এই কবির কবিতা ও আধুনিকতা পরষ্পর প্রবিষ্ট। তাঁর ব্যক্তিগত অনুভব শেষ পর্যন্ত আর ব্যক্তিগত থাকে না, তা হয়ে ওঠে অনেকের। কবি সরকার মাসুদ কবিতার অনুভূতির বিষয়কে রূপ দেয়ার সময় আবেগকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখেন। খুউব পছন্দ করেন যে কোন ভ্রমণের মুখোমুখি বসে থাকতে, জানিনা এর জন্যে ভেতরে ভেতরে কতটা বিরহ পুষেন কবি। কতটা নীরবে সহেন, “ঝিনুক যেমন নীরবে সহে”। আমার দেখায় যা মনে হয়েছে কবিতা কিংবা গদ্যে তিনি একনিষ্ঠ কর্মী। এই একনিষ্ঠতার ছাপ তাঁর সব ধরনের লেখায় দৃশ্যমান। আশির কবিতায় সরকার মাসুদ জীবনানুভবের যে নিশান টানিয়ে রেখেছেন, তা আজও পত্ পত্ করে উড়ছে বাংলা সাহিত্যের পরিমণ্ডলে। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন এই কবি যেন দিগন্তরেখার এক পরিচিত নদী। তাতে আছে তাঁর নিজস্ব ভাষার সাঁতার।
জেলি মাছ
জেলি মাছ! নিয়ে যাবো শহরের বসতবাড়িতে
গদি হবে দোকানে, ড্রয়িঙরুমে;
তার চোখ কোথায়, মুখ কোথায়!
আমার বিস্ময় উপচে পড়ে সমুদ্রফেনা।
কেমন তার সঙসার? কীভাবে ঘুমায়?
সে কীভাবে বাজারে যায়, রাস্তার ভিড়ে?
শ্যাওলার ফাঁকে ফাঁকে মনোহর ছবি
মৎসকন্যারা দোকান সাজিয়ে বসে আছে!
রহস্যমধুর নীল পানি, ওই অতল প্রদেশ
এখন স্রোতের টানে সৈকতে পড়ে আছে,
জেলি মাছ —- বালুতে জীবন নিঃসাড়।
সমুদ্রগর্জন , পাহাড়ের ডাক
দুপুরের খর সূর্য —- কে তাকে জাগাবে ?
নাশতার প্লেটে রুটি আর জেলিকেক
খন্ড খন্ড করে কাটা জেলি মাছ
মানুষের কাঁটাচামচে লেগে আছে সমুদ্রশ্যাওলা
সরবতে নুন, জেলি মাছ যদি জানতো!
আহ্! চিন্তা আর ঘুমাতে দেবে না!
বিস্ময় উপচে পড়ে সমুদ্রফেনা
সারা মনে, শরীরে, বালিশে, বিছানায়!
দৃশ্যজিজ্ঞাসা
সেই কবে গা-পুড়ে-যাওয়া জ্বরের রাতের স্বপ্নে
দাঁড়িয়ে ছিল একটা টকটকে লাল শিমুল গাছ
তাকে আবার বাস্তবেও দেখি
কে জানে কোন দিন অপার্থিব জোছনায়
গাছপালা ফুড়ে উঠেছিল উচ্চাশার মিনার
তার কথা লিখি আজ! মাঝে মাঝে ভাবি
স্বার্থচিন্তায়, শোকে, বর্ষা ও বসন্তের সমস্যায়
মানবহৃদয় আরও শামুকস্বভাবী —-
নিজের তৈরি খোলের ভেতর ঢুকে যায়!
তা যাক; মানুষের মন জানি আকাশের রঙ
তাই বাসের জানালা থেকে কৃষনোচূড়ার ছাতা ,
মন ভালোবাসে চৈতি হাওয়া, রেলব্রিজের ছবি
তাই প্রশ্ন ওঠে, যে হলুদ পাখির লাশ
পড়ে ছিল সিগন্যালে ঐদিকে আজও কী ফুল
ফুটে ঝুঁকে আছে রেললাইনের ওপর, পলাশ?
কোনো কোনো দিন
যেদিন বেশি মদ খাওয়া হয়
আমি জুতা নিয়েই শুয়ে পড়ি নিঃশব্দে
জুতা পরা পা খাটের বাইরে ঝুলিয়ে
আমি শুয়ে পড়ি আলুলিত শাদা বালিশে
যেদিন অনেক বেশি মদ খাওয়া হয়
আমাদের পঞ্চাশোর্ধ মাথা আমরা
গুজে দেই বিছানার অনিশ্চয়তায়।
তারপর বাকি রাত কাটিয়ে দেই
সুরক্ষিত অন্ধকারে
পরদিন খারাপ কিছু ঘটে আমার জীবনে
আমার চুলের ভেতর দিয়ে খারাপ বাতাস বয়
যেদিন বেশি মদ খাওয়া হয়
তার পরদিনই কেন জানি না আমি
সকাল এগারোটার সেমিনারে
বাকপ্রতিমার রূপ নিয়ে কথা বলি
মেঘের ওপর দিয়ে উড়ে যেতে যেতে !
অবগাহনের সৌন্দর্যের দিকে
মাঝারি উচ্চতার গাঢ় সবুজ গাছগুলোর
পায়ের কাছে বসে আছি
বসে থাকবো গাছের কোটরের
কালো খত নিয়ে
চিরকাল থেকে যাবো
ফলবাগানের ধূলো!
গভীর বাতাসে ডুব দেবে গাছের পাতাগুলো
আর আমাকে ডাকবে ওই আশ্চর্য
অবগাহনের সৌন্দর্যের দিকে!
অবসরকল্পনা
আঁধারবন্দি পোকামাকড়ের হৃদয় আর
সবুজগ্রস্ত পাখিদের আত্মকথা ঝোলায় ভরে
আমি বেরিয়ে পড়ি নিরুদ্দেশে
কন্ঠস্বরের মেদুরতা আমাকে ভাবায়
বনতরুদের মর্মলোক , বসন্তের গহ্বর !
সকালের আলোয় দুটি মন-খারাপ ঘোড়া
অন্যমনস্কতার ভেতর ঘাস চিবায়
আমাকে চিন্তায় ফেলে দেয়
গভীর অন্ধকারে তেলাপোকার চলাফেরা
হাওয়া-লাগা শিথিল নারীচুলের হাতছানি !
অসামান্য বিকেলে খুলে যায়
ফলবাগানের রূপ। সামান্য অবসর
ঝর্ণা দেখার শান্তি এনে দেয় আমার দুচোখে !
ছবি
খোলস ছাড়ার পর একটা সাপ মরে পড়ে আছে
নদীর তীরে, পাথরখন্ডের ছায়ায়
নদীতে মূলমুলে হাওয়া
নদীতীরে শান্ত কাশবন
নদীতে দাড়ের শব্দে ভেঙে পড়ছে আশা
নদীতীরে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলেছে দু’জন লোক
তাদের মনে সন্দেহ ভরা ভালোবাসা
এদিকে পিঁপড়ার দল কাঁধে নিয়েছে
ওই সাপের খোলস
কাশবনের ছায়ায় এগোচ্ছে সাপের খোলস
আমি শুনতে পাচ্ছি পিঁপড়াবাহিনীর
হেঁইয়ো হেঁইয়ো, মারো টান হেঁইয়ো
আরো জোরে , হেঁইয়ো —–
যারা বেঁচে আছে
যারা বেঁচে আছে তারা সবুজ ঘাসের পথ
মাড়িয়ে এখানে আসে
তারা পাহাড়ের চড়াই উৎরাই পার হয়ে
উঠে যায় তীর্থমন্দিরে। পাহাড়ি
বনের পাখি মুচকি হেসে চলে যায় !
বলে যায় , কী মানে এই মরীচিকাভ্রমণের
উপত্যকার উচ্চাশী গাছের মাথা ছুঁয়ে আসা
ঠান্ডা বাতাস আবার ঘুরে চলে যাবে
ফেলে আসা পাথর অভিমুখে —-
উচ্ছাসের মুহূর্তে হঠাৎ ঢুকে পড়বে
দড়িপথ পেরোনোর সময়কার অনুভূতি ,
যারা বেঁচে আছে তারা পাথরে জমাট বাঁধা
দীর্ঘশ্বাস পড়ে নিতে আবার আসবে পানছড়ি !
কেন
কালভার্টের নিচে মাতালের অসঙলগ্ন
আলাপের মতো কৌতুকপ্রদ জলশব্দ
আমি তার পাশে বসে নাচের ঝঙকার শুনি
পৃথিবীর চিরপ্রিয়তমার হাসির সুবাস পাই
এমন ঝিরি ঝিরি হাওয়া-জল ভাববিহ্বল
সুসময়ে কেন ঢুকে পড়ে এই ছবি —-
বড় রাস্তার ওপর চ্যাপ্টা হয়ে পড়ে আছে
স্হির চোখ, ফকফকা, নিঃশব্দ খরগোশ !
ব্রেক-আপ এর কাল
এখন অবলীলায় ছেলে-মেয়েরা বলে ,
ওর সাথে আমার ব্রেক – আপ !
না , একথা বলার সময় তাদের গলা কাঁপে না
অন্যমনস্ক চোখে তারা দেখতে পায় না
কুয়াশার ছোট নদী বা রোদপোড়া ফাঁকা মাঠ
এখন ফ্রেন্ড আর গার্ল ফ্রেন্ডের মাঝখানে
ফ্রেন্ড আর বয় ফ্রেন্ডের মাঝখানে
গজিয়ে উঠেছে বড় বড় ফণীমনসা !
সন্দেহের মেঘ খুব সহজে ঢুকে পড়ছে
ছেলে-মেয়েদের ফাঁপা মাথায় মাথায় —-
এক সময় প্রেম ছিল দার্শনিক
তা ছিল বাঁচার বা আত্মহননের বীজ
তারপর প্রেম হলো আধুনিক
এরপর আমরা শুনবো , প্রেম উত্তরাধুনিক !
মাতাল হওয়ার সুবিধা
আশেপাশে গান নেই
কিন্তু তুমি ভেসে যাচ্ছো সুরেলা একটা
গানের সুবাসে। কেউ কথা বলছে না
তোমার সামনে অথবা পেছনে
কিন্তু তুমি শুনতে পাচ্ছো, অদূরে
এক দল মানুষ কথা বলছে একসাথে
অনবরত বকবক করছে গরম কেতলির মুখ
মাতাল হলে অপ্রিয় সত্য অসঙ্কোচে বলে ফেলা যায় , এমনকি তোমার প্রাণবন্ধুকেও !
মাতাল হলে বকা দিয়ে শান্তি পাওয়া যায়
কেননা যাকে বকছো সে কিছু মনে করছে না
মাতাল হলে প্রজাপতির টাল খেতে খেতে
উড়ে যাওয়ার মজা টের পাওয়া যায় !