নীহার লিখন, একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক। বহুমুখী, প্রতিভাবান এই কবি বাংলা শিল্পসাহিত্যের জগতে সাম্প্রতিক সময়ের এক উজ্বল মুখ, ইতোমধ্যে যার ৬ টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, যার প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন ভাব ও ভিন্ন বিষয়ের নির্মিতি ব্যাঞ্জনায় অনন্যসাধারণ হয়ে দাগ কেটেছে পাঠক হৃদয়ে, বোদ্ধাশ্রেনীর মন ও মননে। এ কবি বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতেও কবিতা লিখেন যা, আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, জার্মানি সহ বিভিন্ন দেশের সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর প্রথম ইংরেজী উপন্যাস “নো ম্যান” প্রকাশের অপেক্ষায়। অনুবাদ করেছেন মিরোস্লাভ হলুভ, জন ডান, উইলিয়াম ব্লেইক, ইয়াং লি সহ অনেকের কবিতা।
কবি’র প্রথম বই ব্রহ্মপুত্র যেখানে ব্রহ্মপুত্রকে উপজীব্য করেই পুরো একটি কাব্য রচিত, যার ফলশ্রুতিতে ব্রহ্মপুত্রের কবি হিসেবে খ্যাত নীহার লিখন।
কিংবদন্তির সাথে এখানে থাকছে তাঁর সাথে সংক্ষিপ্ত কথোপকথন, তার সাথে কথোপকথনে থাকছে কিংবদন্তি সম্পাদক কবি সৌহার্য্য ওসমান:-
ওসমান : কেমন আছেন?
নীহার : জ্বী ভালো আছি, আপনি ভালোতো?
ওসমান : জ্বী ভালো, এই মূহুর্তে কী নিয়ে ব্যস্ত আছেন, মানে কী করছেন
নীহার : আসলে খুব স্পেসিফিকেলি একটা ভাব বা ভাবনা বা কাজে আমি থাকি না কখনোই, এটা আমার ভালো বা খারাপ অভ্যাস, তা যেভাবেই দেখেন, আমি একসাথে অনেকগুলো কাজ করে অভ্যস্ত, মাল্টি টাস্কারের মতোই, এমনকি রিডার হিসেবেও আমি ৩/৪ টা বই এক সাথে শুরু করি, যেমন ধরেন কবিতা পড়তে পড়তে যদি বোরডেমে ভূগছি বলে মনে হয়, তখনই ওটা রেখে দিয়ে কোনো প্রবন্ধের বইটি বা অন্য কোনো একটা জনরায় প্রবেশ ,বা গান বা মুভি দেখা এভাবেই সময় যায়, অনুরূপ ভাবে লেখার ক্ষেত্রেও ঠিক একই ব্যপারটা ঘটে, তবে সব কিছুর মধ্যে লেখালেখির ক্ষেত্রে কবিতা কখনোই জোর করে লেখা যায় না বলেই গল্প বা অন্য কোনো লেখার ফাকেই কবিতার জন্যেই অন্তর্নিহিত আর সার্বক্ষনিক একটা টানতো থাকেই, যেটা অবচেতনেই ক্রিয়ারত থাকে
ওসমান: তার মানে বলতে চাচ্ছেন কবিতা জোর করে লেখা যায় না, মানে কবিতাকি কেবলই তাহলে অদৃশ্য কোনো ইশারায় ন্যস্ত কোনো শিল্পই?
নীহার: না, হিসাবটা এতো সরল কিছুও না, বরং এক সার্বক্ষনিক অন্তর্নিহিত টানের কথাই আমি মনে করি, যা থেকে নিস্তার থাকে না কোনো কবির, সেটাই তার মূল বোধ , যা এমন একটি প্রবাহটির মতো যা সর্বগ্রাসী, যখন সে প্রবলে প্রবাহিত হয় তখন না লিখে আপনি থাকতে পারবেন না; এখানেই কবিতা অপরাপর সকল সাহিত্য মাধ্যম থেকে প্রধাণ হয়ে উঠে একটা উন্মুল তাড়নায়, যেমন কোনো গল্প লেখার কথাই যদি আপনি ধরেন তবে আমি বলবো গল্পে আপনি বুদ হবেন হয়তো এবং তা আপনাকে অনেকাংশেই মূলত একটি রেখারই অভিগমনের চুড়ান্ত এক জগতে বিচরণে ব্যস্ত রাখবে, কিন্তু কবিতার পরিভ্রমনে আপনি নিশ্চিত অর্থেই এমন কোনো একটি নির্দিষ্ট রেখা ধরে যেতে পারবেনা আর এ না পাওয়ায় যে অজস্র অবচেতনার জগতের রেখা বা পথগুলো, তাও কিন্তু আপনারই চিন্তাপদ্ধতির নানান রূপের এক অজস্রতার জগত যা আপনারই কল্পনা পর্যন্ত বিস্তারিত হয়, তাই অনেক সময় আমরা যারা কবিতা লিখি তারাও হয়তো ভুলে যাই নিজেদেরই অজান্তে নিজেদেরই কোনো খুব আপন নিয়ন্ত্রণ, আর কবিতা এখানে দায়িত্ব নেয় সেই বোধ,চিন্তা বা ইচ্ছাগুলোকেই আমাদের তারমতো করে লিখিয়ে নিতে, যা অন্য কোনো মাধ্যম পারে না, অন্তত আমি দেখি নাই আমার ক্ষেত্রে পারতে
ওসমান : দারুণ বলেছেন, আচ্ছা এজন্যেই বোধহয় আপনার কবিতা এতো বৈচিত্র্যময়, যেখানে ব্রহ্মপুত্র থেকে শুরু করে ব্ল্যাকহোল, বা বনমোরগ বা বাবা, কিম্বা আপেল নীরবতার পাশাপাশি মনসিজ…
নীহার: অবধারিতভাবেই তো আসা উচিত, তাই নয় কি, কারণ আপনি বা আপনার বোধ যা কবিতায় সতত ভ্রমন করছে, তা একটি জায়গায় আটকে থাকবেনাতো, হ্যাঁ যদি কেউ হাঁটতে না পারে, তা অন্য হিসাব, হা হা হা
ওসমান : আপনার প্রত্যেকটা বইয়ের থেকে পঞ্চম কবিতার বইটির কাব্য ভাষা ও নির্মিতি বেশ আলাদাই লেগেছে, এ সম্পর্কে আপনার অভিমত কী জানতে চাই, বা এই বইটি নিয়ে বোধহয় একটু কমই আলোচনা হয়েছে মনে হয়, যদিও বইটতে একটি দীর্ঘকবিতা ১৮৮ পঙ্ক্তির পারাবত সহ, রাঁজহাস, বা অন্যান্য কবিতাই বেশ ভালো কাজই বলে জ্ঞান করি
নীহার: হ্যাঁ, বইটি ২০২০ এর মেলায় কবি মানস থেকে মেলার শেষ দুদিন সময়ে স্টলে এসেছিলো, আর সে মেলাতেই ‘ বৈভব’ থেকে প্রথম দিন থেকেই থাকা পিনাকী ধনুক বইটির বহুল প্রচারের আড়ালে চলে গিয়েছিলো বলেই আমার অভিমত, আমাদের দেশে এখনো অনেকেই এমন ভাবেন যে এক মেলায় একাধিক কবিতার বই আসাটা রিস্কিই, যদিও কবি হিসেবে সেসব বিষয় নিয়ে আমার ভাবার কিছু আছে বলে মনে করি না, বরং আমি প্রতিনিয়ত ভিন্ন ভিন্ন ভাব ব্যাঞ্জনা, ও চিন্তায় কবিতা লিখতে চেয়েছি, এবং বস্তুত যার প্রতিফলন টের পাই আমার কবিতা সম্ভারে, আমি সব সময় চেষ্ট করি একটি স্পেসিফিক গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলোর মেজাজে যতোটা সম্ভব একটা পরম্পরাগত সাজুয্যতায় রাখতে, তা বিষয় বা অন্য যে কোনো বিচারেই, কিন্তু একজন কবিতো আর ৫০/৬০ টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত একটি কবিতার বইয়েই অখন্ডভাবে বা পূর্নাঙ্গবোধে নিজেকে লিখতে পারে না, এবং তা একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সময়কে দেখার ক্ষেত্রেও এটি কোনো যুতসই কথা না, তাই আমি চেয়েছি যতোটা বেশী পরিসর নিজের জন্যে পেতে, আপনি খেয়াল করলেই দেখবেন, আমি কখনোই তা বিষয়ই বলেন আর ভাবে নিজেকে আটকে ফেলতে চাইনি কোনো নির্দিষ্ট একটি গণ্ডিতে, তাই ২০২০ এর মেলাতেও ঠিক ২০১৭ এর মতোই দুটো বই ছিলো, এবং এবারের করোনাক্রান্ত মেলাটিতেও আমার নতুন পৃথিবীর প্রথম বন মোরগ বইটির পাশাপাশি আরেকটি কবিতার বই ” মন ধুল দোল ” আসার কথা থাকলেও শেষতক আসে নাই মেলার পরিস্থিতি বিবেচনায় এনেই, তো যা বলছিলেন, ২০২০ এর মেলায় আমার পঞ্চম বই মনসিজ বাগানের শ্বেত’এ আমি চেয়েছিলাম, প্রচলিত ছন্দাশ্রয়ী, বিশেষ করে চার মাত্রার স্বরবৃত্তীয় ধাঁচে অন্তমিল রেখে কিছু কবিতা লেখার পাশাপাশি অক্ষরবৃত্ত বা মাত্রাবৃত্তেও কিছু কাজ করতে, তবে এসবতো কেবলই প্রকরণগত ব্যাপার যা কখনোই আমার কাছে মুখ্যত কিছু বলে লাগে না, তারচে বরং এই বইটিতে আমি একটা সুফির দর্শনে পৃথিবীর সত্য ও সত্তাকে দেখতে চেয়েছি, পাঠকের স্বার্থেই পুরান ও মিথের অজস্র চরিত্র থেকে শুরু করে ব্রাত্য অথচ খুব প্রাসঙ্গিক অজস্র ব্যক্তি বা শব্দকে সাথে করেই
ওসমান: নতুন পৃথিবীর প্রথম বনমোরগ সিরিজটিতে আপনাকে যেন আরেক নির্মিতিতে পেলাম, তা এতোসব নীরিক্ষার ভেতর দিয়ে এই যে যাত্রা তাঁর জন্যে নেপথ্যে কী ধরনের প্রস্তুতি আপনার ছিলো তা জানতে চাই
নীহার : প্রস্তুতিতো প্রতিমুহূর্তেরই ব্যাপার,প্রতিদিনকার সাথেই তা আপনার সাথে চেতনে-অবচেতনে বেড়ে উঠে, তা প্রশ্ন করে উত্তরে পাওয়ার মতো বিষয় না এটা, তা আপনিও বোঝেন একজন কবি হিসেবে, তবে হ্যাঁ অনেকেই দেখি আমার সম্পর্কে বলেন “এতো লিখেন কেন ” আমি কোনো জবাব দেই না, আমি জানি না কবিতা কম কে লিখেছেন যারা প্রকৃত অর্থেই আমাদের সামনে কবি হিসেবে হাজির থাকেন, তা সে রুমি,রবী,নেরুদা,জীবনান্দ বা লুইস গ্লিক বা যেইই হোক না কেন!
আর হ্যাঁ, আমি লেখালেখি শুরু করেছিলাম সেই নব্বইয়ের শেষের দিক থেকেই, আর প্রথম বই হয়েছে ২০১৭ তে, মাঝের সময়গুলোর প্রথম দিককার বেশ কিছু বছর বাদ দিলেও, পত্রপত্রিকা বা লিটলম্যাগে নিয়মিত লিখেছি শুন্য দশক বলে চিহ্নিত যা পরবর্তীতে সংস্কার হয়ে প্রথম দশক হয়েছে বোধহয়, তা সেই দশকে বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় লেখা-লেখির চর্চা অব্যাহত ছিলোই, কিন্তু প্রথম বইটি প্রকাশিত হয়েছে আরেকটি দশকের প্রায় শেষের দিকে এসেই অর্থাৎ ২০১৭ তে, এবং এই ব্যাপক সময়ের মধ্যে আমিওতো পারতাম অন্তত দু’এক খান বইয়ের মালিক তখন বনে যেতে, কোনো প্রকাশক আগ্রহ না করলে নিজের অর্থেই বই করারও যথেষ্ট অর্থনৈতিক সামর্থ্যতো ছিলোই বৈকি, কিন্তু যে প্রস্তুতির কথা বললেন সত্যিকার অর্থেই তখনকার সেই ১২/১৪ বছরে আমার সে প্রস্তুতি পূর্নভাবে হয়ে উঠেনি বলেই আমার মনে হয়েছে, তো আজকের দিনে যারা বলেন এতো লিখেন কেন বা এতো বছর বছর বই প্রসব করেন কেন, তারা একটু ঠান্ডা মাথায় এ বিষয়টা ভাবলেই বুঝবেন বলে মনে হয়
ওসমান: আচ্ছা, কথায় কথায় দশকের কথা যেহেতু উঠেই এলো, দশক নিয়ে আপনার কী ভাবনা
নীহার : হয়তো ডেট ইভেন্টগত দিক থেকে এসব দশক-টশকের তাৎপর্য থাকলে থাকতেও পারে, কথা বলার স্বার্থে, তবে প্রকৃত অর্থে কবিতার জন্যে কবিতা আর কবিই মুখ্য,কোন দশক জরুরী না, তবে গৌন কবিদের জন্যে দশক একটা সাইনবোর্ড হতে পারে বোধহয়, হা হা হা
ওসমান : হা হা হা, (হাসি থামিয়ে) আচ্ছা আপনার উপন্যাস “নো ম্যান” ইংরেজিতে কেন?
নীহার: বিশ্বে ইংরেজির রিডার বেশী, তাই সে লোভেই ইংরেজীতেই ফিকশন লেখার স্বপ্ন ছিলো,তা এই লোভটা ক্ষতিকর কিছু হবে না, তাই না?
বহুদিনের লালিত্য সে স্বপ্নটার জন্যেই মূলত ইংরেজিতে, তবে বাংলাতেওতো লেখি, সামনের মেলায় বেঁচে থাকলে আপনাদের হাতে তুলে দিবো “মধুপুর” উপন্যাসটিও, আশীর্বাদ করবেন
ওসমান : নিশ্চই, নীহার লিখন ভালো থাকবেন আপনি
নীহার: জ্বী, আপনিও ভালো থাকবেন