একটি কথোপকথনের স্মৃতি, বর্তমান, এবং ভবিষ্যতের বাস্তবতা।
২০১৩ সালের ৮ নভেম্বর দুপুরে মনের ভিতর কিছু কথা ঘুরে ফিরে বারবার উঁকি দিচ্ছিলো। ফেইসবুকের টাইমলাইনে ‘What’s on your mind’ চোখে পড়ায় কথাগুলো সেখানে পোস্ট ক’রে দিলাম:
“ব্যক্তি নিরপেক্ষ হওয়া কি জরুরী? ব্যক্তির বিচার, ব্যক্তির কর্ম নিরপেক্ষ হওয়াটাই তো বরং আবশ্যিক ভাবে জরুরী। রাজনৈতিক দর্শন ও চিন্তাধারা ভিন্ন হওয়া তো অস্বাভাবিক বা দোষের নয়। অধিক আত্মবিশ্বাসের অহম থেকে এসবের আরোপ, অযথা প্রয়োগ এবং অপপ্রয়োগ অবশ্যই দোষের। মানবতা বিরোধী হওয়াটা অপরাধের। আর অন্যায় নীরবে সয়ে যাওয়াটা ঘৃণার। এজন্য যেখানেই অন্যায় সেখানেই দল, মত, চিন্তা, দর্শন নির্বিশেষে সবাই এক হয়ে যাওয়াটাই তো সরল পথ। স্বাভাবিক। এবং সামাজিক। কারণ, মানুষ পরিচয়ে আমরা তো সমাজবদ্ধ জীব!”
জবাব দিলেন আমার এক শ্রদ্ধেয় ফেইসবুক বন্ধু (জা. নু.): ব্যক্তির কর্ম, বিশ্বাস ও বিচারই তো ব্যক্তি…নইলে সে আর কি?
সহমত। তবে আমি আসলে বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে ভাবার চেষ্টা করছিলাম। বললাম, ঠিক বলেছেন। ব্যক্তির কর্ম, বিশ্বাস, বিচার, চারিত্র্য ধর্মের মধ্য দিয়ে ‘ব্যক্তিত্ব’ অর্জিত হয়। মানুষ ব্যক্তি হয়ে ওঠে নৈতিক অধিকার এবং কর্তব্যের বাহক হিসাবে। তবে এইসব বৈশিষ্ট্য ছাড়াও অস্তিত্ব প্রকাশে ব্যক্তির আরেকটি সংখ্যাবাচক পরিচয় আছে। সেজন্যই আমরা বলে থাকি এক ব্যক্তি, দুই ব্যক্তি, জনৈক ব্যক্তি, একাধিক ব্যক্তি ইত্যাদি। এরকম অনেক ব্যক্তির সমষ্টি হয়ে ওঠে ‘জনতা’। আর বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে (আমাদের অভিজ্ঞতায় এটাই কমন) জনতার মাঝে ব্যক্তির একক-সত্বা, ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য লোপ পায়। সেজন্য বলা হয় ‘সমষ্টির মাঝে ব্যষ্টির বিলোপ’। ‘সাধারণত:’ এসব ক্ষেত্রে ব্যক্তির বিচার, ব্যক্তির কর্ম নিরপেক্ষতা হারায়। তখন জনতা হয়ে উঠতে পারে উত্তেজিত, উন্মত্ত, fickle-minded mob। সেজন্য মনে করি, বিশেষত প্রেক্ষাপট যখন সার্বজনীন, তখন ব্যক্তির বিচার, ব্যক্তির কর্ম নিরপেক্ষ হওয়াটা আবশ্যিক ভাবে জরুরী।
একই সঙ্গে সর্বাঙ্গীন শান্তি নির্ধারক জাতীয় চরিত্র সৃজনের তাগিদে, ব্যক্তির বিচার, ব্যক্তির কর্মের নিরপেক্ষতা প্রাত্যহিক আচারে, অভ্যাসে, চর্চায় আনাটাও তাত্পর্যপূর্ণ।
জবাবে বন্ধু জা.নু. বললেন, “তৌহিদ, জনতার মধ্যে সংখ্যাবাচক পরিচয় তখনই লোপ পায় যখন জনতা এক অভিন্ন বিশ্বাস কিম্বা অবিশ্বাসে যুক্ত কিম্বা বিযুক্ত থাকে, মব আর জনতা দুই ভিন্ন বিষয়…যখন সংখ্যা জনতার চেয়ে বড় তখনও ব্যক্তি কিন্তু তার এক অংশ…তারা সবাই এক চিন্তায় এগোয় না বটে কিন্তু তাদের এগুনোর অন্বিষ্টের দিকে যাবার অন্বেষণটা লোপ পায় না…অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই তাকে এ অন্বেষণ চালিয়ে যেতে হয়… জনতাও কিন্তু জনতাই…অভিন্ন লক্ষ্য না থাকায় তারা তখন পরস্পরমুখী বা বিমুখী সত্তার একত্র সমাবেশ…যা কোনও না কোনও লক্ষ্য নির্ধারণে ব্যস্ত…আপনি আমি কতটুকু এই লক্ষ্য নির্ধারণে তার পাশে দাঁড়াতে পারছি এ বিষয়টিই নির্ধারণ করে দিতে পারে কতটুকু জনতা ও সংখ্যা পরস্পরকে ধারণ করে অর্থপূর্ণ হয়ে উঠছে…ব্যাপক মানব কল্যাণে প্রয়োগমুখী এই কর্মকাণ্ড অটোমেটিক ঘটে না…তা জীবন ধারণের প্রয়োজনের মাত্রা ও উপায়ের সাথে সাযুজ্য রেখে বিকশিত হয়…যদি বাইরের ফোর্স তার সাথে হাত না মেলায় তবে তার গতি শ্লথ হয় বা তার দিক বদলে যায়…বাইরের একটি ইতিবাচক গঠন প্রক্রিয়া যা পারে তা হলো ব্যক্তির পরিবর্তনের প্রবণতার সাথে মেলে এমন উপাদানগুলো বাড়িয়ে তুলে জনতার পরিবর্তনের গতিকে ত্বরান্বিত করা….”
চমৎকার এই যুক্তিগুলো তুলে ধরার জন্য শ্রদ্ধেয় বন্ধু জা.নু.-র প্রতি আজও কৃতজ্ঞতা বোধ করি। কারণ আমার ভাবনা প্রসারিত হতে থাকে। চিন্তার গ্রন্থি খুলে খুলে ক্রমশ আরো এগিয়ে যেতে থাকি। …
জনতার মাঝে ব্যক্তি সব সময়ই জনতার অংশ। জনতার সদস্য। ‘জনতার মধ্যে সংখ্যাবাচক পরিচয় … লোপ’ পাওয়ার কথা আমি বলিনি। বলেছি, ‘জনতার মাঝে ব্যক্তির একক-সত্তা, ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য লোপ পায়।’ আর বলেছি, ‘সমষ্টির মাঝে ব্যষ্টির বিলোপ’-এর কথা। ‘ব্যষ্টি’র অর্থ এখানে ‘পৃথক পৃথক ভাব’ বা ‘স্ব স্ব ভাব’ (নিজস্ব স্বভাব)। অর্থাত, জনতার মাঝে ব্যক্তি এককভাবে তার নিজের স্বভাবের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে। তার নিজস্ব মত, যুক্তি, বিচার গৌণ হয়ে যায়।
জা.নু. বলেছেন, ‘জনতা এক অভিন্ন বিশ্বাস কিম্বা অবিশ্বাসে যুক্ত কিম্বা বিযুক্ত থাকে’। ঠিক। যখন অভিন্ন লক্ষ্য বা বিশ্বাসে যুক্ত থাকে তখন সেই ‘জনতা’ হয় ‘হোমোজিনিয়াস ক্রাউড’, (সমপ্রকৃতির বা একই শ্রেণীর জনতা )। আর যখন বিযুক্ত থাকে তখন সেই জনতা হয় ‘ক্যাজুয়াল ক্রাউড’ বা ‘হেটারোজিনিয়াস ক্রাউড’ (নানা শ্রেণীর জনতা), এদের অভিন্ন লক্ষ্য থাকে না। হোমোজিনিয়াস ক্রাউড বা জনতার ক্ষেত্রে এর সদস্যদের একই লক্ষ্য (common aim) থাকে। এবং অবশ্যই তাদের একজন লিডার থাকতে হয়। সেজন্য সাধারণত জনতার মাঝে ব্যক্তি পরবশ হয়। সম্মোহন বা বশীভবনের চুড়ান্ত অবস্থার অভিজ্ঞতা লাভ করে। আবেগের বশীভূত হয়। জনতার প্রতিটি সদস্য জানে যে অন্যান্য সদস্যও তার মত একই আবেগ একই অনুভূতিতে আন্দোলিত। অর্থাত একাত্মতা অনুভূত হয় আবেগের মধ্য দিয়ে। আর আবেগে তলিয়ে যায় যুক্তি, বিচার, বিবেক।
আবেগের উচ্ছ্বাসের সঙ্গে সঙ্গেই হয় যুক্তির নিমজ্জন। সংখ্যার আধিক্যের চাপে লোপ পায় ব্যক্তির একক-সত্বা। ব্যক্তির আত্ম সচেতনতা এবং আত্ম উপলব্ধির অভাব তৈরি হয়। তাই বলেছিলাম, ‘ব্যক্তির বিচার, ব্যক্তির কর্ম নিরপেক্ষতা হারায়। তখন জনতা হয়ে উঠতে পারে উত্তেজিত, উন্মত্ত, fickle-minded mob।’ এখানে মব জনতারই রূপান্তর।
Crowds are highly egoistic. সাধারণত জনতা স্বভাবে অত্যন্ত উদ্ধত ও স্বার্থপর হয়ে থাকে। এই উদ্ধত স্বভাব এবং আত্মবাদী আচরণের কারণেই জনতা চপল, অস্থির, অস্থিতিশীল এবং অনির্ভরশীল। নেপোলিয়ন এই যুক্তি, এই বাস্তবতাটিকেই মূল্য দিয়েছিলেন। সেজন্য দেখি তাঁর ব্যক্তিগত কর্মচারী যখন জনতার উল্লাসে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন, ‘Your majesty,… hear the crowds cheering for you.’ (জাহাপনা, … ওই শুনুন জনতা আপনার জন্য উল্লাস করছে), তখন নেপোলিয়ন নির্লিপ্তভাবে জবাব দেন, ‘They would cheer just as loudly if I were going to the guillotine.’ (আমি গিলোটিনে গেলেও ওরা সমান উল্লাসে হৈ-হুল্লোড় করতো।) সমষ্টির মাঝে ব্যক্তি আত্ম সচেতনতা এবং স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব হারায় বলেই জনতা anti-normative আচরণে fickle-minded mob-এ অর্থাৎ চঞ্চলমতি অস্থিতিশীল জনতায় রূপান্তরিত হয়। সামাজিক মূল্যায়ন হ্রাস পেয়ে এই উত্তেজনা, উন্মত্ততাই জনতার অঙ্গীভূত ব্যক্তির ডার্ক সাইড বা কালো দিক। Simon Lebon তাই বলেছিলেন, ‘Isolated, a man may be a cultured individual; in a crowd he is a barbarian.’ (বিচ্ছিন্নভাবে একজন ব্যক্তি সভ্য, সংস্কৃতিবান ব্যক্তি হতে পারেন, কিন্তু জনতার মাঝে হয়ে যান অসভ্য, বর্বর।) এ কারণেই আমরা দেখি, পূর্বাপর বিবেচনা রহিত, বিচার-বুদ্ধিহীন, চঞ্চলমতি অস্থিতিশীল জনতা ‘ছেলেধরা’ বলে নিরীহ অভিভাবক মা-কে পিটিয়ে নিষ্পাপ শিশু-ছাত্রীকে নিঃসহায় এতিম বানিয়ে ফেলে; কিম্বা ‘কোরান অবমাননাকারী’ বলে মানসিক অবসাদ্গ্রস্তকে পিটিয়ে হত্যা করে পুড়িয়ে ফেলে।
সেজন্য জাতিগতভাবে ব্যক্তির চারিত্র্য ধর্মে নিরপেক্ষতা সহজাত করার তাগিদে উপরের মন্তব্যে সেটা ‘প্রাত্যহিক আচারে, অভ্যাসে, চর্চায় আনা’র ওপর গুরুত্বারোপ করেছি।
‘ব্যক্তির পরিবর্তনের প্রবণতার সাথে মেলে এমন উপাদানগুলো বাড়িয়ে তুলে জনতার পরিবর্তনের গতিকে ত্বরান্বিত করা’র ক্ষেত্রে ব্যক্তির কর্মের এবং বিচারের নিরপেক্ষতা অনুঘটকের কাজ করতে পারে। আর সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে প্রাসঙ্গিক বিচারে তার নিজের অনুসৃত আদর্শের এবং চিন্তাধারারও মিথস্ক্রিয়া হতে পারে।
‘ব্যাপক মানব কল্যাণে প্রয়োগমুখী কর্মকাণ্ড’ বেগবান করতে অবশ্যই ‘ইতিবাচক গঠন প্রক্রিয়া’ জরুরী। সে উদ্দেশ্যে জনতার যে আন্দোলন তার প্রস্তুতিপর্বে সাংগঠনিক দ্বন্দ্বের কথা বিবেচনায় আনা আবশ্যক। আন্দোলন পরিচালনাকারী কেন্দ্রের সঙ্গে আন্দোলনে অংশগ্রহনকারী ব্যাপক মানুষের পরিধির দ্বন্দ্ব চিহ্নিত করে কেন্দ্র এবং পরিধির সঙ্গে পদ্ধতিগত ও কাঠামোগত সংযোগ গড়ে তুলতে না পারলে জনতার আন্দোলন তার কাঙ্খিত পরিসর অনুযায়ী সফল হতে পারে না। এক্ষেত্রেও নিরপেক্ষতা অত্যন্ত জরুরী। নয়তো অচিরেই আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ে। নিকট অতীতে আমরা তার প্রমান পেয়েছি।
পুনরুক্তি:
ব্যক্তির কর্ম, বিশ্বাস ও বিচারই ব্যক্তি…. নইলে সে কেবলই সংখ্যা, যেমন দুইশ’ — কর্মী, আড়াইশ’ — কর্মী, ইত্যাদি। এখন ‘ড্যাশ’ বা শূন্যস্থান গুলোতে যদি যথাক্রমে ‘বিএনপি’ ও ‘আওয়ামী’ শব্দ দু’টি বসিয়ে দিই, তাহলে এখানে কর্মী বা ব্যক্তি নিরপেক্ষ থাকে না। তার নিরপেক্ষ হওয়াটা জরুরীও নয়। জরুরী তার বিচার ও কর্মের নিরপেক্ষতা। ইস্যু যখন সার্বজনীন তখন এই ‘দুইশ’ কিম্বা ‘আড়াইশ’-র পক্ষপাত, বৈরীতা, বিভক্তি বা বিভাজন মোটেই কাম্য নয়। স্ব স্ব ভাব, চিন্তা, দর্শন বা আদর্শের আরোপ বা অপপ্রয়োগ কাম্য নয়, কাম্য সর্বজন-স্বীকৃত নিরপেক্ষতা। এই নিবন্ধের শুরুতে উল্লেখিত সেদিনের সেই ষ্টেইটাসের ফোকাল পয়েন্ট এটাই।