শোয়েব শাদাব আশির দশকের কিংবদন্তি কবি ছিলেন। এবং তরুনেরা তাঁর কবিতা পছন্দ করতো, প্রভাবিত হতো। এখান সেখান থেকে সংগ্রহ করে পড়তো তাঁর কবিতা। একসময় আশির ছোট কাগজ আন্দোলনের সাথে সক্রিয় ছিলেন। বলা যায় তিনজনের একজন ছিলেন। আশির কবিতায় নতুন স্বরের সন্ধান যারা করেছিলেন তাদের মধ্যে শোয়েব শাদাব অন্যতম। শোয়েব শাদাবের কবিতা মানুষকে নিয়ে যায় শেকড় ও প্রাগৈতিহাসিকতার দিকে। যদি বলি শোয়েব শাদাবের কবিতা নির্মেদ অথচ অবিরত শব্দের খেলায় টলে যেন মাটি, নৃতত্ত্ব, সভ্যতা ও প্রস্তরযুগ নিয়ে। তখন কবিতা এগিয়ে আসে কুয়াশার মতন আবার ডুবে যায় সাগরতীরের সূর্যাস্তের মতন। কেবল কবির হাত থেকে খসে পড়ে সেই ক্ষুধার বল্লম। সত্যি বলতে কবি শোয়েব শাদাব “অশেষ প্রস্তর যুগের” যে ছবি এঁকেছিলেন, সেই আঁকার ভেতর এখনো তিনি জীবন নিয়ে বসে আছেন।
পুনর্জন্ম
পাতার আড়ালে গিয়ে চুপচাপ থাকবো ঘুমিয়ে
একটি মৃত্যুর পরে জমে হিম করুণ বরফ
অসীম অমর তুমি শূন্যতায় সারাটি দুপুর
পৃথিবীতে কেঁদে কেঁদে জলে জলে জাগাবে জীবন
নদী কি ঝরনার মতো গলে- গলে
পর্বতের স্তন বেয়ে চিরে – চিরে জন্মের নাভিতে আমি।
বোধ
অন্তশীল ঘুণপোকা কুচি কুচি জলছবি
বীভৎস আদিম রাত দীপহীন জংলী
দৃশ্যাতীত হাত
বলবান
ডানাঅলা
অনাদি একক বোধ একাকার ত্রিজগৎ
অন্তহীন প্রেক্ষাপট অবিভাজ্য পরিত্রাণ
আত্মা
ডানাঅলা
কাঠের ঘোড়া
ঘোড়াটি হঠাৎ তাকালো পেছনে
দুটি চোখ তার আগুনের থালা
এবং বড়োই রহস্যময়
ঘোড়াটি অমন তাকালো কেন মধ্যপথে?
হৃদয়দুহিতা লীন হয়ে আছে মৃত্তিকাতলে
দূর পাহাড়ের প্রাচীন গুহায় কররেখা – প্রতিলিপি
বাম পাঁজরের শূন্যতা শুধু বিদ্যুৎরেখা জ্বালে।
বোধিবৃক্ষের ফল খেয়ে হলে স্বর্গ – তাড়িত
বাস্তব বনে হাঁটতে গেলেই
পায়ে এসে লাগে সাপের ছোবল
আনন্দে তাই ছুটছি কেবল ঘোড়ার পিঠেই?
জ্বলছে সূর্য একের গর্ভে অন্যের প্রাণ।
হঠাৎ কি কোনো ক্রদ্ধ দেবতা আমবে নেমে
পরাবে কাফন ঝরাবে রক্ত নষ্ট চাঁদ
ঘোড়া কি পেয়েছে টের?
হেডিসের তীরে সূর্য ডোবে
দেখি সে তো এক কাঠের ঘোড়া।
প্রেম
কাটলে বাড়ে, না হলে বাড়ে না
নিদিষ্ট সীমায় থেমে থেমে
পাথরে গজিয়ে ওঠা এই চুল
সমুদ্র ভ্রমণের আগে
পরিণতি ম্যাপ দেখে নিও
সৌন্দর্যে নুন বড়োই ঐতিহ্যিক
বরং সিংহের দেশে যাও
কেশরে বুলালে হাত হিংস্রতা হারাবে
সংস্কার কালো অরণ্যের
কিন্তু সে
শব্দকে পেতে চায় মূর্ত
তৃষ্ণা নয়, গেলাশে হলুদ সূর্য
ও দাফনি
তোমার ডানার নিচে
হাইড্রা ঘুমায়।
স্বগতোক্তি
নষ্ট দ্রাঘিমায় এসে গেছি হে দেবদূত!
অস্থিতে মজ্জায় হিম জমে গেছে অজস্র কদর্ম
কী করতে কী করতে ফেলি বুঝি না পূর্বাপর
কেঁচো খুঁড়ে অজগর!
বুকের ভিতর যেন অহরহ টমটমের শব্দ
শুনতে পাই।
প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকূপে পড়ে থাকি
বিকল জন্তুর মতো পঙ্গুতায়- আর
স্তব্ধ পরাধীনতায়।
ছায়াকে কায়াকে যুগপৎ করে তুলি শত্রু
পারি না এড়াতে অলৌকিক রাক্ষস – সন্দেহ
রক্তের গভীরে যেন ঘাই মারে বিষধর শিং।
ঊরুর আগুনে চেপে যৌবন বল্লম
কেঁপে উঠি মধ্যরাতে-
স্বপ্নের ডানার মতো নেমে আসে সংখ্যাহীন সিল্কের বালিশ
হাতের কলম দঁড়ি ছিঁড়ে
সাপ হয়ে যায়
সাপ, ময়ূর।
অতঃপর,
ফুলের কঙ্কাল থেকে নিঃসৃত সৌরভ
তরল মৃত্যুকে পান করে
বিষাদে বিনাশে হই পূর্ণাঙ্গ পুরুষ।
ভিত
অন্ধকার ছিঁড়েখুঁড়ে আলোক আসে
বিজলির হাসি।
মনে হয় কারা যেন খুলছে জানালা
বৃষ্টির ভয়াবহ রাতে।
শিল্পীর তুলি বন্যায় ভেসে গেছে।
কঙ্কালের রূপটুকু ধরে রাখে
তমসায় ডুবে থাকা মুখ,
স্মৃতি যার দাঁড়াবার ভিত।
আর যদি দাঁড়িয়েই গেলো সেই কঙ্কাল
অন্ধকার ছিঁড়েখুঁড়ে আলোকস্তম্ভ
স্মৃতি তার চলবার ভিত।
তার পর, ভুল হলে
জ্যোত্স্নায় ডুবে গেলে কালো রূপসী
স্মৃতি তার আঁকবার ভিত?
প্রজাপতি
প্রজাপতি বসো তুমি শিল্পীর তুলিতে
আর কী ভাবো?
আঁকা হোক একখানা ছবি?
শিল্পী প্রেমিক নয়
তার চোখে ফুটে ওঠে দূরের ছবি
মূর্তির দেশ।
তখন গভীর রাত
সিংহ পেরিয়ে আসে প্রস্তর দেয়াল
মনে হয় ভেঙে যাবে রক্তের বাঁধ, অশ্রান্ত বৃষ্টিতে
ফিরে যদি এলে, প্রজাপতি
ডানা দুটি রেখে এলে কোন নীলিমায়?
কাকে দিলে রঙ?
শ্রাবণ গভীর রাত নীরবে পোহায়
শিশির লুকায় ঘাসে
পড়ে থাকে শিল্পীর রঙহীন তুলি।
রঙতুলি
শ্রাবণের বৃষ্টিতে তার সঙ্গে দেখা
স্তম্ভিত শিলার পাদদেশে।
তার পর, অনেক কুয়াশা ভেঙে নীল রাস্তা
এবং রাস্তার শেষে বিস্তৃত সমুদ্র, আরো নীল।
কিন্তু তুমি
আকাশের নিঃসীম শূন্যতা থেকে
বিচিত্র রঙ এনে দিয়ে গ্যাছো
আমাদের পালকের স্পন্দিত তুলিতে
আমাদের রক্তের শিখায়।
যাতে কখনোই আঁকা যাবে না
একটি উজ্জ্বল ময়ূরের ছবি।
কিংবা বাতাসে অদৃশ্য শব্দের ছবি
জন্মান্তর
শিকার সমাপ্ত হলে
হাড় ভেঙে মজ্জা খাওয়ার ধুম।
স্পন্দমান আদি সরীসৃপ
রক্তের অবিদিত টোটেম – বিস্ময়ে
খোলস খসায়
নারী – সূর্যের ডিমের ভেতর।
একদিন
বিচূর্ণ হাড় থেকে কিউপিড জাগে
শত শত ব্রোঞ্জের পাখায়
পৃথিবী ঢাকে।
মন যদি মৃত্তিকা চেনে
যে বৃক্ষের নীচে প্রতিদিন বসি
আমি তাকে কখনো দেখি না
তার ছায়ায় অন্যকে দেখি।
হলুদ কঠিন রাতে সিংহ যখন
দেয়াল ডিঙিয়ে আসে
নীল নীলিমা রক্তের পাতালে হারায়
এলোমেলো হয়ে যায় হাওয়ার কাশবন
বৃষ্টি পড়ে সহস্র নদীতে।
আর ঘুঘুপাখি
যে উঁচু পর্বতে পেতেছে আসন
কোন এক ঝরনার ডাকে
আমি সেই স্রোতস্বীর তরল আঁধার
শব্দের বাঁধ ভেঙে দু’ চোখে ঠেকাই।
মন যদি মৃত্তিকা চেনে
শূন্যে ভাসে উড়ন্ত রেলপথ
বৃক্ষের ছায়াগুলি পাতালে চলে।