আষাঢ় মাসের প্রায় পনেরো দিন চলে গেছে বৃষ্টিহীন। আজকের ভোর থেকে টানা বৃষ্টি। মাসের অর্ধেকজুড়ে যতো মেঘ জমেছিল যেন সমস্ত একযোগে নেমে এসেছে। আমার উত্তরদুয়ারী ঘরের বারান্দা বেশ চওড়া। তবু জলের ছাটে আমার দুই পা ভিজে যাচ্ছে। দুয়ারে চেয়ার পেতে আমাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে ফজরের পর থেকে। ছোট্ট একটা কাঠের টেবিলও আছে পাশে। টেবিলের উপর একটা মোবাইল ফোন। দুই তিনটা নতুন মলাট লাগানো বারবার পড়ে ফেলা বই। একটা খালি পানির গ্লাস। সারা উঠান ফাঁকা। বাড়ির অনেকেই এখনও গভীর ঘুমে ডুবে আছে। মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে সময় দেখার চেষ্টা করলাম। ছয়টা বত্রিশ। টেবিলে ফেরত রাখতে যাবো হঠাৎ আমার হাতের মধ্যেই বেজে উঠলো! এতো সকালে কখনও সাধারণত কল আসে না।
কিছুক্ষণ আগে নদীর ওপারে একজন মরে গেছে। সারারাত শুকনা মেঘের গর্জন ছিল। রাতভর মৃত্যু যন্ত্রনায় অস্থির তার শরীরের সবকিছু যখন ভোরে এসে থেমে গেল, ততক্ষনে বর্ষাকালের প্রথম বৃষ্টি সারাদেশ ধুয়ে নিতে শুরু করেছে। সেই মৃত্যুর খবর জানাতেই এতো ভোরে টেলিফোন। বাড়ির বাইরে এই খবর শুনছি এমন আমিই বোধহয় প্রথম ব্যক্তি।
কাইলক্যা আগ রাইত থাইকাই যায় যায় দশা, হারা রাইত হিথানে আমি, গ্যাদার বাপ আর বড় বুজি বসা। ফজরের পর থাইকা কী যে কাইত্যান শুরু অইল! এমন ঝড় আর বিষ্টি! সাড়ে ছয়টা বাজে তহুন আম্মার চক্ষু চিরদিনের জন্যে বন্দ…
খবর দিতে গিয়ে তার গলা ধরে আসছে। মিনিট দু’য়েক কেবল কান্নার আওয়াজ। এরপর সবার আগে আমাকে খবর দেয়ার আসল কারণ বলল সে।
আপনে যতো শিগগির পারেন রওনা করেন। আপনে আইসপেন, তারপরে জানাজার নামাজ। আপনেক ছাড়া কাহুক দিয়া নামাজ পড়ান যাইব না। জবান বন্দ হওয়ার আগে আম্মা আমাক বারবার কয়্যা গ্যাছে।
মৃত্যু সংবাদ শুনে আমার দুই চোখ ভিজে গেল কিনা বুঝলাম না তবে সোজা নজর গেল দুই পায়ের দিকে। লুঙ্গির নিচের অংশ ভিজে লেপ্টে আছে। আমার অবশ হয়ে পড়ে থাকা প্রায় আশি বছর বয়সী পা! আজ প্রায় সপ্তাহ তিনেক তারা চলার শক্তিহীন পড়ে আছে। আমি আর একা হেঁটে নিজের বিছানায়ও যেতে পারি না। নদীর ওই পাড়ে প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে নিজের বাড়িতে মরে গেছে সে। কী করে যাবো এতোদূর?
আর একমাস আগে মরলিও যাইব্যার পাইরত্যাম। এহুন তো আমার আর…
আমি কথা শেষ করতে পারলাম না। কলটা কেটে গেল। নিজের বলা কথা নিজের কাছেই কেমন শোনাচ্ছে। আবেগহীন, নিষ্ঠুর, নির্জলা। এমন করে বলার কী দরকার ছিল? হয়তো আমি যন্ত্র্রের মতো কথা বলেছি। এতো আবেগ, আগ্রহ আর আশা নিয়ে আমাকে যে অনুরোধ করেছিল, তার কষ্ট পাওয়াটাই স্বাভাবিক। নিজের উপর নিজের রাগ হতে লাগল। সারাজীবন যাকেই কোন কথা দিয়েছি, কম বেশি রাখার চেষ্টা করেছি। এইবার পারলাম না।
তার স্বামী যখন মারা গেল আমার কাছে খবর আসে তিনদিন পর। সোমবারে মৃত্যু, আমি গিয়ে পৌঁছাই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। আমার ভয় ছিল তার মৃত্যুর খবরও হয়তো আমি ঠিক সময়ে পাবোনা। তার ছেলে, মেয়ে, ছেলের বউ, মেয়ের জামাই, নাতি, নাতনি- সবাই হয়তো আমাকে খবর দিতে ভুলে যাবে। তাকে দেয়া কথা আমি রাখত পারবো না। তখন চিঠি টেলিগ্রামের যুগ। চিঠিতে জানালে অন্তত দুইদিন, যদি সদরে টেলিগ্রামও করে- এতদূরে আমার বাড়ি পর্যন্ত আসতে কমপক্ষে একবেলা। যদি গরমকালে মৃত্যু হয় ততক্ষণ লাশ আমার জন্যে নিশ্চয়ই ফেলে রাখবে না। ধরেই নিয়েছিলাম তার জানাজা আমি আসলে পড়াতে পারবো না। শর্তহীন প্রতিজ্ঞা করা আমার উচিত হয় নাই। ওই একটা মানুষের কাছে আমার এতো বড় ঋণ থেকে যাবে মৃত্যুর ওপারেও! প্রায়ই ভাবতাম এইসব, ঘুমের ঘোরে, একলা ঘরে, নৌকায়, ডাঙায় যখনই ভাবতাম –কেমন ঘন হয়ে আসতো সারা শরীরের অনুভূতিগুলো। অদ্ভুত এক অস্বস্তি মনের উপর সওয়ার হয়ে থাকত। চোখের চারপাশে তথন যেন আলো নিভিয়ে রাত নামত ধীর, বিষণ্ণ।
আবার যখন দেশে মোবাইল টেলিফোন নামল- আমার মনে তীব্র গতির এক আশার সঞ্চার হল। যদি আমার মৃত্যু তার আগে না হয়, নিশ্চয়ই আমি সাথে সাথে খবর পাবো। পাওয়া মাত্রই ছুটে বেরিয়ে যাবো। বাড়ি থেকে ঘাট এক ঘণ্টা, নদীতে ঘণ্টা দেড়েক, ওইপারে আর আধা ঘণ্টা। বড়জোড় তিন ঘণ্টা লাগবে। জানাজার আগেই নিশ্চিত পৌঁছে যাবো। যখন প্রথম মোবাইল ফোন হাতে পেলাম, তখন থেকে আজ অবধি অজান্তে, অবচেতনে আমি হয়তো আজকের এই ফোনকলটার অপেক্ষায় ছিলাম। তার মৃত্যুসংবাদের নিষিদ্ধ অপেক্ষা; যদিও বেশিদিন মাদ্রাসায় পড়ি নাই, বড় নামাজ পড়ানোর অভিজ্ঞতা নাই, তবু তার জানাজা পড়ানোর গোপন গভীর ইচ্ছা সদা-সর্বদা মনের মধ্যে ছিল। এতোদিনে যখন শেষমেশ সবার আগে খবরটা পেলাম, আমার আর যাওয়ার উপায় নাই। অসুস্থ, অচল, ঘরে বসে বন্দী।
তাদের বাড়িতে পাঁচ বছর ছিলাম। পড়তাম শহরের কলেজে। অন্তত প্রতিদিন দুই বেলা তার হাতের সুমধুর ভাত, ভর্তা, তরকারি, ডাল এসে পৌঁছাত বাহির বাড়ির কাচারি ঘরে। ওই ঘরেই ঘুমাতাম। খাওয়া, পড়াশোনা সব ওখানেই। দুই দরজা, দুই জানলাওয়ালা পশ্চিমমুখী ঘর। যেদিন কাউকে হাতের কাছে না পেত, তখন নিজেই একহাত ঘোমটা টেনে কাঁসার থালা, বাটি নিয়ে চলে আসতো। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকত খানিকক্ষণ। আমার নজরে পড়লে দুয়ারে খাবার রেখে দ্রুত চলে যেত। আর যদি দেখত অন্যমনস্ক বা ঘুমিয়ে আছি, তাহলে দুয়ারে খাবার নামাত বেশ জোরে শব্দ করে। কাঁসার থালায় কাঁসার বাটির আঘাতের সেই সঙ্গীত আজও আমার কানে স্পষ্ট হয়ে আছে। সেই ঘোমটা পড়ে দ্রুত চল যাওয়ার দৃশ্য এখনও তাজা ছবির মতোন।
প্রথম চার বছর একবারও তার মুখ দেখি নাই। একদিন এক ভয়াবহ নাটকীয়তায় প্রথম দেখা মিলল। সেদিন সন্ধ্যার পর আমি কাচারি ঘর থেকে বের হয়ে দেখি সারা বাড়ি অন্ধকার। এমনতো হওয়ার কথা না! মাগরিবের আজান পড়তে না পড়তেই প্রতিটা ঘরে বাতি জ্বলার কথা। তবে কি বাড়িতে কেউ নাই? খুব বেশি দরকার না পড়লে কখনওই আমি বাড়ির মধ্যে যেতাম না। অনেকক্ষণ ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে তার সন্তানদের নাম ধরে একে একে ডাকলাম। তারপর খোঁজ করলাম তার স্বামীর। আশ্চর্য কারও কোন সাড়া নাই! আবছা একটা গোঙানির আওয়াজ ভেসে এল কানে। ব্যথায় কাতর কোন এক নারী কণ্ঠের টানা আর্তনাদ। এই বাড়ির রান্নাঘর বেশ বড়সড়। তার একদিকে মাদুরপাতা। অন্ধকারে তারই উপর ছায়ামূর্তির মতোন কেউ একজন শুয়ে আছে। তীব্র যন্ত্রণায় বার বার এপাশ ওপাশ করছে। আমি কিছুক্ষণ ভালো মন্দ, উনিশ কুড়ি ভেবে শেষমেশ এগিয়ে গেলাম। এদিক ওদিক হাতড়িয়ে বাতি জ্বালাতেই আলো গিয়ে পড়ল তার করুণ রঙের মুখে। যে মুখ এতোকাল ঘোমটার আড়ালে ছিল! যে মুখের ছবি কেমন হবে কোনদিন কল্পনায়ও ঠাহর করতে পারি নাই, আজ তার এতো নিকট দর্শন! সারামুখ ঘামে ভেজা, তবু অদ্ভুত এক মায়া, প্রাণের অজস্র আভা ছড়াচ্ছে সে। কিন্তু হাতে সময় কম। বুঝলাম সে প্র্রসব যন্ত্রনায় পড়ে আছে। তার স্বামী গেছে ছেলেদের নিয়ে হাটে, আসতে আসতে এশা পার হযে যাবে। আর কেউ নাই ধারে কাছে। এক গুরু দায়িত্ব এসে পড়ল কাঁধে। এক দৌড়ে যাওয়া উচিত ঠাকুর বাড়ির দাই বুড়ির কাছে। কিন্তু একে একা এভাবে ফেলে যাই কী করে? ভাবতে ভাবতে কতক্ষণ গেল জানি না, হঠাৎ বাধ্য হয়ে সে ধরে আসা গলায় আমাকে বলল একটা পুরোনো শাড়ি নিয়ে আসতে। আমি তাকে সেই শাড়ি দিয়ে কোন রকমে ঘেরাও করে রেখে ছুটে গেলাম বুড়ির কাছে। ফিরে এসে উঠানে ঢুকতেই শুনলাম নবজাতকের কান্নার আওয়াজ। ধীরে ধীরে বুড়ি এসে আমাকে অনেক গুলো কাজের ফরমায়েশ করে ঢুকল আঁতুর ঘরে। আমি এই বাড়িতে জায়গীর থাকি, পর পুরুষ। বয়স চব্বিশ কি পঁচিশ! এই বয়সে, এই পরিচয়ে তার আঁতুরঘরে কাজ করলাম শরীর আর মন ভরা প্রচুর সংকোচ নিয়ে। পানি গরম করে, রক্ত পরিস্কার করে, রান্নাঘর লেপে মুছে প্রায় শেষ করেছি এমন সময় তার স্বামী সন্তানদের নিয়ে ফিরে আসল। সব দেখে শুনে লজ্জা আর কৃতজ্ঞতায় লাল হয়ে আমার হাত ধরে বেচারা অনেকক্ষণ কথাহীন কেবল দাঁড়িয়ে থাকল। বুড়ি বের হয়ে এসে নতুন ছেলের মুখ দেখাতে নিয়ে গেল আমার হাত থেকে তার হাত প্রায় জোর করে ছাড়িয়ে।
আজকের এত গাঢ়, তুমুল বৃষ্টিও দেখতে দেখতে কমে এল। উঠানে একে একে সন্তান, পুত্রবধু, নাতি নাতনীরা বের হয়ে আসছে। সবাইকে মৃত্যুর সংবাদটা জানানো দরকার। কিন্তু চেষ্টা করেও মুখ খুলতে পারলাম না। কেবল মেহেন্দি লাগানো দাড়িতে হাত বুলিয়ে যাচ্ছি বিরামহীন। কষ্ট না, কান্না না- কোন একটা অন্য অনুভূতি আমাকে অনেকক্ষণ বোবা, স্তব্ধ করে রাখল। আমি সবার দিকে তাকিয়ে থাকি অপলক- যেন চোখ দেখেই সবার বুঝে নেয়া উচিত, আমি কী বলতে চাই। কেউ আমার চোখের দিকে মনোযোগ দিয়ে চাইল না। কেউ বুঝতেও পারল না আমার নজর জুড়ে ফুটে ওঠা তার মরণের খবর।
যমুনার ওপারে মৃত্যু-উঠানেও নিশ্চয় বৃষ্টি থেমে গেছে। একটা গরম বাতাস বয়ে যাচ্ছে বাড়ির উপর দিয়ে। গোসল শেষে কাফন পরিয়ে এতক্ষণে হয়তো তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে তার প্রিয় আম গাছের ছায়ায়। ওই গাছের দুই একটা পাতাও হয়তো ভালোবেসে ঝরে পড়ছে সাদা কাফন ঢেকে মেলে দেয়া একরঙা চাদরের উপর। বারান্দায় সারি সারি ঘোমটা দেয়া নারী সমস্বরে মৃদু সুরে কুরআন পড়ছে। কাঁচা বাঁশ, খেজুরের ডাল কেটে এরই মধ্যে বোধহয় প্রস্তুত করে রাখা হচ্ছে বাহির বাড়ির একটা কোণে। ঢাকা থেকে খবর পেয়ে ছুটে এসে নাতি নাতনিরা লাশ ঘিরে বসে মাতম তুলে কাঁদছে। আগরবাতির ধোঁয়া আর কর্পূরের গন্ধ তাদের কান্নার শব্দে এসে তীরের মতোন বিঁধছে। বৃষ্টির পানি আর লাশ ধোয়া জল একাকার হয়ে উঠানের এখানে ওখানে জমে আছে। বাদ আসর জানাজা। ততক্ষণ প্রায় এভাবেই উঠানের এক কোণায় নিজের হাতে লাগানো আমগাছের তলে দৃষ্টি, বোধ, প্রাণহীন- সে শুয়ে থাকবে কিছুক্ষণ।
তাদের বাড়িতে আমার জায়গীর জীবনের শেষ দিনও সারা সকাল বৃষ্টি আর সারা বিকেল রোদ ছিল। প্রায় পঞ্চান্ন বছর আগের কথা। আশ্বিন মাস। পরেরদিন ভোরে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। মা-বাবার ঘরে ফিরে যাওয়ার আনন্দে উদ্বেল হওয়ার কথা ছিল কিন্তু কোন একটা কারণে খুবই অসহায় বোধ হচ্ছিল। একটা কোমল মায়া জমে গেছে এতোদিনে।
আসরের নামাজের পর আস্তে ধীরে ভেজা উঠানে পা রাখলাম। নিজের জিনিসপত্র কম বেশি গুছিয়ে ফেলেছি। ঠিক করলাম সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাখব আজকে সন্ধ্যার মধ্যেই। কাল ভোর ছয়টার নৌকা ধরে একেবারে ঘরে ফেরা। তাকে পেলাম উঠানের উত্তর-পশ্চিম কোণে। ছোট শাবল হাতে গর্ত খুঁড়ছে। পাশে একটা আমগাছ রাখা। আমি গিয়ে দাঁড়াতেই ঘুরে তাকালো। মাথার ঘোমটা পড়ে আছে ঘাড়ের উপর এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে ঘোমটা তোলার কোন উদ্যোগ দেখাল না সে।
কিছু কইবেন?
আমি চইল্যা যাইত্যাছি কাইলক্যা ভোরের নৌকায়।
খানিক খাড়ান।
বলে সে আগে গাছটা বসালো গর্তে। খুব যত্ন করে মাটি দিল, পানি দিল। একটা বাঁশের শক্ত লম্বা কঞ্চি পুঁতে দিল। এরপর মাটিমাখা হাতে ধুয়ে এসে দাঁড়াল আমার সামনে একেবারে মুখ আর বুক বরাবর। কিছু একটা বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল। তার ভেজা হাত আর চোখের পানির আবেশ এসে লাগল আমার গায়ে। জীবনের সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত, সব থেকে রহস্যের এই সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার কী করা উচিত, কী বলা উচিত জানি না। কেবল বুঝলাম এই কয় বছরে তার আর আমার মাঝে সংজ্ঞাহীন, রংহীন, নামহীন কোন একটা অচেনা সম্পর্ক এতো গভীর হয়ে বেড়ে উঠেছে যে— এরপর যতদিন, যতদূরে, যত যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়েই দুইজন বাঁচি না কেন— এই সম্পর্ক মলিন হবে না। জোয়ার নাই, ভাটা নাই, বন্যা-খরা নাই, উত্তাপ-শীতলতা নাই। আমি ওই মুহূর্ত থেকেই নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতে শুরু করলাম এই সম্পর্কে কোনদিন কোন ভবিষ্যতেই শেষ হবে না।
এরপর সে আমার হাত ধরে অনুরোধ করল, অনুরোধ না ঠিক, আসলে আদেশ করল— যদি জীবদ্দশায় আর কোনদিন দেখা নাও হয়, আমি যদি তার মৃত্যুর খবর পাই, তার জানাজা যেন আমি ছাড়া অন্য কেউ পড়াতে না পারে। আমি মৌলভি বা আরবী লাইনে পাশ করা কেউ না, কেবল বাড়িতে কখনও জামাত হলে ইমাম হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতাম। বাড়ির বাইরে আমার হাতেগোনা মাত্র দুই তিন বার নামাজ পড়ানোর অভিজ্ঞতা, তবু এতো শক্ত অনুভবে ততক্ষণে মনে মনে এতো বেশি জড়িয়ে গেছি ‘না’, ‘যদি’, ‘কিন্তু’ বা ‘হয়তো’ বলার মতোন শক্তি ছিলনা।
আমি বাঁইচ্যা থাকলি অবশ্যই অন্য কাহুক পড়াইব্যার দিমু না!
স্পষ্ট উচ্চারণে বলে আমি প্রায় দৌড়ে ভেজা উঠান পেরিয়ে বাইরের ঘরে ফিরে এলাম।
দক্ষিণে ঢলে পড়া সূর্য মেঘ কেটে পরিস্কার হয়ে যাওয়া আকাশে রোদ উজাড় করে ছড়িয়ে আছে। আমার চোখের সামনে কর্মমুখর উঠান। আপন মুখগুলো নানান রকম কাজে ব্যস্ত। যমুনার ওই পাড়ে আরেক উঠান। হয়তো এখন লাশ বয়ে জানাজার মাঠে নেয়ার প্রস্তুতি চলছে সেখানে। ভ্যানে বাঁশ, চাটাই, খেজুর পাতা উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ছেলে আর নাতিরা প্রস্তুত খাটিয়া কাঁধে তুলে নেবে। শোকের মাতম কিছু সময় থেমে আছে। থমথমে পরিবেশ। টিনের ফটক খুলে দাঁড়িয়ে আছে দুইপাশে দুইজন । লাশ কাঁধে তোলা মাত্রই আরেক দফা শোকের সুর উঠান পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়বে দশদিকে। শবযাত্রার পিছনে সারা বাড়ি খালি করে বাড়ির সবাই ছুটবে উদ্ভ্রান্তের মতোন। প্রাইমারি স্কুলের মাঠে কম করে হলেও হাজার মানুষ অপেক্ষায়। সবার পশ্চিমে দাঁড়িয়ে আছে গাঁয়ের মসজিদের নতুন ইমাম। বছর পঁচিশের যুবক, মুখ ভরা সুন্দর দাড়ি। জনমানুষহীন খালি উঠানে হঠাৎ দেখি আমি দাঁড়িয়ে, একা। আমারও বয়স পঁচিশ, কিন্তু মুখে দাঁড়ি নাই। উত্তর পশ্চিম কোণায় সদ্য লাগানো আম গাছ। তার অল্প কয়েকটা পাতা বাতাসে দুলছে। টিনের ফটক খোলাই ছিল। আমার হাতে জলপাই রঙের মাঝারি সাইজের ট্রাঙ্ক।বাড়ি থেকে মিনিট দশেকের মেটে রাস্তা চলে গেছে পশ্চিমে প্রাইমারি স্কুল বরাবর। আরেকটা দীর্ঘ পথ গিয়ে থেমেছে পুবদিকে যমুনার ঘাটে। সোজা পুবে যাত্রা আমার। একটানে নদীর ঘাট। পশ্চিমে তাকালেই তার শবযাত্রা। পিছন ফিরে তাকানোর কোনরকম সাহস হচ্ছেনা। পায়ের গতি বাড়িয়ে দিলাম। সমস্বরে কান্নার শব্দ তবু কানে এসে বিঁধছে।
মাঝখানে কেটে যাওয়া পঞ্চান্ন বছর এতো অল্প সময়! বছর থেকে বছরের দূরত্ব এতো বেশি কম!