ফুরিয়ে যাওয়া মাঘের কোন এক শেষ বিকালে টানধরা বিবর্ণ শর্ষে খেতের পাশে দীঘল ছায়া নিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম ঝরা খালা নতুন বৌ সেজে কাঁদতে কাঁদতে চড়ে বসেছেন রঙিন শাড়ির ঘের দেয়া নতুন রিকশায়। তখনো জানি না— আসাদ মামা বিষ খেয়ে মরে পড়ে আছেন। মাস খানেক পরে কোন এক চৈত্রের বিকালে যখন পুকুর পাড়ের শিমুল তলায় শিমুল ফুলের লাল জড়িয়ে বুকের ভেতর হাহাকার তোলা বাতাস গা ছুঁয়ে দূরে কোথাও বয়ে যাচ্ছিলো তখন ঝরা খালা এসে নামেন একটা ময়লা বিবর্ণ শাড়ির ঘের দেয়া পুরনো রিকশা থেকে। তারপর উচ্ছ্বল ঝরা খালাকে অনেক দিন ম্লান ও মূক হয়ে বেঁচে থাকতে দেখেছি ঠিকই— কিন্তু সেটা ছিলো বিভ্রম।
২.
ঝরা খালার যখন বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো আর আসাদ মামা তখনো ইন্টারমিডিয়েটে, তখন ঝরা খালা প্রচুর জর্দা দিয়ে পান খেয়ে খেয়ে মুখ লাল করে ফেলতেন। তার ফর্সা মুখে পানে লাল ঠোঁট দুটি রক্ত মাখা মনে হতো। অল্পতেই হেসে উঠতেন ঝরা খালা। ভাবতাম — এই ভয়ংকর মন খারাপের দিনেও এইভাবে ঝরা খালা কেন হেসে উঠেন! কিন্তু সব বোঝা যেত তার অপ্রকৃতস্থ অস্থির দুটি চোখে গভীর শূন্যতা দেখে। আসাদ মামা তখন একটার পর একটা বিড়ি খেয়ে যেতেন। তিনি গায়ে কাঁথা জড়িয়ে ধান শুকানোর খলায় রোদে বসে বিড়ি টেনে টেনে কেন যেন মুচকি মুচকি হাসতেন। শুধু অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপতো তার বিড়ি ধরা আঙুল দুটো।
৩.
জৈষ্ঠ্যের খরতাপে বাতাসে মাটি পোড়া গন্ধ মেশা কোন এক দুপুরে ধান খেতে একা দাঁড়িয়ে থাকা জারুল গাছের ছায়ায় একটা শালিকপাখিকে গুলতি দিয়ে মেরে ফেলার অপরাধে মিজান মামাকে আসাদ মামা ঘুষি মারেন। মরা শালিকের শোকে আসাদ মামার চোখে অশ্রু চলে আসে। অথচ গুলতি দিয়ে পাখি শিকারে আসাদ মামার খ্যাতি ছিলো খুব। দোয়েল, ঘুঘু, শালিক এমন কি বকও শিকার করে এনেছেন কত! না, মার্কেজের গল্পে যেমনটি দেখি— ছুঁয়ে দিলেই কাচ রঙ্গিন হয়ে ওঠার মতো আসাদ মামার চোখ থেকে লাল বা নীল রঙের কোন অশ্রু গড়ায় নি। অশ্রু অশ্রুর মতোই ছিলো। যেমনটি থাকে। তবু আসাদ মামা ক্ষোভ বা অভিমানে বাড়ির দিকে চলে গেলে লুঙ্গির কোঁচায় রাখা প্যাকেট থেকে বিড়ি বের করে ধরিয়ে ধূঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আসাদ মামার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছোট মামা বলেন— আসাদ প্রেমে পড়ছে। এ দিকে ঝরা খালার চোখ থেকে কাজল সরে না— তার দীঘল খোলা চুলের চারপাশে বাতাস সুগন্ধে ম-ম করে। জৈষ্ঠ্যের বৃষ্টিহীন খরতাপেও তার বাগানের ফুলগাছগুলো ফুলে ফুলে ভরে থাকে। আর ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ায় বসন্তের প্রজাপতিগুলো।
আসাদ প্রেমে পড়ছে। এ দিকে ঝরা খালার চোখ থেকে কাজল সরে না— তার দীঘল খোলা চুলের চারপাশে বাতাস সুগন্ধে ম-ম করে। জৈষ্ঠ্যের বৃষ্টিহীন খরতাপেও তার বাগানের ফুলগাছগুলো ফুলে ফুলে ভরে থাকে। আর ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ায় বসন্তের প্রজাপতিগুলো।
৪.
সেবার শীতেও স্বৈরাচার বিরোধী স্লোগ্নানে উত্তাল দেশ। হিমালয় থেকে হিম নিয়ে আসা হিমেল বাতাসও উত্তপ্ত হয় ওঠে ক্রোধে। চেয়ারম্যান বাড়ির পুরনো পেপারে নূরহোসেনের বুকে-পিঠে স্বপ্নের নাম লেখা দেখে কিনা জানা যায় না আসাদ মামাও তার বুকের বাম পাশে এসিডে লিখে ফেলেন ঝরা খালার নাম। আর সেখান থেকে কেবল সুগন্ধ ছড়ায়। প্রেমতো সুগন্ধী-আতর, তাই সকলে টের পেয়ে যায়— লুকানো যায় না খুব একটা। আসাদ মামার বাবা শাসিয়ে দেন— সাবধান, কখনোই মেনে নেয়া হবে না এইসব প্রেম-আদিখ্যেতা। ঝরাতো বোনের মতো। দূরের তো কেউ না। বাবার চাচাতো ভাইয়ের মেয়ের সাথে এইসব! লজ্জা নাই আসাদ মামার! আর ঝরাখালার বাগানের ফুলগুলো এতো উজ্জ্বল হয়ে ফুটে— মৌমাছির গুঞ্জন, পাখির কলতান তাকে ঘিরে— বুঝে ফেলেন ঝরাখালার মা। আর রটে যাওয়া আসাদ মামার বুকে লেখা ঝরা খালার নাম শুনে তিনি সাফ জানিয়ে দেন— ধাঙ্গি মাগী প্রেম করার আর লাঙ নাই, তাই বলে আসাদের সাথে— ছি ছি! যদি ঝরাখালা আসাদ মামার সাথে কিছু করে বসেন— পালিয়ে যাওয়ার চিন্তাও করে থাকেন, তবে জেনে রাখুক গলায় দড়ি দিবে ঝরাখালার মা।
৫.
আসাদ মামা যেদিন বিষ খেলেন সেদিন বিকালে একই সাথে আকাশে ছিলো চাঁদ ও সূর্য। যতক্ষণ সূর্য থাকে ততক্ষণ চাঁদ ম্লান, শাদা এক ছাপ কেবল আকাশে। সূর্য ডুবে যাবার পর চাঁদ জেগে ওঠে। তখন জোছনা ততো গাঢ়ো হয়ে উঠেনি— হালকা কুয়াশা জোছনা খেয়ে ফেলেছিলো বোধ হয়। সেই সন্ধ্যারাতে জানা যায়— আসাদ মামা বিষ খেয়ে মরে পড়ে আছেন তার নিজের বিছানায়। আসাদ মামার বাবা ছেলের লাশ জড়িয়ে ডুকরে কাঁদেন— বাপ, বাপরে আমার, আসাদরে সোনাচান। তারও মাসদুয়েক পর ঝরাখালা তার শ্বশুড়বাড়ি থেকে ফেরত এসে চুপচাপ অনুভূতিহীন বেঁচে থাকতে থাকতে একদিন ভোরে গলায় দড়ি দিলে ঝরাখালার মা-বাবার পাশে আর জনকেও বিলাপ পেরে কাঁদতে দেখি—আসাদ মামার বাবা— কাঁদেন— ও মা, মারে আমার, ঝরা সোনাচান। আসাদ মামা মরে যাওয়ার পর তার লাশ নিয়ে পিতার গভীর আবেগের বিষাদ যে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন আসাদ মামার বাবা;
— ও মা, মারে আমার, ঝরা সোনাচান। আসাদ মামা মরে যাওয়ার পর তার লাশ নিয়ে পিতার গভীর আবেগের বিষাদ যে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন আসাদ মামার বাবা;
ঝরাখালার লাশ নিয়ে তার সেই একই গভীরতার বিষাদ কান্না বাতাসকে গোপন কিছু প্রকাশ করার ইঙ্গিত দেয়। আসাদ মামা আর ঝরা খালার প্রেমের বিষাদ-ভারী বুকে আর কোন সন্দেহ তুলে নিতে না চাইলেও আমরা বুঝে যাই কেন আসাদ মামার বাবা আর ঝরাখালার মা তাদের এই সম্পর্ককে মেনে নিতে চায়নি। যদিও গোপন থাকে না আসাদ মামার বাবার গভীর কান্নায় যে আসাদ মামার মতো ঝরাখালাও তারই ঔরসজাত। তবুও আমরা এইসব মনে নেই না। আমাদের মনে আসাদ মামা ও ঝরাখালার বিষাদ পরিণতি ঘন হয়ে জমে। তারপর পৃথিবীর কোন কোকিল আর কোনদিন এই দিকে গান গায় নি। বাতাস তার সুগন্ধ হারিয়েছে।