নাটক কী
নাটক হলো সুন্দরের প্রতিচ্ছবি। যে কোন বিষয়কে সুন্দর করে উপস্থাপনের কৌশল। নাটক বাস্তব জীবনেরই প্রতিরূপ। আমরা প্রাত্যহিক জীবনে যা করি তা অনুকরণই হলো নাটক।
সাহিত্যের একটি বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে নাটক। নাটক প্রধানত দৃশ্য কাব্য। নাটক হচ্ছে সেই কাব্য যাতে কর্মরত মানুষকে বা মানুষের জীবনকে দৃশ্য রীতিতে উপস্থাপন করা হয়। দৃশ্যত্ব এবং অভিনয়ত্বের মধ্যেই নাটকের বিশেষত্ব নিহিত। সাহিত্যতত্ত্বের মহাগুরু অ্যারিস্টটলের মতে- নাটক হচ্ছে, “Imitation of Action’ অর্থাৎ তাঁর মতে,“কর্মের অনুকরণ’ই হচ্ছে নাটক।
ড্রাইডেনের মতে নাটক হলো -“মানবিক আবেগ ও ভাবের এবং জাগতিক পরিবর্তনের যথাযথ জীবন্ত প্রতিরূপ”।
নাটক সাহিত্যের একটি শক্তিশালী ও সফল মাধ্যম, যার মাধ্যমে সহজেই একটি বিষয়কে উপস্থাপন করা যায় এবং যে কোন শ্রেণির মানুষই তা সহজভাবে উপলব্ধি করতে পারে। নাটক নন্দন শিল্পও বটে। এখানে মানব মনের আনন্দ-বেদনা, ক্ষোভ, মান-অভিমান সকল উপলব্ধির বহি:প্রকাশ ঘটে এবং শিল্প সৌন্দর্যের নানান দৃষ্টিকোণ থেকে পরীক্ষা বা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার যথার্থ সুযোগ এখনে আছে। আমরা মনে করি আনন্দ উপলদ্ধি কিংবা শুধু আনন্দের বহি:প্রকাশই শিল্প। বেদনা থেকে কি শিল্প জম্ম নেয় না? নেয়। বেদনা প্রকাশের এক ধরনের আনন্দ থাকে, যন্ত্রনা থেকে এক ধরনের মুক্তি থাকে। আর সে মুক্তি নাটকের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে দর্শক ও পাঠকের মাঝে। তাই নাটক একটি নন্দন শিল্প।
বাংলা নাটকের উৎপত্তি
বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ। চর্যাপদে কাহ্নপা, লুইপা, ভুসুকুপা এমনই তেইশজন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যের পঞ্চাশটি গীত বা পদ রয়েছে, যা মূলত রচিত হয়েছে ধর্মীয় প্রেরণা থেকে। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে সকল মঙ্গল কাব্যসহ যা কিছু রচিত হয়েছে যেমন মনসামঙ্গল, শ্রীকৃষ্ণ কীর্ত্তন, ইউসুফ জুলেখা, জঙ্গনামা। তেমনি নাটকও ধর্মীয় ভাবাদর্শে সৃষ্টি হয়েছে। অ্যারিস্টটলের মতে গ্রীক দেবতা ডায়োনিসাসের উদ্দেশ্যে যে নৃত্য গীত সম্বলিত শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন উৎসবের আয়োজন করতো প্রাচীন গ্রীকগণ, তা থেকেই গ্রীক নাটকের উদ্ভব হয়। ডায়োনিসাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হচ্ছে প্রকৃতি, বসন্ত, ঋতু, উর্বর ফলন। নবজন্ম এবং বিশেষ ভাবে করা নৃত্যগীতের উৎসব নিবেদিত হতো সেই ডায়োনিসাসের উদ্দেশ্যে। প্রথম পঞ্চাশ জনের একটি দল এতে অংশ নিতো। অর্ধ-মানব, অর্ধ-পশুর সাজে সজ্জিত হয়ে স্যাটিররুপে তারা মঞ্চে এসে দাঁড়াতো, সুরেলা গীত গাইতো, তাল ছন্দ লয় অনুসরণ করে তার সঙ্গে সঙ্গে নাচতো। এই নৃত্য-গীতোৎসব তথা স্যাটির ডিথির্যম্ব চলা কালেই হয়তো দলনেতা বা কোরাস লিডারের সঙ্গে দলের অন্য কোন সভ্য আলাপ করেছে, বাক্যবিনিময় করেছে। আর তখন শুধু সঙ্গীত নয়, জন্ম নিয়েছে সংলাপ। হয়তো এক পর্যায়ে দলনেতা গান বা কবিতায় কাহিনী বর্ণনা করতে করতে নিজেই কাহিনীর চরিত্র সেজে নায়কের বক্তব্য পেশ করেছে। তখনই জন্ম নিয়েছে অভিনয়। এসব সিদ্ধান্ত অনুমান নির্ভর হলেও অপ্রাসঙ্গিক নয়, এর মাঝেই লুকিয়ে আছে সত্যতা। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতক থেকে প্রতি বছর দু’টি ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে দু’বার নাট্যোৎসব হতো। একটা হতো শীতকালে জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারিতে। এই উৎসবের নাম ছিল ‘লেনা’ কিংবা ‘সুরা-দলন উৎবস’। এটার গুরুত্ব ছিল অপেক্ষাকৃত কম। অপর বৃহত্তর উৎসবটি হতো বসন্ত কালে, মার্চে অথবা এপ্রিলে। তার নাম ছিল ‘বৃহত্তর’ অথবা ‘নগর ডায়োনিসিয়া’।
এই উৎসবটি চলতো পাঁচ ছয় দিন ধরে। নগরের প্রায় প্রত্যেক অধিবাসী আনুন্দমুখর মন নিয়ে এই উৎসবে যোগ দিতো। নাটক ভালো লাগলে প্রচুর করতালি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করতো। আর ভালো না লাগলে কখনো কখনো মঞ্চের উদ্দেশ্যে ইট-পাটকেল ছুঁড়ে মারতো। ইউরোপিয় নাটকের সূচনা হয় গীর্জা প্রাঙ্গনে, ধর্মভাবের আদর্শে। কিন্তু বাংলায় ধর্মীয় যাত্রানুষ্ঠান থেকে নাটকের উৎপত্তি হয়নি। ইংরেজদের নাটকের অভিনয় দেখে উনিশ শতকের তরুণরা মঞ্চে নাটকাভিনয় শুরু করেন। প্রথমে ইংরেজি পরে সংস্কৃতির বাংলা অনুবাদ ও তারপর প্রকৃতি বাংলা নাটক সে যুগে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। বাংলা নাটকের সাথে “হেরাসিম লেবেডেব” এর নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। জাতিতে রুশ হলেও তিনি বাংলা ও হিন্দি ভাষা ভলোভাবে রপ্ত করেছিলেন। ১৭৯৫ খ্রিঃ তিনিই সর্বপ্রথম এ দেশে বাংলা নাটকের অভিনয় করিয়ে ছিলেন। নাটকটি ছিল “Love is the Best Doctor” নামক ইংরেজি নাটকের বাংলা অনুবাদ। এইভাবে বাংলা নাটকের উৎপত্তি ঘটে।
বাংলা নাটকের ক্রমবিকাশ
মূলত ইংরেজি নাটকের বাংলা অনুবাদের মধ্যদিয়েই বাংলা নাটকের ক্রমবিকাশ ঘটেছে। তেমনি আমরা দেখতে পাই, তারাচরণ সিকদার রচিত ‘ভদ্রার্জুন’ ইংরেজি আদর্শে রচিত প্রথম বাংলা কমেডি নাটক। বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের আবির্ভাব ঘটে কবি রূপে নয় নাট্যকার রূপে। ১৮৫৮ খ্রিঃ সংস্কৃত রীতি বাদ দিয়ে ইংরেজি নাটকের অনুকরণে মধুসূদন দত্ত ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক রচনা করেন। মহাভারতের কাহিনী হতে নেয়া ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক সে যুগে বিশেষ সফলতা অর্জন করে। এর পর মধুসূদন দত্ত ‘পদ্মাবতী’ কৃষ্ণকুমারী’ একেই কি বলে সভ্যতা ও বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ রচনার মধ্যে দিয়ে বাংলা নাটকের ব্যাপক বিকাশ ঘটে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মূলত কবি হলেও তাঁর নাটকগুলি পৃথিবীর মহৎ ও শ্রেষ্ঠ নাটকের সমকক্ষ। বাংলা নাটকের ক্রমবিকাশে তিনি একজন যুগান্তকারী পথিকৃত। রাজা ও রানী, বিসর্জন, চিরকুমার সভা তাঁর বিখ্যাত নাটক। রক্তকরবী, ডাকঘর, ফাল্গুনী প্রভৃতি সাংকেতিক নাটক রচনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অসাধারণ মৌলিকতার পরিচয় দিয়েছেন। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ শ্যামা, চলন্তিকা, শাপমোচন, চিত্রাঙ্গদা, ইত্যাদি অনেক অমর গীতিনাট্য রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের নাটক প্রতীকধর্মী এবং তাঁর সংলাপ কাব্যিক। তাঁর নাটকের শিল্প সৌন্দর্য, অপূর্ব বাক-প্রতিমা, ভাষার প্রাণবন্ত সৌন্দর্য তাঁর প্রতীক নাটক তথা সব নাটকেরই বিম্ময়কর সম্পদ। তার প্রতিটি নাটকই বাংলা নাটকের ক্রমবিকাশের সাক্ষ্য বহন করে।
পরবর্তীতে আধুনিক নাট্যধারায় অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, সেলিম আল-দীন, আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন, মামুনূর রশীদ, হুমায়ুন আহমেদ সহ আরও অনেক সফল নাট্যকারের অনবদ্য লেখনী শৈলীর মাধ্যমে বাংলা নাটকের ক্রম বিকাশ ঘটেছে এবং বাংলা নাটক এখন সারা বিশ্বজুড়ে জায়গা করে নিয়েছে।
বাংলা নাটক যাদের মাধ্যমে বিকাশ ঘটেছে–
১. তারাচরণ সিকদার
২. হরচন্দ্র ঘোষ
৩. রামনারায়ন তর্করত্ন
৪. কালিপ্রসন্ন সিংহ
৫. উমেশ চন্দ্র মিত্র
৬. মাইকেল মধুসূদস দত্ত
৭. দ্বীনবন্ধুু মিত্র
৮. মনোমহন বসু
৯. জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর
১০. গিরিশচন্দ্র ঘোষ
১১. দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
১২. অমৃতলাল বসু
১৩. ক্ষীরোদ প্রসাদ বিদ্যাবিনোদ
১৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৫. কাজী নজরুল ইসলাম প্রমূখ।
নাটকের শ্রেণি:-
বিষয়বস্তু এবং পরিণতির বিচারে নাটককে প্রধানত তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়।
১. ট্রাজেডি বা বিয়োগান্তক।
২. কমেডি বা মিলনাত্বক।
৩. ফার্স বা প্রহসন।
ট্রাজেডি, কমেডি ও প্রহসন প্রভৃতি নাটককে আবার অন্যভাবে শ্রেণি বিন্যাস করা যায়। যেমন-
১. ঐতিহাসিক নাটক : ঐতিহাসিক কাহিনীকে অবলম্বন করে যে নাটক তৈরি হয়। যেমন- “শাজাহান” — দ্বিজেন্দ্র লাল রায়
২. পৌরাণিক নাটক : রামায়ণ, মহাভারত, বেদ প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থ থেকে প্লট সংগ্রহ করে ধর্ম, অতি প্রাকৃত ও অলৌকিক ক্রিয়া কলাপের সঙ্গে যখন নাটকীয়তা সৃষ্টি করা হয়। যেমন- “জনা” — গিরিশ চন্দ্র।
৩. নৃত্যনাট্য: নৃত্য, অভিনয়, গান, সংলাপ যে নাটকে লক্ষ করা যায়। যেমনঃ “মহুয়া”– মৈমনসিংহ গীতিকা।
৪. সাংকেতিক নাটক: আধুনিক কালের জীবন সমস্যা, যুগজীবন যখন রূপক ও সাংকেতিকভাবে নাটকে রূপ লাভ করে তাই সাংকেতিক নাটক, যার ইংরেজি Symbolic Drama । যেমনঃ “রক্ত করবী” — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৫. অতিনাটক: অতি নাটক হলো কাল্পনিক বিষয়কে কেন্দ্র করে অস্বাভাবিক ঘটনা বিন্যাস, অলৌকিক, আকষ্মিক ও লোমহর্ষক পরিণতি নাটকে প্রকাশ পায়। Melo Drama যেমনঃ “বিসর্জন” — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৬. গীতিনাট্য: যে নাটকে সংগীতই প্রধান, তাকে গীতিনাট্য বলে।
যেমনঃ “নকশি কাঁথার মাঠ” — জসিম উদ্দিন ।
৭. চরিত নাটক: ঐতিহাসিক ও বিখ্যাত বিভিন্ন মহাপুরুষের চরিত্রকে অবলম্বন করে ঘটনা বিন্যাস ও নাট্যসৃষ্টি করা হয়। যেমনঃ শ্রী মধুসুদন দত্ত “বনফুল”।
৮.সমস্যা প্রধান নাটক: রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের সমস্যাকে কেন্দ্র করে লেখক যখন তাঁর বক্তব্য, মতবাদ ও মানসিকতা পরিব্যক্ত করেন, তখন তাকে সমস্যা প্রধান নাটক বলে। যেমনঃ “নীলদর্পন” — দীনবন্ধু মিত্র।
৯. একাঙ্ক নাটক: এক অংক বিশিষ্ট নাটক, যেখানে সাম্প্রতিক রাজনীতি, আধুনিক ঘটনা, সামাজিক বিভিন্ন ঘটে যাওয়া সমস্যা। যেসব নাটক প্রধান ভাবে রূপলাভ করে। যেমন: এখনও কৃতদাশ — আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন।
১০. বিমূর্ত নাটক: আধুনিক যুগের বুদ্ধিদীপ্ত মননশীলতা বির্মূত নাটক বলে থাকে ইংরেজিতে Abstract Drama। যেমনঃ ‘ইন্দ্রজিৎ’– বাদল সরকার
১১. যাত্রা: প্রাচীন সংস্কৃতির একটি বিশেষ ধারা। যা একসময় খুব জনপ্রিয় ছিল। অতি নাটকীয়তা Over Acting যাত্রার অন্যতম ধর্ম। যেমনঃ ‘দস্যু ফুলন দেবী’– শ্রী পূর্নেন্দ্র রায়।
১২. উপন্যাস নাটক: বাংলা সাহিত্যের সার্থক উপন্যাসকে নাট্যরূপ দেয়া হয় যেসব নাটকে। যেমনঃ ‘দেবদাস’– শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
১৩. গণ আন্দোলনের নাটক: সামাজিক অন্যায়, দারিদ্রতা ও শোষণের হাত থেকে মুক্তির লক্ষ্যে যে সব নাটক রচিত হয়। বাংলাদেশে নব্যনাট্য আন্দোলন ক্রমশ গণনাট্য আন্দোলনে পরিণত হচ্ছে, তাই বর্তমানে প্রায় নাটকই এ ধারার।
অভিনয় ও অভিনেতা
পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই অভিনেতা। সকলেই অভিনয় করেন। যদিও কেও কেও বলেন আমি অভিনয় করতে পারি না। আমি মনে করি উনি ভুল বলেন। তিনি অবশ্যই অভিনয় করেন, মানুষ তার নিজ নিজ চরিত্রে অভিনয় করে যান আমৃত্যু। অনেকেই মনে করেন অভিনয় অনেক কঠিন একটি বিষয় আসলে তা নয়। কারণ আমরা আমাদের মনের অজান্তেই প্রতিনিয়ত অভিনয় করে চলছি। আমরা ঘুমাতে যাই, ঘুম থেকে উঠি, নাস্তা করি, স্কুলে যাই, বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে মজা করি, আড্ডা দেই। স্যার কিংবা বাবা-মার বকা খেয়ে অভিমান করি, কান্না করি, এ সব কি অভিনয় নয়? অবশ্যই অভিনয়। একজন আরেক জন থেকে ভিন্ন, চলা ফেরায়, কথা বলার, হাস্য রসাত্বক, মোটা পাতলা কোন না কোন মুদ্রা দোষেদোষি সব দিক থেকেই ভিন্নতা। আর এই সবই হলো চরিত্রের বৈচিত্র। একজন বাবা, বাবার চরিত্রে, মা-মা’র চরিত্রে, এমনি ভাবে ছেলে বুড়ো, নাপিত-ধোবা থেকে শুরু করে বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত যে যার চরিত্রে অভিনয় করে…
অ্যারিস্টটলের সূত্র ধরেই বলতে হয়, ‘কর্মের অনুকরণই হচ্ছে অভিনয়’ আর যিনি এটা করেন তিনিই হলেন অভিনেতা। তাই আমরা প্রত্যেকেই প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে একেক জন একেক চরিত্রের অভিনেতা।
‘অভিনয়’ শব্দটির গঠন হলো; অভি- উপসর্গের সঙ্গে ‘নীঞ’ ধাতু অব্ প্রত্যয়। অভি মানে অভিমুখ্য। ‘নী ঞ’ ধাতু প্রাষান্ অর্থাৎ ‘নিয়ে যাওয়া’। অর্থাৎ অভিনয় অর্থ গিয়ে দাঁড়ালো – শৈল্পিক ভাবনা চিন্তাকে দর্শকদের অভিমুখে নিয়ে যাওয়া।
অনেকের মতে অভিনয়ের উৎস তিনটি;
১. অভিজ্ঞতা
২. সাঙ্গীকরণ
৩. প্রকাশ।
১. অভিজ্ঞতা : অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র দুই ধরণের হতে পারে একটি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, অপরটি অপ্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হলো আমরা প্রাত্যহিক জীবনে যা করছি, হাসছি কাঁদছি, হাঁটছি, অভিমান করছি ইত্যাদি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। অপরটি হচ্ছে অপ্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। যা আমরা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে শিখি না। বই পড়া, গল্পশুনা, নাটক, সিনেমা দেখে অভিজ্ঞতা অর্জন করি। যেমন একজন মুমূর্ষু ব্যক্তির মৃত্যু যন্ত্রণা প্রত্যক্ষ ভাবে না দেখেও আমরা কোন সিনেমায় দেখে তা অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারি এটা হলো অপ্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। আসলে যিনি অভিজ্ঞতা অজর্ন করেন তার ধারণ ক্ষমতার উপরই নির্ভর করে তার অর্জন। অনেকে মনে করেন বয়সেই অভিজ্ঞতা অর্জন হয়। আসলে তা নয়। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে “যদি না হয় নয়ে, তার হয় না নব্বইয়ে।” তেমনি বানার্ড শ বলেছেন, “বয়সই যদি অভিজ্ঞতা গ্রহণের মাপকাঠি হতো তাহলে লন্ডনের পাথরগুলো সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞ হতো ”। তাই অভিজ্ঞতা ‘অর্জন’ করতে হয়।
২. সাঙ্গীকরণ: নিজের মধ্যে অভিজ্ঞতাকে গ্রহণ করা, যাকে বলা চলে স্মৃতির দ্বারা অভিজ্ঞতাকে পাখির মতো পোষ মানিয়ে নেওয়া। আস্তে আস্তে আরো নানা অভিজ্ঞতা জমা হয় এবং মনের গভীরে পুরনো ছবি দূরে চলে যায়। অধুনা ছবি সামনে থাকে কিন্তু হারায় না কিছুই। যারা সৃজনশীল শিল্পী তাঁরা মাঝে মাঝে নিশ্চয়ই নিজের কোন কোন কাজে অবাক হয়ে ভাবেন।
৩. প্রকাশ: সর্বশেষ এবং সবচেয়ে শক্ত হলো প্রকাশ। রসিক লালের কাছে শিল্পীর কেবল এই অংশটুকুই প্রকাশিত। এতেই তাঁর গৌরব ও প্রতিষ্ঠা। তৃপ্তি ও সার্থকতা। অবশ্যই এক্ষেত্রে দর্শক বা শ্রোতার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথের গান ভঙ্গ কবিতার মতো একজনকে ভাব থেকে রসের দিকে যেতে হবে। আরেকজনকে রস থেকে ফিরতে হবে ভাবে। দর্শক বা শ্রোতা যদি সৃষ্টি শিল্পকর্মের সূক্ষ্মতা ধরতে বা বুঝতে না পারেন তবে শেষ অবধি শিল্পীর অনেকটা কাজই মাটি হবে। এমন কি আত্মতৃপ্তির অবকাশও হয়ে উঠবে খুবই সংকীর্ণ।
অভিনয় শেখার উপায়
অভিনয় শিখতে গেলে প্রথমেই একজন অভিনেতাকে যে কয়টি বিষয়ের উপর খেয়াল রাখতে হবে তা হলো আত্মপ্রত্যয়ী, অনুশীলন, কল্পনার প্রাচুর্য, অন্তর্দৃষ্টি, সূক্ষ্ম বোধ ইত্যাদি। প্রতিটি কাজ করার আগে অবশ্যই আমদের একটা মানসিক দৃঢ়তা থাকতে হবে যে, এই কাজটি আমি করবো এবং তা আন্তরিকতার সঙ্গে করবো, এর নামই হচ্ছে আত্নপ্রত্যয়ী। অভিনয়ের ক্ষেত্রেও এটা জরুরী। আমি একটা নাটকে অভিনয় করার মনস্ত করলাম, আর প্রতি ক্ষণেই আমার মন দোলছে। অভিনয়টা আমি করবো-? না, থাক। আচ্ছা তবে করি। না, থাক। যদি অভিনয় ভালো না হয়, সবাই হাসা হাসি করবে। – এমনি দোদুল্য মন নিয়ে কখনই অভিনেতা হওয়া যাবে না।
দ্বিতীয়ত হলো, অনুশীলন। অনুশীলন ছাড়া কেও কোন কাজে সফল হতে পারবে না। একজন অভিনেতা কঠোর অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে দক্ষ অভিনেতা হয়ে গড়ে ওঠেন। একজন অভিনেতা মঞ্চে অভিনয় উপস্থাপনের আগে যতবেশী অনুশীলন করবে অভিনয়টি ততবেশী দর্শক নন্দিত হবে। অনুশীলনের কোন বিকল্প নেই।
কল্পনার প্রাচুর্যতা না থাকলে অভিনেতা হওয়া যাবে না। একজন অভিনেতা তার চার পাশের কর্মমুখর মানুষগুলো দেখবে এবং সেসব মানুষগুলোকে এক একটি চরিত্র হিসেবে ভাববে এবং প্রচুর ভাববে। অভিনেতার এই ভাবনাই হচ্ছে কল্পনা প্রাচুর্যতা। একটি চরিত্র অভিনেতার মাঝে ফুটিয়ে তুলতে তাকে কল্পনা বিলাসি হতে হবে। একজন ডুবুরী যেমন সুমুদ্রের তলদেশে ডুবে ডুবে আহরণ করেন অমূল্য নিধি, তেমনি একজন অভিনেতাকেও কল্পনার সাগরে ডুবে ডুবে আবিষ্কার করবে একটি চরিত্রকে। তাই অভিনেতাকে কল্পনা বিলাসী হতে হবে। যেমন আমাকে একজন ফেরিওয়ালার চরিত্র করতে হবে, এখন আমার শহরের অলি গলিতে ফেরিওয়ালাকে সব সময় দেখে থাকি সর্বদাই তার হাঁক-ডাক শুনে থাকি।
ফেরিওয়ালার চরিত্রটি আমাদের কাছে অতি পরিচিত। কিন্তু যখন কাউকে চরিত্রটি অভিনয় করতে বলা হবে তখন অতি পরিচিত এই চরিত্রটিই আমাদের কাছে অতি অপরিচিত মনে হবে, ভীষণ কঠিন মনে হবে। কিন্তু যখন একজন অভিনেতা ফেরিওয়ালাকে নিয়ে কল্পনার সাগরে ডুববে। নিজেকে ভাববে একজন ফেরিওয়ালা, তার কল্পনায় যখন তার বর্তমান পরিচয় সে ভুলে যাবে, যখন নিজেকে একজন সামান্য ফেরিওয়ালা ছাড়া আর কিছুই তার মনে পড়বেনা তখন তার অভিনয় সফল হবে। একজন দক্ষ অভিনেতা হিসাবে সুনাম ছড়াবে।
এই পদ্ধতিকে ‘ইম্প্রোভাইজেশন’ও বলা যেতে পারে। ইম্প্রোভাইজেশন শব্দের বাংলা আভিধানিক অর্থ বিনা পূর্বপ্রস্তুতিতে উপস্থিত মত রচনা ও ডায়লক উপস্থাপন করা অথবা জরুরি অবস্থায় হাতের কাছে পাওয়া উপাদানাদির দ্বারা উদ্ভাবন করা। ‘ইম্প্রো’ যা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদের কল্পনা শক্তিকে প্ররোচিত করে। স্বত: স্ফূর্তভাবে কথা বলতে বা চলাফেরা করতে অনুপ্রাণিত করে। এই পদ্ধতিতে অভিনেতা ইচ্ছেমতো মনের মাধুরী মিশিয়ে, কল্পনার পক্ষপুটে প্রসারিত করতে পারেন তাদের। এই পদ্ধতির কার্যকারিতা ও গুণমান সম্পূর্ণভাবে অভিনেতার উদ্ভাবনী শক্তির ওপর নির্ভরশীল। একজন অভিনেতার অর্ন্তদৃষ্টি সম্পন্ন হতে হয়। কেননা প্রত্যেকটি অভিনেতার অভিনয়ের বিষয়বস্তু তার চরিত্রের উপজীব্য বিষয় তার পারিপাশ্বিক জীবন যাপনের মধ্যেই অন্তনিহীত রয়েছে। অভিনেতা তার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে এগুলো বিষয় তার অভিজ্ঞতার ভারে পুঞ্জিভূত করবে কর্মের অনুকরণই হলো নাটক। আর নাটকের চরিত্র আমরা সবাই। আর একজন অভিনেতা তার অর্ন্তদৃষ্টির মাধ্যমেই এসব চরিত্রের মাঝে অভিজ্ঞতা অজর্ন করবে। অভিনেতার সুক্ষ্মবোধ তার অভিনয় ক্ষেত্রে… রস ব্যাঞ্জনা এনে দেয়। তাকে দশর্ক নন্দিত হতে সহায়তা করে। অভিনয়ের ক্ষেত্রে সুক্ষ্মবোধ অত্যাবশ্যক একটি বিষয়। যখন একজন অভিনেতা তার সুক্ষ্মবোধের মাধ্যমে অভিনয় উপস্থাপন করবে তখন তার অভিনয় প্রাণবন্ত হবে।
অভিনয় একটি শিল্প। শিল্প মানেই আকাশ, পাহাড়, সমুদ্রের মেঘ ব্যাপ্ত, উচ্চ এবং গভীর। অভিনয়ও তাই। অগাধ রহস্যে ঘেরা এ যেন এক অজানা রহস্যময় দেশ। প্রতি মুহূর্তে নতুন কোনো আবিষ্কারের মুখোমুখি হওয়ার জন্য চাই কৌতুহলী মন। আর সেই সঙ্গে যুক্ত হয় আবিষ্কারের চেষ্টা।
অন্যদিকে অঞ্জন দাশগুপ্ত ‘অভিনয় শিল্প’ মন ও সৃজন গ্রন্থে তার অভিব্যাক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে লিখেছেন ‘অভিনয় ব্যবহারিক বিজ্ঞান’ ফলিত শিল্প। অভিনয় শেখার একমাত্র উপায় হচ্ছে অভিনয় করা। যেমন ভাবে সাতাঁর শেখা বা গাড়ি চালানোর শেখার পর সাতাঁর কাটা বা গাড়ি চালানো। এ জন্যই অভিনয় পারফরমিং আর্ট অর্থাৎ অভিনয় করার মানেই হচ্ছে একদম প্রত্যক্ষভাবে শারীরিক ক্রিয়ার স্তরে কোন কিছু করা। কোন কিছু করা বলতে অভিনয়ের ক্ষেত্রে বোঝানো হচ্ছে একটি চরিত্রকে উপস্থাপন করাকেই তার মানে অভিনয় প্রক্রিয়া বিশেষ ভাবেই শারীরিক পারফরমেন্সের ওপর নির্ভরশীল।