কবি আহমেদ মুজিব বিচিত্র থিম নিয়ে কবিতা লিখতেন। লিখতেন লিটল ম্যাগাজিনের পাশাপাশি দৈনিক পত্রিকাতেও। ‘প্রেসের কবিতা’ নামে তাঁর একটা বই আছে। আজকে আমরা “কিংবদন্তি” যে দশটি কবিতা বেছে নিয়েছি তার অধিকাংশই “প্রেসের কবিতা” র বই থেকে। বাংলা ভাষায় প্রেস উপজীব্য করে হয়তো কবিতা রচিত হয়েছে কিন্তু এ বিষয়ে পুরো একটা বই কখনো লিখা হয়নি, এটাই প্রথম। আমাদের কাছে মনে হয়েছে এই কবির কল্পনার ধরণটি একেবারেই ভিন্ন। কবি আহমেদ মুজিবের কবিতা পড়লে বুঝা যেতে পারে, ভেতরে ভেতরে তিনি কতটা সুন্দরের ছোঁয়া নিতেন। লক্ষ্য করে দেখেন দুইটি লাইন-
“মরা ডাল থেকে শাদা বাল্ব-ফুল আলো ছুড়ে দেয়”
“প্রজাপতি তুমি উড়ন্ত ইজেল”
এরকম অসংখ্য দৃষ্টান্ত কবিতায় তিনি স্থাপন করেছেন। কবি আহমেদ মুজিব ২০১৩ সালের ৩ জানুয়ারি ইতালিতে মারা যান। তখন তাঁর বয়স ছিলো মাত্র ৪৮ বছর।
ক্ষমা
বারবার তোমাকে ক্ষমা করি আমি।
যদি কালো পাথরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতাম
তাহলে সে ছুটতো ঝর্ণার মতো শাদা কণ্ঠস্বরে।
যদি কুকুরকে ছুঁয়ে দিত আমার দু’হাত
তাহলে সে হতো মানুষের ছোটো ভাই।
ক্ষমা করার জন্য আকাশের দিকে তাকালে
মুক্তি পেত খুচরা পয়সার মতো ঝমঝমে তারা;
প্যারেক থেকে প্যাঁচ খুলে মশারির চিকন দড়ি কালসাপ হয়ে
ফিরে যেত মায়েরই কোলে।
বারবার ক্ষমা করি আমি তোমাকে, বার-বার।
মহেশ
আহ, মহেশের চামড়ার ওপরে কী চিরস্থায়ী আঁধার!
পশ্চাৎপদের ভিতর থেকে বেরুনো যে-লেজ সে-ও তৈরি লম্বা অন্ধকারে।
রাতের আকাশে দুটি তারা যেন মহেশের খোলা চোখ,
হঠাৎ উড়ে গেল তাকে ফেলে,
গাবতলী থেকে আসা বিশ্বরোডে
একটি ট্রাকের দু’টি হেডলাইট জ্বলজ্বল করে,
মনে হয় ঐ মহেশের হারানো দু’টি চোখে,
দু’ফোঁটা জল চোখ মেলে তাকিয়েছে বিশাল আকাশে।
প্রেসের কবিতা
প্রেসের মধ্যদিয়ে সময় ঐ যায়, সময়।
রাত তুমি যাও?
আহা, কী সুন্দর হাওয়া
টেবিলের মধ্যখান দিয়ে যায়
আর আমার চুল ছোঁয়
আর আমার কান্না ছোঁয়।
কয়েকটি কান্না যায় গড়িয়ে, ঐ।
কোথায়?
দিনগুলো কোথায় যাও? প্রেসে?
শাদা আমাকে নাও না।
রঙ, প্রেসে যাও?
কাগজ, কালো ক্যালেন্ডার, টাকা তুমি,
পাইপের জল, আর ঐ তিতাসের চাপ
কই যাও, কোথায়,
কোন প্রেসে?
শুধু আমাকে নাও না,
ও বিদ্যুৎ
ও নতুন মিটার
শুধু আমাকে নাও না।
লোহার বড়ুইগাছ
স্বর্ণলতা উঠে এলো বুড়ো মেশিনের ঘাড়ে।
আহা, চারিদিকে শাদা ভোর, রোদের হলুদ ফোঁটা;
বাইলেনের কাঁটা বড়ুই ঘষছে হাহাকারে
হিম চোখে কুয়াশা – কেতুর, একটি বছর মোটা।
পরিত্যক্ত মেশিনঘরে দুলছে কানা জানালা
চালক নেই কোথাও কোনো, ছাপার ধাতব শব্দ-
পুরনো ঘামের গন্ধ ঠাসা নীল মাকড়ের লালা
আহা, ভিতর – ঘরে অম্ল- বায়ূ, ভারি এবং জব্দ।
ও রসালো স্বর্ণলতা, পেলে কি- না গরম চাকার আঁচ
আরো দূরে, খুঁটিয়ে দেখলে, লোহার বড়ুইগাছ।
মুদ্রাক্ষর
এটা মুদ্রাক্ষরদের ঘর।
মুদ্রাক্ষর বাঁধবার ঘরও এটা।
মুদ্রাক্ষরদের যৌথ ভালোবাসা থাকে।
মুদ্রাক্ষরদের যৌথ ভালোবাসা থাকেই।
এখন মুদ্রাক্ষররা গভীর আগ্রহে আছে,
নিবিড় গ্যালির পর
মেশিনে দেহ নিয়ে জ্যান্ত হতে চায়।
দেখো, অক্ষর- মানুষ আজ অক্ষর বসাচ্ছে।
২৩. ৩. ৯১
তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে,
এই প্রেসের ভিতর, আর এই ক্ষুদ্র চাকার মহান ছোট্রো দাগে
লোহায় তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে।
ধাতব শব্দ সুদূরে পায় মানা, তবু
আমি থামি না;
কঠোর ওহে হলুদ কাঠ শোনো,
ছোট্রো ঘুণের নিঃশ্বাসে আজ
তোমাকে কেন দেখতে ইচ্ছে হয়?
ক্ষুদে ও কালো
নীরব আর গভীরতর কিংবা
বধির আর প্রতিবন্ধিই এক ছোট্রো করেট, এখন হলো ব্যথাময়।
তার পাশে বসে আছি ঘন প্রিয়তমা আমি-
তাকে নয়, থেকে – থেকে তোমাকেই খুব দেখতে ইচ্ছে হয়।
তুমি এসেছো প্রেসে
রুল – শিরিশের লোক যে – ভাবে আসে
আর হরফ গলানোর লোক;
দুটোর সাথেই মুদ্রা জড়িত
তুমি ভালোবাসার।
তুমি এসেছো প্রেসে
আমাকে ফেরত নিতেই,
আমার তবু
তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে।
পরিত্যক্ত বস্তুদের না- যেতে চাওয়া
চ্যাপ্টা করেট, পাইকা আর ঐ হলুদ ঝুড়িটা
যদিও বাতিল তবু যেতে চায়নি প্রেসের বাইরে
কেউ কাউকে ছাড়ে গতানুগতিক।
এই শীত অনেক ভালো,
ভালো একেবারে কাউকে না পাওয়া।
ভাবলো মাকড়ের জাল আর কিছু লালা
মাটি ছুঁয়ে দু’টি বাল্ব।
পোকা
চারটি নিবিড় পোকাকে দেখি, আর তাদের জীবন;
হালকা অথচ কত দামি তারা তাদেরই শক্ত ভিতরে।
ঘুণ খেয়ে যায় কাঠ আমৃত্যু,
ও সবুজ ময়দা তুমি তেলাপোকার
প্রতিরাত পায় টের এইসব
যখন ঠাণ্ডা আর কালো,
আর পিঁপড়ে আর উঁই বাড়ায় আবাস ধীরে
বইয়ের ভিতরে
নতুন লালায় যতো।
বাঁধাই করা বই উঁইয়ের সুদিন
বাঁধাইকারের আঙুল তেলাপোকার দেওভোগ
আর নতুন কাঠের কেসে ঘুণপোকার হল্লা
আর সব পিঁপড়ের।
সরসর সরে যায় ঠাণ্ডা হাওয়া রাতের ওপর দিয়ে
জ্বলে তারা থোকাথোকা যদি বাতি নিভে যায় একসাথে।
তখন প্রেসে, ও পোকার দল
তোমরা কি ভাবো–
একটি লোহার মেশিন কত হালকা
যদি বন্ধ থাকে ছাপায়।
বোল্ড ক. আর র.
কালিঝুলি মাখা কবিতা সাজাই,
তোমাকে পাই না কেন?
তাই এমন দিনে বোল্ড ক.-এর পর তিন এম দিই।
এমন দিনে তাইলে বোল্ড র. এর আগে তিন এম।
গণ্ডগোলে বুক কী যে,
তলপেটের আর্দ্রতায় সীসার ছয় এম বীজ পুঁতে
বসে থাকি আরামে,
মাটির ওপরে, পা দোলানোর কথা ভাবি;
সাফ করি নখ, ধুলো দূরে যাও।
অজানা রক্ত খাইয়ে, মাটি খুঁড়ে মূলে
খুঁড়ি হিম জলে মৃত প্রতিবিম্ব ভুলে,
একি রক্তমাখা!
ছয় এম ফাঁকা কবিতা সাজাই
এই দুর্গত হাতে,
এমন দিনে ক. আর র.
সাঁতার শিখেনি রাতে।
থাকা
ঢালো রঙ প্রকৃত মনে পাটাতনে
কালো রঙ রাত্রের খোপে;
শাদা হলো দিন
আর লাল আমারই রক্ত
সুঁচ দিয়ে গাঁথা বই।
সবুজ একটি বড়ো টিয়েপাখি নির্জন
একাকী গাছ কিংবা কমলা সুপারির সাথে
থাকে ও থাকে
সুমুদ্রিত রাতে।