কবি অসীম কুমার দাসের কবিতার পঙক্তিমালা খুউব বিক্ষিপ্ত ভাবনা থেকে উঠে এলেও অত্যন্ত গোছালো ও গভীর। তাঁর কবিতা মূলত আত্মার গান। এই যে বেদনা কিংবা বিষাদের যে ক্ষরণ তা অনায়াসেই তীক্ষ্ণ তীর হয়ে অনুভূতিতে ছুঁড়ে দেবার মতন। কবি অসীম কুমার দাস বহুল পঠিত না হলেও আশির দশকের এক গুরুত্বপূর্ণ কবি। অসীম কুমার দাসের একমাত্র প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ “ঝঞ্ঝা ও পুনরুত্থান” ১৯৯২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে শ্রী নারায়ণ চন্দ্র দাস কতৃক রাজশাহী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। কবির নিভৃত জীবন এবং কবিতা প্রকাশের ক্ষেত্রে এই যে নীরবতা পাঠক হৃদয় তেমন একটা জয় করে নিতে পারেনি বলে আমাদের ধারণা। তো আমরা ” কিংবদন্তি ” র পক্ষ থেকে মনে করি, সময় তাঁর কথা বলবে একদিন।
ব্রেইল
মৃত্যু নিভে গেলে
আলো-তুষারের মতো সাদা
স্বপ্ন ভেঙে গেলে
হলুদ নিয়ন
বিলুপ্ত রঙের দেশে যায়
এলম-গাছ বলেছিলো যাবে
পাতা ঝরে গেছে
পাহাড় আড়াল ক’রে আছে
সমুদ্র-ঝড়ের শেষে
তোমার অস্পষ্ট মুখ
কুয়াশার জ্যামিতিকে পায়
গভীর অরব রাত্রি
নেমে আসে গ্লাসের কোণায়
সুরার অমৃত-জল কালো
ইন্দ্রনীল আদিম জ্যোৎস্নায়
সেতো প্যাপিরাস-ব্রেইল
ছুঁয়ে দেখো ধ্বংসস্তূপ
পোড়া হাড়
চেতনার কাদা
হারানো কোরাস ভেঙে
একা-
কোদাল ঝিমিয়ে পড়ে
পায়ের স্নায়ুর থেকে নির্বাসিত
রক্তের পাখিরা
মৃত্যু নয়
আলোহীন বরফের গ্রাসে।
বেলাডোনা সমুদ্রের পারে
দেখা হবে-
বেলাডোনা সমুদ্রের পারে,
হাজার হাজার নীল বাতাসের
বিভ্রান্ত ডানায়
দিশাহারা যখন আকাশ।
ফসফরাস-চূর্ণ তমসায়
তারা হবে লুপ্ত রাত্রি
হাঙরের অবলুপ্ত দাঁতে;
অগনন সূর্যহননের পরে
দানবেরা যখন ঘুমের
তেপান্তরে
বিরাট রাত্রির নীচে কেবলই ঘুমের,
দেখা হবে তখন আবার
বেলাডোনা সমুদ্রের পারে।
স্তব্দতার সাথে আরো স্কব্ধতার
ক্রুশবিদ্ধ ঝড়ে
যখন বিদ্যুৎরেখা
দিগন্তে মিলায়
নিরাকার দিগন্তের যৌবরক্তে
পরাচেতনায়
যেখানে দেবতা নেই
প্রাঞ্জল ধ্বংসের প্রান্তে উৎপাটিত
লবনাক্ত স্মৃতি
অন্ধকার-গ্রাসিত পাহাড়
বেলাডোনা সমুদ্রের পারে।
লুপ্তি
তোমাকে দেখিনা আর
আলোকিত আকাশের পথে
তুমি চলে গেছো কবে
অন্ধকার সূর্য-ভাঙা রথে
ভোর নেমে আসে মাঠে
সবুজ পাতায় আর ঘাসে
ভোর নেমে আসে রক্তে
পাখির গানের কলহাসে;
অথচ আসেনা আর
উষার আলোয় রাঙা প্রাতে-
তোমার আঁধার-ভাঙা মুখ
তোমার আকাশ-ভাঙা স্মৃতি
এখন স্মৃতির পারে স্মৃতি
স্তব্ধতার মতো কোনো গান
স্তব্ধতার মতো অবসান।
ভালোবাসা সেই লুপ্ত রাত্রি মায়া
তুমি সরে যাও
ফেরিঘাটে যেন আলো
তারপরে শুধু
খঞ্জ আকাশে কালো।
তুমি ছিলে সুরে
আলো বছরের দূরে
রক্ত আঁধার নিয়তির পরিহাসে
এখনো তোমার চুম্বন ফিরে আসে
রক্তের মাঝে বিদ্যুৎ আর জ্বালা।
প্রতিটি সকাল অন্ধ সূর্যে নাচে
রিক্ত রাত্রি তোমাকেই শুধু যাচে
এখন আমার চেতনায় কালোছায়া
ভালোবাসা সেই লুপ্ত রাত্রি মায়া।
অযোনিসম্ভবা রাত্রি
রূপ ফিরে গেল স্বপ্নে
স্বপ্ন ফিরে গেল কুয়াশায়,
তারপরে
নীলাকাশও নাই।
অযোনিসম্ভবা রাত্রি
চেয়ে থাকে
লুপ্ত তারকায়।
ভষ্মীভূত জিহবা
শেষ হলো শঙ্খধ্বনি
শেষ হলো রুদ্র বীঠোফেন,
ভুলে গেছে
ভষ্মীভূত জিহবা
তোমার যোনির স্বেদ
লবণাক্ত
বন্য রাত্রি – ধোয়া
দানবী আশ্লেষ – ঋদ্ধ
পৃথিবীর শেষ নদী,
করস্পর্শ
চূড়ান্ত চুম্বন।
হিমযুগ উদাসীনতায়
নেমে এলে
হিমযুগ উদাসীনতায়,
বরফের ঝর্ণা আর দ্যুতি
অলৌকিক পাখির নিভৃতি।
দেবতারা যখন ঘুমায়
ব্রোমাইড – বিধ্বস্ত শিরায়
দেবতারা এখন ঘুমায়,
জলোচ্ছ্বাসে
প্রলয়সন্ধ্যার,
নক্ষত্র- খচিত মহাকাশ
নিমজ্জিত
চূর্ণ তমাসায়;
অথচ আমার চোখে আলো
তোমার চোখেই আলো পায়।
লোকান্তরে
সূর্য – সীমানায়
যেখানে আকাশ নেই
বাতাসের গান শুধু নেতি,
অনন্তনাগের বিছানায়
শুয়ে আছে নারায়ণ
সমাধিবিলীন
নীলাস্থুরাশির চেতনায়।
হৃদয়ের রক্ত জানে
চোখ যদি লুপ্ত হয়
হোক
স্মৃতি তো হবে না,
হৃদয়ের রক্ত জানে
উড়ে- যাওয়া
পাখির ঠিকানা।
রক্তাক্ত সূর্যের পরপারে
তোমাকে চুম্বন করি
রক্তাক্ত সূর্যের পরপারে,
যেখানে দিগন্ত রেখা নেই।
কালো বাতাসের শব্দে
ঢেউ জাগে
অজানা নদীর।
গন্ধহীন স্বপ্নহীন
অধ্বনিন পরাজিত রাতে
তোমার চুলের কালো প্রাতে,
অসমাপ্ত গল্পের মতন
আঁধার অপরিমেয় শব্দের পতন
অনুচ্চার্য স্তম্ভের হৃদয়।
জ্যোতিষ্কলোকের বহু নিচে
স্তব্দতার মতো এক বিচূর্ণ কঙ্কাল
রক্তের পেছনে ধাবমান।
যেখানে দিগন্তরেখা
পরিচিত নদী,
নিয়ন আলোর নিচে তোমার ক্রন্দন,
একে একে গ্রাস করে
শব্দহীন কৃষ্ণ যবনিকা।