কাজল শাহনেওয়াজ
হাসপাতালে
ভালবাসি তাই বশ্যতা স্বীকার করতে দ্বিধা নাই
হাসপাতাল ছাড়ার আগেই মহাশুন্যের চিত্রময় সর্বশেষ ছবিটা প্রকাশ পেল
আমি ঠিকমত শ্বাস নিতে পারছিলাম না বলে
তুমি মন খারাপ করে আমার সাথে জেমস ওয়েবে চোখ পেতে ছিলে আর ভাবছিলে
আমি কি আর দম ফিরে পাব না?
তোমরা মহানগরে উল্লসিত তুমি গ্রামে বসে লাল রঙের জাল ফেলতে দেখছ
আমি এর মাঝখানে পড়ে আছি হাসপাতালে
আমি কবি
আমার কোন বন্ধু নাই
আমি বহু দিন ধরে একা
শৈশব থেকে
অনেক নির্জন উপকুলে নায়িকার রূপ দেখে কেটে গেছে বেলা
আমার দুই ফুসফুস আক্রান্ত হয়ে
আজ ক্লান্ত হৃদয়
মৌসুমি হাওয়া দোলা
কালের গালে একটা চুমু দিতে তৎপর
সর্বদা শুধু বেদিশা
হাসপাতালে
কেন গো আল্লা কিছু ঘাস পাঠালে
এ ধরনীতে আজ সকালে
একটা ইন্দুর কাটে কুট কুট পরমায়ু
আমি হেসে উঠি
ঘাস খাই
তারপর চিবুকের দাড়ি কেটে ফেলি!
শিবলী মোকতাদির
ডাক্তার
এমন শ্রাবণে;
হাসপাতালের পাশে ভাঙাচোরা ট্রাক,
পড়ে আছে বহুদিন।
তাদের চুপসে-যাওয়া চাকার নিচে ছত্রাক
আশেপাশে রক্তমাখা তুলো, ব্যান্ডেজ…
কিছুটা দুর্গন্ধ, অভিমানী নার্সদের সাথে তার
চূড়ান্ত প্রকাশনা, অসাধ্যের ছড়াছড়ি।
তবু এই নির্জন বসন্তে;
প্রতিদিন মেডিক্যাল পড়ুয়ারা দলবেঁধে আসে, তাই—
ঝুঁকে পড়ে তারা ট্রাকদের দেখে।
ঘন চৈত্রে;
ভাঙাচোরা ট্রাকগুলো পড়ে থাকে বহুদিন।
বিনয় কর্মকার
দ্বি-কোণমিতি
হাসপাতাল পাড়া জুড়ে, গল্পগুলোই এমন;
দ্বৈতসত্তা খেলা করে, ডাক্তার-রোগীর পেট ও পকেট।
ওদিকে ঝিলিক চোখে চেয়ে থাকে ফার্মেসি।
আর;
মৃত্যুশোক পাশকাটিয়ে হেসে ওঠে কফিন সজ্জিত প্রতিটি দোকান।
বানিশান্তার মেয়েটা কেমন অবলীলায় বলে গেল,
শরীর খারাপের দিনগুলোতেই আমরা ভালো থাকি!
আর-তোমরা শরীর ভালো থাকার দিনে।
নয়ন আহমেদ
হাসপাতালে
হাসপাতালের রাত- দিনগুলো কমলালেবুর মতো ;
কেমন আদুরে!
অসুস্থতা গলে গলে নামছে ভোরের আদলে
ধীর পায়ে ;
যাবে রূপকথার দেশে।
সূর্যোদয় হাতে তার।
রঙধনুকের সাহসী ডানায় সব লাল মেখে যাচ্ছে কোথায় ।
কোনখানে?
শুশ্রূষা এখানে রূপসী ঘুম নিয়ে আসে।
বড় আপা ! বড় আপা !
তোর নিঃশ্বাসের গন্ধে রজনীগন্ধা ফোটে।
কাশফুলের মতো নার্সের ভোর নেমে আসে।
ফেরদৌস মাহমুদ
হাসপাতালের বেডে একটি বিড়াল দেখে
আমাদের ফুপাতো নদী মানে বাবার বোনের বড় সন্তান
৩টি গুলি খেয়েছে
২ টি রানে ও ১টি পাকস্থলীতে;
নদীটি আমাদের ব্রিলিয়ান্ট ছিল না, সাহসী ছিল
তার
একাউন্টসে টাকার পরিমাণ অগণিত
এরোপ্লেন ৭ টি;
তার ধার্মিক মা প্রথমে ওই টাকা গ্রহণ করেননি
আজ তিনি ওতে অভ্যস্থ; অর্থাৎ
অন্যায় এমন এক খেয়ালি ঘোড়া
যা বহুল প্রচলিত হয়ে গেলে তাকে আর
অন্যায় মনে হয় না, সেই অর্থে
পৃথিবীতে ইদানিং কোন অন্যায়ই নেই!
শামীম হোসেন
হাসপাতালে শাদাদিদি
ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরে বেড়ায় শাদাদিদি
বেডে বেডে সৌরভ ছড়ায়¬
লিখে দেয় বকুল ফুলের ঠিকানা।
আমিও নিকটে যাই, দিদির নিকটে
দেখি ঘাম জমে আছে শ্যামলা ঠোঁটে!
অসুখের কথা তাকে জানাই ইশারায়
হাসপাতালে দিদি দেখলেই
অসুখ বেড়ে যায়…
পিয়াস মজিদ
হাসপাতাল থেকে
হাসপাতালে ঢুকলে
মনে হতে থাকে
০১টা চন্দ্রবিন্দু-বিহীন হাঁস
এমন মাটিরে পানি ভেবে
তই তই করছে
যেখানকার মূলত
আকাশই পাতাল।
প্রেসক্রিপশন
সিরিয়াল
ইনভেস্টিগেশন
ডেলিভারি
আর
ওষুধি হাওয়ায় সঙ্গে
চুটিয়ে প্রেম জমিয়ে
হাসপাতাল থেকে
বেরুতে বেরুতে দেখি
আমারে
আকাশে ফেলে রেখে
পৃথিবী নামের
প্রকাণ্ড পাতালে
চন্দ্রবিন্দু ছাড়াই
হাঁসটা ঢুকে যাচ্ছে
তই তই করছে!
সোয়েব মাহমুদ
হাসপাতাল, এসো বাড়ি যাবো
অতঃপর হাসপাতাল,
একটা অপহরণের দুপুর চেপে বুকে জন্মের খোঁজ নিতে বেরিয়ে পড়লো।
অথচ এই যে গতকাল বিকেলে,
আমি আমার শরীরে রেখে হাত,অনুভব করছিলাম
বুকের ভেতর ক্ষয়িষ্ণু জ্বর।
থার্মোমিটার গুলো যখন অপারগ তখন
এইযে আমি
কবিতার শব্দগুলোর শরীর থেকে খুলে
নিয়ে কাপড়-জামা;
পাশে বসে নিয়ে আরোগ্যসদন ভাবছিলাম
কিভাবে নিজের অসুখ
নিজেই সাড়াশব্দ শব্দহীন ভালো করা যায়!
ঠিক তখন
তোমার আয়নাজামায় ভেঙ্গেচুরে পড়ে যাওয়া আমাকে
দ্বিধাহীন তুমি ধ্বসের ভেতর থেকে আমাকেই বপন
করে তুলে নিচ্ছো এক-একটা ফুল।
হাসপাতাল,
আমি বাড়ি যাবো,
এইসব ফিনাইল গন্ধ দেয়াল
আমার ভালো লাগেনা।
এইসব সাদা বিধবার রঙ আমার চোখে সয়না।
হাসপাতাল,
আমি ঘর নিয়ে আজ
অথবা কাল বাড়ি ফিরবো।
সন্ধ্যার রিকশায় চড়ে
তোমার আঁচল হউক আমার একমাত্র কাফন!
হাসপাতাল,
অপহৃত দুপুর নিয়ে
তাই আমি চড়ুই
বেরিয়ে পড়ছি নিতে আমার জন্মের খোঁজ!
গৌতম কৈরী
হাসপাতালে লেখা কবিতা
কাল রাতে আমি কালো গুইসাপ ছিলাম
আজ সকালে খোরগোশ।
রোদের সাথে আজ আড্ডা হবে
কথা দিয়েছে বাগানবাতাস।
ছাতা হাতে দেখতে এসেছে অ্যাটেনডেন্ট।
হায়দ্রাবাদ। এআইজি হসপিটাল।
নাঈম ফিরোজ
হাসে পাতাল, কাঁদে আসমান
বাদ এশাতক বাস বে’তে দাঁড়িয়ে
কিছু একটা হাতড়াচ্ছে
একটা পাগল—
“মেহেরবানি করে দেখুন ত— ওটা আপনার পায়ের কাছে কীনা?”— তারে ডেকে বলে—
‘আ নারভাস প্যাসারবাই’।
সে নিচে তাকায়া বলে, “না অইটা আমার না। ওখানে অনেক… অত আমার না!”
সে বলে আমার পকেটে ছিলো…
সে বলে আমার বুক পকেটে ছিলো…
সে বলে আমার পাঞ্জাবির বুক পকেটে ছিলো…
“ক্যাওয়াজ কইরেন না তো এখেনে, ভাগেন মিঞাঁ!”— শুধায় তারে বাস-টিকেট-বেচা লোকটা।
সে বলে চলে— দুরন্ত দিল আনচানে, তার উদভ্রান্তি ঢেকে, ‘ছিলোতো, আরে ছিলোতো, কই গেলো, এখন আমি কী করবো, যাবো কী হারে, ক্যামনে কী?’
“বিড়বিড় করে যায় সে— হাসপাতালের-বেডে- শোয়া-মায়ের শেষ একখান ফটো ছিলো না আমার বুকপকেটে? সেইটা কই? আরে আল্লা অইটা কেন পাইনা!”
তার মায়ের ছায়া ও শরীর— কোনোদিন পাবে নাকি সে আর, পায়ের কাছে পড়ে থাকা ‘দুনিয়া’ থেকে?
তার এই বিধুর বিলাপে—
হাসে পাতাল, কাঁদে আসমান— অনঘ অবলীল মেঘেরাও..
সাম্য রাইয়ান
ফুলকুমার
মানুষের প্রতি নিষ্ফল প্রণয়যান
এড়িয়ে চলেছি আমি৷ দেখেছি
সেসব জীবনের ব্যর্থ অভিযান৷
মৃত্যুকে নেমন্তন্ন করে
দরজা আটকে বসে আছি৷
চারিদিকে শুধু মানুষ৷
বাড়ির মোড়ে মানুষ
বাজার ভর্তি মানুষ৷
গোরস্থানে মানুষ আর
হাসপাতালগুলো ফাঁকা৷
জ্বরের পাশ দিয়ে ফুলকুমার…
ভরা পূর্ণিমায় বাড়িতে থাকতে নেই৷
মোস্তফা হামেদী
প্রিয় দর্শনে
আমাদেরই পাশ ঘেঁষে শ্যামলীর জ্যাম নিজের চরিত্রে সাবলীল। ঝিলকে উঠছে রূপ দুপুরের রোদে। এ নির্বিকার নগরের কণ্ঠি ঘেঁষে
বড় কড়ুইয়ের পাতাটি তখনও দুলেই চলছে।
কেউই জানছে না এখানে একটি লোক লড়ে যাচ্ছে জীবনের সাথে।
যেন ‘কবুল’ বলে ফেলে কেউ প্রিয় দর্শনে হয়ে উঠছে উন্মুখ।
অশান্ত দুটি হাত সজোরে সরিয়ে দিতে চাইছে আমাদেরই আকুল বন্ধন।
চোখ যেন খুঁজে পেয়েছে নিশান। শরীর স্রেফ খোসামাত্র
ভেবে খোসামুদে ফিরিয়ে দেন দুনিয়াকে।
রুহ মোবারকের ভিতর ঢুকে পড়ার আগে শিশুর সহজতায়
চেখে নেন আলো ভরা দিন।
মানুষ হাঁটছে। হাসছে। ছোট স্বরে কথা বলছে।
আমার বুকের ভিতরে ‘আব্বা আব্বা’ ডাক ভারী হয়ে উঠছে ক্রমে।
বিপ্লব রায়
কমলালেবু
মা, অন্ধকার বারান্দায় তবে আরো দীর্ঘ রাত
ওরা বলেছিল- পুরোটা আনো, তবেই ছুঁতে পারা যাবে
হাত তোমার,
চুড়ির স্পর্শ আর আঙুলের সেই কাটা দাগ।
অদূরে যতোটা ঝিঁকির কোরাস- আরো কতকটা হিম
নামিয়ে রেখেছে ময়লা বেড থেকে শীতল মাদুরে যখন।
মা, বড়ো ভাইয়ের তো আসার কথা ছিলো কারখানা থেকে সরাসরি
যদিও ফোন ধরছে না আর কত আত্মীয় স্বজন
লোকাল ট্রেনে ফিরে গেলো যারা, সবাই শহরে ছিলো।
মা, একটা গ্রিলের ওপার থেকে তোমার ঘ্রাণ পাচ্ছি
এখনো, একটা পানির গ্লাসে কিছুটা পানি,
সিরাপের শিশির পাশে আরো একটা পিঁপড়ের সারি।
একাকী একটা মেয়ে এই শহরের কলরবে
ভাবছি, শুধু ভাবছি;
হাসপাতাল- ফেরত এইসব কমলার তবে কি হবে!
তানজিন তামান্না
মিনু
পেছনে ফেলে এসেছি হেমায়েতপুর
তারও অধিক পেছনে ফিরলে—
একমাত্র মানসিক হাসপাতালের ঝকঝকে
করিডোর ধরে পৌঁছানো যায়—
বন্ধ কেবিনের দরজার সামনে।
খোলা জানালার কাছে এসে দাঁড়ায় মিনু;
মিনুকে ঘিরে উৎসুক আমার ছোট্ট হৃদয়!
তাঁর ভাঙা ভাঙা তোতলানো উচ্চারণে
পাল্টে যায় আমার ডাকনাম।
তারও অধিক গালভরা হাসিঝনঝন নাচে তাঁর শিকল বাঁধা পায়ে—
কাউসার সাকী
তাপমাত্রা
ট্রেন চলে যাওয়ার পরও
কী যেন থাকে
বুকের ভিতর বেড়ে ওঠে
জ্বরের মতন
জ্বর বাড়বে তাই
থার্মোমিটার লুকিয়ে রাখি
কিন্তু ট্রেন,
এই এত দীর্ঘ পাইথন আমি কই লুকাব!
দুই.
রিলিজের পর নি:সঙ্গমাত্রই জানে এ সত্য
মানুষই মানুষের হাসপাতাল; স্পর্শ পথ্য
শিহানুল ইসলাম
শিক্ষানবিশ তরুণ ডাক্তার
এবং
সাইকেডিলিক ছুরি-কাঁচি
পরিধী প্রান্তরেখা ধরে মূষিক ভাঙছে ক্রমশ বৃত্তের দেয়াল
আর চেয়ে দ্যাখে ক্যামনে আরক্ষ জানুদেশ হোতে তার
বিলীয়মান সুরের তন্তুরেখা খসে পড়ে গেলে এর সাথে
কেন্দ্র হোতে পরিকেন্দ্র বরাবর
সহস্র বৃত্তের আঙিনা মৃত নক্ষত্রের মতন ফুটেছে ক্রমশ
পৃথিবীর সমস্ত ব্যস্ততায় যখন ক্লান্তি এসে
অশ্বত্থের ডালে ডালে মিমিক্রি করেছে মৃত্যুগামী স্বর্ণগুড়ারোদ
হাসপাতালের বিষণ্ন ধূমল করিডোরে প্রায় সান্ধ্য বেদনারা-
টিন্ডেলবার্গের ধূসরিত চিলতে আলোর তূণে
বিদ্ধ করে পিতার শিথিল হাতে তার প্রিয় প্রিয়তমাটির
পাণ্ডুর ডেথ-সার্টিফিকেট-
শিক্ষানবিশ তরুণ ডাক্তার ত্রস্ত পেনসিলে আঁকে গাঢ় ব্যথা
গূঢ় লীন য্যানো একেকটা অশ্লেষা নিহত শব্দের ডানায়
উড়ে গেছে একটা নীল মাছি হঠাৎ কোথাও
নিখোঁজ সমন বয়ে এনে-
অস্তগামী তুরুপের সাময়িক গর্বিত গ্রীবার ভঙ্গিমায়
মানুষ মৃত্যুর পরে যেইসব মাছিদের পাখনায় চেপে বসে
উড়ে উড়ে সাইকাডিলিক জীবন চিনেছে-
সম্পর্কের প্রেক্ষা ডিঙ্গায়ে আবার এসেছে নতুন মাছি তার
বেপথু মর্গে হিম-চেম্বারে অশ্রুবাষ্প মেখে
হাসপাতালের শূন্য শয্যাগুলো যতটা শূন্যতা হৃদয়ে বাজায়
দেখেছি সেরূপ এক মাছরাঙাটির প্রিয় নিঃসঙ্গতা-
শিকারের খিপ্র বাসনা কতটা স্বৈর হোলে মীনের হৃদয়
জলেদের রাজ্য হতে বিতাড়িত হয়
প্রকৃত সাঁতার ভুলে নীলিমায় অপরূপ চন্দ্রখচিত শোভন
একদা সে দ্যাখেছিলো এক শুক্লাপক্ষ তিথি
শ্যামাসুন্দরী বয়ে গেছে আকীর্ণ সেই জোনাকিপ্রধান রাতে
জলজ জ্যোৎস্না গলিত রূপার ঘ্রাণ গায়ে মেখে মেখে
রজঃফুলকার বুদ্বুদে গোলাপ ফুটিয়ে তার মৎস্যিনীর সাথে
ব্যর্থ মীনকাহনের দিনে-
উডুক্কু মৎস্য চোখের বিস্ফার জিজ্ঞাসায় সেই নীল মাছি
বেকসুর এসে ঢুকে গেছে মহা-জাগতিক রশ্মি অভিখোঁজে
নোমান প্রধান
দিনের দিন আখেরী
সিলিন্ডার থেকে সন্তপর্ণে মেপে মেপে আসছে দম
স্যালাইন নল বেয়ে সাপের মত নামছে তরল রিজিক
স্যাভলনের সান্দ্র ঘ্রাণে হাসফাস জন্মে বাতাসে।
স্বাভাবিক রক্তচাপ ধরে রাখতে লড়ছে শিরায় ঔষধ
সুঁই বয়ে ক্যামিকেল ছড়িয়ে পড়ছে দেহে ফ্যাসিবাদের মত!
সুতোয় ঝুলছে তাপ পঞ্জিকা, পারদ যেনো পাগলা ঘোড়া
সবাই বলছে – আর একটু, আর একটু সহ্য করো। সব ঠিক হয়ে যাবে।
সত্যিই কি তাই? ধরণীর অফুরন্ত হাওয়ার মজলিসে যে দমহীন
স্পন্দিত পৃথিবীতে যার হৃদয়ের কম্পন মেশিনের মুখাপেক্ষী
সদা ডাক্তারের সাথে উঁকি দিয়ে যারে দেখে যমদূতের বার্তাবাহক
সব কিছু সে শুধু সহ্য করে ঠিক করে ফেলতে পারে না।
সন্তান-স্ত্রীর বুকের ভেতর ভাঙণের চিরস্থায়ী দাগ রেখে
সবাই একদিন শেষবিন্দুতে, নিজ নিজ লড়াই শেষ করে।
সর্বগ্রাস একদিন ছুটি দিবে, দেহঘড়ি কাটার ক্লান্তি ফুরাবে।
স্বার্থপুরী হতে কেউ বিদায় নেবে নিজ বিছানায়, কেউ অচেনা হাসপাতালে।
আবির আবরাজ
মরণের জ্যোৎস্না
হাসপাতালের করিডোরের মতো দীর্ঘ এই চুপচাপ বসে থাকা
কতকিছু করার কথা ভাবতে ভাবতে কিছুই না করা
সময়কে মৃতদেহের মতোন ভাসায়ে দেয়া জলসমাধিতে
কী যে বাকোয়াস লাগে জিন্দেগী
সারাক্ষণই মর্গের সামনে বন্ধুর লাশের জন্য অপেক্ষার মতোন এক অবসাদ
মৃত্যু তো মুক্তি নয় তবুও কতো মরে যাওয়া
যেদিকেই মুখ ফেরাই, দৃষ্টির আপতন মানেই যেনো মরণের জ্যোৎস্না লেগে আছে চৌদিকে
এমনও ভ্রমের ভেতর কী উত্তাপে পুড়ে যায় প্রেম ও কাম বিরহের মতো
যে যেভাবে পারছে প্রেমে পড়ে যাচ্ছে
প্রেমে মরে যাচ্ছে যেভাবে পারছে
আমি তো সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ার আক্ষেপেও মরে যেতে পারি
তবুও যাপন কেনো আমার হাড়মজ্জায় ঢুকে এইভাবে সচেতন হাসে?
কোথাও কেউ থাকে—যার কাছে যাওয়ার কথা ভাবলেও মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়
তবুও বেঁচে থেকে থেকে সেখানেই যাওয়ার এই অনন্ত তিয়াসা
কী বলবো তাকে?
আমি যে সুইসাইডাল পীপিলিকাটি, গৃহিণীও রাত হলে আলো ভালোবাসে
কে বলবে পায়েদের দৃশ্যায়ন মানেই চলাচল নয়
অসার দাঁড়ায়ে থাকারও ঘটনা বর্তমান আছে?
বৃক্ষ তো চিরকালই ছলনার ডাহুক
মাটি যেইদিন মাটির থেকে প্রিয়জনের অপ্রিয় হওয়ার কায়দায়মাফিক আলগা হয়ে যাবে, সেইদিনই বেফাঁস হবে এসকল আঁতাত
কী বা সে যাতনা, মনে হয় ভোর নয় কোনো ভোর শুধু এক ঘোর লেগে থাকা
অহেতুক আশ্লেষে এমনও রাতেদের শেষ হয়ে আসাও সহজ
তবুও না হওয়া ঘুমের মতো ঘোলাটে আধারের অশ্লীলতার ম্যাটিনি শো
আলোর তামাশা ভেঙে পুষ্কনির পানি হেসেখেলে উঠে
রোদও সহায়ক তাই চির ঝলমল টলমলতা ভেঙে
কীনারের কাছে কয়েকটা টোপাপানা
অতিষ্ঠ হয়ে যায় যূথবদ্ধ হাঁসের ছানাদের ঠোঁটের আক্রমণে
সমস্ত সিনারিও কেবলই ভেঙে পড়ে এমন যেনো
জীবন আর কিছুই নয়, হিপোক্রেসির তা না না
ছেড়ে আসার পরও বাকি থাকা কিছু জিজ্ঞাসার মাতম
বলো তো বলো কে এখন চিঠিগুলি নিয়ে যায় তার বাড়ির দিকে?
মিথ্যা বোলো না মনা, জানি এই কাজও ওই চুতমারানি শালিখের
ওকে ধরে আনো
ম্রিতোষ তত্রাচ
হাসপাতাল
একজন রোগী! মনে করি তাকে আমি চিনি না।
যে একটু পরেই নিথর হয়ে যাবে
অর্থাৎ আত্মীয়-স্বজন বা উৎসুক রোগীর সাহায্যকারীরা এবং
নার্স ও ডাক্তার, তার চলে যাওয়া দেখছি
কিছু করার নেই কারো
অদ্ভুত নিরবতা আর চাপা শোকে কাতর হয়ে যাচ্ছি
সবাই ছুটছে সুস্থতার জন্য অথচ কেউ কেউ চিরস্থায়ী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে।
কোন ছটফট নেই, যন্ত্রণা নেই, উৎকণ্ঠা নেই।
সবাই! যে যার মতো ছুটছে
মায়ের যন্ত্রণাকাতর মুখ
যেনো হীরা খচিত ছুরি
প্রতি নিঃশ্বাসে ফালিফালি হই
রিদওয়ান নোমানী
৬০২ নম্বর ওয়ার্ড ৪০ নম্বর বেড
২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিক্যালের বেহুশ সন্ধ্যা
যেন ফেব্রুয়ারির আকাশ বাতাস তোলপাড় করে আমার চিৎকার
বাংলা কবিতার অনেক বাইরে চলে যাচ্ছে!
আমার চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো
কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না শুধু
দু’একবার অসুস্থতার অহংকার নিয়ে দাঁড়িয়েছিলো আবুল হাসান।
আহা ৬০২ নম্বর ওয়ার্ড ৪০ নম্বর বেড
সাতদিনের নয়া পৃথিবী
মনে হয় কাটিয়েছি যেন কতযুগ!
আমার ভর্তি হওয়ার দিনে
আমার বয়সী একটা ছেলে লাশ
হয়ে বেরোয়। যদিও ওর মায়ের
বিলাপ আমার ব্যথার চিৎকার
ভেদ করতে পারেনি।
হাসান তোমার বুঝি ও চিৎকারেও
অহংকার ছিলো।
এখন প্রত্যেকটা থাকার জায়গাকেই
৪০ নম্বর বেড মনে হয়।
মানুষ অসুস্থ হলে নাকি শুকিয়ে যায়
সত্যিই শুকিয়ে যাচ্ছি!
সবকিছু এত রসকষহীন লাগে।
শুনেছি দুইটা মানুষ একসাথে
বসবাস করে। কিন্তু একটা
নোমানীকে তো খুঁজেই পাচ্ছি না অনেকদিন। এই খুঁজে না পেতে পেতে হয়তো আরো শুকিয়ে যাবো।
আর গন্তব্য
যেখানে পা থামে
সেটাই তো!
তাবৎ গন্তব্য খুঁজতে খুঁজতে তো
জুতোর সাথে ক্ষয়ে ফেলেছি পা।
এখন কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না
আবার কোথাও থাকার ইচ্ছেও কুলোচ্ছে না
শুধু চোখ বুজলেই ৬০২ নম্বর ওয়ার্ড
ভাঙাচোরা কিছু চেহারা
কিছু ডাক্তার
ডেইলি বহুবার দেখা হওয়া নার্সের দল।
আহা! হাসপাতাল, আহা! ৪০ নম্বর বেড