বাংলা কবিতায় আশির দশকের
বাকবদল এক নতুন কবিতার দাপটের সত্যবিশেষ। এই যে তাদের জীবন, বেদনা, পরাজয়, জয় কিংবা মৃত্যু সেইসবই নিকটতম দূরত্ব থেকে আমাদের দেখতে হবে। তবেই তাদের কবিতার মর্ম ও চিত্রকল্প আপনি ধরতে পারবেন। আশির দশকের কাব্যের যে আন্দোলন তার মূলে ছিলো কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিন। আশির দশকের সবচেয়ে উচ্চারিত শব্দটি “প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা”। যদিও সেই প্রাসঙ্গিকতা সময়ে ম্লান হলেও তাহাদের কবিতা একটা সময়ের স্মারক।
আজ আশির দশকের এক তীব্রতম কবি রিফাত চৌধুরীর কবিতা নিয়ে ওয়েব ম্যাগ ” কিংবদন্তি” হাজির করছে তার “মেঘের প্রতিভা” কবিতার বই থেকে বাছাইকৃত দশটি কবিতা। আমাদের দৃঢ় আশা আশির এইরকম বিশজন কবিকে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কাজ করার। জানিনা সেই আশার কতটুকু সাধন বা কী করতে পারবো আমরা। তবে চেষ্ঠা অব্যাহত থাকবে। কবি রিফাত চৌধুরি যার উচ্চারণ মাত্রই কবিতা। নিজস্ব নিয়মে কবিতা লিখতেন তিনি। বাংলা কবিতায় কবি রিফাত চৌধুরী এক আশ্চর্যজনক গোঁয়ার্তমি নিয়ে বেঁচে আছে।
মেরিলিন মনরো
নগ্ন মেয়েটিকে দেখে মেরিলিন মনরোর কথা মনে পড়ে
মেয়েটি হাঁটু মুড়ে মাথা একটু ওপর দিকে তুলে শুয়ে আছে।
খোলা চুলের ঢল ঝুলে পড়ছে নিচে।
উন্মুক্ত বুকে।
বাগানের ভিতরে
বাগানের ভিতরে একটা লম্বা বেঞ্চ।
সেই বেঞ্চর ঠিক মাঝখানে অর্ধনগ্ন দুই রমণী আলাপে ব্যস্ত।
পায়ের কাছে ইতস্তত কিছু বুনো গাছে ফুল ফুটে আছে।
ফুলগুলো গাছ থেকে ঝোলে- ফুলগুলো মাটির দিকে মুখ করে থাকে।
তাদের নিম্নাঙ্গে একজনের পরনে লাল শাড়ি অন্যজনের ঘন নীল।
তাদের একজনের গলায় লাল ফুলের মালা পরা,
চোখ দুটিও কেমন যেন ত্রাসসঞ্চারক।
অন্যজনের মুখে হাসি, এ হাসিতে কি রহস্যই বেশি?
তারও চোখ দুটিতে আছে ভয় ও ভয়- পাওয়ানোর দৃষ্টি।
বস
ভিতরে যা থাকার কথা ছিলো কিন্তু নেই
কিংবা দুটি শাদা ফলের মতো দুটি চোখ আছে
কিন্তু ভিতরে মণি নেই।
ভিতরে যা থাকার কথা ছিলো কিন্তু নেই।
মণি নেই, চোখ যেন পাথরের মতো কঠিন।
তরমুজ
একটি মেয়ে একটা তরমুজ কাটছে।
তার হাতে ছুরি।
তরমুজ দু’ টুকরো করে ছুরির ঠাণ্ডা ইস্পাতের ফলা চলে গেছে।
পাকা তরমুজের লাল বুক চিরে
তরমুজের ঘোর সবুজ রঙের উপর দিয়ে তরমুজের রস গড়িয়ে পড়ছে।
কাটা তরমুজ থেকে টপটপ করে রস গড়িয়ে পড়ছে।
তরমুজের রস থেকে একটু বেশি লাল, যেন রক্ত।
শিকার
গাছপালার ভেতর মাটির বাড়ি,
বন পথে গ্রামের মোড়লের চলে যাওয়া,
পাহাড়ের সামনে গ্রামের ভোর,
সূর্যস্নাত গ্রাম ধূলামাটির রাস্তা,
ঈষৎ বিস্তৃত চালাঘর।
একটা বেড়াঘেরা গাছের পাশ দিয়ে গরুর পিঠে চেপে চলছে
একটি লোক।
আবছা গ্রামের ধু-ধু সকালবেলার কপিশ চেহারা।
শিশির ভেজা ধূলিসাৎ মাঠ। সবুজ ঝোপ।
তার একপাশে গাছের উপর নিশ্চিন্ত নিরাপত্তায় বসে আছে
রঙিন দুটি ছোট পাখি।
আর বিপরীত দিকে ঝোপের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে শুধু হিংস্র
দুটি চোখ।
রাজা
রাজাকে কখনও আমি পুতুল ভাবি,
আবার ভিখারি বালককে কখনও রাজা ভাবি।
মেঘের প্রতিভা
ছেঁড়া জামা পরা এক কিশোর,
ছেঁড়া জামা তার প্রতিভা
আলো – ছায়াঘেরা আকাশের নিচে
বোরখা পরা প্রার্থনারত মহিলা,
বোরখা তার প্রতিভা
আয়না হাতে একটা বেশ্যা,
আয়না তার প্রতিভা।
পুকুর
একটি পুকুর। একটা ডাব গাছ। সূর্য গাছটার মাথায় এসে পড়েছে। তার রশ্মিগুলো সদ্য- ছাঁচে- ঢালা ইস্পাতের ছুঁচের মতো সোজা হয়ে সামনের পুকুরটাকে এসে ধাক্কা খেয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। পুকুরটাকে সূর্যের মুখোমুখি রাখা একটি বিরাট আয়না বলে মনে হয় আমার। আমি সেই
আয়নাসদৃশ্য জলের ওপর দৃষ্টি নিবন্ধ করে দাঁড়িয়ে দেখি, পুকুর পাড়ে কাটা ডাব হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন লোক। মণ্ডুহীন। (মস্তিষ্কহীন?)
তার মাথাটি দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ওপরে ডাব গাছে ঝুলে থাকে।
ডেইটি
অসংখ্য কুঞ্চনসহ একটি মুখ,
পরনে মলিন নীল রঙের গলাবদ্ধ কোট,
হাতে জ্বলন্ত সিগারেট।
মাথায় সাদা চুলে মাখানো সূর্যাস্তের জ্বলন্ত লাল।
নিঃশব্দে, সিগারেট টানার মতো,
যন্ত্রণাকে শুষে নিচ্ছে সত্তায়;
সিগারেটের ছাই ঝরার মতো ঝরিয়ে দিচ্ছে কয়েকটি গান।
শাড়ির দোকানে তিনজন মহিলা
কলাপাতা সবুজ শাড়ি পরা তিনজন মহিলা।
তিন মহিলাকে শাড়ির দোকানের ভিতরে
শাড়ি নিয়ে পরীক্ষা আর দরদাম করতে দেখা যায়।
যেন চাঁদের আলো দিয়ে তৈরি কাপড়।
এমন পাতলা যেন আশ্বিনের হাওয়া দিয়ে তৈরি আঁচল।
এমন নরম।
পাট করা শাড়ি প্রায় সবখানি খুলে দু-পাশে দুজন মহিলা বসে দেখছে।
বাঁ পাশের জন প্রান্ত ঘেঁষে। ডানপাশের জন একটু সরে।
রয়েছে আরেকজন মাঝখানে, কিন্তু পিছনে।