
আজ কবরে শুতে যাচ্ছে
তুমি কি ওর জন্য এখনি প্রার্থনায় বসছো?
দেখো, তোমাকে সস্তায় কাপড়গুলি দেবার জন্য
আমাদের রাষ্ট্র পর্যন্ত কি রকম বিচলিত হয়ে ওঠে!
আমাদের ম্যাংগো মানুষেরা কি মারাত্মক ঝুকি নিয়া
ঐ ন্যাংটা দালানটার ভিতরে আত্মার সন্ধান করছিল
আমরা তোমাদের কাছে সস্তায় পৌছাইয়া দিবার জন্য
আমাদের ব্যাংকের পাছা খুলে দিছি
আমাদের মিডিয়া ২৪ঘন্টাই তোমাদের জন্য জাগে
হে হাড্ডি, হে ভাঙ্গাচুরা
হে ফর্ক লিফট, হাইড্রলিক ভাই
তোমরা একটু নরম করে হাত লাগাও
শক্ত মানুষেরা তাদের শক্ত হাতে
শক্ত কংক্রিটের ভাজে ভাজে
আমাদের অনেক অনেক মানুষকে
ধুলাবালির মধ্যে যে গুজাইয়া রাখছে
আমরা ওদেরকে অক্সিজেন দিতে পারি নাই,
পানি দিতে পারি নাই,
বাচাইতে পারি নাই
চেহারা রাখতে পারি নাই
নাক পারি নাই
চোখ পারি নাই
শব্দ পারি নাই
চাদ তারা আর দিতে পারবো না কোনদিন
ভারী যন্ত্রপাতি, অন্তত তোমরা একটু আদর দাও ওদের
কিভাবে আখ থেকে মদ তৈরি হয়
বিশ বছর পর দেখা হল কিভাবে আখ থেকে মদ তৈরি হয়
জীবননগরের ডালে ডালে গরু দর্শনায়
প্রতিবেশিনী উচ্চকণ্ঠে সামনে এসে দাড়ান
কুড়ি বছর পর
আমাদের ছেলেমেয়েদুটি মথ থেকে প্রজাপতি হয়ে উড়িতেছে
আপনি আখ থেকে ভাল মদ বানাতে পারছেন তো
তাদের যন্ত্রপাতিগুলি পুরাতন
তাদের গাছে ভাল আম হৈবে কিভাবে
তোমরা আম্রপালী লাগাও
হিজিবিজি জীবনে গরুগুলি পুত্রকন্যার চেয়েও আজো দরকারি
সন্ধ্যায় হুড়মুড় খুড়ের ফোসফোসানির
ভিতর থেকে মাথা বের করে
এতটুকু আলস্যের আলো পড়ে চোখে
এতটুকু ছোট ছোট চাকা
ছোটচাকা ছোটছোট কাজ করে
গরুগুলি বর্ডার পারাপার করি
আমাদের ছোটছোট হাতে
আমরা দর্শনায় প্রজাপতি উড়িতে দেখিলাম
বুঝিলাম জীবনের সাধারণ আখ থেকে
উৎকৃষ্ট মদ বানানো কতো দরকার
সারফেস টেনশন
এক টুকরা মাটির চারা
পুকুরের পানির সারফেস টেনশনের উপর দিয়ে
লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে
একবার টেনশন পাকড়াও করছে
একবার সারফেস উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে
একবার শাদা আসছে জীবনে
আরেকবার কালো এসে চুমু খাচ্ছে
একবার চোখের সামনে সেগুনগাছ
আরেকবার পানি ফলের চারা
সন্দেহ এমন একটা পোকা
যে মনের সারফেস টেনশন নষ্ট করে
তোমাকে সে
সারফেস থেকে
ডুবিয়ে দেয়
একটা হাতির বাচ্চা কিনতে চায় মন
একটা হাতির বাচ্চা কিনতে যে চায় মন
বিকাল বেলা আবাহনী মাঠে নিয়া
ফুটবল খেলা শেষে ফুচকা খাওয়াইতাম
সন্ধ্যা বেলা ফুরফুরে হাওয়ায় ঠাণ্ডা বাতাস খাইতাম বেঙ্গল গ্যালারিতে
হাইটা চইলা যাইতাম চারুকলার শুকনা পুকুরে
হাতির বাচ্চাটারে কলাপাতা খাওয়াইতাম আমি
লালনের নামে মহানাগরিক মাইফেলে গিয়া!
গিয়া বসতাম আজিজ মার্কেটে,
লিটল ম্যাগাজিনের প্রৌঢ় সম্পাদকের দপ্তরে আসা
বাচ্চা কবিদের পরিচয় দিতে গিয়া বলতাম তারে
এরা সব পথ ভ্রষ্ট পাখি, এরা কবিতা চায় না – রুটি চায় নাকি?
ওদের পুরষ্কার দাও।
তখন ভদাম করে আমার বন্ধূ ছোট্ট হাতি একটা পাদ দিয়া
ওদের কবিতার খাতা ভরে দিত
তারে নিয়া যাইতাম শিল্পকলা বা পাবলিক লাইব্রেরিতে
সা.জাকারিয়ার লোকবাংলার মঞ্চনাটকে,
তা.মা.র বাঙালি ফিলিম প্রদর্শনীতে
শ্রেণীভুক্ত কর্পরেট কালচারে
ফ্রেমকরা আদি হস্তচিত্র প্রদর্শনীতে
সর্বত্র রঙবেরংয়ের ফতুয়াপড়া এলিট মানুষদের মুর্খ আস্ফালনে…
সে কী বিরক্ত হয়ে এতসব কলার ভিতর তার নিজস¡ কলার খোজে
আমাকে অতিষ্ট করে তুলতো?
আমি হেসে হেসে তাকে নিয়া যাইতাম ছবির হাটে
ওকে দেখে কফিল নিশ্চয়ই হেসে ফেলত
আমাকে বলত, এতদিন একটা কাজের কাজ করছেন
রিফাত অন্ধকার থেকে এসে ওর শুড় চাপড়ে বলত
এমন একটা হাতিই তো আশির দশকের স্রষ্টাদের পিঠে উঠাইয়া ঘুরাইতে পারে
আমি একটা ভাল কবিতা ঢাকা শহরকে দেখাইতে চাইবার আগেই
কিনা তথাকথিত মিডিয়াঅলারা কর্পরেটদের টাকা খাইয়া
বিরাট বিরাট লম্বা শপথের সতরঞ্চি বোনে
যেন বোনদের সত্যিকারের ছোট ভাই ওরা!
এত বড় মানুষদের এত ছোট ছোট শপথ!
এই শহর বহুদিন বড় জিনিস দেখে নাই
উচু জিনিস দেখে নাই
তাই আমি ওদের একটা শুধু বড় জিনিসের বাচ্চাকে দেখাইতে চাই!
একটা বাচ্চা হাতির দাম কত? বলেন তো সুমন রহমান?
সিংগাপুরে কি সস্তা হবে? নাকি শেরপুর? রাইসু, আপনি কি জানেন?
হাতির কথা উঠলেই পিয়াল এর দরাজ গলায় জালাল খাঁ-র গান মনে হয়
চয়ন খায়রুল কাছে থাকলে জিগাইতাম লন্ডনের চিড়িয়াখানায় কি
বুইড়া হাতির পেটে জারজ বাচ্চা পয়দা হৈলে কম দামে পাওয়া যায়?
আমার এক ১৮বছরের কবি বন্ধু, যে প্রতিনিয়ত তার নাম বদলায়,
হে অনীশ বৃক্ষ, বলতো, হাতির বাচ্চা দিয়া তুমি কি করতা?
সে বলে, প্রথমালোর সম্পাদকের কাছে বাচ্চাটারে পাঠাইয়া কইতাম
এই দেখ সত্যিকারের বড় জিনিস কেমন
চ্যানেল নয়ন কেও বলতাম: দেখ, সত্যিকারের চোখ কতই না সুন্দর!
ফাঁপা বুদ্ধিজীবিদের থেকে কত বড় সত্যিকারের হাতির বাচ্চা!
একটা তাল গাছের কথা
আমি একটা উঁচু তাল গাছ। আমার মাথা একেবারে সব গাছ ছাড়িয়ে বাবুই পাখির বাসার কাছাকাছি।
বাবুই পাখিরা আমার প্রতিবেশী।
উঁচু থেকে আরো উঁচুতে ওঠার আকাঙ্খাই আমাকে এতো উঁচুতে নিয়ে এসেছে। ভালই আছি এই উঁচুতে।
অনেক দূরের অনেক কিছু দেখতে পাই। খোলা মাঠের জন্য আমাকে হা হা করতে হয়না।
সকাল বা বিকাল দেখার জন্য কোথাও যেতে হয় না।
সত্যি বলতে কি একটা সময় আমার এত উপরে ওঠার কোন ইচ্ছাও ছিল না, ভালও লাগত না।
সবার সাথে মিলে মিশে ছিলাম। অন্যরা যখন হু হু করে বড় হতে থাকত,
আমি থাকতাম আমার পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা টুনটুনিদের সাথে। মা
টির পোকামাকড়দের গরমের দিনে বাতাস করতাম।
বৃষ্টির দিনে ছাতি ধরতাম শিয়ালের বউয়ের মাথায়।
একদিন দেখলাম সবার চেয়ে আমার বেশ খানিকটা বাড় হয়েছে।
কবে যে উচ্চাকাঙ্খার ডাক এসেছিল মনে নাই, তবে উড়ে যাওয়া
কাকের আত্মার নীল একটা ঢেউ আমাকে ছুঁয়ে ছিল
আজ আমি ভালবাসার উর্ধ্বে একটা উঁচু তাল গাছ
ভীষন ফাঁকা উঁচু আর এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকি
আর ছোট ছোট বাবুই পাখিরা আমার প্রতিবেশী
অনেক উঁচু থেকে আর অনেক দূর থেকে
মিষ্টি ধোঁয়া ওঠা ঘাস আর পোকা মাকড় কে দেখি
সারাদিন ধরে ভাবি ওদের, শিয়ালের বাচ্চাটাকে ভাবি
কিন্তু ওরা আমাকে ভুলে গেছে
ওরা আমাকে একটা লম্বা গর্বিত একা তাল গাছ ছাড়া কিছুই ভাবে না।
ব্যাঙনি
তুমি সেই প্রাগৈতিহাসিক ব্যাঙনি
যে কিনা বহু ফুট মাটির নিচে সারা বছর বসবাস কর
আর কেবল যৌনমাসে অন্ধকারের উপরে আলোতে উঠে আসো আর
একটা ছোট্ট পুরুষ ব্যাঙকে পিঠে চড়িয়ে
ঘুরতে যাও প্রান্তরের পথে
তুমি দুনিয়া, আমাকে তুমি দারী দেখাতে দেখাতে
হঠাৎই ফেলে দাও বিগব্যাং খাদে
আমিও চমকে উঠি সেই সংবেদে
আমি নরম ব্যাঙ, তুমি শক্ত নারী
একটা বিশেষ কাজের জন্য তুমি আমাকে পিঠে চড়িয়ে
ঘুরে বেড়াচ্ছ
তোমাকে কি ফেরাতে পারি?
বাঁকা চশমা
তোমার সঙ্গ ছাড়া আর কিছুতেই মন টিকে না। কোন প্রিয় খাদ্য নাই, পানিয় নাই।
দোকান নাই, জুতা নাই, জামা নাই, তুমি ছাড়া।
তুমি আবার আসবে, জানি। এসে বলবে অনেক কিছু এনেছি তোমার জন্য।
ব্যাগ ভর্তি নানা রকম উপহার সংগ্রহ করেছো। কিছু আমাকে দিবে।
কিছু জমিয়ে রাখবে। কাল দিব, পরশু দিব বলে। আর এভাবেই একদিন
দেখবো তুমি আরেক হাতের কাছে চলে যাচ্ছ।
আর আমাকে তা দেখতে হচ্ছে একটা বাঁকা চশমা পড়ে।
আবার তোমার সেই রকমসকম। ঘুরে ঘুরে ফতুর হয়ে, আবার আসার পায়তারা।
অনেকগুলি অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করেছো। অনেক ভুল আলিঙ্গন করে এলে।
কিন্তু এবারো কী আমি সেরকম করবো?
তুমি যে ফিরে আসবে, সেই অপেক্ষায় পথে বসে থাকবো?
মন বানাতে আমি এখন পটু হয়ে গেছি।
তুমি চলে গেলে মনটা থাকেনা
ফিরে এলে
পটাপট তৈরি হয় আমার সেই মন
সেই মনটাই আবার কেমন করে ওঠে।
আমি আমার শত্রুর চশমা
আমি আমার শত্রুর চশমা পড়ার পর
এখন বেশ আগের চেয়ে ভাল দেখতে পাচ্ছি
শত্রুর চশমায় একটা আলাদা লেন্স লাগানো থাকে বুঝি
ছয়টা ইন্দ্রিয়ের সতর্কতা সেখানে অনবদ্য
অন্য ভাষায় লেখা সব দর্শন
যা দেখি তার অন্যরকম মানে
তুমি যখন আমার সাথে অনর্গল মিথ্যা বানানো কথা বলতে থাকো
আমি তখন সেই বিশেষ চশমাটা চোখে লাগাই
তখন সব ফকফকা। তোমাকে স্পষ্ট দেখতে পাই
এতো সব করি কেনো?
কারন তোমাকে আমি ক্ষমা করতে চাই।
বারবার ক্ষমা করতে চাই।
এতে যদি কিছু শাস্তি পাও, সেটা কী কঠিন শাস্তি হবে না?