কবি সাজ্জাদ শরিফ কবিতা ছাড়াও তিনি বিচিত্র বিষয়ে লিখেছেন। অনুবাদও করেছেন অনেক। সাজ্জাদ শরিফ একজন কবি, সাংবাদিক ও অনুবাদক। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা পুরান ঢাকায়। আশির দশকের শুরু থেকে তিনি কবিতা লিখছেন। তিনি দীর্ঘকাল ধরে সাংবাদিক পেশার সাথে যুক্ত রয়েছেন। বর্তমানে তিনি দৈনিক প্রথম আলো- তে কর্মরত। আমার জানা মতে সাজ্জাদ শরিফ খুবই কম কবিতা লিখেছেন। ধারণা করি বিচ্ছিন্নতার কারণে হয়তো হয়ে ওঠেনি। এটাও তার একটা বৈশিষ্ট্য। আর কম লেখা বা বেশি লেখাকে তিনি ম্যাটার করেন না বলে মনে করি। কবি সাজ্জাদ শরিফের কবিতায় বেদনামগ্নতার ভিন্ন ভিন্ন ব্যঞ্জনা পাওয়া যায়। যা পরক্ষণে একজন পাঠকের চিন্তার সামনে প্রতিভাত হয়।
আত্মলীনা
যদিও থাকে একলা ভিড়ে সারাটা বেলা ঘরে
তবুও তার তরল বুকে আকাশ ঝরে পড়ে
মাদুরে বসে আদুরে মেয়ে ব্যথার ভঙ্গিতে
অসহ জল নেয় কেবল এবং তার ধার
স্রোতস্বিনী ভাবনা থেকে শ্যামল কচি চিতে
তপ্ত নদী উথলে ওঠে শীতল দেহে তার
চিরুনি রাখে সংবেদনে, আয়না অন্তরে
সন্ধ্যেবেলা পৌরুষের গন্ধে তার মন
ছটফটালে কেউ জানে না কেন অচেনা স্বরে
কাকে যে ডাকে, ডেকেই চলে, হৃদয় উচাটন
তরুণ বুকে দীঘল বেনী তীক্ষ্ণ ছেনি হানে
কিন্তু তার ব্যাথার ভার নির্বিকার থাকে
যদি সে নিজ অতীত আর ভবিষ্যত জানে
এখনি ডেকে আনুক তার স্মৃতির হন্তাকে
কেন সে থাকে একলা ভিড়ে সারাটা বেলা ঘরে
যেখানে তার তরল বুকে আকাশ ঝরে পড়ে
বনপরী
অরণ্যে তোমার সঙ্গে দেখা হলো, পরিচয় হলো
ছিলে পরী, ডানা ছিঁড়ে মানুষ হয়েছ
তুমি জানো সবুজ রহস্যটিলা, গুপ্তশাস্ত্র, এখন মানুষ
দেখবার নাম করে আমার সন্ধ্যানে বেরিয়েছে
জানো অন্ধকার হলে প্রণয়ীর গলা
মুচড়ে সকল রক্ত শুষে নিতে হয়
আজ তাই ঝাঁপিয়ে আসছে কালো মেঘ
তবু বসি তোমার নিকটে এসে নত
সফল গোয়েন্দ তুমি, দৃষ্টিচোর, পদচিহ্নভেদী
আমার গোপন সব প্রকাশ করেছ রাজপথে
তোমার জানুর কাছে বসি তবু; অরণ্য শহর ঢেকে দিলে
ওই কোলে ঘাড় নুইয়ে দেব
মৎস্যপুরাণ
আবার এসেছো যদি মর্মব্যথা নয়, কোনো ঘৃণা
তোমাকে দেব না, তিমি, গর্ভপালিতার
মতন রেখেছ পেটে, যদিও গনগনে তীব্র ক্ষার
দিয়েছে শরীর দগ্ধ করে
ঝাপসা অতীতের কথা আজো ভাবো কিনা
জানতেও চাইব না, এই দগ্ধদেহ কুষ্ঠদেহ নিয়ে জনে জনে
করেছি তোমারই খোঁজ। শ্বাসরুদ্ধ মাতাল সাগরে
আমাকে আশ্রয় দিলে, এরই গর্বে বৎসরে দুমাস রেখো মনে
প্রতিবেশী
এই ঘুমন্ত নিচু গ্রামে
হাওয়া এলোমেলো, বিদেশিনী
তাকে ভাষাহীন সঙ্কেতে
আমি চিনি না বা ঠিক চিনি
দূরে দিগন্ত কাঁটাতার
দূরে মেঘে মেঘে মশগুল
শাদা উড়ন্ত মিনারের
নিচে একাকিনী লাল ফুল
বলো ওগো প্রতিবেশী ফুল
হাওয়া তোমার কি সন্তান?
তার অবোধ্য সঙ্কেতে
প্রাণে জ্বলে ওঠে আরো প্রাণ
তুমি নর্তকীমুদ্রায়
কেন দিচ্ছ অপ্রমাণী?
কেউ বুঝি না তো এই রাতে
তুমি তুমি, নাকি তুমি আমি
তবু ভূগোলের সিলেবাসে
আজও একথা পড়ানো হয়:
এই রাতজাগা উঁচূ গ্রামে
হাওয়া প্রসঙ্গক্রমে বয়
বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট
গায়ে বিঁধছে রোদের ফলা, দেখতে পেলাম ঝাউয়ের তলায়
তুমি তখন চলেই যাচ্ছ নৌকা গেছে ছেড়ে
তাকিয়েছিলে একটু ফিরে কিন্তু তখন তোমায় ঘিরে
সূর্য ফেটে আমার চোখে গাঁথিয়ে দিল পেরেক
ফিনকিতে উৎকণ্ঠা ছোটে, প্রজাপতির প্রাচীন টোটেম
উপড়ে পড়ে গর্জে ওঠা নোনা হাওয়ার তোড়ে
তখন আমার ভূলুণ্ঠিত স্বপ্নে আমিই অবাঞ্ছিত
তুমি অপসৃত সে কার সবল বাহু ধরে
অরণ্য, খাদ, ঝরনাধারার মধ্যে আমি ছন্নছাড়া
প্রাণীর সঙ্গে পশুর মতো ছিলাম খানিক বেঁচে
ডাইনি, দানো, বামন, পরি আর হারানো সে সুন্দরীর
গল্পগাথার জগৎ কোথায়, কোথায় আছে কে যে!
রাতের পরে ফিরেছে রাত, রাতের মতো নামে প্রভাত
তোমার খবর রটিয়ে হঠাৎ বনের শাখায় চেরি
বুকে ঘেষটে আবারও যাই ততক্ষণে তুমি তো নাই
তোমায় পেতে আবার হলো এক মুহূর্ত দেরি
আবার হামা আবার গুড়ি মাথায় অগ্নিগিরির পুরীষ
দিন যে গেল সময় হলো গুহায় ফিরে যাবার
সুন্দরী ও পশুর ছলে মুখস্থ রূপকথার তলে
আগুনে খাক এই কাহিনি পেছনে থাক চাপা।
জন্মান্তর
শামুক, তোমার দিকে নির্ণিমেষ দৃষ্টি মেলে রাখি
ক্রমশ এগোও তুমি নিরুদ্বেগ, শান্ত, অপিপাসু
তোমার নিবিষ্ট গতি আমি ধরে রাখি এই দেহে
ওই খোলে, রাজসিক মুকুটের তলে
লুকিয়ে রাখছ মৃদু চলনভঙ্গিমা, ক্ষতি, মৃত্যু-সম্ভাবনা
নরম পায়ের নিচে ক্ষয়ে যাচ্ছ ক্রমাগত পলে-অনুপলে
যত্নে তুলে রাখি আমি ক্ষয়ে যাওয়া শরীরের কণা
ভ্রমণ সমাপ্ত হলে পড়ে থাকো দেহমুক্ত উদাসীন খোল
তোমার সর্বস্ব নিয়ে আমি হয়ে উঠি দ্যাখো তোমার জাতক
সরস্বতী
ঝাঁপিয়ে পড়েছি তোমার বক্ষে
মাথার ওপরে তরঙ্গ বয়
গহন, তোমার আঁধির অতলে
ডুবে মরা একমাত্র অভয়
ডোবারই মন্ত্র শিখিয়েছ তুমি
ডুবেছি মধুতে ডুবেছি কাদায়
কাদা মুছে গেছে সাদা পালকের
পথ মুছে গেছে গোলকধাঁধায়
ও সরস্বতী, এবার আমাকে
বাহন করো গো যুগান্তরের
অথবা বাজাও বীণার মতন
সীমা ভেসে যাক ছোট এ ঘরের
আমার স্বপ্নে তোমার স্বপ্ন
মিশে যাক, বিষে ভরে যাক মন
কেন? এ প্রশ্নে মাথা কুটে মরে
অঝোর শ্রাবণ, অঝোর শ্রাবণ!
উপাখ্যান
যে দ্বীপে বসত করি তার নাম ক্ষণপরিত্রাণ
সীমানানির্দেশ দেখে ভীত নাবিকেরা
জাহাজ ফিরিয়ে নেয়। এই দ্বীপ ছয়মাস মোমসমুদ্রের
মধ্যে ভেসে থাকে আর বাকি ছয়মাস
অগ্নিপরিখার পেটে। মেঘ এসে উদরে চেপে রাখে
ধাতুর ডিমের মতো এই জতুগৃহ, এর ঘন কালিমার
ক্রন্দন-আকুল দিন—বেদনাশিখর
কখনো হঠাৎ ঝড়—কোমরে পালক গোঁজা দ্বীপবালিকারা
ফেনার জোয়ারে ভাসে। মানুষের বীজ
দু’ পায়ে থেঁতলে দিয়ে অতিকায় দানো
দাঁড়ায় সামনে এসে; আরো চায় ভোগ, করোটির
পাত্র ভরে আরো চায় পানীয়, ক্ষরণ
কী আছে আমার, বলো, প্রসারিত দুই হাত ভরে
তোমাকে কী দেব আর? দেহের কলম
পারিনি লালন করতে, দাওনি সুযোগ, দেব, তোমায় তোষণ
এতই কঠিন, তাই অবশিষ্ট বীজ
ভাসিয়ে দিয়েছি আমি তরঙ্গশীর্ষের জলে জলে
কথার ওপারে
কথার ওপারে যেতে চাই
সবই দেখি অর্থময়, সবকিছু প্রবল বাঙ্ময়—
যা কিছু সচিহ্ন তার সবটাই সশব্দ হুঙ্কার
হয়ে উঠছে, ভাসিয়ে লোপাট করছে সমস্ত সংসার।
কোথায় সে হ্রদ যার চিরস্থির জলে
ঢিল ছুড়লে তরঙ্গ ওঠে না?
নিরুচ্চার, তুমি জেগে ওঠো
ডানা
কেমন ঝাপটে এলে, ডানা, এই জলাভূমি থেকে
আমাকে নখরে গেঁথে, ও স্বতঃপ্রকাশ,
তুলে নেবে? রাত্রি এলে কেন দূর বনে চলে গেলে
অচেনা জন্তুর ঘায়ে ন্যুব্জ হয়ে থাকি, আমি জলে ডুব দিয়ে
কাটাই দিবসযাম। হাঙর আমার
বাবা-মাকে খেয়ে নিল, আমি তো অনাথ, আমি শ্যাওলার ঝোপে
লুকিয়ে বেঁচেছি এতকাল
আমার শরীর থেকে খসে, ডানা, অপরহরণে
চলে গিয়েছিলে যদি হাওয়াকে পাঠাই খোঁজে, ঝড় আমার ছেলে
জন্তুর খুরের তৃণে বিষ্ঠা ও লালায়
ভরেছে সমস্ত দেহ; নিজে নিজে, ও ডানা, ফিরেছ তুমি আজ
বাঁকানো নখর নিয়ে এ জলাভূমিতে কেন বলো?
নিঘুমজাগর আমি দিগ্ব্যাপী এ জলপাতালে
দেখছি উঠছে জেগে সমাধিমহল—
একটি সে খালি, তাতে মনুষ্যচর্বির দীপগুলো
জ্বলে উঠছে একে একে, আমাকে কী বেছে নিতে বলো
ও ডানা, ও পুনরাগমন?