আশির দশকের কবি বিষ্ণু বিশ্বাস আজও প্রাসঙ্গিক ও বর্তমান। বিষ্ণুর কবিতায় জন্মের অসারতা, দুর্বিষহ ক্ষয়ষ্ণুতা, চারিদিকে উপচানো অন্ধকার ও মৃত্যু বিষয়ক একটা বিশাল অংশ জুড়ে বিদ্যমান। প্রকৃত কবি মাত্রই তার যাপিত জীবন ও পারিপার্শ্বকতা থেকে কাব্যের রসদ সংগ্রহ করে। অতঃপর কবিতায় তা প্রয়োগ করে চিন্তা কল্পনা ও গভীর দর্শন বোধে। অবশ্যই বিষ্ণুর কবিতার ক্ষেত্রে তার ব্যত্যয় ঘটেনি। কবি বিষ্ণু বিশ্বাস সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন। চিকিৎসাধীন ছিলেন একজন মনোচিকিৎসকের। একটা সময় ডাক্তার বিষ্ণুর বন্ধুদের সার্বক্ষণিক দেখাশুনার ওপর নজর দিতে বললেন। কিন্তু হঠাৎ করে একদিন বিষ্ণু উধাও হয়ে গেলেন বন্ধুদের সব নজরদারি ফাঁকি দিয়ে। উধাও হয়ে আবার ফিরে আসা এভাবে চললো কিছুকাল। কখনও রাজশাহী কখনও ঝিনাইদহ। এভাবেই একদিন নিজ মাতৃভূমির প্রতি ক্ষোভ জানিয়ে চলে গেলেন পশ্চিমবঙ্গে। এখনো তিনি শাররীক – মানসিক বিপর্যস্ততা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গেই আছেন।বিষ্ণু বিশ্বাস নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন ১৯৯৩ সালে। তখন বয়স ছিলো ৩১ বছর। এখন তার বয়স ৬০ পেরিয়ে গেছেন। বয়সের ছাপ পড়েছেন আর অযত্ন অবহেলায় রুগ্নতায় হয়ে পড়েছেন অসুস্থ। শব্দহীনতা কে স্থান দিলে অন্ধকারের দেখা মেলে বলে হয়তো কবিতায় তিনি আগেই বলেছিলেন-
সূর্যের কাছাকাছি সূর্যের মতো পুড়েছে
আলোর বহুদা রাস্তার প্রান্তে
বারবার অন্ধকার
সময় থেমেছে
শব্দহীন।
ঈশ্বরের জন্মজন্মান্তর
আমাকে পেরিয়ে গেলে তুমি পাবে এক ধূলিপথ
ডানে বাঁয়ে সবখানে শিলীভূত পাখিদের শব
মৃত্যু যেখানে অমর অমেয় জলের স্বপ্ন ধোয়া
বাঁশপাতা খড়খড়ি ঊষর দানোর লোহাগড়।
হয়ত থামতে হবে, বহুবার অনাত্মীয় শোকে
তোমার সোনালি জামা, হলুদ গন্ধের শাড়িখানা
উড়িয়ে নিয়েছে ঝড়। শুধু স্বপ্নের আঁধার-গান
তারাদের নীল জলে তোমাকে দিয়েছে কামরতি
তোমাকে বিয়োতে পারো আদি ঊষা, প্রথম বাগান?
দ্বিতীয় ঈশ্বর তবে তৃতীয় ঈশ্বর জন্মদানে
আবার মিলিত হবে সোনালি জামা হলুদ গন্ধে।
এই অনুবর্তনের গল্পে যে পথে গিয়েছে ধূলিপথ
ডানে বাঁয়ে সবখানে জাম আম সবুজ কথক
আমাকে পেরিয়ে গেলে নিশ্চিন্ত কল্পতরুর গাছ।
গল্পের কুমার
ধরাতলে একদিন পৃথিবী এনেছে ধারাজল
দেবতা-চোখের আলো ক্রমে নিভে হয়েছে সকাল।
বেড়াতে এসেছে এক গল্পের কুমার অসময়ে
তার অবসর ছিল। স্রোস্বতী কিনারে দেখেছে
নীল বাঁদরের হাট। দীর্ঘক্ষণ পলক পড়েনি
দেবতা-চোখের আলো ক্রমে নিভে হয়েছে সকাল।
এমন গল্পের কবি অন্ধ হলে সৃষ্টি স্থিতি লয়
নিশ্চিহ্ন আলোর সখা, তোমাদের শোনা কোন গান
পাথরে স্থির হয়েছে। জ্যোতিষ্কের পরশ পাথর
সীমাহীন ঘটমানে, নিয়তির চুল ছিঁড়ে ছিঁড়ে
নীল পশমি ছাগল। হাটবারে হাটে বাঁধা থাকে।
পাইকারি কথামালা। শোরগোল গন্ডোলায় ভেসে
চলে যায় চলে যায় তারাদের পৈশুন্য আঁধার
ধরাতলে একদিন পৃথিবী এনেছে ধারাজল
দেবতা-চোখের আলো ক্রমে নিভে হয়েছে সকাল।
বলবার ছিল
জায়গা ছিল না কোনো কথা বলবার, শুনবার।
সমুদ্রের ধারে যেতে পথের বাদাম গাছগুলি
মিহি কথার কৌতুকে পাথর ফুলের ধাক্কা দিল
আমি কী বলেছিলাম, তোমরা যারা শুনেছো বেশি
শোনাবে–একটু খানি। আমি ভুলে গেছি জন্ম আছে।
কিছু যন্ত্রণার কথা যেভাবে বলেছি মনে নেই
একটু আনন্দ কথা, গোলাপি স্তম্ভে স্থির রয়েছে
অন্ধ থেকে চোখে জেগে সমুদ্র দেখি বালির স্তূপে।
অ- ভাব মৃত্যুর কবিতা
‘ In the skull all save the skull gone’
Samuel Beckett, Worstward Ho
এবং পাহাড় এখানে চূর্ণিত পাথর
হাওয়া
হাওয়া, আত্যন্তিক বরফ।
পাতাঝরা।
পাতাঝরা বৃক্ষ
কীর্তিস্তম্ভের মতো দাঁড়ানো
শীতার্ত, আগুন জ্বালো
আগুনের অন্ধকারে, পূর্ণজ্যোতি চাঁদ
ভীত বৃক্ষের ছায়া আঁকে
( ভীত ও মৃতের পার্থক্য খুঁজো না)
ঢেউ। ঢেউ ভেঙে আসা সাদা ধুলো
বিমর্ষ পূর্ণিমার আলো
নিক্ষিপ্ত তারা
রাতের শিশির
এখানে, খুলির ভিতর
শূন্য, খুলির ভিতর
কেউ মরে না
মৃত্যু মরেছে আলো নিবিয়ে
অন্ধকার জ্বলে।
অন্ধকার পহাড় সমুদ্র
নক্ষত্র নিভে গেলে
বিস্তীর্ণ ধুলির পথ
বহুদিন পায়ে হেঁটে সমুদ্রে মেশে।
পাহাড় পেয়েছে পান্থ রক্ত
নৃত্য। পৃথিবী ছায়ার
বিচিত্র মুদ্রার মৌরিবনে
বৃক্ষময় নৃত্য অগ্নি
পাতায় আগুন জ্বালে
আগুন অন্ধকারে।
পথের পথিকের সমবেত গান
হাওয়ায় ভেঙে ভেঙে ভাঙার মন্ত্র
শব্দ। অদৃষ্ট তীক্ষ্ণ আলোক
পাথর দরজা ভেঙে পাথর
পাথর ভাঙে পাথর
ঝর্না চলে।
হঠাৎ থেমে গেলে অগ্নিক্ষরণ
রক্তক্ষরণ থেমে গেছে
কালো ছাই, ধুলোয় ঢেকেছে অরণ্য।
তখন অন্ধরাত্রি
অন্ধকারে কেটে চলে পিশুন আঁধার
আর সমুদ্রের বিপরীতে সমুদ্র, হাওয়া কেবল সমুদ্র টানে।
আকাশগঙ্গা
কোনদিন ভোরবেলা অবাক হয়েছ তুমি জেগে
স্নান করেছি কোথাও আমি প্রপাতের জলে
নগ্ন – সূর্য শুভেচ্ছার পরে।
ক্রমোন্মুখ আলো করি অনুভব চোখের পাতায়
আমি চোখ বুজে
এবং আমার এই বিবর্তিত শরীরের কোথা থেকে ফুল গন্ধ আসে
কত না যুগের ধূপ, বনস্পতির স্নেহ শুধু ঝরে পড়ে।
কিন্তু তুমি দ্যাখো এই অতীতের জঙ্গলে জঙ্গলে
রাশি রাশি ফুল আর ফলের নিশ্চুপ সমারোহে
মাংসাশী দাঁতের অতি উৎসাহ। তবুও
কালবেলা আমি চোখ খুলেছি এখন ধীরে ধীরে
অনেক আলোককণা তুমি শেষে মিলিয়ে গিয়েছ
আকাশের এক কোণে
যেখানে হয়েছে শুরু, কিংবা শেষ, আকাশগঙ্গার।
কালো মেয়ে
শুধু মৃতদের গল্প কত আর কাঁধে ঝুলে যাবে
এবার নিস্কৃতি পেলে, শান্তি অন্বেষণে মহাকাশে
গিয়ে, দু’ টুকরো লোহা ঠুকে দেব আগুন জ্বালিয়ে
অসহ অসীম শব পুড়ে হোক ছাই, পুড়ে ছাই
তারপর আমাদের নিমগাছটির পাশে নদী
কদমগাছটি আছে অন্যদের মুঘলের ঘাটে
তুমি, সন্ধ্যাস্নানের ঝংকৃত দূরে, আছো, কালো মেয়ে
আমি ভালোবেসে ভুলে তোমাকে জ্বালিয়ে দিই নাই।
তরবারি
এবার মৃত্যুর পর আমাকে পাহাড়ে যেতে হবে-
রুদ্রকান্তি হাড়ের তরবারি
রাখা বরফের অন্ধকারে।
ধীরে আস্তে স্তব্দ ঊষাকালে
বলবার কথাগুলি
কবে মরে জ্বলে আছে কাঠ
মন্বন্তরের শবে।
মৃত্যু, যদি নিশ্চিত নিশ্চিহ্ন কোথাকার হাওয়ায় হাওয়ায়
হাওয়ার আলোককণা ঝরে পড়ে বৃক্ষের নিচে-
দাঁড়ানো ওড়ানো চুল, কুমারীর, কালো কালো স্তনে-
ধীরে আস্তে স্তব্দ ঊষাকালে
বলবার কথাগুলি
তুমি বলে গেছ তরবারি
এবার মৃত্যুর পর আমাকে পাহাড়ে যেতে হবে-
নীল কৈ
গল্পের শেষ ওরকমটি ছিলনা মোটেই, তেমার মনে নেই।
সেদিন ছিল রাত্তির-জ্যােস্নার। শোনো, আবার বলি,
সেদিন ছিল জ্যােস্নার -রাত্তির জোনাকিরা কেন যে
হঠাৎ আন্দোলনের মতো কেঁদেছিল উথালপাথাল
যদিও আমার আর মনে পড়ে না। তাদের কান্নার জলে
চৈত্রের মাঠ গেল ডুবে। ভেসে এল কোথা থেকে
শত শত নীল কৈ-
তাদের নীল ডানা আর লাল দৃষ্টি জ্বলে, জলের ভিতরে।
তুমি আমি আর আরো বহু কথা কইনি কোনো
সেদিন গেয়েছি গান- সমুদ্রের আকাশের আগুনের।
অন্তত তুমি এবং আমি, না জেনে
কী সম্পর্ক সমুদ্র আর আকাশের আর আগুনের।
তারপর থেমে গেল জল- কান্নার – জোনাকির
নীল ডানা ও লাল দৃষ্টির জল নেমে গেল-
জেগে উঠল ভূমি।
তারপর বহুদিন আমরা গান গাইনে কোনো-
শুধু গল্প করি নীল কৈ- নীল কৈয়ের।
জয়
বহু জ্যােতিষ্কের দিকে একবার তুমি চেয়ে বলো
আছে স্বপ্নধোয়া নদী, তার ধ্রীয়মান জলাধারে
কদলী- তরুর ছায়া, তাদের ঘাটের জবামালা
নেশা- স্বপ্নের মতন এই অনিবার্য অবস্থিতি।
বিস্তৃত এ স্বপ্নরেখা অসম্ভব যুদ্ধের কিনারে
হয়ে গেছে কাল কালে, তুমি যে যুদ্ধের যুদ্ধ বলো।
অপূর্ব খণ্ডিত খণ্ডে তোমাকে নিয়েছে কোনো ভুলে
শ্রাদ্ধের ভোজনে কোনো, যাকে ভাবো পবিত্র, পাকাল্যা।
আমাকে হবে যে জানতে যুদ্ধ হয়েছে কালে কালে
অর্জুন অথবা ভীম, অথবা কে তুমি, তুমি কর্ণ?
আর যুদ্ধার ভিতরে অহিংস দিগর। পিতামহী?
তুমি জয়ী হলে জয়, তবে যুদ্ধ হবে পুনর্বার
দূরীকৃত অন্ধকারে ময়দানের প্রাকৃত জ্যোস্নায়
যদি হয়, জয়দ্রোহী জয় প্রভৃতি পরাজিতের।