“এই জীবনে আমি শশী হক, সে তো এক বহু-মানুষ, মাঝে মাঝে গ্রন্থনের সূতাটাও হয় উধাও।” এই হইলো শশী হক, আর তার পূর্ণতা। শশী হকের কবিতা সাবলীল কিন্তু বহুরূপী। দৃষ্টিভঙ্গি যেন অসংখ্য বাস্তবতার। তার কবিতা একপ্রকার ভাষার ম্যাজিক। যেমন ধরি “ঠিক কতটা অন্ধকার হলে ভাল লাগতে পারে আতশবাজি।” কবিতার সাথে শশী হকের সম্পর্কটা কতনা সুগভীর, যেখানে আছে নিজস্ব যাপন। তাইতো সকল বৃত্তের বাহিরে এসে তিনি দৃশ্যায়ন করতে পারেন কত কত ঘটনার। আমার কাছে মনে হয় বিচিত্র সম্ভবনার কারণেই হয়তো তিনি সাহিত্য জগতের এই বহমান স্রোত থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেন। এই আড়াল কী তিনি সচেতনভাবেই পুষেন? আমার খুউব জানতে মন চায়- এই যে সমসাময়িক কবিদের চেয়ে কিছুটা আলাদা থেকে যাপনের ভেতর অতন্ত্য বোধ দিয়ে যে কবিতার শরীর তিনি নির্মান করেন তা কি তারই উজ্জ্বীবিত রূপ। এখানে তার কবিতায় শব্দবন্দির চেয়ে সরল বিষয়ের প্রভাব হয়তো তারই প্রকৃত উদাহারণ।
লাল কবরের কবিতা
কোন সঙ্গত খোয়াব নাই।
ও পাবনি, তুমি শুধু পুস্পনেশা বা হাওয়া-তাস হয়ে
শীতের প্রতিশ্রুতি।
আমাদের সংগ্রাম চলবে চলবে’ জাতীয় জিগির পারা
কিছু পালিত পতাকার গান।
অপাংতেয় কবি আমি, ফেরারি,
রাতের পর রাত করছি তালাশ, কারে দিব ভার?
গোলাপ সাধুর চিৎকার বাজে দ্রিম বাজে দ্রিম
মাটি টাকা, টাকা মাটি …
ও পাবনি, লাল কবরের এ কবিতা আমি কারে দিব?
তুমি আজ কবরের শ্রুতি।
বেঁচে থাকা
বেঁচে থাকার বাসনা
পুরোনো জিন্সের মতো, আরামদায়ক।
রংচটা ফ্যাকাশে এক রাস্তার পাশে
সহ্য-ক্ষমতা ঘষাঘষির নীল আসক্তি।
আহ, বেঁচে থাকা
কী মধুর, কী যে বিরক্তি !
গৃহকাম, ক্ষমা, আর আষাঢ়ের মত
শুধু মুছে মুছে চলা …
কিংবা, ছাতা হাতে বাসে লাফিয়ে ওঠা ঐ বৃদ্ধ বাবাটা …
আয়না-বন
কান্নার শেষ হয়তো দেখে ফেলেছে সে।
এ এক এমন সীমা, যখন দলিত অধিকার
তার দু’চোখ থেকে পাখির মতো ঊর্ধ্বগামী।
কান্নায় কান্নায় কুঁচকে যাওয়া মুখ থেকে
শুধু হাসি ঝরে, শুধু হাসি ঝরে অবিরাম।
কান্নার শেষ হয়ত পার হয়ে যাচ্ছে সে।
একটা উন্মাদ নদী সাঁতরে উঠে যাচ্ছে আয়না-বনে।
বাবা শব্দটা
বাবা শব্দটার খুব ধার।
প্রপঞ্চের ব্যাঞ্জনার ভিতর এই শব্দটা
ক্রমশ সার্প হতে থাকা এক ডিভাইন টাচ।
ডি-কন্সট্রাকশান।
মেটাফর। ছায়ানাচ।
একটা বাঁকা বিন্দুর ভিতর অজস্র ঘোড়ার কান্না ।
বাবা শব্দটার খুব ভার।
সামান্য আর্তি
এখন আর একদম ভাল লাগে না দেখতে
আমার অনাহার ঘিরে কোন মহাজনি আয়োজন, বাজেট,
ত্রাতার মরা-কান্না।
আমি ত ডাকি নাই কাউরে। বরং পালায়েছি, দাবি ছেড়ে দু’হাতে
পথে — লোলনাচ, নম্বর, প্রিয়মুখ।
ক্ষুধা ভালবাসা স্থবির অবকাশে
সহিষ্ণু ক্যাকটাস ছাড়া আর কারো সঙ্গ এখন আর সহে না।
মিটেছে সাধ, প্রহ্লাদ। ফুলেতে নেশা ধরে না।
অভাবই নিধি, প্যারী, বাসনা-হৃদয়।
অজ্ঞতা সাধনসঙ্গী, বন্ধন-ক্ষয়।
আমি ত বলি নাই কাউরে, মোচন কর হে, তবে কেনো আসো ?
আমার এই ভাঙ্গা ঘরে বারবার —
শুনাইতে গস্পেল, নবি কাহিনী।
জানালাটা বরং খুলি ঘাসেদের দেশে।
চড়ইগুলি উড়ুক ফুড়ুৎ ফাড়ুৎ।
তালগাছে ভুত থাক।
ভুলে যাও মুছে ফেলো ত্যাগ করো, যা-ইচ্ছা-খুশি
শুধু কাছে এসো না। আমাকে আমার ঘরে শান্তিতে খেলতে দাও।
আমার স্ত্রী গর্ভবতী।
উন্নয়ন-বাদ্য
উন্নয়ন-বাদ্যে মদনা-কালা থৈ থৈ নাচে।
বিধবারা রাঁধে ষাঁড়।
রজ: ঝরে।
কলঘরে বেশ্যাদের কলরব।
ব্যান্ডেজ বাঁধিতে আয়শা কাশবনে যায়।
ফুটিতেছে নগর। চকচক বালুচর।
আশিয়ান, আশিয়ান।
মেঘেরা ভাত খায় উনুনের পাশে।
নাচে ট্রাক মাইক ক্যাটারপিলার।
বুলডোজার ক্রুগার।
আরব্য-রজনী-বাতি।
নাচে নকশা, দন্ত জিহবা চশমা।
অনলে চলে লো জল-ঝিয়ারি।
টিপ টিপ বৃষ্টি
০১
তোমাদের আদর্শে তছনছ এক শ’ অবুঝ গ্রাম।
আমি বললাম।
আফিমের ক্রিয়ায় বন্ধু তখন উগ্র, স্বপ্ন-চুর।
চায়ে অম্লান মিশাইতে মিশাইতে
আমারে বুঝাইল দাস ক্যাপিটাল
জি.ই.মুর
আল কুরআন।
টিপ টিপ বৃষ্টি আলোর দ্বিধা।
টিপ টিপ বৃষ্টি হাওয়ার প্রশ্ন।
হরতাল ব্যারিকেড সমাবেশ সব তুচ্ছ করে
নি:সঙ্গ ক্ষোভ বারান্দার সবুজ।
অপেক্ষা: ক্যাকটাস।
তুমি অবশ্য যেতে পারো আলাদা পথে।
সিনেমা তো খোলা।
০২
ভেজা মেয়েটি এই স্থবির দুপুরের পর
তার বৃষ্টি-ঘষা নিশ্চল ছাইমুখসহ রাস্তার কারুকাজ।
শূন্য ভাগশেষ।
বাড়ি কি চর ফ্যাসান?
আমারে জিজ্ঞাসিল, খাবার হোটেল কত দূর।
০৩
মাসিরা কাঁদছে। শ্যালক চিল্লাইতেছে।
একটা ফর্মুলার প্রসব না এবর্শন।
টু স্কুল অব থট।
টিপ টিপ বৃষ্টি মোছে ছোপ ছোপ
দন্ত ও নখ।
সিনেমার ঘোড়ারা
সিনেমার ঘোড়ারা যাচ্ছে দুলে দুলে
বাবুদের বাজারে।
গানের গাড়ি কি আমি চাইনি কোনদিন?
তব ফুর্তির আঁচ, অই ইংলিশ গলি?
মম অবৈধ প্রণয়?
সে যেন বাজার-সূত্র ঘুড়ির খেলায় কাটে।
অনুপমে খুলে দেয় গোল্লাছুট।
মনুমেন্ট, সেন্ট বা ভার্জিন মেঘে যে আলো
আরো শাদা আরো ভয় আরো দাহ, তাহারে ভেংচায়ে
চা-স্টল, নায়িকা, কেরু-মদ
যেন বলাকার ডানা।
সে আমার কৌটা চৈচির করে হাসে।
তার শ্যামকালো দেহের গোলাপি কামিজ
ব্রীজ থেকে উড়ে উড়ে মশহুর হাউই হলে, হায় আল্লা
আমি যে সুবাসে মরি।
সে আমার অহংকার কেশফিতা করে।
আনন্দরস বহিছে।
মন্টু কুত্তা রে তুই চালা, তোর ল্যাংটা গাড়ি চালা।
কিছুক্ষন জ্ঞানচক্ষু আন্ধা মাইরা রাখি।
শিশ্নের বেদনা চুবাই।
কিংবা রুদ্ধ হ্রেষা, অই ব্যার্থ ছায়ালাফ।
সিনেমার ঘোড়ারা যাচ্ছে ঢুকে মগজে।
বাজনা বাজায়ে বাজায়ে।
চিৎকার
আমাদের আশকোনা প্রাইমারি স্কুলে সত্য পড়ানো হয়।
সত্য কাহাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী।
সত্য মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয় কর।
সুর করে শেখানো হয় সুবচন।
দুই একে দুই, দুই দুগুনে চার
সবই আল্লার।
সদা সত্য কথা বলিবে।
শিক্ষকেরা সাক্ষাৎ ফাদার ডেয়ারি
ননি ছাড়া। হেডমাস্টার চিরকুমার।
আমাদের আশকোনা প্রাইমারি স্কুলে কোন খেলাধুলা নাই।
কিন্তু আমি তারে তখনই শুধু স্কুল বলি
সত্য মানি, আমাতে পাই, যখন বাজে ঘন্টা, ছুটির ঘন্টা।
আমার ঘর থেকেও শোনা যায় যার দূর চিৎকার।
রহমত
আষাঢ় আসলেই আমার সেক্স উঠে যায়।
জংলা গাছের মত ব্যাঙের মত মেঘের মত
দেহে ভাব বসে যায়।
কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে
এই মানব জনম কখনই শেখে নাই
কোথায় কার কাছে গিয়া কী করে খরচ করে এই ধন।
সমস্ত রহমত মাঠে মারা যায়।