হঠাৎ জানালার পাশে থাকা আকাশের টুকরো কেঁপে উঠল। লাল গুল মোহরের ফুল গুলি ঘিরে থাকা সবুজ পাতাগুলি অস্থি্রভাবে নাড়াচাড়া করে উঠল। একটা বড় পরিচিত,ভয়াবহ সংবেদন মাসুমার পায়ের বুড়ো আঙ্গুল থেকে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ পর্যন্ত ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে লাগল। তার বুক ধপধপ করতে লাগল। অদ্ভুত প্রবলতার সঙ্গে ধড়মড় করে এগিয়ে আসা ঝিনঝিনের অনুভূতিটা তাকে গ্রাস করার ঠিক আগের মুহূর্তে সে আর্তনাদ করে উঠল,‘নারায়ণ’। অনতিদূরে চায়ের কাপ-প্লেট রাখতে থাকা নারায়ণ দৌড়ে আসতে আসতে মাসুমার মগজ অসার হয়ে পড়েছিল। ভূমিস্থলিত একটা গাছের মতো বসে থাকা চেয়ারটা থেকে মেজেতে মাসুমা গড়িয়ে পড়ল।
নারায়ণ মাসুমার কাছে দ্রুত এগিয়ে এল। তার স্থলিত শরীরটা আরাম চেয়ারটাতে কাত করে শুইয়ে দিল। মাসুমার মুখ দিয়ে কিছু সাদা তরল পদার্থ বেরিয়ে এল। ইতিমধ্যে ক্লাস শেষ হওয়ার ঘণ্টা মারার সময় হয়ে এসেছিল। নারায়ণের দিকে একবার তাকিয়ে অন্য একজন চৌকিদার কৈলাশ অধ্যক্ষের ঘরের সামানের বাটামে ঝুলিয়ে রাখা ঘণ্টাটা বাজিয়ে দিল।একজন একজন করে ভেতরে আসা শিক্ষকদের দ্বারা কমনরুমটা ভরে উঠল। মাসুমার কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকা মানুষগুলির চোখ বিতৃষ্ণা এবং শঙ্কায় ভরে ছিল। ক্লাস থেকে বেরিয়ে বাথরুমে প্রবেশ করা শিক্ষক ত্রৈলোক্য বরুয়া নিজের পুরোনো,নোংরা জুতো একটা খুলে মাসুমার দিকে এগিয়ে গেল। নারায়ণ আতঙ্কে দুই হাত মেলে ধরে উঠে দাঁড়াল।বরুয়ার অপরিষ্কার জুতোর ওপরে তখনও জ্বলজ্বল করছিল পস্রাবের কণিকা। নারায়ণের সভয়-বিস্ফোরিত চোখের সামনে ত্রৈলোক্য বরুয়া জুতোটা মাসুমার নাকের সামনে তুলে ধরল। মাসুমা নড়েচড়ে উঠল। দুচোখের অবশ পাতি দুটো একটু মেলে সে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে রইল। মুখে বিজয় গর্বের হাসি নিয়ে ত্রৈলোক্য বরুয়া চারপাশে তাকালেন। তার জুতো থেকে খসে পড়া ধুলিগুলো মাসুমার মুখের ঘামের ফোঁটাগুলির সঙ্গে মাখামাখি হয়েছিল। তার চাদরের আঁচল দিয়ে মুখটা মুছে দেবার সময় নারায়ণ অপরাধ বোধে ধড়ফড় করে উঠল। মাসুমা মাঝে মধ্যে বলে থাকে ‘আমি স্কুলে অসুস্থ হয়ে পড়ে গেলে তুই পাশে থাকবি। দশমিনিটের মধ্যেই ভালো হয়ে যাব। আমার মুখে নোংরা জুতো লাগাতে দিবি না।’ অবশ শরীরটা নিয়ে বসে পড়া মাসুমাকে অগ্রাহ্য করে তার সহকর্মীরা হঠাৎ নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। একটা ভিজে কাপড় দিয়ে বেঞ্চের নিচের মেঝেটা মুছতে থাকা নারায়ণের দিকে তাকিয়ে মাসুমার দুইচোখ সজল হয়ে উঠল।
ঠিক কবে থেকে অসুখটা শুরু হয়েছিল মাসুমার স্পষ্ট মনে আছে। সে ক্লাস নাইনের উজ্জ্বল, চঞ্চল, প্রাণোচ্ছল ছাত্রী ছিল। সম্পূর্ণ স্কুলের ছাত্র ছাত্রী, শিক্ষক -শিক্ষয়িত্রী প্রত্যেকেই জানত মাসুমা ডাক্তার হবে। সে পড়ার টেবিল থেকে দূরে থাকলে মা বিড়বিড় করত, ‘এভাবে পড়লে ডাক্তার কীভাবে হবি! স্কুলের ক্লাস টেস্টের অঙ্কে একশো শতাংশ না পেলে শিক্ষক ভৎর্সনা করতেন, ‘এই নাম্বার নিয়ে কীভাবে মেডিকেল পড়বি?’ ছোট শহরের একমাত্র সরকারি হাইস্কুলটির সবচেয়ে মেধাবী মেয়েটির একটি স্বপ্ন পূরণ করার জন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।
সেই দিনগুলিতে একটি ঘটনা ঘটেছিল। স্কুলের প্রার্থনা সভায় ধমাস করে কিছু একটা সজোরে মেঝেতে ধাক্কা মেরেছিল। ঘটনাটা এতই আকস্মিক ছিল যে প্রত্যেকেই ভেবেছিল দৌড়াদৌড়ি করে প্রার্থনা সভায় প্রবেশ করা কারও বই ভর্তি বেগটা কাঁধ থেকে খসে পড়েছে।
মাসুমাকে পরীক্ষা করা চিকিৎসক প্রেসক্রিপশনটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, মাসুমার অসুখটা সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ নিশ্চিত নন। কিছুদিন দেখতে হবে,লক্ষণগুলির পুনরাবৃত্তি হয় কিনা সেটা লক্ষ্য রাখতে হবে। কিন্তু ইতিমধ্যে মাসুমাকে নিজের সম্পর্কে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। ব্যস্ত রাজপথ দিয়ে চলার সময় তার সঙ্গে কাউকে থাকতে হবে। পুকুর,নদী,সুইমিং পুল থেকে দূরে থাকতে হবে। মাসুমা ছলছলে চোখে মায়ের দিকে তাকাল।সে সাঁতরাতে খুব ভালোবাসে। বাড়ির পেছনেই পুকুর,ঠাকুরমাদের গ্রামের নাতিদূরে বয়ে যাওয়া নদীতে কত যে জলকেলি করে সে। মা তার হাতটা ধরল,ডাক্তার কাকাতো মাত্র কিছুদিনের জন্য জল থেকে দূরে থাকতে বলেছে।
চব্বিশ ঘণ্টাও অপেক্ষা করতে হল না। পরের দিন দুপুরবেলা মা লক্ষ্য করলেন মাসুমা অস্বাভাবিক ভাবে কিছু চিবিয়ে চলেছে, জোরে জোরে গিলছে, তার মুখ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ছে, দুহাতে সে কিছু যেন হাতড়ে বেড়াচ্ছে, দু-পা দিয়ে মেঝেতে থপথপ করে আওয়াজ করছে। ওকে জড়িয়ে ধরা মা ওর সঙ্গে মেঝেতে ছিটকে পড়লেন। নিজের শরীরের ওপরে থাকা মেয়ের অচেতন দেহের ভার বুকে নিয়ে মা সশব্দে কেঁদে উঠলেন।
বেশ কয়েকটি পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে মাসুমার দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা আরম্ভ হল। ডাক্তার মা-বাবার দিকে তাকিয়ে সহানুভূতির সুরে বললেন, ও এপিলেপ্সিতে ভুগছে, ‘ইন ইটস সিভিয়ার ফর্ম’। ওষুধের একটা দীর্ঘ তালিকা দেওয়ার পরে ডাক্তার পরে অস্ত্রোপচার করার সম্ভাবনার কথা ও বললেন। এই অসুখে ওষুধের চেয়ে ও বেশি প্রয়োজন সতর্কতা সেকথাও ডাক্তার বলে দিলেন। মাসুমার দিনগুলি যেন পালটে গেল। বাড়িতে মায়ের সঙ্গ ছাড়ে না। ঘন ঘন স্কুল কামাই হতে লাগল। তার ঘনিষ্ঠ বান্ধবীরা তাকে এড়িয়ে চলতে লাগল। অনবরত একটা ত্রাস তাকে ভেতর থেকে কুড়ে কুড়ে খেতে লাগল। সেই ভয়াবহ শিহরণে শরীর মগজ অসার করে তোলে বলে সে প্রতি মুহূর্তে শিউরে শিউরে উঠে। শ্রেণির পরীক্ষা গুলিতে তার প্রদর্শন খারাপ হতে থাকল। শিক্ষকরা তাকে নিয়ে করা আশা এবং উৎসাহ অভাবনীয়ভাবে কমে এল। একসময়ে তাকে স্নেহের সঙ্গে তিরস্কার করা শিক্ষকরা তার প্রতি সহানুভূতি দেখাতে লাগল। দিনের পর দিন তার স্কুলে অনুপস্থিতি কাউকে শঙ্কিত করল না। নিয়মিতভাবে ওষুধ খাওয়া সত্ত্বেও অসুখটা তার পরাক্রম বজায় রাখল। এক মাসের ভেতরে কয়েকটি আক্রমণ মাসুমার আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দিল। এক সময়ে সাঁতার কেটে আনন্দ লাভ করা মাসুমা জলাশয় দেখলেই আতঙ্কে চমকে উঠে। হতাশা গ্রাস করে আনা এই পরিস্থিতির মধ্যে একমাত্র তার আব্বা তার মনে ক্রমশ সাহস জুগিয়ে চলল।
মাসুমের পাশে বসে তিনি তাকে বলেন-‘দেখ মা, সক্রেটিস, আর্কিমিডিস, টমাস আলভা এডিসন, আলফ্রেড নোবেলের মতো মহান মনীষী তোর মতো রোগী ছিলেন। কিন্তু এই রোগ তাদের সাধনা, কর্মে কোনোরকম বিঘ্ন ঘটাতে পারেনি। মৃগীরোগী জন্টি রোডস বিশ্ব ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠতম ফিল্ডার ছিলেন। তুই ভেঙ্গে পড়িস না। তুই যা হতে চাস হতে পারবি। তোর অসুখ তোর ভবিষ্যতের একটি দরজাও বন্ধ করতে পারবে না।’
আরও একজন ছিল যে তার হেলে পড়া আত্মবিশ্বাসের দেওয়ালটা সোজা রাখার প্রাণপন চেষ্টা করেছিল।তার সহপাঠী রুদ্র। সে স্কুলে যতদিন যেতে পারেনি ততদিন রুদ্র প্রতিদিন বিকেলে তার কাছে এসেছিল। তার ক্ষতি হওয়া পাঠগুলিতে সাহায্য করেছিল। একদিন সে রুদ্রকে বলেছিল, ‘তুমি মেডিকেল পড়বে।’ রুদ্র একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়েছিল।
ডাক্তার হয়ে রোগীকে ভালো করবে। প্রতিদিন বিকেলে সাঁতার কাটবে। পুকুরে ডুব মেরে পুনিগুলির শিকড়ে কামড়ে থাকা মৌরলা মাছগুলি ছুঁয়ে দেখবে। পুকুরের মাঝখানে এত সুন্দরভাবে সাদা ভেঁটফুল গুলি ফুটে থাকে। একটা ছিঁড়ে নিও। মাঝে মধ্যে নৌকা নিয়ে যেও। ভাঁটার স্রোতে চিল সাঁতার দিয়ে আকাশের মেঘগুলি দেখ। কত যে ভালো লাগবে।’
সে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল। ফুলে ভরে থাকা লাল ঝোপটার মধ্যে দুটো প্রজাপতি খেলছিল।
‘আমার ভালোলাগা কাজগুলি তুমি না করলে আর কে করবে?’
সে সোজাসুজি রুদ্রের মুখের দিকে তাকিয়েছিল। তার সজল চোখে বিকেলের সূর্য লাল হয়ে ঝলমল করছিল। সে চেয়ে থাকতে থাকতেই সূর্যটা তার চোখের জলে ডুব মেরে নাই হয়ে গিয়েছিল।
সেদিন থেকে রুদ্র অধিক মনোযোগের সঙ্গে পড়াশোনা শুরু করেছিল। কারও অপূর্ণ স্বপ্ন গুলি পূর্ণ করার দায়িত্ব তাকে পরিশ্রমী করে তুলেছিল।
স্কুলের শেষ পরীক্ষাটা খুব ভালো ভাবে পাশ করার পরে রুদ্র মা-বাবার সঙ্গে দূরের একটা শহরে চলে গিয়েছিল। কোনোভাবে প্রথম বিভাগ পাওয়া মাসুমা স্থানীয় কলেজটির বিজ্ঞান শাখায় নাম লিখিয়েছিল। বিএসসি পাশ করার পরে শিক্ষকের যোগ্যতা নির্ণায়ক একটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মাসুমা একটি সরকারি হাইস্কুলে বিজ্ঞানের শিক্ষয়িত্রী হয়েছিল। তার নিয়ম মাফিক চিকিৎসা ও তার অসুখের আক্রমণকে অনিয়মীয়া করতে পারেনি। ইতিমধ্যে অসুখটার সঙ্গে শারীরিক, মানসিকভাবে মাসুমা অভ্যস্থ হয়ে পড়েছিল।
তার মাসি,জ্যেঠিমারা মাকে বলেছিল বিয়ের পরে যৌবন কালের রোগগুলি থাকে না। দূর সম্পর্কের কয়েকজন মেয়ে মৃগী রোগী বিয়ের পরে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে স্বাভাবিকভাবে ঘর সংসার করতে দেখা গেছে। মাসুমার নার্স পিসি বিজ্ঞের মতো বলেছিল বিয়ের পরে মেয়েদের শরীরে হওয়া হরমোনের তারতম্য মৃগীরোগকে আরোগ্য করে তোলে। মাসুমার চিকিৎসক ও নিরুৎসাহ করল না। একটা সময়ে যদিও মৃগী রোগীদের বিয়েতে আইনগত বাধা ছিল, দুই দশক আগে সেই নিষেধ উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। কেবল কিছুটা সাবধানতা এবং সতর্কতার প্রয়োজন। সুস্থ বৈবাহিক জীবন মৃগীরোগীদের পক্ষে অসম্ভব নয়।
মাসুমার মা-বাবা তার বিয়ের স্বপ্ন দেখতে লাগল। প্রস্তাব ও এল। একই শহরের ইকবাল মাসুমার অসুখ সম্পর্কে সমস্ত কিছুই জানত। তার পড়াশোনা কম। নতুন করে ব্যবসা আরম্ভ করেছে।কিন্তু ছেলেটি নম্র এবং চালাক চতুর। মাসুমার মা-বাবা সুখী হলেন। কতদিন পরে যে বাড়িতে আনন্দের একটি অবকাশ এল। আম্মা -আব্বার হাসি ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে মাসুমা নিজের বিষয়ে চিন্তা করা ছেড়ে দিল। চিন্তা করেই বা কী লাভ।এগিয়ে চলাই জীবন। যতদিন পর্যন্ত পথ থাকবে সে এগিয়ে যাবে। সে পেছনের বারান্দা থেকে বাগানের নির্জন ছায়াঘন পুকুরটার দিকে তাকিয়ে রইল। সে সাঁতার ছেড়ে দেবার পর থেকে পুকুরটা পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল। জলজ-ঘাস বনে ভরে থাকা পুকুরটাতে একটাও ভেঁটফুল ছিল না। সে জানে সেই দীর্ঘ কোমল ডালগুলি বড় সুকোমল ভাবে ধরে রাখা ছোট ছোট সাদা, সতেজ ভেঁটফুল গুলি আর কখনও ফোটে না।
ঠাকুরমার কিংখাপের মেখেলা পরে পাটের চাদরের উড়না নিয়ে মাসুমার এক লক্ষ টাকা নজরানায় ইকবাল হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল।
স্বামীগৃহের ফরমাশগুলি পূরণ করার সময় মাসুমার মনে হয়েছিল তার চাকরিটা বোধহয় বিয়ের ক্ষেত্রে বড় প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ছিল। ধীরে ধীরে তার নিজের প্রয়োজনগুলি কমে এল। মখমলের উড়নাগুলি, ফিরোজা পাথরের চুড়িগুলি সে ভুলে গেল। আর একদিন দুবাই থেকে এসে উপস্থিত হওয়া ইকবালের মামা-মামী আসায় আদর যত্ন করতে থাকা মাসুমা মেঝেতে ছিটকে পড়ল। হাত থেকে সুন্দর গন্ধ ছড়ানো ক্ষীরের বাটিটা ছিটকে পড়ল। মাসুমার খিঁচতে থাকা অবশ শরীরটার দিকে তাকিয়ে মামা-মামী আতঙ্কে হাহাকার করে উঠলেন। দামী উপহারে সমস্ত পরিবারটাকে সন্তুষ্ট করে রাখা গুরুত্বপূর্ণ অতিথি তারা। শ্বশুর, শাশুড়ি লজ্জায় অধনমিত হল। তার অচেতন শরীরটা ছেঁচড়ে নিয়ে বিছানায় ফেলে দিয়ে ইকবালের মুখটা ক্রোধে থমথম করতে লাগল।
শাশুড়ি কৈফিয়তের সুরে ভাইকে বলল, ‘আমরা শুনেছিলাম, বিশ্বাস করেছিলাম বিয়ের পরে তার অসুখ ভালো হয়ে যাবে।’
একমাত্র ভাগ্নেকে একটি অসুস্থ মেয়েকে বিয়ে করতে দেখে মামা-মামী স্পষ্টত বিরক্ত হলেন। তার পরের দুটি দিন তারা একবারও মাসুমার দিকে চোখ তুলে তাকালেন না। কোনো কথা বললেন না।
মামার অর্থ সাহায্যে ইকবাল নতুন করে ব্যবসা শুরু করল। আর্থিক প্রাচুর্য আসার সঙ্গে সঙ্গে ঘরে মাসুমার স্থান নিম্নগামী হল। অবহেলা এবং অনাদরের জায়গা নিল স্পষ্ট নিন্দা, ভৎর্সনা, গঞ্জনা। তার মধ্যে অসুখটা তাকে নিয়মিতভাবে প্রহার করতে লাগল। চিকিৎসকের কাছে যাবার মতো অবসর না থাকা মাসুমা পুরোনো প্রেসক্রিপশন মতে ওষুধ খেয়ে যেতে লাগল। একদিন প্রতিবেশী হাফিজা বলল, ইকবাল দ্বিতীয় বার বিয়ের চেষ্টা চালাচ্ছে।মেয়েও ঠিক হয়ে গেছে। খবরটা শুনে মাসুমা স্তম্ভিত হয়ে গেল। অসুখটা আক্রমণ না করা সত্ত্বেও তার সমস্ত শরীরটা মাথা থেকে পা পর্যন্ত শিরশির করে উঠল। পুরো সন্ধ্যেটা তার হাত-পা গুলি কাঁপতে লাগল।
আম্মা! আম্মা!
তার বাড়ি থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছা করল।
বিকেলের দিকে সে সাহস সঞ্চয় করে ইকবালকে জিজ্ঞেস করল। বিন্দুমাত্র সঙ্কোচ না করে ইকবাল সোজাসুজি তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘যা শুনেছ তার সবই সত্যি। তুমি ডিভোর্স পাবে।’
বৈঠকখানা ঘর আত্মীয় স্বজন এবং গণ্যমান্য লোকে উপচে পড়ল। ইকবালের কাকা এল, মসজিদের মৌলবী এল। ইকবাল বলল তার স্ত্রী অসুস্থ।ঘর সংসার চালানোয় অক্ষম। তাকে শারীরিক, মানসিক সুখ দেবার ক্ষমতা তার নেই। সে এগিয়ে দেওয়া মাসুমার প্রেসক্রিপশন সবাই উঁকি দিয়ে দেখল। সবাই বিশ্বাস করল যে মাসুমা তাকে স্ত্রীর সুখ দিতে পারেনি। একজন সুস্থ,সবল,সুন্দরী পত্নী তার প্রাপ্য। বৈঠকখানা ঘর ভর্তি শ্রদ্ধাস্পদ সভাসদরা ইকবালের তালাকের আর্জি মঞ্জুর করল।সবাইকে সাক্ষী রেখে ইকবাল মাসুমার মুখের দিকে তাকিয়ে সজোরে সশব্দে ঘোষণা করল—‘তালাক।’
মাসুমার কান দুটি ঝিনঝিন করে একটা সময়ে কিছুই শুনতে পেল না। বিবাহ বিচ্ছেদের এক তৃতীয়াংশ সম্পূর্ণ করা ইকবালের মুখে সন্তুষ্টির আভা ছড়িয়ে পড়ল। আগামী দুই মাসের একই তারিখে একই পদ্ধতিতে দুবার করে তালাক উচ্চারণ করার পরে তালাক প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হবে এবং দুজনেই স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতে পারবে। তৃতীয় মাসে অন্তিম বারের মতো তালাক শব্দটা উচ্চারণ করার এক সপ্তাহ আগে বাড়িতে হুলুস্থূল কাণ্ডের সৃষ্টি হল। মাসুমার ঋতুস্রাব বন্ধ হয়েছিল। তার গর্ভে ইকবালের বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছিল। গর্ভবতী নারীকে তালাক দেওয়া নিষিদ্ধ।ইকবাল ক্রোধে চিৎকার করে উঠেছিল। প্রচণ্ড জিঘাংসায় মাসুমার চুলের মুঠি ধরে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল। মাসুমা দুই হাতে তলপেট ধরে আর্তনাদ করে উঠল-‘আমি আব্বা-আম্মার কাছে ফিরে যাব।এখানে আর কখনও ফিরে আসব না। তুমি যা খুশি কর।আমাকে ছেড়ে দাও।’
আম্মা-আব্বার স্নেহচ্ছায়ায় মাসুমা মরিয়মের জন্ম দিয়েছিল। জবাকুসুম ফুলের মতো লাল কোমল মেয়েকে বুকে নিয়ে মাসুমা উপরের দিকে তাকিয়েছিল। ‘ওকে সুস্থ,স্বাভাবিক জীবন দাও আল্লা। ওর সমস্ত দুঃখকষ্ট আমাকে দিয়ে ওকে সুখী করে দাও।’
মাসুমার মাথাটা বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে মা অস্ফুট স্বরে বলে উঠেছিল,‘আমিন।’
মরিয়ম এখন তিন বছরের হয়েছে। ইকবাল এবং তার বাড়ির কেউ তার সন্তান কে দেখতে এলনা। মাসুমাও কোনোদিন সেই বাড়ির দিকে ফিরে তাকাল না। মরিয়মের জন্ম হওয়ার আগেই সে শুনেছিল ইকবালের দ্বিতীয়বার বিয়ে করার কথা। তার মাসি,কাকিমা তাকে কোর্টে যাবার পরামর্শ দিয়েছিল। মেয়ের ভরণ পোষণ দাবী করে মামলা করতে বলেছিল। মাসুমা সেইসব কিছুই করল না।
অর্ধস্ফুট স্বরে মরিয়ম দাদুকে ডাকে,‘ আব্বা,আব্বা।’
দাদুর চোখ জলে ভরে আসে। মা-বাবার দেখা শোনা করা এবং মরিয়মকে লালন পালন করায় ব্যস্ত মাসুমার কঠোর মনটা সেই মুহূর্তে কেঁপে উঠে।
মুখ হাত ধুয়ে আসা নারায়ণ মাসুমার দিকে এক কাপ গরম চা এগিয়ে দিল। মাসুমা দুই ফোঁটা চোখের জল মুছে ফেলল। স্কুলটির চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নারায়ণ তার নিজের ভাইয়ের মতো। তার মাথার ওপর দিয়ে পার হয়ে যাওয়া ঝড়-তুফান গুলি সে দেখেছে। বাবার চিকিৎসায় সে না থাকলে কীভাবে যে কী করত ভাবতেও ভয় হয়। প্রায় এক বছর আগে বাবার অসুখ ধরা পড়েছিল। গলার স্টেজ টু ক্যান্সার। অপারেশন, কেমোথেরাপির পরে বাবা ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠছে। তাকে শেষ কেমোটা দেবার জন্য গতকাল মাসুমার গুয়াহাটি যাওয়ার কথা ছিল। আর আজ হঠাৎ সে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।
‘আপনাকে একা গুয়াহাটি যেতে হবে না দিদি।আমিও যাব।আমি হেডস্যারের সঙ্গে কথা বলেছি। ছুটি ছাড়াই আমাকে দুদিনের জন্য রেহাই দেবে।’
মাসুমা জানে হেডস্যার তাকে ভালোবাসেন। রিটায়ারমেন্টের এক বছর বাকি থাকা মানুষটা তার আব্বার সহপাঠী বন্ধু।
হাসপাতালের বিছানায় পড়ে থাকা আব্বার দুর্বল শরীরটার দিকে তাকিয়ে মাসুমা এক অদ্ভুত মুক্তির নিশ্বাস অনুভব করে। আব্বার যন্ত্রণাদায়ক চিকিৎসার প্রায় সমাপ্তি ঘটতে চলেছে।ডাক্তারের মতে সমস্ত কিছুই ঠিক আছে। ধীরে ধীরে আব্বা সুস্থ সবল হয়ে উঠবে।
কেবিনে প্রবেশ করা পরিচিত ডাক্তারের সঙ্গে আজ একজন নতুন ডাক্তার এসেছে। সে আগে মানুষটাকে এই হাসপাতালে দেখেনি। উঁচু,লম্বা মিষ্টি দেখতে একজন যুবক।মানুষটা আব্বার চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজপত্র গুলি দেখল। তারপরে মাসুমার দিকে তাকিয়ে একটা পরিচিত হাসি হাসল। মাসুমা মানুষটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। তাকিয়েই রইল সে। অবশেষে সে একটা অস্ফুট চিৎকার করে উঠল,‘রুদ্র!’
রুদ্র দিল্লিতে থাকে। কিন্তু সে মাসুমার সমস্ত খবর রেখেছে। আব্বার চিকিৎসা করা ডাক্তারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছে,সাজেশন দিয়েছে। এই হাসপাতালে প্রতিমাসে দুইদিন চিকিৎসা সেবা দান করার জন্য আসে। পার হয়ে যাওয়া বছরগুলিতে একবারের জন্যও মাসুমার সঙ্গে তার দেখা হয়নি। গত তিনদিনে কয়েকবার তার কেবিনে, রেষ্টুরেন্টে, সন্ধ্যের ফুটপাথে, মন্দিরের সিঁড়িতে বসে তার সঙ্গে মাসুমা কথা বলেছে।
আজ সে মাসুমাকে নদীর তীরে নিয়ে এসেছে। বিশাল নদীটির পারের এই দিকটা নির্জন। মানুষের আসা-যাওয়া খুবই কম। দূরের জলে ঢেউ তুলে মাঝে মধ্যে এক একটি ছোট নৌকা পার হয়ে যায়। রুদ্র মাসুমার হাত ধরে,
‘চল,জলে নামি।’
মাসুমা শিউরে উঠে। কত দিন, কত বছর সে জলাশয়ের কাছে যায়নি। সেই ভয়াবহ ঝিন ঝিনানি শরীর,মগজ অসার করে তাকে জলের অতল গর্ভে টেনে নিয়ে যায় যদি! অনেক বছর আগে ডাক্তার দেওয়া এই উপদেশ সে নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলে।
রুদ্র তার হাত ধরে টানে। জলে পা রেখে মাসুমার সর্ব শরীর কেঁপে উঠে। ইস এক সময়ে জলের সঙ্গে তার কী নিবিড় সম্পর্কই না ছিল। কত আপন,কত আবেগ,কত আহ্লাদের স্পর্শ তার দুপায়ে। পর মুহূর্তেই সে সচেতন হয়ে উঠে। যদি হঠাৎ তার শরীর খারাপ করে। বাড়িতে মা এবং মাসির মেয়ে শবনমের কাছে মরিয়মকে রেখে এসেছে। হাসপাতালে তার আব্বা আছে। এই মুহূর্তে তার জীবন তাদের কাছে বড় প্রয়োজনীয়। সে তীরের দিকে এগিয়ে যেতে চায়। রুদ্র তাকে আলগোছে জড়িয়ে ধরে।
‘তুমি আমাকে ডাক্তার হতে, সাঁতার কাটতে বলেছিলে। মনোযোগ সহকারে পড়াশোনা করে মেডিকেলে সিট পেলাম। কিন্তু সাঁতার শেখার জন্য অনেক বছর লেগেছিল জান কি? আমি জলকে ভীষণ ভয় করতাম।’
রুদ্র হাঁটু পর্যন্ত ভেজা জীন্সের প্যান্টটা খুলে তীরের দিকে ছুঁড়ে দিল। শর্টস আর গেঞ্জি পরে সে সাঁতার কাটতে লাগল। সামনে থেকে দূরে,দূর থেকে কাছে জলে ভাসতে থাকা তার শরীরটার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে মাসুমা তাকিয়ে রইল। একবার সে উঠে এসে তার হাত ধরল,
‘এস, সাঁতার কাট।’
সে মাসুমার চূর্ণিটা লাডু করে তীরের দিকে ছুঁড়ে দিল। মাসুমা কেঁপে উঠল।
‘না, না আমি পারব না। আমার ভয় লাগে।’
তার দুহাত নিজের হাতে নিয়ে রুদ্র বলল,‘আমি তো আছি ।’
যেন পাশে দেবদূত রয়েছে। অভয়, আশ্বাস, বিশ্বাসে ঘিরে থাকা এই ঈশ্বর। আকাশ আলো করে নেমে আসা মরিয়ম পুত্র। শরীরটা জলে ছেড়ে দেয় মাসুমা। তার শরীরে শীতল, প্রাণোচ্ছল তরঙ্গ। সেই কত যুগ আগে ছেড়ে আসা বাগানের পুকুরে ছায়াঘন শীতলতা। সেই মামার বাড়ির পেছনে রৌদ্রোজ্জ্বল খরস্রোতা জলরাশি। হাত দুটি পেছনে দাপিয়ে দাপিয়ে ওপরের দিকে মুখ করে চিল সাঁতার কাটা। আকাশের সাদা মেঘের মধ্য দিয়ে শূন্য অভিমুখে পাখা ঝাপটে এগিয়ে চলেছে একটি পাখি। তার পাশেই সাঁতরাতে থাকা রুদ্রের দিকে সে তাকাল।সে চোখের পলক না ফেলে রুদ্রের দিকে তাকিয়েই রয়েছে। মাসুমার ভয়, সংশয় কিছুই নেই। ঐ যে একটা শুভ্র ভেঁটফুল পাপড়ি মেলেছে। কী আশ্চর্য!স্রোতস্বিনী নদীতে কীভাবে ভেঁটফুল ফুটতে পারে!সে থেমে গেল। কখনও বোধহয় মরুভূমির ভূত সবুজে আশ্রয় নেয়। পাথরের ফাঁকে পাপড়ি মেলে নীল বন্যফুল। হ্যাঁ,তার সামনেও তো হেলছে দুলছে ঐ যে তার আশার ভেঁটফুল। গতকাল সেই ফুল ছিল না। আগামীকাল থাকবে কিনা সে জানে না। কিন্তু এই একটি মুহূর্ত এসেছে তার জন্য। হারিয়ে যাওয়া একটা সুবাস নতুন করে জড়িয়ে ধরার জন্য সে দুহাত মেলে দিল।
মুল গল্প – প্রকৃতি নাজির
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ – বাসুদেব দাস
প্রকৃতি নাজির – অসমের যোরহাটের বাসিন্দা। ১৯৭৩ সনে জন্মগ্রহণ করেন। ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতকোত্তর এবং বর্তমানে ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষয়িত্রী।