আশির দশকের কিছু কবি ওই সময়ের নিয়মিত ধারা থেকে বের হয়ে এসে, নতুন এক ভাষার দিকে যাত্রা করেছিলেন। যা তাদের কবিতার মধ্যেই ধরা পড়ে। তো আশির সেই একজন গুরুত্বপূর্ণ দিওয়ানা কবি, অনুবাদক জুয়েল মাজহার। জীবনের দীর্ঘ একটা অংশ জুড়ে তিনি কাটিয়েছেন ভবঘুরে জীবন। কাটিয়ে দিয়েছেন পাহাড়ে একটা সময় গাছেদের ছায়া ধরে হেঁটে চলা জীবনের নানা বাঁকে। সেভাবে আর বাড়ি ফেরা হয়নি তাঁর। যিনি কিনা নিজের সময়ের বাস্তবতাকেই নির্মাণ করেছেন, কল্পনার সমস্ত রঙ, দৃশ্য আর শব্দ দিয়ে। আমাদের কাছে মনে হয়েছে তিনি উপযুক্ত ভাষার রঙে কবিতার মূল ভূমিকাটিই পালন করে গেছেন, থেকে গেছেন সংবেদনশীল। তখন আশির দশকের কবি-বন্ধুদের নিয়ে লেখা তাঁর “মম প্রিয় বন্ধুগণ” আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কবিতা, যা এখন অবধি পাঠকদের অন্য রকম নাড়া দেয়। যদিও সে সময়কার কবি-বন্ধুদের অনেক প্রেম ও গোমড় ফাঁস হয়েছে এই কবিতায়। কখনো কখনো কবিকেও করেছে অভিমানী আর একইসঙ্গে প্রীত। কবি জুয়েল মাজহারের অসংখ্য কবিতা আছে, শুধু তাঁর কবিতাগুলো নিয়ে লিখতে গেলেই তা হবে এক অসমাপ্ত রূপ। তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলা কবিতার ট্রেন্ডসেটারদের একজন। এই কবির কবিতা পড়লে বোঝা যায়, ব্যক্তিসত্তা থেকে বেরিয়ে এসে, তাঁর ভেতরে যে আরেকটা মানুষ বাস করে, সে সারাক্ষণ কী সাবলীল কথা বলে চলে তাঁরই নিজের ভাষায়।
ছাগাসুর
সে-রমণী, তাঁহাকে অল্পকাল চিনি। অশ্বেতর প্রাণীদিগের জন্য তাঁহার সে কী মায়া! প্রভাতে পুষ্পচয়নের পরিবর্তে ইহাদের জন্য শষ্প ও বিবিধ তৃণাহরণেই তাঁহার সকল মনোযোগ; হ্রেষার পরিবর্তে ইহাদের রহিয়াছে কেবল অলস-প্রহরের-গাঁড়ফাটানো রাসভনিনাদ। কাকস্য পরিবেদনার সহিত এই রাসভস্বর মিশাইয়া বারান্দায় বসিয়া বিবিধ ককটেল বানাই। গলদেশ দিয়া নহে, কর্ণকুহরে ঢালিয়া তাহা পান করি।
রমণীকে দেখিয়া কাম জাগে। এ-বিষয়ে তাঁহার প্রভূত প্রশ্রয় আঁচ করি। তবে কাহারও তরফে কোনোরূপ বাক্যবিনিময় নাই।
ঈগলচঞ্চুর ন্যায় তাঁহার বক্র নাসাখানি তিলনিন্দিত। হাকালুকি হাওরের হাঁসিনীর গ্রীবার ন্যায় তাঁহার গ্রীবা। তদুপরি তাঁহার পাউটি লিপস। তাহাতে একখানি ডাঁশা জড়ুল। আর তাঁহার বগলে ঘাম। বগল ক্ষৌরহীন দেখিয়া সঙ্গত পুলক জাগে।
আমার বারান্দার গাঢ় লাল জবাটিকে দেখিবার অছিলায় তিনি ডাগর চক্ষু তুলিয়া তাকান। সেই চক্ষে অথির বিজুলি। তিনি শ্যামাঙ্গিনী। তাঁহার কম্বুগ্রীবাটি আহ্লাদে ঈষৎ কাত। এক্ষণে জবাফুলটি আরও লাল, আরও গরিমাময় হইল। হইলে হউক ! তাহাতে আমার কি! তাঁহার হস্তধৃত তৃণাদি মাতৃহারা খচ্চরশিশুটি খাইবে, সদা ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করা বকরিদল খাইবে; খাইতে খাইতে ইহারা গুটলিময় নাদা ত্যাগ করিয়া ক্রমশ উঠান ভরিয়া তুলিবে। তাহাতেও রমণীর স্নেহ ও প্রশ্রয়।
ইহাদিগের মধ্যে একটি প্রাণিই কেবল ব্যতিক্রম। খাবারে ইহার মনোযোগ নাই। আঁচ করিলাম প্রাণিটির ইচ্ছা মদীয় ইচ্ছার নিকটতর। এই কথা কাহাকেও কদাপি বলা যাইবে না। আপনাদিগকেও নহে। কেননা লোকে আমাকে ভালো লোক বলিয়া মান্য করে। কেহ কেহ ‘কত্তা কত্তা’ বলিয়া ষাষ্টাঙ্গ প্রণামে উদ্যত। মান্য লোকদিগের অঙ্গ হষরিত হওয়া বোধ করি অনুচিত। অন্তত অস্থানে। লোকে এমত ভাবে।
সংসারে লোকের ভাবাভাবিকে মূল্য দিয়া চলিতে হয়। আমাকে এবং— যিনি বুঝিয়াও না বুঝিবার ভাণ করিয়া খোঁপা বাঁধিবার ছলে কুচযুগ আন্দোলিত করিয়া আড়চোখে আমাপানে চাহেন—— তাঁহাকেও। ইহাই রীতি। এই অতিশিষ্ট অণ্ড-শিশ্নহীন, যোনিহীন মনুষ্যজঙ্গলে এইমত বিধান। যদিও এমত বিধানে এক মুষ্ঠি ধান্য ফলিবে না।
পাঁঠাটির সেই বালাই নাই। ইহা স্বাধীন। কেননা ইহা ছাগাসুর, তদুপরি তরুণ। আর ইহার বিশেষ অঙ্গটির সে কী গরিমা, সে কী তেজ! জিভখানা বাহির করিয়া, মুখে তপ্ত ফেনা তুলিয়া, সে তাহার চর্মঘেরা লোমশ খাপ হইতে দেমোক্লিসের তরবারিসদৃশ অঙ্গটি বাহির করিল। আচমকা। আর তাহা পেন্ডুলামবৎ দুলিতে থাকিল। লাল। এবং জবাফুলেরও অধিক। সূর্যেরও অধিক। ইহার রঙ কেবল আসামদেশের কামরুপে ফলিত নাগা মরিচের রঙের সহিত তুলনীয়।
লজ্জাহেতু আমরা উভয়ে অন্য দিকে মুখ ঘোরাই। চকিতে তাঁহার, রমণীর, মুখের একপাশ দেখিলাম। মনে হইল তিনি ঈষৎ বিব্রত; তথাপি আমোদিত। ঝটিতি তিনি ফটকদরজা দিয়া ভেতরবাটীতে অন্তর্হিত। আর আমি অসীম তিতিক্ষা লইয়া ছাগাসুরের পানে তাকাই।
পাঁঠাটির প্রতি আমার গোপন ঈর্ষা হইল। এমন সময় প্রতিবেশীর ট্রেসপাসার নচ্ছার হুলোবিড়ালটি কোথা হইতে আসিয়া আমার দিকে ‘আইবল টু আইবল’ তাকাইয়া কহিল ‘ম্যাঁও’।
মেগাস্থিনিসের হাসি
নিঃশব্দ কামানে তুমি একা বসে ভরছো বারুদ
শীতকাল গেল
নিঃশব্দ কামানে তুমি একা কেন
ভরছো বারুদ?
আমি ভাবছি
মেগাস্থিনিসের হাসিও কি মেগাস্থিনিস?
শক্তিচালিত এই তামাশার মধ্যে বহু
বাদামি ঘোটক উড়ে যায়
——এঞ্জিনের শব্দ আর রোবটের কাশি শোনা যায়
নিঃশব্দ কামানে তুমি এখনো কি ভরছো বারুদ?
কিন ব্রিজ দেখবার স্মৃতি
দুই কিংবা তিন সাল আগে আমি শ্রীহট্টতে গিয়া
শ্রীহট্টরে ফিরা পাই নাই
কিনব্রিজে গিয়া দেখি কিনব্র্রিজ নাই
শুধু একটা জংধরা, জীর্ণ লাল লোহার ধনুক
সুরমা নদীর উপ্রে উপ্তা হয়া আছে
তাহার বুগলে একটা আলিশান ঘড়ি, যারে
চাবি মাইরা রাইখা গেছে আলি আমজাদ
তবে এর দীর্ঘ পেন্ডুলাম
আজ আর লড়ে না, চড়ে না…
যেন সে আসঙ্গবঞ্চিত কোনো
অভিশপ্ত মৃত দানবের
নতমুখ প্রকাণ্ড, নিঃসাড় লিঙ্গ
আইজকা তাহারে
ঘিরিয়া ঘিরিয়া শুধু
বেশুমার চামচিকা ওড়ে
দর্জিঘরে একরাত
শূন্যতা বল্লম এক, গেঁথে আছে দর্জিমহলে!
রাশি রাশি বস্ত্র ফেলে দর্জিদল গোপনে উধাও
শুধু দেয়ালের গলদেশে ঝুলে আছে
একটি পুরনো ঘড়ি— মৃত !
দশবস্ত্রে-দিগম্বর বেশ্যার ইশারা আজ মেঘেতে উত্থান
তাই, লক্ষ শিশ্ন হাতে চেপে দর্জিদল মেঘে ধাবমান
শৃঙ্গারের গোলাপি আরকে আজ প্রতিপার্শ্ব ঢাকা;
আঁধারে ঝরনার মতো বেজে ওঠে গণিকামহল
সবুজ প্রিজমে আমি চোখ রেখে সবকিছু দেখি:
দর্জিদের অনুপস্থিতির এই দীর্ঘ অবসরে
আতশি কাচের গুঁড়ো জড়ো করে চুপে
ঢেকে রাখি ফাঁকফুঁক, দর্জিঘর, ঘড়ি ও জানালা
ধুতুরাগোধূলি
এখন সকাল খুব লাল। তবু সকালের হৃদয়ে গোধূলি
আমি সদ্য বানানো নৌকার খোলের ভেতর শুয়ে; নৌকার একা-কারিগর
গাবের আঠার গন্ধে, তারপিনের গন্ধে আমার নাক ভরে আছে। একদিন ছুতোরের ছদ্মবেশে
ঢুকে পড়েছিলাম জেলেপাড়ায়। সেই থেকে তৈরি করে চলেছি নৌকা। উত্তল আর অবতল নৌকা
সমুদ্রের ছোবলে জেলেপাড়ার মরদেরা সব একে-একে চলে গেল ঢেউয়ের অতলে
এখন নৌকার মতো কাত হয়ে আছে জেলেপাড়া। সদ্যবিধবাদের সারি সারি ঝুপড়িঘর বিষণ্নতায় ঠাসা
এখানে ভোর আর বিকেলের একটাই নাম ——গোধূলি!
একা এক ঘেয়ো কুকুরের কান্নায় ভরে আছে আমার দু’কান
যে ঝুপড়িতেই আমি ঢুকতে চেয়েছি, বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রকাণ্ড এক মাকড়জাল
মাকড়েরা আমাকে না দিয়েছে একাকিত্ব ঘোচাতে
না দিয়েছে জেলেপাড়ার নম্র বিধবাদের বিষণ্নতার গাদ সরাতে
প্রতিবারই নিষেধের লাল তর্জনী
এবার রাগী বেড়ালের মতো নিজের ভেতরের মাকড়জাল ছিঁড়ে ফেলতে চাইছি আমি
হঠাৎ ফরসা হয়ে উঠছে আমার চোখ
বিধবাদের কামনাতুর দেহে জ্বলে উঠছে ফসফরাস;
সমুদ্র ঝিলকে উঠছে মাছের পেটির মতো
আমার পা টলছে ধুতুরার নেশায়। একটি একক মুহূর্তকে আমি সকাল ও গোধূলি বানিয়ে
ধরে আছি দু-হাতের মুঠোতে। এ-খেলা আমি অসংখ্য একা-আমিকে দেখাই বারবার
একটা সরু দড়ির উপর দিয়ে একা-পিঁপড়ে হয়ে হেঁটে চলেছি
ধোঁয়ায় মোড়ানো কোনো আবছায়া বাড়ির দিকে
আমার সঙ্গে নতমুখ হেঁটে চলেছে কুড়ি বছরের পেনিলোপিহীন নৈশাঘাতে বিবর্ণ এক
একা-ইউলিসিস। ছিন্নবস্ত্র ভিখিরির বেশে। শূকরপালক, ছাগপালকের অবজ্ঞার ভেতর দিয়ে
—একবার সে আমার ছায়ার ভেতর ঢুকে পড়ছে। পরক্ষণে আমি তার ছায়ার ভেতরে।
লাল সকালের ভেতর দিয়ে আমরা বয়ে নিয়ে চলেছি গোধূলি
সব বিষণ্ন লাল সকালই একা-মানুষের গোধূলি
তবু সামান্য ভাতপচানো মদ আর ধুতুরার ভেতর থেকে এবার উঁকি দিচ্ছে
সদ্যবিধবাদের স্পর্শ ও চুম্বন। ধূসরতার ভেতর রাংতার ঝিলিক
ওই তো! মরীচিকার ভেতরে পেখম তুলছে বিধবাদের ময়ূর
ওই তো! হঠাৎ হেসে উঠছে, গান গেয়ে উঠছে একা মানুষেরা
তাদের তীব্র স্বমেহনে ফেটে পড়ছে শত-শত অসহ্য কামারশালা
মাকড়জাল সরিয়ে কামনাতুর বিধবারা আমাকে ডাকছে
তারা ময়ূর ছেড়ে দিয়েছে বৃষ্টিতে …
একা-মাছ লাফিয়ে উঠছে শূন্যে
একা-মাছ ঝিলকে উঠছে শূন্যে
একা-মাছ পার হচ্ছে মরীচিকা
একা-মাছ সওয়ার হচ্ছে ঢেউয়ের ওপর
দিওয়ানা জিকির
১
আমারে পড়ব মনে, জানি তুমি, ডাকবা আমায়
খাড়া-সোজা-উপ্তা হয়া দিওয়ানা জিকিরে অবিরাম;
বাঁশের ঝিংলা দিয়া, জালিবেত-সুন্ধিবেত দিয়া
কানমলা দিয়া মোরে আর কত করবা প্রহার।
আমি এর প্রতিশোধ নিব ঠিক। খাল-বিল-নদীনালা বাইদ
পার হয়া চলে যাব একশো ক্রোশ দূরে একদিন; যেন
কনফুসিয়াসের স্বপ্নে বিভোর কোনো চীনা
সারাদিন একা একা খালেবিলে কিস্তি ভাসায়
২
ডাকবা আমারে তুমি লুকায়া লুকায়া একদিন!
যেন এক ভেকশিশু, হাইঞ্জাকালে কচুর বাগানে
ডর পায়া, চিল্লায়া, মায়েরে একলা তার ডাকে।
৩
যেমতি বাদলা দিনে পাইতা মোরে হাকালুকি হাওরে হাওরে
সাড়া তবু পাইবা না। যেন বোবা কালেঙ্গা পাহাড়
চুপ মাইরা বইসা রব; আর দেখব তোমার জিল্লতি
যতো জোরে ডাক পাড়ো কোনোদিন পাবা না আমায়
লক্ষ ক্রোশ দূরে গিয়া তোমা হতে থাকব স্বাধীন;
——খেলব, খেলার ছলে একা বসে তাস সারাদিন!
৪
আমারে খুঁজবা তুমি হবিগঞ্জে, তে-কোনা পুকুরপাড়ে
মিরাশির মাঠে আর উমেদনগরে
করবা তালাস চুপে পুরান মুন্সেফি আর বগলা বাজারে
দুই হাত উঁচা কইরা হাঁক দিবা যেন ক্যানভাসার :
চিফ রেইট, দুই টেকা, হলুদি ব্যাটাটা!
৫
বেফিকির উড়াধুড়া আমি এক ফকিন্নির পোলা
আন্ধা-কানা ঘুইরা মরি লালনীল স্মৃতির বাগানে
চান্নি-পশর রাইতে জারুলের নিচে বেশুমার,
আবালের সর্দি যেন সাদা-নীল ফুল ঝরে পড়ে
৬
মগরা নদীতে আর লাফুনিয়া-কইজুরি বিলে
তোমার নাকের মতো বেঁকা ঘোলা জলে নাও লয়া
মনভরা গোস্বা লয়া, পেটভরা ভুক লয়া আমি
অলম্ভূত কালা বাইদে ভাইসা রবো একলা স্বাধীন!
৭
যেন আমি বাচ্চা এক উদ
খিদা লাগলে উপ্তা ডুবে আচানক কালবাউস ধরে
কুশার-খেতের ভিত্রে বইসা খাব ফুর্তি লয়া মনে
৮
আসমানে লেঞ্জাহাঁস উইড়া চলে হাজারে-বিজারে
চিতলের পেটি যেন কলকলাবে সামনে ধনুগাঙ;
তার বুকে ঝাঁপ দিব, করবো আমি সেখানে সিনান
৯
আমারে না পায়া যদি নিজের জাগ্না চউখে মাখো তুমি নিদ্রাকুসুম
আমি তবে পুটকিছিলা বান্দরের মতো
বসে রবো
চুপচাপ
বদ্যিরাজ
গাছের
আগায় !!
রুবিকন
আমার সামনে এক রুবিকন, পুলসিরাত, ভয়ানক ক্রূর অমানিশা
এর সামনে একা আমি;
কিস্তিহীন, নিরশ্ব, রসদহীন
পিগমিদের চেয়ে ছোটো আমি!
আর আমার ভাঙা হাড়, থ্যাঁতলানো খর্বকায় দেহের ভেতরে যত
রক্ত-পিত্ত-কফ-থুথু-বীর্য-লালা সবই
অসীম বরফে-হিমে গ্রানিটের মতো ক্রমে হতেছে জমাট;
আর ওই থেকে-থেকে ফুঁসন্ত ব্লিজার্ড এক
আর এক আনক্যানি করাল হিমানী
আমাকে আদ্যন্ত ঘিরে আছে
সান্নিপাতিক হেতু নাসিকার ছিদ্র বেয়ে
চোখ বেয়ে যে-জল গড়ায় আর মাটিতে পড়ে না;
শূন্য থেকে বর্শা হয়ে সিগ্নি ঝুলে রয় যেন নর্স দেবতার!
সারি সারি শতশত বল্মীকূট পেছনে আমার…
তাদের আড়াল হতে জুলজুল চেয়ে থাকে লোম-কর্ণ শিবা
লোলজিভ, অভ্রংলিহ জিভ নাড়ে মেদুসা-মনসা আর কালী
আমার তরবারি নাই। তাই
দু-হাতে নখর আমার তরবারি!
আমি কি ডরাব?
—না, আমি ডরাব না।
অসীম হিম্মত লয়ে এক পায়ে হয়ে আছি খাড়া
কিস্তিহীন,শস্ত্রহীন, নিরশ্ব, রসদহীন… আমি একা
—-পিগমিদের চেয়ে ছোটো আমি!
আমি ফুঁ দিচ্ছি হাপরে আমার
আমি আমাকে বলছি : ওঠো, জাগো!
আমার অশ্ব নাই
এক দুর্বিনীতাশ্ব জন্ম নিচ্ছে ভেতরে আমার
থ্যাঁতলানো, ভাঙা-পায়ে আমি লাফ দিচ্ছি
আমি সাঁতরে চলেছি আমার আয়ুর চেয়ে দীর্ঘ এক গন্ধকের নদী
আমি ভেদ করে যাবো ক্রূর অমানিশা
আমি জয়ী হব
আমি পার হব রুবিকন!!
বীতশোক ফিরে এসো
১
বিকেলের করোটিতে সন্ধ্যারাগ ঢেলেছে আগুন;
জ্যোতিরথে চোখ রেখে চেনা পথ শান্ত পায়ে হেঁটে
নিজেকে শুনিয়ে কোনো গূঢ়কথা, গোপন মর্মর
বীতশোক, চলে গেছে। পশ্চিমের প্রত্যন্ত প্রদেশে
আমার ‘সামান্য ক্ষতি’…. বিপর্যয়! খসে পড়ে ফল
বহুঘুম-রাত্রিব্যেপে অনৃত ঢেউয়েরা! তরী ডোবে!
২
পুরাতন বিষণ্নতা গোপনে যে আঙুরলতায়
ফল রূপে পেকে ওঠে, সারারাত তস্করের ভয়ে
শুষ্ক তৃণে ঢেকে তারে সযতনে দিয়েছে প্রহরা
৩
প্রত্যহের দুঃখ-দৈন্য-বেদনা ও ক্লেশে হয়তো সে
বসন্ত-রুধির এনে চেয়েছিল কিছুটা মেশাতে
যেন নীল প্রজাপতি এসে তার কাছে চায় মদ;
অধীর মক্ষিকা শুধু দ্রাক্ষা মেগে উড়ে উড়ে চলে
৪
সন্তর্পণে একা বসে পানপাত্রে দিল সে চুমুক;
লম্বা ঢোঁক গিলে নিয়ে স্তনলোভী শিশুর নিয়মে
আলগোছে মৃগনাভী ভরেছে উদকে স্বার্থপর!
‘শিশির-চোঁয়ানো রাতে, মধ্যদিনে দহনের শেষে’
অন্যরা ঘুমিয়ে ছিল? এ-সুযোগে হলো সে কর্পূর?
৫
হেমন্তের মঞ্চ থেকে গরুড়ের ছড়ানো ডানায়
অতর্কিতে চড়ে বসে শরীর সারাতে গেছে দূরে;
কত দূরে? কাউকে বলেনি; শুধু উপশমহীন
অনন্ত গোধূলিপথ ছেয়ে আছে হলদে পাতায়!
এই তবে গূঢ়লেখ? বৃথা তব নর্তকী ও মদ?
৬
বীতশোক, তুমি আছো! অনন্ত পশ্চিমে নাকি পুবে?
অসম্ভব ভুলে থাকা; লিথিজলও স্মৃতিসমুজ্জ্বল!
অফুরান দ্রাক্ষা থেকে অন্ধকার প্রশীর্ণ আঙুলে
নিজের ভিতরে, চুপে, শমদায়ী পেড়ে আনো ফল?
৭
বিকেলের করোটিতে সন্ধ্যারাগ! জ্বলছে আগুন!
ফিরে এসো সেই পথে; ঝরাপাতা-মুখর সরণি
কিছুটা যবের মোহে, কিছু প্রেমে, শর্করার টানে।
৮
উপশম হলো ব্যথা পিঞ্জিরার ভেতরে পাখির?
দ্রুত তবে চলে এসো, পরিত্যক্ত আঙুরের বনে
অনন্ত গোধূলিপথ ভরে দিয়ে পাতায়, মর্মরে
আততায়ী
আমি জানি, আমার প্রস্থানপথ হয়ে থাকবে
শয়তানের পুরীষে আবিল!
স্বপ্নের ভেতরে গিয়ে জিরোবার ছল করে ডাকলে তোমাকে
কান দুটি ভরে উঠবে প্রতিধ্বনিময় কা-কা রবে
অথবা, আমার স্বর শুষে নেবে খর মরুবালি;
ঘুমের অশক্ত ডাল ভেঙে যাবে
চোখ দুটি খসে পড়বে নগরের নর্দমার পাঁকে
আমাকে ঘুমন্ত দেখে কালো দাঁড়কাক
অবসিডিয়ান নাইফের মতো তার ঠোঁটজোড়া নিয়ে
আমার মুখের দিকে ঝুঁকে র’বে, চেয়ে র’বে চুপ;
—সারারাত শান্ত হয়ে বসে থাকবে বুকের ওপরে
আমি এর কিছু জানব না…
বিষভল্ল মনোশৈলচূড়ে
কথা বললে চুপিসারে ঘুমন্তের স্নায়ুর ভেতরে
সেই থেকে গলছে বরফ। সেই থেকে কত
পার্বত্য ঝরনা এসে হিম-জলে ধুয়ে দিল
অভিমানী পাথরের জ্বরতপ্ত মাথা
উঁচু থেকে নীচে পড়ে ভেঙেছে পাঁজর
তার রক্তের প্রগাঢ় বুদ্বুদে এই কালো রাত্রি হয়ে উঠল লাল
দলছুট একা সেই বনমানুষের মাথার ওপরে তুমি
মেলে ধরলে ছায়ার ক্যানোপি;
অগাধ ঘুমের জলে দিলে তাকে অপার্থিব স্নান
বললে তাকে: হে পাগল, পদতলে ক্ষত নিয়ে এভাবে ছোটো না
নররাক্ষসের বনে, সর্পঘেরা এ-ঘোর জঙ্গলে
নগ্ন হয়ে একা হয়ে এভাবে ছোটো না!
ইশারায় এই কথা বলে তুমি মৃদু হেসে অন্তর্হিত হলে
বিষভল্ল মনো
মম প্রিয় বন্ধুগণ
[আশির দশকের কবি-বন্ধুদের জন্য]
মম প্রিয় বন্ধুগণ তপ্ত লাল শলাকা শানায়। আর
রক্তজবা কানে গুঁজে শব্দ করে ভয়ানক হাসে;
মাঝেমাঝে বক্ষো’পরে বসে তারা মোর পানে উঁচায় খঞ্জর
তাদের চেহারাগুলি ঘোর লাগা, লাল আর বিভীষিকাময়
আমাকে তারাই ফের পিঠে নিয়ে চলে বহুদূর
আমারে তারাই ফের তৃপ্ত করে লেহ্য-পেয়ে, সুরায় আরকে!
দিন ক্রমে নত হয়, সূর্যের গ্রীবা ঢলে পড়ে;
যখন সবাই ঘুমে বদ্দিরাজ গাছে এক চোর
মগডালে রুপোলি, বর্তুল
সাদা-নীল পরচুলা, উঁচু টুপি, লাল মোজা, কালো মোকাসিন
বিনোদক বাঁশি নিয়ে রাতেই নীরবে তারা আসে;
সময় হলেই তারা অবলীলাভরে
বুকে উঠে দ্রুত হাতে চালায় খঞ্জর!
—-(সূর্মাটানা চোখজোড়া প্রপীড়িত অন্ধ খোড়লে!)
রুপালি নদীর জলে ভিস্তি ভরে দল বেঁধে কারা আসে, কারা যায় হেঁটে
মোগলটুলিতে আর আরমানিটোলায়?
—বৈকালিক পথে-পথে বাজখাঁই হাঁক দিয়ে যায়!
আর আমি, হয়তো চোখের ভ্রম, দেখি:
খাম্বিরা-তামাকে-তৃপ্ত পুরান ঢাকার সব
রাংতা-মোড়া জানালার কাচ ভেঙে পড়ে
দুই
এ-সময় তুষারঝড়ের গ্রীবা নড়ে যদি সমূহ বিপদ
সুবিস্তীর্ণ স্তেপজুড়ে ঠাণ্ডা হিম করাতের দাঁত
তারপর শান্ত সব। গর্জনেরা নীরব হঠাৎ!
চতুর্দিকে অসীম বরফ আর ধ্বংসরেখা;
পাহাড়ের উচ্চাবচ চূড়া
যেন কোনো বিমর্দিত স্তনের কাফেলা
ঝড় শেষ হওয়া মানে
আকাশে রুপালি তাঁবু ফুলে উঠবে এখন আবার
ধারালো নখের নিচে ঈগলেরা লুকায় শিকার
আর তারা বিপুল ডানার তলে ছানাদের আগলে রাখে
সুকোমল লোমের আদরে
অপর্যাপ্ত খাদ্যকণা, যবদানা, ঠান্ডা মাংস পথে-পথে এখন সম্বল;
মিতব্যয়ী, সচেতন তারা জানে রসদ সামান্য আর
সামনে আরো লড়াই লড়াই শুধু… লড়াই লড়াই!
ঠান্ডা রুটি ধেনো মদ যবদানা তারা তাই ভাগ করে খায়
নিজে খায়, পশুকে খাওয়ায় আর
পালান নামিয়ে রেখে ঘোড়াগুলো ছেড়ে দেয় ঘাসে
ত্রস্তে তারা জড়ো হয়
চমরি গাইয়ের ত্বকে তৈরি এক দড়াটানা তাঁবুর ভিতরে;
মধ্যরাত। বাইরে হু-হু হাওয়ার ঝাপট
তাদের ক্লান্ত হাতে অভ্যাসের তাস জমে ওঠে
তাঁবুর ভেতরে তারা খুমিশ ঢালছে পেয়ালায়!
তিন
ক্রূর, বক্র, ভীতিপ্রদ অতিকায় তাদের নাসিকা
গুম্ফ নেড়ে নেড়ে তারা ত্রাহিরবে দুনিয়া কাঁপায়!
তাদের করাল ঠোঁটে রক্ত-চর্বি, ছিন্নমাংস চুনিগাঢ় লাল!
বক্র-শ্যেন-ঘোরলাগা রক্তজবা তাদের নয়ান!
তাদের দু-চোখ থেকে ঝরে শুধু মৃত্যু আর শব
তারাই আমার সখা
সদাহাস্য তাহাদের কপালে তিলক
যুদ্ধ আর খুনে-লাল তরবারি দিয়ে তারা ক্রমাগত আমাকে শাসায়
আস্তিনের ভাঁজ খুলে বের করে খড়্গ-চাকু, জংধরা বাঁকা তলোয়ার
কল্লাবালু দিয়ে তারা সঙ্গোপনে ছুরি-কাঁচি ধার দিয়ে চলে
আর আমি ঈশ্বরের প্রিয়তম ভেড়া যেন
প্রতিদিন দিবালোকে বলি হয়ে যাই
কপালের ফেরে হায়, এ-যেনবা শেষ নিশিভোজ
সকলের মধ্যে আমি নীলমণি-যিশু!
নিজের কল্বে আমি কান পেতে থাকি আর শুনি:
‘পাপাল বুল’-কে ঘিরে টানা দীর্ঘ চারশো বছর
কোটি কোটি মার্জারের অবিরাম মরণ-চিৎকার!
চার
অভ্রভেদী লাফ দিয়ে ভয়ে আমি অবিরাম দ্রুত উড়ে-উড়ে
শত-শত ক্রুশ আর সূচ্যগ্র শলাকা থেকে নিজেকে বাঁচাই
ক্রমাগত ভিক্ষা করি লক্ষ নিমেষ আর একটি নিমেষ!
আর আমি দুই চোখ মুদে
প্রেমপূর্ণ রিরংসায় মম প্রিয় বন্ধুদের দেখে যেতে চাই:
মধ্যরাত। তাঁবুর ভেতরে তারা
খুমিশ ঢালছে পেয়ালায়…