“সেই তৃণকবি আজ লতাগুল্ম আচ্ছাদিত,
উদ্ভিদ আত্মায় শুয়ে মিশে আছে নিশ্চিন্তপুরে“
সুমন প্রবাহন যার মৃত্যুর পর ‘সুমন প্রবাহন স্মরণ প্রয়াস‘
থেকে বের হয় তার কবিতার বই ‘পতন ও প্রার্থনা‘।
সুমন প্রবাহন এক আত্মহত্যার বাঁক। যে কিনা স্বভাবে
রিযায়ী হয়েও জীবনকে দেখেছেন বোধসম্পন্নতায়।
কেউ নই শূন্য মাতাল
প্রশ্নহীন আমি, পকেটে অসংখ্য ছায়াপথ
চোখে চাঁদের আকাশ, পায়ে তপ্ত কাঁচের কণা, ধূলিস্তর
এখানে ডানা মেলেছে উঁচু–নিচু বধির প্রান্তর
এখানে ছিঁড়ে গেছে বাতাসের কণ্ঠনালী
দূরে– শিলাকঠিন পাহাড়
শুকনো সাগর
অনাহারী ঝর্ণা!
কলঙ্ক! তবু রাজটীকা
ওই যে পৃথিবী নীল গ্রহ আমার
সূর্য! দেখি তোমাকেও
কখনও কন্যা রাশিতে কখনও তুলা, বৃষ–মেঘ–বৃশ্চিকে
দেখি গ্রহণের অক্টোপাসে, তবু
প্রশ্নহীন, পকেটে অসংখ্য ছায়াপথ
ভেসে যাই ছুটে ছুটে
যেন ধূমকেতু–আন্তঃনাক্ষত্রিক।
ক্রমপ্রসারমান ছায়াপথ থেকে
ছায়াপথে। বেড়াই। সাদা কিংবা কালো–
গুহা গহ্বরে,
সে আমার পর্যটন নয়, ধ্যান।
সাদা পাত্রে ধরা আত্মা আমার যেন সবুজ আপেল
ঝলসানো ব্লেডে কেটে দু’ভাগ
দ্বিধা থরো থরো, ভিতরে তবুও
হাজার বছর লাঠিতে ভর সলোমন
কমলা পিরানে প্রাচীন গাছের নিচে মুদ্রিত চোখে–
বিলীন হয়েছে, হবে
জন্মের পর নিরানব্বই ভাগ বীজ
টিকে আছে তার ওপারের একজন।
ভাবি, শূন্য হয়ে এক থেকে আজ ওই সাত–
খণ্ড।
নিজেরই তৈরি যে নরক–ক্লোন, গ্যাসচেম্বার
হাইরাইজ কুঠুরিতে ফেরো
–ক্লান্ত ফাইল তুমি
তোমার গ্রাউন্ড ফ্লোরের নিচে খুঁজে পাই ডাইনোসরের পা,
পায়ের ছাপ
নিঃশ্বাস
শীৎকার
শিলাস্তরে কেঁপে ওঠা রণের দামামা।
রেডিওর দ্যুতি ছড়াতে ছড়াতে
এই যে ছুটছি, ছুটে যাচ্ছি আলোর গতিতে গোপন কোয়াসার।
আমাকে পাওনি, পেয়েছে নূরের কণা
অথচ এত অহং দাবানল!
পুড়ে যাচ্ছে মাইল মাইল জনমনভূমি
ধসে পড়ছে পাহাড়, জনপদ
কোনও খোঁজ ব্যর্থ নয়
চোখে রেখো ওই ভস্ম
হে বোধি, বৃক্ষ আমার!
হে প্রকৃত রণ!
ফিরে আসব সংকোচনে
পাটি গোটাতে গোটাতে
ছায়াপথে পথে কালো গহ্বর নিয়ে হাতে
ঘূর্ণিপাকে উড়ে উড়ে যাবে বইয়ের খইয়ের পাতা।
তৈরি থেকো শেষ বারুদকাঠি
তৈরি থেকো হে বিরাট ধস!
পতন ও প্রার্থনা
যদি আমার উড়বার পক্ষে একজন
মানুষও না থাকে
যদি অবিশ্বাসের ছায়া দেখতে দেখতে
আমার বিশ্বাসের ভিত কেঁপে ওঠে
তবে আমি কার কাছে করবো অভিযোগ
মন আমার
লোকে লোকে হিংসার থাবা দেখে
আতঙ্কিত আমি
কার কাছে খুঁজবো
আশ্রয়ের প্রেরণা
লক্ষ রাতের প্রেরণা, কবিতা, প্রেয়সী আমার
আমার কাছ থেকে অনেক দূরে নারী
আমার কাছ থেকে অনেক দূরে সুরা
মগজের ঘুণপোকা
কুরে কুরে খায় আমার
মেধার ধার
আশা
ছেড়ো না আমাকে
পৃথিবীর যে ভ্রুণে জন্ম আমার
ফিরেছি তারই দিকে আবার
মানুষ তোমাকে দেবো
বলে রাঙা সন্ধ্যা
স্বপ্ন নির্মাণের
আমি কারিগর।
তারই অতলে লক্ষ যুগের
মুদ্রার শোক
বৃথা বন্ধন
আগুনে পুড়ছি আমি
যুগান্তের নির্মাণে
ভুলে ভুলে শোক ভুলে
আমি গেয়েছি প্রেরণার গান
স্বপ্নের নির্মাণ
বুকে যে ব্যথা
যে কথা
বলিনি কাউকে আমি
আমি শোক কুলের প্রাচীন কবি
যুগ্ম আধ্যাত্মিকতার নিপুণ কারিগর
অন্ধবিশ্বাস থেকে অবিশ্বাসে
ফের নিজেরই তৈরি
বিশ্বাসের দিকে তাকিয়ে
মহাজাগতিক সাফল্য আমি
পেয়েছি সত্যি
কিন্তু সে কথা শোনাবার
মানুষ জোটেনি
এখনও
কিংবা মানুষ আছে
দূরের মানুষ
কি লাভ হয় জানি না
এই অনর্গল আত্মরতিতে
তবু পৃথিবীর দিকে ছুঁড়বার
মতো আর কোন
ভাব আমার নেই
ফলে ক্রমশই সংকুচিত পৃথিবীর
জবুথুবু রাজা
নিকোটিনের দুর্ভিক্ষে
এতটা কাবু
ভিতরের মহাজগত হয়ে ওঠে
আরও আরও কোনঠাসা
ফলে মানুষ কী চাও যার বিনিময়ে
পাই কিছু স্বাচ্ছন্দ্যের স্বাদ
এই নাও কিছু অক্ষর সম্বল আমার
কিছু যাদুকরী ছবি
আর এক খন্ড কিতাব
আমার গ্রাম
চলে গেছে আমার ছোট্ট গাঁয়ে
মাঠময় গাভির ওলান, উঠোন, হেঁসেল
ছোট নদী, মাছ– মাছরাঙা
ধ্যানে থাকে
পুকুর পাড়ে
বড়শির জলা
শস্যক্ষেত, কাস্তে হাতে কৃষক
এই পৌষে
কুয়াশার চাদর মেলেছে
আমার ছোট্ট গাঁয়ে
ফসল তুলছে বদলি কাজের লোক
মালিকের ঘরে
স্কুলে ঘন্টা পড়ল
দলে দলে স্কুলছুটি বালক–বালিকারা
ফেরে ঘরে
ঝাউয়ে জাল ফেলে মাছ আজ তুলব না
কাছি বেঁধে খেজুরে বাট আজ বসাবো না
আঙিনার নিকট বনে বনভোজন
তাও নয়
স্ব’মিল নয় রাইস মিল নয়
এমনকি শিশুরহাটে আজ আর যাবো না
বরং কিছুক্ষণ
বড়শি হাতে
ছোট নদী, খালে
কাটুক সময়
মাছদুপুর আজ নামুক
মহাকালের লগ্ন কুড়িয়ে।
বুকের বোতাম খুলে দিলেই মাছ ছিলো
ভাবছি–
নৌকার দিন ভালো ছিলো
নৌকা নদীতে নির্ভর যাপনে।
বুকের বোতাম খুলে দিলেই মাছ ছিলো
চরে ধানক্ষেত পালংপুঁই
দিনভর নৌকা রোদে পুড়ে বপনমগ্ন
মন ঢেলে নদী ঢেঁকিতে
রাত এলে,নৌকা হাতে ছেড়ে নদীতে বেড়াতো।
নৌকা এখন মোটরগাড়ি
নদী উঠেছে রাস্তায়।
জ্যামে না পড়লে কথার অবসর হয় না
নদী ও নৌকার মতো কুল–কুল কথাতো নয়
বালু আর পাথরের ঘষ ঘষ কতক্ষণ।
রাতে গাড়ি গ্যারেজে আসে, থাকে কিনা জানি না
রাস্তা গ্যারেজকে ঘরে তোলে। পোশাক ছেড়ে বলে,
কোথায় কোথায় গাড়ি চালালে?
যায় দিন ভালো
আসে দিন কালো
রাস্তা লাবণ্য ঢালে বহুজাতিক কোম্পানির
পণ্য প্রপেলার, গাড়ি দৌড়ে দৌড়ে বড় জোর রানওয়ে।
রানওয়েতে কত বিমান ওঠে নামে!
তবু শখের বিমান উড়ে গেলে পর
হ্যাঙারে বসে গাড়ি ভাবে– যুগটা বিমানের।
বন্ধুত্ব ও দূরত্ব
ক’দিন দেখা হয়নি অথচ যেন বহুকাল…
বিকেল বারান্দায় বসে ভাবছি তোমার কথা
সামনের লেকের সিথানে পাশাপাশি দু’টি তালগাছ
দাঁড়িয়ে আছে
তাদের ছায়া জড়িয়ে আছে গোধূলি আলোর জলে
ভাবছি–
কেন যে গাছজন্ম হল না
একবার কাছাকাছি দাঁড়াতে পারলে
আর দূরত্বের ভয় থাকতো না।
গোধূলি দহন
ছুঁয়ে দিলে
আর সহসা সোডিয়াম প্রহেলিকার পেট কেটে
ছড়িয়ে পড়ে দুধজ্যোৎস্না।
ঠাস–বুনোট এ শহর গলি–উপগলি
আজ রেখায়িত ছোট ছোট জ্যোৎস্নানদী
এখনও মিহি জ্যোৎস্নায় লেপটে যাচ্ছে
হঠাৎ বাতাস
জানালার শার্সি ছুঁয়ে
জ্যোৎস্নার মাদুরে দু’জন ছায়া গোধূলি দহনে
নিখোঁজ আমাকেই পাই
তাদের আত্মায়।
আগুন ভাগ্য
কুয়াশা যাপিত জ্যোৎস্নায়
সবুজের অন্ধকার পাহারা দু’পাশে।
সাথে ঝাঁকে ঝাঁকে বাতাসের আপ্যায়ন
মাঝখানে আমি পথ, পথে–
নিকোটিন আহ্বানে সিগারেট নিই
বারবার জ্বালাতে নিয়েও জ্বলছে না
ভাবছি–
দিয়াশলাইয়ের প্রথম কাঠিতে আগুন জ্বলে ক’জনার!
পতন
ভূতগ্রস্থ মহাশূন্যে ঝাঁপিয়ে মেলেদি’ দু’হাত
শুনশান পতন নামে অস্তিত্বের চরাচরে
পতন ডানার এ ঝাঁপে হারিয়ে ফেলি সময়
বুকের ভিতর ওৎ পাতে সময়হীন মহাকাল
স্থানিকতা শূন্য এ যাত্রায়,
যা দেখি সেখানে চোখ নয়
যেখানে চোখ সেখানে দৃষ্টি নয়।
সমাধিস্থ আত্মার পর্দা ছিঁড়ে তাকালে,
পৃথিবী নামে
ঘরে কবরের দাগ
ঝোড়ো কাকের মড়ক সংসারে
কোথায় আমি!
জানি না, জানার নেই।
অন্ধকার রাতে নিজস্ব নক্ষত্রের পাহারায়
অনেক চেনা কবরের অচেনা অন্ধকারে
কংকালের গলা জড়িয়ে ধরি
মা, আমার গায়ে খুব জ্বর!
মৃত্যুক্ষুধা
যাচ্ছে তারা যাত্রীদল; পশ্চিম অভিমুখে সওদাগর
দেশে দেশে বিক্রি তাদের।
যাবো–
আমরাও যাব ঠিক হয়তো বাণিজ্যে নয়
যেভাবে প্রাচীন প্রজ্ঞা দূরগামী হতো
চত্বরে দাঁড়িয়ে দেখি
কারখানা থেকে নেমে আসা যন্ত্রযান
তাদের অটো সিগ্ন্যাল।
সভ্যতা এগিয়েছে বেশ
হাওয়া চিরে মেঘ ছিঁড়ে যন্ত্রপাখি।
জানিনা এখন কোথায় দাঁড়াতেন রবীন্দ্রনাথ,
কিংবা আইজ্যাক নিউটন
তাদের চোখের বিস্ময়
আমার চোখে লাগে
আর আমি বেকুব চুপ।
রাত একটা পনেরো মিনিট
ফাঁসির কাঠে ঝুঁকে রইলাম এবং নিঃশব্দে দীর্ঘ শ্বাস
প্রশ্বাস আমার পাকস্থলি ঘুরে আসে
মায়ের চুলের গন্ধ মনে আসে
শিশুদের কথা ভাবি কল্পনার
এত সুন্দর আমার শিশুরা আবারও জীবন পেতে ইচ্ছে হয়
মনে হয়
সুদীর্ঘ আদিম হতে এই যে মানবযাত্রা
এর শেষফল এই শিশু
যতনের হীরামণি !
বর্ষা জানালায় ভিড় করে স্মৃতিচারণে।
এখন কুয়াশায়–
চাদরমুড়ি ভাঁপা পিঠা
জেনারেল আমার মৃত্যুযন্ত্রণা বেশিক্ষণ স্থায়ী না হয়
জেনারেল দ্রুত; দ্রুত করো
আর আত্মায় ভর করে চলে যাবো
নিঃশব্দে অস্পৃশ্যালয়ে
ধ্রুবতারা দেখে
কখনও ডানে ভর করি কখনও বামে
আর আমি তো সূক্ষ্ম সুতোয় ভর করে
টলে টলে হাঁটি
ধীরে খুব ধীরে হাত সামলে নেই
উৎপল আমায় জানিয়েছে এমনই হয়
তবু আমি সমুদ্রপাড়ে দীর্ঘ প্রলাপে প্রলাপে ভাবি
শেষ নেই
জেনারেল এসব কথা হয়তো আপনি জানেন
আপনার উপস্থিতিতে আমি বলে উঠি, ইয়েস্ স্যার
এবং হাঁটি, বাম ডান… বাম…
এবং আমি ফাঁসি কাঠে
জেনারেল ফাঁসির কাঠে আমার দীর্ঘশ্বাস
আপনি মনে রাখবেন।
আমার ফায়ারবক্সটা খুঁজে পাচ্ছি না
জেনারেল সিগারেট
জেনারেল ম্যাচটা ধরুন
আমার হাতটা উড়ে গেছে।
জেনারেল মাথায় আমার নিকোটিনের আহ্বান
কে জানে জন্মঘোর পেয়েছে বুঝি
তবু ভালবাসি
হাত থেকে সিগারেট খসে পড়ে
জেনারেল আমি অজানায় কাঁপি
জেনারেল আমি অজানা
জেনারেল প্রধানমন্ত্রী আমার খবর রাখেন
জেনারেল বিরোধী দলীয় নেত্রী
খুব শাসিয়ে গেলেন আমাকে
জেনারেল তবু সিগারেটের অবশিষ্টাংশে
ঠিকই চুমুক দেব
হয়তো খাবো আর এক কাপ চা
হয়তো জোর করে বলবো, মামস্,
বলো না স্কুলে কি হলো ?
লাবিব, আসো আরও কিছুক্ষণ বালু–ট্রাক ভরি
জেনারেল আপনার হাতের স্পর্শে
জোনাকি পোকা নিভে গেল
জেনারেল আমি
কখনও চোখের জল
দেখাবো না কাউকে
বাঁশি বাজে খুব
বাঁশি বাজে খুব
আমি সুরের পাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়ি
জেনারেল এমন হয়
আমাদের অর্থ্যাৎ কবিদের
আপনাদের হয় কিনা জানি না
এখনও রাত জাগা কতটুকু স্থির হবে
স্থির করতে পারিনি
এখনও ভোর কতটুকু হবে স্থির করতে পারিনি
প্রায়ই আমি কিছুই স্থির করতে পারি না
বুঝলেন জেনারেল
আমার হয়, আপনার মত জানাবেন
আপনার সাথে
দুপুরের খাবার খেতে খেতে
মাংসের পেশি খুব ধীরে ধীরে
চিবুতে চিবুতে আমরা
রাষ্ট্র–বিপ্লব নিয়ে ভাববো না হয়
ভাববো আফগানিস্থান অতীতে কিংবা
বর্তমানে কতটা স্বচ্ছল আছে
আর পিপাসা
রাত যত গভীর হয়
আমার কণ্ঠনালী বেয়ে নামে পিপাসা
পিপাসার পুত্র আমি
বাবার নাম আকাশ নীল
এসব কথা যদি রাষ্ট্র হয়ে যায়
খুব একটা ভাববো না আমি
বরং ভাববো
এ বছর বোমার আঘাতে কতজন মানুষ পঙ্গু হলো
ভাববো; হয়তো কিছুই ভাববো না
বিবশ হয়ে বসে দেখবো
চড়–ই বাঁধে বাসা
প্রান্তে আমার ঘরের
শালিকেরা উড়ে গেছে কবে বহুদূরে।