‘there is no frigate like a book/ to take us lands away/ nor any coursers like a page/ of prancing poetry’ – [Emily Dickinson]
স্কুল মানেই তো বই খাতা কলম ছেঁড়া নিউজপ্রিন্ট খাতা। স্কুল মানে কিন্তু কবিতা নয়। কবিতা মানে স্কুল পালানো। য়্যুনিফর্ম লুকিয়ে ফেলে হারিয়ে যাওয়া। স্কুল পালিয়ে রবীন্দ্রনাথ হওয়া না গেলেও পাখি হওয়া যায়। ধবধবে সবুজ হওয়া যায়।
‘ছুটিপ্রাপ্ত বালিকারা দু’পা এগিয়ে মোচড় মারে নদী ঢঙে/ আমি বনে যাই— স্কুলের হলুদ দারোয়ান’ [স্কুল পালিয়ে]
ছুটির ঘণ্টা সিনেমাটির কথা মনে আছে? নায়করাজ রাজ্জাক অভিনীত? স্কুল পড়ুয়া বাচ্চা ছেলেটির টয়লেটে আটকে পড়া মৃত্যুর মতো ভয়ঙ্কর — স্কুল। স্কুল— রাগী মাস্টার মশাই। ক্লাস-পরীক্ষা আমার কখনও ভাল লাগেনি। কেবল ভাল লেগেছিল এক— শিলাদিমণি। ভাল না লাগলেও আমি স্কুল পাশ। পাশ করে বর্ষীয়ান স্কুল মহাশয়ের মতোন আমিও বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। স্কুল কারও ভাল লাগে না। তবু অধিকাংশ স্কুলে যায়। এবং স্কুল জীবন শেষে সবাই স্কুল বিষয়ক স্মৃতিকাতরতায় ভুগে। বছরে বছরে রি-য়্যুনিয়ন করে।
আমি একটি ব্ল্যাকবোর্ডকে সাদা চকের লোভ দেখিয়ে/ ভুলে গেছি আমার ডাস্টারজীবন। সুন্দরবনে জারুল/ গাছে বসন্তবৌরি এসে হাওয়ায় মেলায় গলা।’ [গ্যাব্রিয়েল সুমন]
তখন বালক বয়েস। হাফপ্যান্ট ছেড়ে ফুল প্যান্টে ঢুকে পড়ার দিন। ফ্রক ছেড়ে সালোয়ার কামিজে অভ্যস্থ হওয়ার সময়। দুরু-দুরু বুকের অ্যাসেম্বলি। রোল কল। ফেলে আসা জ্যামিতি বক্স। মারমুখি বেত। দপ্তরির ঘণ্টা। নিজের ভেতর নিজেকে আবিষ্কার।
‘নামের পেছনে দৌড়াচ্ছিল গরু। গরুর পেছনে রাখাল। রাখলের হাতে লাঠি ও দড়ি। সুযোগ পেলেই পরিয়ে দিবে গলায়। দৌড়ায় গরু, ওড়ে লেজ, নড়ে দুগ্ধ ওলান। একটু থামলেই ধরে রাখাল চুষে নেবে বাট। দৌড়াও গরু দৌড়াও। পার হয়ে যাও একাডেমির মাঠ।’ [অপাঠ্যসূচি]
এই যে স্কুল ভয়— এটা সংক্রামক। এই ভয়ের পেছনের ইতিহাস করুণ। ধূর্ত শেয়াল; মস্ত টোলপন্ডিত — যে বিদ্যার্জনের নাম করে কুমিরের বাচ্চা সাবাড় করেছিল…
we don’t need no education
we don’t need no thought control
no dark sarcasm in the classroom
teacher, leave them kids alone
[Another Brick in The Wall-Pink Floyd]
…তারপর অঙ্গুলিমাল। যিনি গুরুর দক্ষিণা পাঁচশটি কাটা আঙুল মালা বানিয়ে দানের জন্য চারশ নিরানব্বই জনকে হত্যা করেছিলেন এবং মাতৃহত্যার দিকে যাচ্ছিলেন এগিয়ে; কিংবা ধরুণ— মহাভারতের একলব্যের কথা; যে একলব্য দ্রোণাচার্যকে গুরু জ্ঞানে পুজা করতেন অথচ ক্ষমতা দ্বন্দ্বে, ক্ষমতাবান অর্জুনের জন্য গুরু দ্রোণাচার্য কেড়ে নিয়েছিলেন অন্ত্যজ একলব্যের বৃদ্ধাঙ্গুল। তো স্কুল/বিদ্যালয় এমন কিছু বৈষম্য তৈরী করে। করে নাকি?
‘ওই যে সদ্য এলেন পেকে/ হাড়ের ডালপালা থেকে/ তিনি হলেন বিদ্যালয়/… আর যত মাস্টারনী-গাইনী বেরুচ্ছে/ ওইসব, পিপীলিকার মতো ঝাঁকে ঝাঁকে তারা দলবল বেঁধে।’ [আমির খসরু স্বপন]
স্কুলে সবচেয়ে জনপ্রিয় রচনাটির নাম সম্ভবত ‘শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস’। এবং বাংলা ফিল্মে এই নিয়ে যথেষ্ট কাজও হয়েছে। অকাল প্রয়াত অমর নায়ক সালমান শাহ’র একটা সিনেমাও আছে এতদ্ববিষয়ে। মহামতি জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক একবার আহমদ ছফাকে (যদ্যপি আমার গুরু) বলেছিলেন, অহরহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না করে স্কুলের ভিত শক্ত করতে। বিদেশে যেরকম হয় আর কী…। তো এসব জ্ঞানতাত্ত্বিক কথা। বলা যাক, এমন কেউ কি আছে যে স্কুল পালায়নি? স্কুলে পড়ার সবচেয়ে আনন্দ ও উপভোগ্যের বিষয় হলো স্কুল পালানো। আমি তো সেই ক্লাস সেভেন থেকেই স্কুল পলাতক, ঘর পালানো ছাত্র। সেই যে পালিয়ে এসে শহরে একবার, আর ঘরে ফিরতে পারিনি।
‘ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেপ সমস্ত কাগজ/ আমি বাজে ছেলে, আমি লাস্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না!/ ক্ষমা করবেন বৃক্ষ, আপনার শাখায় আমি সত্য পাখি বসাতে পারবো না!/ বানান ভীষণ ভুল হবে আর প্রুফ সংশোধন করা যেহেতু শিখিনি/ ভাষায় গলদঃ আমি কি সাহসে লিখবো তবে সত্য পাখি, সচ্চরিত্র ফুল?/ আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ!’ [আবুল হাসান]
তো স্কুলে না যাওয়ার বিভিন্ন কৌশল আমি রপ্ত করেছিলাম। সাদা য়্যুনিফর্ম ফুটবল খেলার নাম করে কাদায় চুবিয়ে নিতাম বা স্কুলে যাওয়ার পথে অসুস্থতার ভান করে রাস্তায় পড়ে যেতাম; আরেকটু বেশী হলে গলায় হাত ঢুকিয়ে বমি করতাম। কিংবা স্কুলে গেলেও বন্ধুদের সাথে পালিয়ে চলে যেতাম রাজারকুল। বাঁকখালী নদীতে।
‘ঐখানে নদীদের স্কুল; চর্চা হয় জলের স্বরলিপি/ কান পেতে শুনে ন্যাড়া চাঁদ মাতাল তরণী।’ [রাজারকুল]
আমি কেবল স্কুল থেকে পাঠ্যবই থেকে দূরে থাকতে চেয়েছি। এখনও তা চাই। পালিয়ে যেতে চেয়েছি রাজারকুল। হতে চেয়েছি কাকতাড়–য়া। তো এখন এটার নামকরণ করা যাক—স্কুলফোবিয়া।
‘হায় সময় কাটাই আমি বসে বসে/ ভয় ভীতি আর করুণ দীর্ঘশ্বাসে।/ বইতে আমি পাই না খুঁজে মজা,/ স্কুলে মন বসে না বেশ সোজা/ বই পড়তে মন চায় না মোটেই।’ [উইলিয়াম ব্লেক]
শুক্রবারের জন্য আমরা অপেক্ষা করতাম। অপেক্ষা করতাম ডিসেম্বরের ছুটির আর গ্রীষ্মের বন্ধের জন্য। বন্ধ মানে ব্ল্যাকবোর্ডে চকের কুচকাওয়াজ থেকে মুক্তি।
‘ব্ল্যাকবোর্ডে আর চকের ঘর্ষণে মাতবে না বেঞ্চ’ [শিলাদিমণি]
পুরাতন সব পড়া ভুলে যাওয়া শেষে আমরা অপেক্ষা করতাম নতুন বাঁধাই করা বইয়ের জন্য। সবচেয়ে আবেদনময়ী বইটির নাম হতো— ‘সহজ পাঠ’। সবচেয়ে মনোটোনাস বইটির নাম— ‘নিম্ন মাধ্যমিক গণিত।’
‘অনেক কিছুই তবু বিশুদ্ধ গণিত শাস্ত্র নয়/ লিখিত বিশিষ্ট রূপ গণিতের অআকখময়/ হয় না, সে সব ক্ষেত্রে উপযুক্ত গণিতসূত্রের/ নির্যাস দর্শনটুকু প্রয়োগ ক’রেই বিশ্লেষণ/ করা একমাত্র পথ, গণিতশাস্ত্রীয় দর্শনের/ বহির্ভূত অতিরিক্ত দর্শন সম্ভবপর নয়।/ সেহেতু ঈশ্বরী, দ্যাখো গণিতের ইউনিট/ পাউন্ড সেকেন্ড ফুট থেমে থাকে চুপে,/ এদের নিয়মাবদ্ধ সততা ও অসততা মনস্তত্তে¡ বর্তমান ইউনিট রূপে/ আলোকিত ক’রে রাখে বিশ্বের ঘটনাবলী, চিন্তনীয় বিষয়গুলিকে/ সিরিজের কতিপয় টার্মের চরিত্র ফুটে চরিত্র নির্দিষ্ট করে’ [বিনয় মজুমদার]
তো এসব নতুন কেতাব নিয়ে আমরা ভয় ও বিরক্তি নিয়ে পুনঃ স্কুলে যেতাম। ভাল ছাত্ররা পড়তো খুব (তাই বোধহয় ভাল)। আমি পড়তাম সবুজ মাঠ, সাদাকালো ফুটবল।
‘কেতাবে কিছু ভুল পাইবে আর/ কেতাবে দৃশ্য পাপীদের’ [রজত সিকস্তি]
ফরাসী দেশ নাকি রক্ষা করছিলো ফেল্টুসরা। আমার স্বপ্ন ছিল ফেল্টুস হয়ে দেশের মধ্যমণি হওয়া। স্কুল পলাতক কবি হওয়া। জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার আগে আমরা অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে শপথ নিতাম— আমরা এই শপথ গ্রহণ করিতেছি যে…
‘this man had kept a school/ and rode our winged horse’ [W.B. Yeats]
দেশমাতৃকা রক্ষার শপথ। এই শপথ গ্রহণ কেউ মনে রাখে না। আমিও রাখিনি। স্কুল আমাদের কিছুই শেখায় না। শেখানোর ভান করে। চাকর বানায়। স্কুলের সবচেয়ে ভালো দিক হলো— সে আমাদের কিছু শ্রেষ্ঠ বন্ধু দেয়। তারপর আমাদের শেখায় কিভাবে সব ভুলে যেতে হয়। কিভাবে প্রতিষ্ঠানের দাস হতে হয়। শিক্ষিত-অশিক্ষতদের মধ্যে একটা ডিসক্রিমিনেশন তৈরি করে স্কুল।
‘কে যেন অদৃশ্য ডাস্টার হাতে/ আমাদের সব বীরগাথা মুছে দিয়ে যায়? আগামী শিশুরা শুধু বসে থাকে/ চিবুকে দু’হাত রেখে/ চোখের সামনে নিয়ে বিবর্ণ ব্ল্যাকবোর্ড।’ [ত্রিদিব দস্তিদার]