আজ কোজাগরী পূর্ণিমা। শুক্লপক্ষের আশ্বিনী রাতের আকাশটা অমল দ্যুতিতে ঠাসা। স্নিগ্ধ আলোচ্ছটায় চারপাশে যেন কৌমুদী-স্নানের উৎসব চলছে। কলোনির সামনের গলির শিউলি-ছাতিমের ঝাড় থেকে সুমিষ্ট সুবাস আসছে। সুমন্দ হাওয়ার পেলবতায় আর প্রসূনের পরিমল-মৌতাতে চারপাশ যেন উদ্বেল। সারা চরাচর যেন অনেকটাই চুপচাপ-নীরব-নিথর। মাঝে মাঝে নিসর্গের সেই মৌনতা ভাঙছে পাশের মন্দিরের শঙ্খের বিরতি মাফিক মন্দ্রিত ছন্দে।
কলোনিরসর্ব উত্তরের বাসাটাই আমাদের। বাসার ঠিক পেছনের একপাশে লতা-গুল্মের ঝোপ। আরেক পাশে হাতে গোনা কয়টা ফুলের গাছ। এখানে সেখানে ইচ্ছেমতো লাগানো অবিন্যস্ত গাছগুলো দেখে তাকে ফুল-মালঞ্চ বললে অত্যুক্তিই হবে। এর মধ্যে ছাতিম গাছটা ভরে আছে শ্বেত-শুভ্র পুষ্পগুচ্ছে। একটি গাছ লাল রক্তজবার। আর সিত-কমলার অঞ্জন মেখে চক চক করে ডাগর নেত্রে চেয়ে আছে শিউলির বড় ঝাড়টা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘড়ির কাঁটা বারোটা স্পর্শ করবে। রাত বাড়লেও বিশেষ একটা কারণে ঘুমের আয়োজনটা আজ একটু পরেই হবে।এই মুহূর্তে জানালার মরচে পড়া লালচে গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আনমনে আলোর খেলা দেখছি। তারপরও চোখ জোড়া ভীষণ নিদালু। কিন্তু মনটা ভারী হরষিত,শিহরিত, উল্লসিত। মাঝে মাঝে কী সব ভেবে একা একাই মুখ টিপে হাসছি। ঠিক যেন শরমে বিভাস অবুঝ বালকের মতো!
কলোনির এই বাসাটা একটা ব্যাচেলর মেস। তিনতলার এই ফ্লোরে আমি ছাড়াও থাকে আরো পাঁচ জন। এর মধ্যে রায়হান, ডারল আর নাঈম আমার বন্ধু। অন্য দুজন হলো খোকন আর সাকিব। ডারল আর খোকন আবার সম্পর্কে মামা-ভাগ্নে। আর সাকিব খোকনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তবে আমাদের পারস্পরিক হৃদ্যতা আর অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব যেন ইতোমধ্যেই জাগতিক সকল সম্পর্কের ঊর্ধ্বে স্থান করে নিয়েছে।
মেসে উঠার পর একটা বিষয় আমাদের মাঝে বিশেষ রূপ পরিগ্রহ করেছে। সেটি হল জন্মদিন উদযাপন। কারো জন্মদিন আসলেই দেদারছে আয়োজন চলে। রাত বারোটায় কেক কাটা দিয়ে শুরু হয় শুভ উদ্বোধন। সাথে থাকে মোমবাতি প্রজ্বলন উৎসব আর রঙ-বেরঙের বেলুন ফোটানো। ল্যাপটপে বেজে চলে মাইলসের সেই বিখ্যাত গান ‘আজ জন্মদিন তোমার’। সহসাই এক চিলতে শৈশব যেন উঁকিদিয়ে যায়‘বর্ণহীন’ যৌবনে। দুপুরে থাকে মধ্যবিত্তের রাজভোজ–পোলাও আর মাংস। সাথে থাকে সুরেশ খাঁটি সরিষার তেলে পোড়া বেগুন ভাজা। সবই তৈরি হয় আমাদের বুয়া রহিমা খালার হাতে। রাতে চলে যাই পুরান ঢাকার কোন এক রেস্টুরেন্টে। ডিনারের বিলটা কার দিতে হয়,তা অবশ্য এখানে না বললেও চলে।
জন্মদিনে একেকজনকে আমরা একেক ধরনের বিস্ময় উপহার দেই। এই যেমন বারোটা বাজার আগেই সদলবলে ঘুমের ভান করে বিছানায় গা এলিয়ে দেই। হঠাৎ রাত তিনটায় উঠে শুরু করি উদযাপন। কখনো রাত বারোটায় ঢাকার নানা প্রান্তে থাকা বন্ধুদের হাজির করি। কখনো বা কেক-মিষ্টি কিনে খাটের নিচে বা অন্য কোথাও লুকিয়ে রাখি।উদ্দেশ্য,যার জন্মদিন সে যেন ঘুণাক্ষরেও কোন কিছু টের না পায়। তাকে আড়াল করেই চলে আমাদের সমস্তযজ্ঞ, যাবতীয় আয়োজন। তবে একথা হয়ত আমার মেসবাসীরাও একবাক্যে স্বীকার করবে যে,এসকল আয়োজনে আমার ভূমিকাটাই থাকে ঢের ঢের বেশি।
আজ এখনো আমার না ঘুমাতে যাওয়ার কারণটা আর কিছুই না। একটু পরেই যে আমার জন্মদিন! মনে মনে ভাবছি, আজ হয়ত মেসবাসীরা আমার জন্য রাজ্যের সব আয়োজন করেছে। সন্ধ্যায় কলোনি সংলগ্ন টং দোকানে চা খেতে যাওয়ার সময় খোকন যেমন বলছিল,“মামা, খালা বলেছেন দেশলাই শেষ। বাইরে যখন যাচ্ছেনই, ফেরার সময় দেশলাই কিনে নিয়ে আসবেন।” মনে মনে বললাম, দেশলাইযে শুধু গ্যাসের চুলা জ্বালাতেই নয়, জন্মদিনের মোমবাতি জ্বালাতেও লাগে, তা কি আর আমি জানিনে! বুদ্ধু কোথাকার! একটু মুচকি হেসে বললাম, “ঠিক আছে”। সাথে সাথে সাকিব বলে উঠল,“মামা, আমার জন্য একটা কোক নিয়ে আসবেন। দুপুরে এক বন্ধুর বাসায় দাওয়াত ছিল। সব ছিল, শুধু কোক ছাড়া। কোক খেতে ইচ্ছে করছে।” মনে মনে ওকে আরো গবেট-মূর্খ ভাবলাম। আরে, আজ রাতে যে তোরা ঘটা করে আমার জন্মদিন পালন করবি, এভাবে আকারে-ইঙ্গিতে আমাকে না বোঝালেও তো পারিস! শত হলেও জন্মদিনে ‘সারপ্রাইজ’ পেতে কে না চায়!
কলোনির সামনের টং দোকানের চা। মলিন কাপে দেয়া, আধা ধোয়া, আদা-লবঙ্গের এই চায়ের মজাই আলাদা। চুমুক দিতেই পেছন থেকে রায়হান আমার চোখ টিপে ধরল। ওর দিকে তাকাতেই মনটা বেশ ভালো হয়ে গেল। অফিস করে ফিরছিল। বেচারা ফেরার পথে হাত ভরে নিয়ে এসেছে নানা পদের মিষ্টিরপ্যাকেট। অবশ্য আমি তাতে মনে মনে একটু লজ্জাও পেলাম। আমার জন্মদিনের জন্য এত মিষ্টি! পাগলগুলো যে কী করছে। আমার জন্য এত আয়োজন! আমার আনন্দ যেন আর ধরেই না। রুনা লায়লার মতো আমার ঘড়ির কাঁটাও যেন তখন মেপে মেপে চলছে। ভাবছি ‘কখন বাজে বারোটা? কখন বাজে বারোটা?’ তবে রায়হানটাও নির্বোধ! ‘বার্থ ডে বয়’-কে এভাবে সব কিছু প্রকাশ করে দিতে হয়? মিষ্টি এনেছে ভালো কথা, বারোটার পর দেখালেই পারত! নাহ। এরা আমার কাছ থেকে ‘সারপ্রাইজ’ দেয়ার বিষয়টা এখনো আয়ত্ত করতে পারল না। অবশেষে দুজনে মিলে চা খেয়ে, দেশলাই আর দুই লিটারের একটা কোক কিনে বাসায় ফিরলাম।
বাসায় ফিরে দেখি আরেক এলাহি কাণ্ড। ডারলের হাতে আড়ং-এর অনিন্দ্য নকশা করা মেরুন একটা পাঞ্জাবি। আমার জন্য হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছে। কাল নাকি ওর এক সহকর্মীর জন্মদিন। উনার জন্য কিনেছে। ওর ওই সহকর্মীর উচ্চতা নাকি আমার সমান। তাই আমার সাথে মেপে-জোখে নিশ্চিত হবে। অবশ্য, আমার কী আর বোঝার বাকী থাকে, যে এটা আসলে কার জন্য কেনা! মনে মনে পাঞ্জাবিটা আমার দারুণ পছন্দ হলো। ভাবলাম কাল সকালেই পাঞ্জাবিটা পরে সারা ঢাকা শহর ঘুরে বেড়াব। তবে, অন্যদের মতো এই ডারলটাও কিভাবে একই রকম বোকামি করল! উপহার দিবি ঠিক আছে, কিন্তু ‘সারপ্রাইজ’ বলেও তোদুনিয়াতে কিছু একটা আছে!
“এদের এসব পাগলামি আর কীর্তিকলাপ দেখে মনে মনে আমার আনন্দ যেন নদী থেকে সাগর, সাগর থেকে মহাসাগরের রূপ নিল। তবে সবার মধ্যে নাঈমটাই যেন বেশি বলদ”
একটু পরেই নাঈমের ডাক শুনতে পেলাম। ওর রুমে ঢুকতেই টেবিলে দেখি এক গোছা রজনীগন্ধা। অবশ্য রজনীগন্ধা যে আমার সবচেয়ে প্রিয় ফুল, সেটা আমার বন্ধুরা বেশ ভালো করেই জানে। নাঈম সমরেশের ‘গোয়েন্দা অশোক ঠাকুর সমগ্র-২’আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল,“দোস্ত, তোর হবু ভাবীকে নিয়ে বিকেলে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। ফেরার সময় শাহবাগ থেকে কিছু ফুল আর নীলক্ষেত থেকে এই বইটা কিনে দিল। জানিসই তো, আমার বই পড়ার অভ্যাস একেবারেই নেই। তুইতো আবার খুব পড়িস। এইটাপড়ে আমাকে একটু সারমর্ম বলিস।উনি আবার যে কোন সময় আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারে।” এদের এসব পাগলামি আর কীর্তিকলাপ দেখে মনে মনে আমার আনন্দ যেন নদী থেকে সাগর, সাগর থেকে মহাসাগরের রূপ নিল। তবে সবার মধ্যে নাঈমটাই যেন বেশি বলদ। তা না হলে কি জন্মদিনের আগেই কেউ কাউকে এভাবে গিফট করে বসে!
বারোটা বাজল।সবাই অবশ্য তার আগেই লাইট বন্ধ করে যে যার রুমে ঘুমাতে গেছে। এবার পালা আমার অপেক্ষার,বিস্মিত হওয়ার, কেক কাটার, ‘আজ জন্মদিন তোমার’ গান শোনার। বারোটা থেকে একটা বেজে গেল। মনে মনে হাসতে লাগলাম। বুদ্ধুগুলো দারুণ অভিনয় করছে। এবার হয়ত আরও গভীর রাতে আমাকে ‘সারপ্রাইজ’ দেবার পরিকল্পনা করেছে।
ভাবলাম, কেকটা খুঁজে বের করে আমি নিজেই লুকিয়ে রাখি। তাতে কেক না পেয়ে উল্টো ওরাই বিস্মিত হবে। ফ্রিজে কেক খুঁজলাম। রায়হানের সেই মিষ্টি পেলাম,কিন্তু কেকতো নাই! আরো কয়েকটা সম্ভাব্য জায়গা ভালো করে খুঁজে দেখলাম। নাহ,নাই। হয়তবা ওদের কারো রুমে বিশেষ ব্যবস্থায় লুকিয়ে রেখেছে। আহা! বেচারারা আমাকে সারপ্রাইজ দেবার জন্য কত প্লানই না করেছে!
অগত্যা আমি আমার রুমে গিয়ে বিছানায় গা’টা হালকা এলিয়ে দিলাম। আনন্দের আতিশয্যে অনেক আগেই ঘুম পালিয়ে গেছে।এদিকে কখন এসে পাগলগুলো যে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে! নাহ। সবাই দেখছি তুখোড় অভিনয় করছে। এপাশ-ওপাশ করতে করতেই টের পেলাম নাঈমের নাসিকা-গর্জন ক্রমান্বয়ে রুটিনমাফিক ভূমিকম্পে রূপ নিয়েছে। খোকনের নাক চিকন সুরের বাঁশি বাজাচ্ছে।আর সাকিব স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ফুঁস-ফুঁস করে দম ছাড়ছে।
মাঝে মাঝেই ওদের রুম গুলোতে উঁকি-ঝুঁকি মারতে লাগলাম। এভাবেই কেটে গেল কয়েক ঘণ্টা। ততক্ষণে আমি নিশ্চিত হয়ে গেছি, এবারের সারপ্রাইজটা আমি হয়ত সবার কাছ থেকে ঘুম ভাঙলেই পেতে যাচ্ছি – যা হবে সবার চেয়ে ব্যতিক্রম।
ভোর তখন ছয়টা। আনন্দে-উত্তেজনায়-রোমাঞ্চে এতগুলো ঘণ্টা যে কখন কেটে গেল টেরই পাইনি। অকস্মাৎ কলিং বেল বেজে উঠল। দোর খুলতেই দেখি রায়হানের বাবা ও ছোট ভাই শাওন। বরিশাল থেকে পুরোটা রাত তারা লঞ্চে করে এসেছেন। টিভির রুমে তাদেরকে বসিয়ে রায়হানকে ডাকলাম।
সাতটা বাজল। একে একে সবাই ঘুম থেকে উঠল। আমি মুচকি মুচকি হাসতে থাকলাম। ভাবলাম, আর কত ‘সারপ্রাইজ’ দিবি? এবার একটু কেকটা কাট।
কিছুক্ষণ পর রহিমা খালা আসলেন। এসেই আমাকে সামনে পেয়ে বললেন,“মামা, দেশলাই নাই। খোকন মামাকে গতকাল আনতে বলেছিলাম। আনছে নাকি, জানেন? নাহলে তো নাস্তা বানাতে পারব না।” আমার চক্ষু তখন ছানাবড়া। প্যাকেট থেকে একটা দেশলাই বের করেখালার হাতে দিয়ে বললাম,“খালা, এই নিন দেশলাই।”
ওদিকে ডারল প্যান্ট-শার্ট পরে তড়িঘড়ি করে অফিসের দিকে ছুটছে। হাতে পাঞ্জাবির ওই ব্যাগ। খালাকে ডেকে বলল,“খালা, আজ রাতে আমি খাব না। আমার এক কলিগের বাসায় দাওয়াত আছে।”
কিছুক্ষণ পর দেখলাম রায়হান নতুন সুন্দর একটা পাঞ্জাবি পরেছে। আংকেল, শাওনও কোথাও যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। জিজ্ঞেস করতেই রায়হানের উত্তর,“দোস্ত, তোদের কাউকেই বলা হয় নাই। আজকে নিশুদের বাসায় আব্বাকে নিয়ে যাচ্ছি। কোন প্রোগ্রাম না, নিশুকে শুধু আংটি পরাবে। বিয়ের প্রোগ্রাম অনেক পরে হবে। তখন তো তোরাই সব করবি।” বের হওয়ার সময় দুই ভাইয়ের হাতে সেই বাহারি মিষ্টির প্যাকেট! “আমার বলার কিছু ছিল না,না-গো,আমার বলার কিছু ছিল না। চেয়ে চেয়ে দেখলাম, তুমি চলে গেলে” …আমার মিষ্টির প্যাকেট।
একে একে সবাই বাসা থেকে বের হয়ে গেল। ততক্ষণে আমি বিস্ময়াভিভূত। কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে ঠায় বসে রইলাম। পরেটিভির রুমে গিয়ে টিভি দেখতে বসলাম। স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই দেখি দুই লিটার কোকের খালি বোতলটাও পরে আছে টিভি’র পাশের এক কোনায়!
অবশেষে লজ্জায়-ক্ষোভে-অভিমানে-কষ্টে মুঠোফোনখানা হাতে তুলে নিলাম। ওই পাঁচজনের একটা গ্রুপ খুলে টেক্সট করলাম,“Today is my birthday. Please wish me!”বাকীটা ইতিহাস। তবে,সেদিন থেকে জগজিৎ সিং-এর এই গানটা আমার প্রিয় গানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলো – “বেশি কিছু আশা করা ভুল, বুঝলাম আমি এতদিনে।”