কলেজে মোট চারটে ক্লাস ছিলো আজ। দুপুরের পর পরপর দু’টো ক্লাস নিয়ে ঘরে ফিরে ফ্যান চালিয়ে, ঘেমো পাঞ্জাবিটা আলনার দিকে ছুঁড়ে দ্যায় শান্তনু। তারপর সটান শুয়ে পড়ে। আশ্বিনের মাঝামাঝি। কোথায় পরিষ্কার, ঘন নীল আকাশে তুলো শাদা মেঘ উড়তে থাকবে, তা নয়। বরং পিচকালো মেঘ জমে আছে। বৃষ্টি নামি নামি করেও নামছে না। ভ্যাপসা গরমে জান পেরেশান। অথচ, ঢাকায় সকাল থেকেই টানা বৃষ্টি হচ্ছে। ফেসবুকের বন্ধুদের কল্যাণে ঢাকার পথঘাটের ছবি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে—কোমর-ডুব জলের শান্তিনগর-আদাবর-পান্থপথ-নিকুঞ্জ কিংবা গোঁড়ালি-ডুব জলের ক্যাম্পাসের।
মফস্বলের কলেজ মাস্টারিটার খুব বেশিদিন হয়নি। মাস দুয়েক মাত্র। শহরটা সবে চেনা হয়ে উঠতে শুরু করেছে আর এ অঞ্চলের কথ্য ভাষার মর্মোদ্ধার করতেও পারছে সেইসাথে। কানে সয়ে আসছে লোকেদের উচ্চঃস্বরে কথা বলবার ভঙ্গিটিও। শুরুতে সমস্যাই হতো বেশ। শহর আর শহরের ভাষার সাথে পরিচয় গড়ে উঠতে শুরু করলেও ছাত্রছাত্রী, কলিগ ছাড়া অই অর্থে আলাপ হয়নি স্থানীয় কারও সাথে। আড্ডার সম্পর্ক দূর কি বাত! ক্রমে সেটাও হয়ে উঠবে নিশ্চয়ই। এখন অবধি যেহেতু সেরকম কিছু হয়নি, ফলে কলেজ থেকে সোজা বাসাতেই চলে আসে সে সাধারণত। গলির মুখের দোকানে দরকারি জিনিসপত্র, বিশেষত সিগারেট, কিনে নিয়ে বাসায় ঢুকলে আর বের হওয়াহওয়ির সম্ভাবনা বা দরকার কোনওটাই থাকে না বললেই চলে! এরকম নিশ্চিন্তিতে অবসন্ন শান্তনুর ঘুমিয়ে পড়তে বিশেষ বেগ পেতে হয় না।
ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যার মুখে। জানালা খুলে বাইরে তাকালে পেঁপে গাছটার ঘন সবুজ পাতার খাঁজালো কিনার বেয়ে পানির ফোঁটা ঝরতে দেখে আফসোস হলো শান্তনুর। এমন ঘুমে ছিলো যে বৃষ্টিটা দ্যাখার সুযোগই পেলো না। অবশ্য বৃষ্টি দ্যাখার বিলাসিতার চে’ ঘুমটাই জরুরি ছিলো বেশি। সকালে বেরিয়ে, বিকেল তক এই গরমে ছাত্র ঠেঙানোর খাটুনির পর রাতের রান্না, খাওয়া, পরের দিনের ক্লাসের প্রস্তুতি নেওয়া সবই লাটে উঠতো ঘুমটা না হলে। বেশ হালকা এখন মাথাটা।
বৃষ্টির পর আরামদায়ক একটা ঠান্ডাও টের পাওয়া যাচ্ছে। গুটিকয় চড়ুই-শালিক ভেজা শরীর নিয়ে ওড়াউড়ি আর বকবকুনি দুটোই চালিয়ে যাচ্ছে সমান তালে। জানালার পাশে বসে থেকে এইসব দেখলো খানিক শান্তনু।
ঘুম থেকে ওঠার পরের অভ্যেস মাফিক যথারীতি চায়ের তেষ্টা পায়। বিছানা ছেড়ে কিচেনে গিয়ে চুলো জ্বালে শান্তনু।। লবঙ্গ-দারুচিনি সমেত ফোটানো পাতলা লিকারে আদাকুচি আর লেবুর বেশ বড়োসড়ো একটা টুকরো ফেলা এই চা-টা বিশেষ প্রিয় ওর। এ ওর নিজস্ব চা-ও বলা যায়। চায়ে কয়েক দানা নুনও মেশায় যখন! লোকেরা চায়ে নুনটা ঠিক নিতে পারে না। ঘরে বসে মগ ভর্তি চায়ের সাথে একটা সিগ্রেট পোড়ালেও ঠিক মন ভরলো না। মেঘটা এখন আবার জমতে শুরু করেছে। রাতে বেশ ভারী বৃষ্টি-ই নামবে মনে হচ্ছে। আর ঘরে থাকতে ইচ্ছে করছে না। বাইরে বেরোবে যে সেটাও ভাল্লাগবে না। চাইলেই বেরোনো যায়। অন্তত গলির মাথা অবধি তো যাওয়া যায়-ই। মুশকিল হচ্ছে, একা দাঁড়িয়ে চা-সিগ্রেট খাওয়াটা ঠিক হজম করতে পারে না শান্তনু। এক-দু’জন কলিগের সাথে চা-সিগ্রেট চলে বটে, কেউ কেউ থাকেও কাছাকাছিই; কিন্তু, এই সন্ধ্যায় কাউকে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। বাড়িতে কিংবা টিউশনে আছে যে যার মতো। অগত্যা জলগন্ধি হাওয়ার নেশায় ছাদে চলে আসে শান্তনু, সিগ্রেট-লাইটার সমেত।
শহরের এ-দিকটায় ঢাকার মতোই আবাসন গড়ে উঠতে শুরু করেছে সবে। ছাড়া ছাড়া সমাপ্ত বা অর্ধসমাপ্ত বিল্ডিং চারধারে, এখানে-সেখানে এখনো বিস্তর খালি প্লট পড়ে আছে। শান্তনুদের বিল্ডিংটাই যা পাঁচতলা অব্দি উঠে একটা পরিপূর্ণতার স্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছাদটা খোলা নয়। বেশ যত্ন করেই রেলিং দেওয়া হয়েছে। ছাদের খানিকটা জুড়ে বাড়িওয়ালার শখের বাগান দুটো কাগজি লেবু, গুটিকয় গোলাপ, কিছু অর্নামেন্টারি প্ল্যান্টস, একটা হাসনাহেনা আর একটা রোগাপটকা গন্ধরাজেই থেমে গেছে। কাগজি লেবুর ফুল এসেছে বলে ছাদটা সুঘ্রাণে ভরে আছে। পরিষ্কার হাওয়ায় সুঘ্রাণটা কয়েকগুণ বেশি টের পাওয়া যাওয়া যাচ্ছে।
একটা সিগ্রেট জ্বালিয়ে সামনে তাকায় শান্তনু। আধা কিলোর মধ্যেই কীর্তনখোলা। লঞ্চঘাট। আলো জ্বলে উঠেছে সেখানে। মুহুর্মুহু ভোঁওওও শব্দে আকাশে স্থির মেঘেদের চমকে দিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাচ্ছে লঞ্চ। কোনটা ছাড়লো? কীর্তনখোলা নাকি জলপায়রা? শুরুতে বেশ কিছুদিন সন্ধ্যার দিকে লঞ্চঘাটে গিয়ে বসে থেকেছে সে। অই কয়দিনে লঞ্চের নামগুলো মুখস্থ হয়ে গেছে প্রায়। বেশ লাগে লঞ্চের নামগুলো।! এ অঞ্চলের নদীর নামগুলোও যেমন ভীষণ সুন্দর, খেয়াল করেছে শান্তনু। এইসব সুন্দর নদীর বুকে চলা লঞ্চের নামও সুন্দর হবে সেটাই স্বাভাবিক। উল্টো হলেই বরং বেমানান লাগতো। সুন্দর নামওয়ালা এইসব লঞ্চের যেকোনো একটাতে চাপলেই কাল ভোর নাগাদ সদরঘাটে নেমে সকাল-সকাল সেঁজুতির সাথে চা খাওয়া যেতো নীলক্ষেতে—ভাবে শান্তনু।
মাস্টার্স শেষ করে বেশ কয়েক বছর চাকরির পড়াশোনা-পরীক্ষা নিয়েই ছিলো শান্তনু। হল ছেড়েছিলো বছর খানেকের মাথায়। ইউনিভার্সিটির ছাত্রহলগুলোর ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের খুব একটা মাথাব্যথা থাকে না বলে অই অতিরিক্ত বছরখানেক হলে থাকতে পেরেছিলো। অন্য জোরও ছিলো। হয়তো আরও দু’চার বছর কাটিয়ে দিতো পারতো সেই জোরেই। তা না করে হল ছেড়ে লালবাগের এক সরু গলির তস্য সরু বাসায় সাবলেটে একটা ঘর নিয়ে থাকতে শুরু করে সে। যে-করেই হোক একটা ভালো চাকুরি পেতেই হবে—এই ছিলো পণ। সেঁজুতির সাথে পাকাপাকি থাকতে গেলে সেটার দরকারও ছিলো অবশ্যই। সেঁজুতি ওর ডিপার্টমেন্টেরই এক ব্যাচ জুনিয়র। সম্পর্কটা বেশ পুরোনোই ছিলো। সেকেন্ড ইয়ারে শুরু করে টানা ছ’ সাত বছর। ম্যারাথন প্রেম বলা চলে।
ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পরপর ছোটো মামার সাথে দেখা হলে তিনি যে সদুপদেশটি শান্তনুকে দিয়েছিলেন, মানে, প্রেম ও পলিটিক্স থেকে দূরে থেকে মন দিয়ে পড়াশোনা করবার, ক্যারিয়ার গোছাবার—সেটি বিফলে গেছে বলাইবাহুল্য। ছোটো মামার নিজের অভিজ্ঞতাজারিত সদুপদেশ ভাগ্নের কাজে লাগেনি। মানুষ স্বভাবতই নিজে পায়ে হেঁটে অভিজ্ঞ হয়, হতে চায়; পরের অভিজ্ঞতা কমই কাজে লাগে তার।
হলে উঠবার পর, একরকম বাধ্য হয়েই, পলিটিক্সে জড়িয়ে পড়ে শান্তনু। যেহেতু ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের পলিটিক্সে না জড়ালে হলে টিকে থাকা মুশকিল। ধীরে ধীরে পাওয়ার পলিটিক্সের নেশাও পেয়ে বসে তাকে। সে নেশা ছুটতে ছুটতে বেশ দেরি হয়ে যায়। এরমধ্যে পড়াশোনাটা মোটামুটি ঠিকঠাক শেষ করতে পেরেছিলো অবশ্য। রেজাল্ট নেহায়েত খারাপ ছিলো না। বরং বেশ ভালোই বলা যায় সবদিক বিবেচনায়। সেটা কতক নিজের মাথার জোরে, কতক ইউনিভার্সিটির কারিকুলাম ইত্যাদির দুর্বলতার সুযোগে আর বাকিটা সেঁজুতির ক্রমাগত পেছনে লেগে থাকার কল্যাণে। হ্যাঁ, ছোটো মামার উপদেশবাণীর দ্বিতীয় নিষেধও ভেঙেছিলো শান্তনু। সেঁজুতির সাথে প্রেমেও জড়িয়েছিলো। নিষেধ লঙ্ঘনের কোনওটা নিয়েই খুব বেশি খেদ ছিলো না তার মনে। খেদ থাকবেই বা ক্যানো! বেশ তো কেটে যাচ্ছিলো দিন।
পড়াশোনার পাট চুকে গেলেও বছর খানেক ফুরফুরে মেজাজেই কাটে শান্তনুর। ঘোরটা কাটে তারপরই। হঠাৎ করেই টের পায় পলিটিক্সে সেই জায়গাটা তৈরী করতে পারেনি সে যাতে করে চাকরির পেছনে দৌঁড়াতে না হয়, পলিটিক্সকেই ক্যারিয়ার হিশেবে নিতে পারে। বুঝতে পারে, পলিটিক্যাল ক্যারিয়ার আর খুব বেশি দূর এগোবে না তার। এইদিকে বাড়ি থেকে টাকা আসা বন্ধ না হলেও প্রতি মাসে আম্মার বয়ানে আব্বার উদ্বেগ, চাকরির জন্য তাড়া আসতে থাকে। আব্বার রিটায়ারমেন্টের প্রস্তুতি পর্ব চলছিলো। খুব স্বাভাবিকভাবেই এসব ঘটনা সংকুচিত করে. শান্তনুকে। ভয়টা আরও বাড়ে যখন সেঁজুতির বাড়ি থেকেও বিয়ের জন্য চাপ আসতে থাকে।
এদিকে ব্যাচমেটদের অনেকেরই টুকটাক চাকরিবাকরি হয়ে যাচ্ছিলো। তাদের অনেকেই চাকরির বাজারের নাড়িনক্ষত্র বুঝতে পেরে শুরু থেকেই আসল পড়া, মানে, চাকরির পড়াটা পড়তো নিয়ম করে। এদের দেখেছে তো সে—হলের রিডিং রুমে নিয়ম করে পড়তে যাচ্ছে, রাত গভীরে ঝিমুচ্ছে টেবিলেই মাথা রেখে; আবার খুব সকালে উঠেই দৌঁড়ে লাইন দিচ্ছে লাইব্রেরির সামনে। হাসাহাসিও কম করেনি এসব দেখে!
পরিস্থিতি দিনে দিনে আরও খারাপের দিকে যাবে এটা আন্দাজ করেই পলিটিক্স, হল এবং ক্যাম্পাস এই তিনটেই একসাথে ছেড়ে দ্যায় শান্তনু।
টনক নড়বার পর যাকে বলে কাছা বেঁধে নেমে পড়ে শান্তনু। বাইরে বেরোনো বন্ধ করে দেয় একরকম। ঘরেই কাটতে থাকে দিন যদি না পরীক্ষা থাকে। তা সেসব অবশ্য থাকতোই প্রতি শুক্কুর কি শনিবারে। অই উপলক্ষেই বাইরে বেরোনো, বন্ধুদের সাথে যৎকিঞ্চিৎ দ্যাখাসাক্ষাৎ, আড্ডাও হতো। এর বাইরে ডুব-দেওয়া শান্তনুর খোঁজে, উচাটন সেঁজুতি প্রায়ই চলে আসতো শান্তনুর লালবাগের সরু গলির তস্য সরু বাসার সাবলেটের ঘরে।
এইতো গত আষাঢ়ের কথা। সেঁজুতি এলো শেষ বিকেলে, সন্ধ্যার মুখে। ভিজে চুপচুপে জামা, চুল। ঘরে ঢুকে দড়িতে ঝোলানো গামছা দিয়ে মাথা মোছে সেঁজুতি। ‘জামাটা ছেড়ে ফ্যালো,’ শান্তনু বলে, ‘ফ্যানের বাতাসে শুকোবে। ফেরার সময় আর ভেজা জামায় ফিরতে হবে না তাহলে, গলির ওদের বুক টাটিয়ে।’ কোনও কথা না-বলে ভিজে জামাটা ছাড়ে সেঁজুতি।
ঘরের ঢোকা শেষবেলার কমজোরি আলোতে শান্তনু দ্যাখে, মিঠে গোলাপী রঙের ফিতে সেঁটে আছে সেঁজুতির মধুরঙা পিঠে। ওর মেরুদন্ডের অবতল রেখা ধরে কোনওমতে মোছা চুল থেকে ঝরে-পড়া কয়েক বিন্দু জল গড়িয়ে যাচ্ছে খুব আয়েশি ভঙ্গিতে।
গড়ানো জলকণাকে মুক্তোর মতোন মনে হয় শান্তনুর। ‘ওটাও ছাড়ো। ভিজেছে নিশ্চয়ই!’ লোভী হয়ে ওঠে শান্তনু। বাইরে, কার্নিশে বসা, কোনও শৌখিন প্রতিবেশীর পোষা পায়রার উচ্ছ্বসিত গুঞ্জন শোনা যায়।
সেঁজুতি দেওয়ালের দিকে মুখ করে ছিলো। হাত দুটো কায়দা করে পেছনে নেয়, য্যানো যোগাভ্যাস করছে কোনো। একটু পেছনের দিকে ঝুঁকে বেঁকে যায়, তাতে ফিতেটার আঁটুনি ঢিলে হয়ে আসে। হুকটা খুলে ফ্যালে, দুদিকের ফিতে দুটোকে মাঝবরাবর টেনে এনে। হুকখোলা ব্র্যা ধনু-মুক্ত তিরের মতোন ছিটকে সামান্য সামনে যায়। এবং পুরো পিঠ উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। শান্তনুর অসহ্য লাগতে থাকে, ফিসফিসিয়ে ওঠে সে, ‘এদিকে ফেরো, সেঁজুতি!’
সেঁজুতি, ঈষৎ গ্রীবা বাঁকিয়ে, ক্যামোন অদ্ভুত চোখে তাকায় শান্তনুর দিকে।
হঠাৎ-ই সম্বিত ফিরে এলো শান্তনুর। আশ্চর্য! সে তাকিয়ে আছে পাশের বিল্ডিংয়ের চিলেকোঠার জানলার দিকে। আর সত্যি সত্যিই একটি তরুণী মেয়ে খোলা পিঠে দাঁড়িয়ে সেখানে। ঘরে আলো জ্বলছে। ফলে শান্তনু স্পষ্ট দেখতে পায়, মেয়েটি ওর দিকে বেশ ভালোরকম সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। ভাগ্যিস অন্ধকার নেমে এসেছে। ওকে হয়তো দেখতে পাচ্ছে না মেয়েটি! কী লজ্জার ব্যাপার! ছি! ছি!
কিন্তু, ও তো সেঁজুতির কথা ভাবছিলো। মেয়েটি কি তা জানে? জানবে কখনো!
এই মেয়েটিকেই ছাদে ওঠার সময় ফোন-মগ্ন দেখেছিলো শান্তনু। একটা কাঁপুনি আসে শান্তনুর। শরীর ভিজে গেছে। এরইমধ্যে বৃষ্টি নেমেছে আবার। অই মেয়েটি, যেহেতু কুড়ির শুরুর মধ্যেই রয়েছে, অর্থাৎ খেয়ালি টিনএজার বলা যায়, বৃষ্টিতে ভিজেছে। এবং নিজের ঘরে ফিরে ভেজা কাপড় খুলে নগ্নতার আস্বাদন করছিলো আপন খেয়ালে, ঘরে আলো জ্বলছে সেটা চিন্তা না করেই। যখন মনে পড়েছে, বাইরে তাকাতেই পাশের ছাদে শান্তনুর শরীরকে ঘিরে থাকা জমাট অন্ধকার দেখেই অমন সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে!
কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ফিরে, ভেজা কাপড়েই বিছানায় শুয়ে, তীব্র জ্বরের ভেতর ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে শান্তনুর মনে পড়ে—অই দিন সব কিছু হয়ে যাবার পর, শান্তনু যখন সেঁজুতির পদ্মগন্ধা বুকে নাক গুঁজে পড়েছিলো, তখন, শান্তনুর লম্বা চুলে বিলি কাটতে কাটতে সেঁজুতি আসছে শ্রাবণের পয়লায় তার বিয়ের কথাটা জানায়। সেঁজুতির বিয়ে অবধি ঢাকায় থেকেছে শান্তনু। সেটার পর আর থাকতে পারেনি। সহ্য হতো না। সহ্য করা সম্ভবও ছিলো না আসলে শান্তনুর পক্ষে। বায়ান্নো বাজার তিপ্পান্ন গলির শহরটির সবখানে সেঁজুতি ছড়িয়ে ছিলো। তাকে এড়িয়ে যাবে কোথায় সে! হোক না সে সেঁজুতির ছায়া-ই!
ঝুলে থাকা ইন্টারিভিউ, রেজাল্ট, ভালো চাকুরির স্বপ্ন, ভীষণ প্রিয় ক্যাম্পাস, প্রিয় শহর ঢাকার মায়া ও মোহ ছেড়ে সপ্তাহ খানেকের মধ্যে এই মফস্বলে চলে আসে শান্তনু। বেসরকারি কলেজের মাস্টারিতে ঢুকে শ্রেয়তর সম্ভাবনাগুলো নষ্ট করবে কি না এই দোলাচলে দুলবার মতো পরিস্থিতি ছিলো না আর তার। এবং তারপর দু’টো মাস মানে ষাট দিন, মানে চোদ্দোশ’ চল্লিশ ঘণ্টা, মানে ছিয়াশি হাজার চারশ’ মিনিট, মানে কতো সেকেন্ড কতো মুহূর্ত কেটে গেছে—সেই হিশেবটা আর করা হয়ে ওঠে না শান্তনুর!