ইতিহাস পাঠে জানা যায় আজ থেকে পাঁচ, সাড়ে পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে বৃহত্তর ময়মনসিংহের অধিকাংশ অঞ্চলই সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত ছিলো।তবে, অনুমান করা হয় যে, শুধু মাত্র মধুপুর ভাওয়াল বনাঞ্চল শৈল শিলার উচ্চতা নিয়ে বিরাজ করেছিলো। ধারণা করা হয় যে, সোমেশ্বরী নদীর পাড়ের গারো পাহাড় হতে ভাওয়াল গড় পর্যন্ত যে পাহাড়মালা তাই হচ্ছে বাংলাদেশের একটি প্রাচীনতম স্থলভাগ। এই স্থলভাগের বড় অংশ গাজীপুর জেলার অন্তর্গত। কাজেই এ অঞ্চলের জনবসতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য যে সু-প্রাচীন তা বলা যেতেই পারে।
প্রাচীনকালে(৬২৯-৬৪৫খ্রিস্টাব্দ) পরিব্রাজক হিউয়েন-সাঙ ভারতবর্ষ পরিভ্রমণ করেন। হিউয়েন-সাঙ এর ভ্রমণ কাহিনী পাঠে জানা যায় বঙ্গভূমি ছয়টি প্রধান রাজ্যে বিভক্ত ছিলো।
১) পৌন্ড্র, (উত্তর বঙ্গ, ব্রক্ষপুত্রের পশ্চিম ভাগ)
২) কামরূপ (ময়মনসিংহের পূর্বভাগসহ পূর্ববঙ্গ ও আসাম)
৩) সমতট (ঢাকা-ফরিদপুর)
৪) কমলাহু (ত্রিপুরা বা কুমিল্লা)
৫) তাম্রলিপ্ত (দক্ষিণ পশ্চিম ভাগ) ও
৬) কর্ণ সুবর্ণ (পশ্চিমবঙ্গ)
উপরের বর্ণনায় প্রতীয়মান আমাদের টাঙ্গাইল জেলা তৎকালে কামরূপ রাজ্যের বা প্রাগ-জ্যোতিষপুর রাজ্যাংশ- যাকে বলা হয় ‘ভাটির মুল্লুক’এর অন্তর্গত ছিলো। মহাভারত কাব্যগ্রন্থের কামরূপ রাজ্যের সীমানা পর্যন্ত প্রসারিত বলা হয়েছে। হিন্দু শাসন আমলে খ্রি. দশম শতাব্দীতে বাঙ্গালা সেনও পাল রাজ বংশের আবির্ভাব হয়। এই উভয় বংশের নৃপতিবর্গ বঙ্গভূমির বিভিন্ন অঞ্চল শাসন করতো। ক্রমে কামরূপ রাজ্যেও তাঁদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। জানা যায় টাঙ্গাইল অঞ্চল খ্রি. দশম হতে একাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত ১২০ বছর কাল পাল রাজেন্যবর্গ এই অঞ্চল শাসন করেছে। এই সময়ে ময়মনসিংহর দক্ষিণ অংশ বর্তমান কাপাসিয়া, রায়পুরা ও ধামরাই নামক স্থানত্রয়ে শিশুপাল, হরিশ্চন্দ্র পাল ও যশোপাল নামক পাল বংশীয় তিনজন ক্ষুদ্র নৃপতির রাজ্য ও পশ্চিমাংশে মধুপুরে পাল রাজ ভগদত্তের ক্ষুদ্র রাজ্য অল্পে অল্পে বধিষ্ণু ছিলো। এর পর দ্বাদশ শতাব্দীতে সেন বংশের নৃপতি সেনের আমলে টাঙ্গাইল জেলা সেনদের অধিকারে আসে। সেন রাজবংশের অভ্যূদয়ে এই ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো লয় প্রাপ্ত হয়ে যায়। এয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে সোনার গাঁ পতনের সময় পর্যন্ত পূর্ববঙ্গ সেন রাজ্য বংশের শাসনাধীন ছিলো।
লোকসংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ সংকলনকারী- শ্রদ্ধেয় দীনেশ চন্দ্র সেন উল্লেখ করেন ‘‘মধুপুরের জঙ্গলে এই বারতীর্থ এখনো বিদ্যমান যা প্রাচীন মৈমনসিংহ পরগণার জোয়ানসাহীর অন্তর্গত। এই কীর্ত্তিসমূহ উক্ত সময়ে কিংবা তাহারও পূর্বে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। এই গীতিকায় যে ভগদত্তের নাম উল্লিখিত আছে তৎসম্বন্ধে এবং মধুপুর জঙ্গলের ইতিহাস কীর্ত্তন উপলক্ষে মৈমনসিংহ গেজেটীয়ারে কিছু বিবরণ আছে’’।
রাজা ভগদত্ত ও বারতীর্থ সম্পর্কে লিখিত ও জনশ্রুতি সম্পর্কে জানতে আমি দীর্ঘসময় শোলাকুড়ি গ্রামে অবস্থান কালে রাজা ভগদত্তের বিভিন্ন স্মৃতি চিহ্ন দেখতে পাই ।
মধুপুরের রাজা ভগদত্ত ও কামরূপের বিখ্যাত ভগদত্ত একই ব্যক্তি নন। বারতীর্থের গানে পরগণা জোয়ানসাহীর উল্লেখ রয়েছে। এই পরগণাটি কস্তাহলের বিখ্যাত দত্ত পরিবারের জনৈক মুসলমান ধর্মাবলম্বী বংশধর দ্বারা স্থাপিত হয়েছিল। তার নাম সাধারণতঃ মনুর খান বলিয়া পূর্ববঙ্গ গীতিকায় পরিচিত। বারতীর্থের গান পালার নায়ক ভগদত্তের রাজত্বকাল সম্ভবতঃ ৯ম খৃষ্টাব্দে অনুমান করা হয়ে থাকে ।
এই গানের বর্ণনায় দেখা যায়, রাজা ভগত্তের মা ভীষণ অসুস্থ। কোন চিকিৎসাতেই তার অসুখ দূর হচ্ছে না।একরাতে রাজার মা স্বপ্নে দেখেন,বার তীর্থস্থানের জল দিয়ে স্নান করালে তিনি আরোগ্য লাভ করবেন। রাজমাতার শারীরিক অবস্থা এতটাই ভংগুর ছিল যে, তাকে নিয়ে তীর্থস্হানে যাবার মতো কোন বলই ছিল না। তখন রাজা বারটি তীর্থের জল একত্রিত করার চিন্তা করেন। কারও মতে,মায়ের আদেশে আদিষ্ট হয়ে রাজা ভগদত্ত ১২ ঘোড়ায় ১২ রাজকর্মচারিকে পাঠিয়ে দেন বারো তীর্থের জল আনতে। ঘোড়ার সোয়ারী ওই ১২ জন ভারতের বৃন্দাবন, মথুরা, প্রয়াগ, গয়া, কাশি এরূপ বারো তীর্থ থেকে জল এনে বর্তমানে শোলাকুড়ি যে স্থানে দীঘি সেই স্থানের মাঝখানে বসিয়ে বৈশাখের অমাবস্যার রাতে রাজার মাকে স্নান করালে তিনি আরোগ্য লাভ করেন। একথা পরে লোকমুখে রাষ্ট্র হয়ে যায়।
আবার বারতীর্থের গান নামক পালায় দেখা যায় – তীর্থস্হানের জল সংগ্রহের জন্য অন্যের প্রতি রাজার বিশ্বাস ছিলনা, তাই আপন ছোট ভাই রামচন্দ্রের উপর রাজ্যভার দিয়ে জল সংগ্রহে বের হলেন। রামচন্দ্র নতশীরে বলেছিলেন- দাদা, তুমি বনে জঙ্গলে অনাহারে অনিদ্রায় ঘুরিয়া কাটাবে আর আমি স্বর্ণসিংহাসনে বসিয়া রাজত্ব করব,এ কখনই হতে পারে না ।বড় ভাইয়ের আদেশ তিনি পালন করতে বাধ্য হলেন। রামচন্দ্র প্রকৃতই অযোধার রামচন্দ্রের মতোই শাসন করতে লাগলেন। গরীব দুঃখীদের তিনি মা-বাপ হলেন। যখন রাজা ভগদত্ত ফিরে এলেন, তখন প্রজারা তার নিকট রামচন্দ্রের বিরুদ্ধে অনেক মিথ্যা অভিযোগ করলেন। মর্মাহত হয়ে রামচন্দ্র নীরবে অশ্রু ভরাক্রান্ত চোখে প্রজাদের এই অভিশাপ দিলেন যে, তারা কখনই সুখী হবে না এবং এই বিরাট সাম্রাজ্যটি জঙ্গলে পরিণত হইবে। এতটুকুই ছিল পালাটির মূল বিষয়। রামচন্দ্রের অভিশাপের ফলেই হয়তো পালার শেষে এই কয়েকটি ছত্রে পাওয়া যায়,
“রাজা গেছে প্রজা গেছে গেছেরে ভাই ঠাট ঠমক।
উজাড় ভিটা পইরা রইছে এ্যাহন শিয়ালের বৈঠক
বারতীর্থের পূণ্যজলের স্নানে রাজমাতা দ্রুত আরোগ্য লাভ করেন। মাতার সুস্থতায় রাজ পরিবারের সবাই আনন্দিত। রাজমাতা প্রতিদিন যেন বার তীর্থের জলে স্নান করতে পারেন তাই রাজা একটি দীঘিতে সমস্ত জল মিশ্রণের উদ্যোগ নেন। পুত্রের কথায় মা আনন্দিত হয়ে একতাড়া সূতা ভগদত্তকে দিয়ে বলেছিলেন তুমি আমার সন্তুষ্টির জন্য এমন একটি পুকুর খনন করবে, যার আয়তন এই সূতার সমপরিমাণ হবে এবং সূতার নলি খুলতে চারদন্ড বেলা লেগেছিল। সুতরাং সূতার দৈর্ঘ্য সম্পর্কে আমরা ধারণা পেতে পারি। মায়ের অদেশ পাবার পর মন্ত্রীরা রাজাকে বলেন, এমন বিশাল দীঘি খনন করার মতো অর্থ রাজ কোষে নেই। কিন্তু রাজা জানিয়ে দেন, ‘‘ইহা মাতৃ আজ্ঞা, আমার রাজত্বের মূল্য এক কড়া। মাতৃ আজ্ঞার ন্যায় জগতে আমি কিছু মূল্যবান মনে করি না। ভারতের দ্বাদশাতীর্থে স্বয়ং যাইয়া তিনি নিজে তীর্থসলিল-সংগ্রহ করিবেন, ইহাই তাহার সঙ্কল্প হইল’’।
এই কাহিনীকে ঘিরে তখন থেকেই এ দীঘির জলে পূণ্যস্নান,পূজার্চ্চনাসহ নানা আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। শ্রীকেদারনাথ মজুমদার উল্লেখ করেন- প্রবাদ এই যে,রাজা ভগদত্ত স্বীয় পুণ্যশীলা জননীর আজ্ঞামতে বারতীর্থের পূণ্যোদক আনিয়া নিজ রাজধানীকে ‘বারতীর্থাশ্রম’ করিয়াছিলেন। সেই ‘বারতীর্থাশ্রমের’ পুণ্যনাম আজও তিরোহিত হয় নাই। বারতীর্থের গান পালাটির সংগ্রাহক স্বর্গীয় বেহারীলাল রায়। সম্ভবত: এই পালা সংগ্রহের সপ্তাহকালের মধ্যেই তিনি সহসা প্রাণত্যাগ করেন। পালাটি ১২৮০ বাং সনে সজুবয়াতি নামক এক কৃষক-কবি রচনা করেছিলেন।
প্রতি বছর বৈশাখ মাসের অমাবস্যা রাতে পূণ্য-স্নানের মাধ্যমে মেলার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। মেলায় গ্রামীণ জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির পরিচয়বাহী হরেক রকম বাহারী পণ্যের জমজমাট কেনাবেচা চলে। হাজার হাজার মানুষ এই মেলায় সংসারের বাৎসরিক কেনাকাটা করেন। বাদ যান না গৃহবধূরাও। মেলার ২য় দিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শুধু মহিলারা কেনাকাটা করেন। মেলার দ্বিতীয় দিনের নাম বউমেলা। এই দিন মেলায় কোনো পুরুষের প্রবেশাধিকার ওই সময়ে নেই। সারা এলাকায় পুলিশি নিরাপত্তার পাশাপাশি গেটে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা পাহারা দিয়ে এই ব্যবস্থা বহাল রাখেন। ওই সময়টায় গ্রাম্য গৃহবধূরা নির্বিঘ্নে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সারেন। বাইরে অনেক কৌতূহলী মানুষ দর্শক হয়ে এই ব্যতিক্রমী দৃশ্য অবলোকন করেন। এই অঞ্চলের মানুষদের কাছে ঈদের ন্যায় উপভোগ্য এই দিনটি। ছোটদের সালামি, বাড়িতে মিষ্টি, নাইওর আনা সব কিছুই হয়।
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে চেচুয়া হয়ে শোলাকুড়ির বারতীর্থে যাওয়া যায়। আবার মধুপুরের পঁচিশমাইল বাজার হয়েও বারতীর্থে আসা যায়। বারতীর্থের পুকুর, রাজভীটার ধ্বংসাবশেষ ও অরণ্য ঘেরা নৈসর্গিক নীরব প্রকৃতি সবাইকে আকৃষ্ট করবে।