বাংলা কবিতায় অমিতাভ পাল নামটা কবিদের কাছে প্রবলভাবে উচ্চারিত নাম নয়। কেন নয় তার উত্তর হয়তো একদিন মহাকাল দিবেন। বাংলাদেশের আশির দশকের উজ্জ্বল একজন কবি ও গল্পকার অমিতাভ পাল। তাঁর গল্প এক কথায় অসাধারণ। আমাদের কথাসাহিত্যের জন্যে ব্যতিক্রমী এক কাজ। অমিতাভ পাল “ব্রহ্মপুত্র” নামের একটি স্বল্পায়ূ ছোট কাগজের সম্পাদকও ছিলেন। তাঁর কবিতার বড় গুণ বিষয়ের সাবলীলতা ও ভাষার সহজবোধ্যতা। তাঁর কবিতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গাছের সবুজ কচি পাতার মতন দোল খাওয়া বাতাস, যেন বেশ সরস। কিন্তু নিষ্ঠুর বাস্তবতা এই অমিতাভ পাল আর আমাদের মাঝে নেই। ১৩ অক্টোবর ২০২১, সকালে নেত্রকোনায় তাঁর প্রয়াণ ঘটেছে আমাদের সবাইকে ব্যথিত ও হতবাক করে দেওয়ার জন্য। জানিনা মৃত্যুকে তিনি কতটা সরল মনে করতেন। এই কারণেই সম্ভবত তাঁর কবিতায় মৃত্যুর ছায়া হেঁটে গেছে পিছু পিছু। তাঁর শিল্পিত বিষয় কবিতার ভাষাকে করেছে দৃশ্যময়, দৃশ্যকল্পগুলো হয়েছে শব্দময় উজ্জ্বল।
“তারপর কেটে ধুয়ে পরিচ্ছন্ন করে
মিশিয়ে পছন্দমাফিক নিদিষ্ট মশলা
এক একটি যান্ত্রিক ভোজ তোমার ক্ষুন্নিবৃত্তি করে
আমি এই মৃত্যু ভালবাসি?
(আমার মৃত্যু)
শূন্য আবিস্কারের গল্প
একটি বিন্দু থেকে যাত্রা শুরু করে একটি
বক্ররেখার মাধ্যমে ওই বিন্দুতে ফিরে আসা
একটি চিত্রকে বৃত্ত বলে
আমার বউও ঠিক এইরকম
প্রতিদিন সে একই জায়গা থেকে শুরু করা
একটি প্রসঙ্গ ওই জায়গাতেই এনে শেষ করে দেয়
আর আমি বৃত্তস্থিত কেন্দ্রের মতো নিঃশ্চুপ বসে
এই বৃত্ত আঁকায় তাকে ব্যাসার্ধের মতো সাহায্য করি
শয্যাতেও দেখেছি আমার বউএর শরীরে
অনেক বর্তুল উপাদান আছে
আমি নিশ্চিত- আর্যভট্ট বিয়ে করার পরই
শূন্য আবিস্কার করেছিলেন
মেঘগুলি
মেঘগুলি যেন আকাশের মাঠে শুকাতে দেয়া
ধোপাবাড়ির কাপড়
জল ঝরে গেলেই ধোপা ওদের নিয়ে যাবে
আর আকাশটা নীল হয়ে পড়ে থাকবে একা
সমুদ্রের ব্যস্ততায় মেঘগুলি ময়লা হয়
ধোপাবাড়ি যায়
ডেঅফ
ডেঅফের দিন আমি বাজার করি
ঘুম থেকে ঊঠি ঘুমের সর্বোচ্চ সীমানা পেরিয়ে
দ্রুত চলতে চাওয়া হাতপাগুলিকে
ধীরে চলার পরামর্শ দেই
বউয়ের সাথে সেক্স করি
সময়কে শেখাই এগিয়ে যাওয়ার বিকল্প পথ ধরতে
বারে যাই
হাসি
রসিকতা করি
ডেঅফের দিন আমি হাজারটা কাজ করি
বাকি ছয়দিনের দাসত্বের জীবনে
আমার এতে কাজই থাকে না
মুক্তির অনেক দায়
পথচারী
যে পথটা আমি পার হয়ে এসেছি
সেই পথে হেঁটে আসতে থাকা তোমাদের আমি চিনি
কেননা আমিওতো তোমাদের মতোই ছিলাম
আমিও লাফিয়ে হেঁটেছি
গলা ছেড়ে চিৎকার করেছি
আর ডুবে গেছি মেয়েমানুষের সরোবরে
দমের কথা চিন্তা না করেই
আমি এখন যেখানে আছি—
তোমরাও একদিন সেখানে এসে
আমার মতো দাঁড়াবে
আমার সামনেও কিছু পথচারী আছে
অস্তমিত সূর্যের মতো লাল
সামাজিক
সামাজিক চরিত্রগুলির আদর্শ সংলাপ ও স্ক্রিপ্ট
আমি প্রায়ই দেখি বিভিন্ন বাসায়
বাবা মা ভাই বোন স্বামী স্ত্রী—সকলেই মুখস্থ সংলাপ বলে যাচ্ছে
নাটকে নিজের নিজের সিনে
তারপর টানা বলে যাওয়ার আনন্দে মনে মনে নিজেকেই হাততালি দিয়ে
চেটে খাচ্ছে আত্মতৃপ্তির মধু
সামাজিক চরিত্রগুলির আদর্শ সংলাপ ও স্ক্রিপ্টের ফটোকপি
আজকাল যেকোন কোচিংয়ে পাওয়া যায়
আমাদের শুধু কিনে নিয়ে মুখস্থ করলেই হলো
তারপর পরিস্থিতি অনুযায়ী বলে যাওয়া
সামাজিক হওয়া আসলেই খুব সোজা
সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ
রাত দশটা—ঈশ্বরের ডিনার শেষ
এখন স্বর্গের বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিনি সিগারেট খাচ্ছেন
ঈশ্বরের শতমুখে জ্বলছে শতশত সিগারেট
আর রাতের কালো আকাশ ভরে মিটমিট করছে
তাদের আগুন
দিনে ঈশ্বর কিউবান সিগার খান
সূর্যটা যেন সেই সিগারের জ্বলন্ত ডগা
আর তার চারপাশে জমা ছাইগুলো সব মেঘ
সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: সিগারেট মানুষকে
ঈশ্বরের নিকটবর্তী করে
স্বপ্নপরিধি
শহরের রোড ডিভাইডারে গাছ লাগানো হচ্ছে
একটা গর্তে তাদের পুঁতে
জল ঢেলে দিচ্ছে মালিরা
তারপর তাদের ছেড়ে দিচ্ছে নিজের পায়ে দাঁড়াতে
আমিও এই গাছগুলির মতো একদা
মফস্বলের নার্সারি থেকে শহরে এসেছিলাম
এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠে পেয়েছিলাম
প্রথম গর্ত এবং জল
তারপর বেরিয়ে এসেছিলাম নিজের পায়ে দাঁড়াতে
ভাড়া বাসা প্রেম সংসার
রঙিন পুঁতির মালার মতো স্বপ্ন
শিশু
ব্যস্ততা-
এইসব জনসমাগমে থাকতে থাকতে
কবে যেন বুড়িয়ে গেছি
কোন এক ফুটপাথে কোনমতে দাঁড়িয়ে থাকা মৃত গাছটার মতো
এখন আবার সেই মফস্বলে ফিরে
তার মাটিতে একটু শুতে পারলে হয়
কিন্তু গাছ কাটার কন্ট্রাক্টর কি সাধারণ একটা গাছের ইচ্ছাকে
এতটা মূল্য দেবে
বরং শূন্য রোড ডিভাইডারে আমার শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য
আরো একটা গাছ মাথা তুলে দাঁড়াতে আসবে
আর আমি-
কোন এক স মিলের কবরখানায় হয়তো পড়ে থাকবো
নামগন্ধহীন কোন লাশের মতো।
তিমির হননের গান ২০১৫
আমার সমস্ত রোদ বিক্রি করেছি আমি অফিসের কাছে
আর যতটুকু আলো আমার জীবনে বাকি আছে
তাদেরও সিংহভাগ চলে যায় ফ্ল্যাটের বিদ্যুৎবিল মেটানোর কাজে
বাকি থাকে অন্ধকার- ঘুমহীন রাত্রির ভাঁজে ভাঁজে
বিষণ্ন প্রেমের স্রোতে ঢুকে গেছে শিশুদের দল
খাটের ক্ষেত্রফলে শব্দে ভরা কারখানার মতো
নতুন পণ্য আসে নতুন লাভের আশা নিয়ে
বাণিজ্য- কাহার তুই বল
ডুবে যাচ্ছি অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছি- ধরো
হে সূর্য বাড়াও তোমার রশ্মির আঙুল
শতখণ্ডে ছড়িয়ে পড়া আমাকে আবার জড়ো করো
ফুটাও আমার মনে জীবনের বিষভরা হুল
মাতৃসমা
সিএনজির ভিতরে হাত পা গুটিয়ে বসে আছি
গর্ভের শিশুর মতো
অন্ধকার চাপা এই থলিটা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে আমার পৃথিবীতে
তারপর গন্তব্যে পৌঁছে নতুন শিশুর মতো
কুঁকড়ে বেরিয়ে আসবো আলো বাতাসের সমুদ্রে
সিএনজি মাতৃসমা
প্রসপেকটাস
পৃথিবীর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদে
পড়ছে বিভিন্ন অণু পরমাণু
শিক্ষাজীবনে তাদের কারো কারো মধ্যে বন্ধুত্ব হয়
পরস্পরের হাত আঁকড়ে ধরে তারা
একসাথে চলে
তৈরি করে নতুন যৌগের দল
নতুন প্রসঙ্গ
প্রাণ অণু পরমাণুদের রিসার্চ ওয়ার্ক
তাদের নতুন সমাজ