শাখাওয়াত বকুলের ‘ফাঁসির দূরত্বে  থাকা মানুষ’  গল্পগ্রন্থটি মনস্তাত্ত্বিক এক অভীন্সা জাগিয়ে রেখেছে আমার মনে। ফলে এমন একটি প্রশ্ন জাগে যে, একজন গল্পকার হিসেবে ঈর্ষণীয় সামর্থ্য থাকার পরেও গল্পকার শাখাওয়াত বকুল কেন খুব কম গল্প লিখেন?

হয়তো এই স্বভাব সুলভ কমের মধ্যেই ভালো গল্পকে সম্বল করে তিনি এগিয়ে যেতে চান। যাই হোক আমরা তো জানি শিল্পের একটি মহৎ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সঞ্চারণশীলতা। লেখকের অনুভূতির প্রকাশ যদি পাঠকের অনুভূতিতে রূপান্তরিত হতে না পারে তবে সেই সাহিত্যকর্মের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়। সেই দিক থেকে উপলব্ধি মাত্র মনে হয় ‘ফাঁসির দূরত্বে থাকা মানুষ’ গল্পের বইটিতে বহুরঙের পেখম উন্মুক্ত করে পাঠক খুঁজে পাবে বহুবর্ণ। মানুষের বঞ্চনা,  পীড়ন আর নৈরাশ্যের নিবিড় বন্ধন নিয়ে যখন গড়ে ওঠে তার গল্প ‘সমান্তরাল মৃত্যু’-  এর অন্তর্নিহিত ব্যাঞ্জনা।  এখানে যাপিত জীবনের যে অনুধ্যান তা তার এই গল্পে লক্ষ্য করবার মতো। যেখান থেকে জীবনের হাতছানি মেলে ধরা যাপিত জীবনকে নানারূপে দেখিয়েছেন তিনি। যে জীবন চাকচিক্যময় জীবন নয়।  এই যে তার গল্পের ভেতর একেকটা চরিত্রের জীবন  তা একটি দেশের প্রতীকী চেহারাও হতে পারে।

তার আরেকটি গল্প ‘কাঁটা’ বৈষম্যমূলক সমাজে একটি শিল্পসফল গল্প। যেখানে তিনি সমাজের ভেতরকার রুগ্নতা,  সংকট, সৌন্দর্য, অভাব, এনজিও গুলোর আগ্রাসন, দুর্নীতি, ও রাজনীতির শরীর কাঠামো এক জামিলার মধ্যদিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।

তার আরেকটি গল্প ‘কাঁটা’ বৈষম্যমূলক সমাজে একটি শিল্পসফল গল্প। যেখানে তিনি সমাজের ভেতরকার রুগ্নতা,  সংকট, সৌন্দর্য, অভাব, এনজিও গুলোর আগ্রাসন, দুর্নীতি, ও রাজনীতির শরীর কাঠামো এক জামিলার মধ্যদিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।

আমাদের চেনা জগতের বিবরণটি যদি একটু অন্যরকম না হলো তবে একজন পাঠকের মনে তা নাড়া দিবে কেন? সে ‘অন্যরকম’ ব্যাপারটি তার গল্পে স্বতঃস্ফূর্ত বা স্বচ্ছন্দ প্রকাশ পেয়েছে।  এই গল্পে সময়কে ধরা যায়। প্রতিনিয়ত সময় বদলাচ্ছে, বদলাচ্ছে আমাদের বোধও। ধরুন  জীবন কতরকম। আছে বাঁকবদল।  সেখানে পাঠক হিসেবে আপনি ভাবতেই পারেন,  জীবনটা খুব ছোট তাই এত বইয়ের ভেতর জিস্ট বইগুলোকে পড়তে চান। তাই বেছে পড়ার কারণে অনেক লেখাই আপনার পড়া হয়ে ওঠে না। আবার পড়ি পড়ি করেও পড়া হয় না। একটু খোঁজ খবর নিয়ে অনেককেই বেছে পড়েন। যদিও আমাদের এইখানে মুখচেনা অনেকের আলোচনা পড়ে পরে তাদের লেখা পড়ে সেই আনন্দ পাইনি। সেইদিক থেকে বলবো বিষয় ও আঙ্গিক বদল করার মতো কিছুটা চমক দেওয়ার চেষ্টা করেছেন,  শাখাওয়াত বকুল তার প্রথম গল্পের বই ‘ফাঁসির দূরত্বে থাকা মানুষ’ বইটিতে।

অথচ গল্প পাঠে কে না  বুঝবে তিনি একজন সমাজ ও রাজনীতি সচেতন মানুষ? গল্পের তাড়নাকে সুন্দরভাবে তুলে আনা যার কাজ। গল্পতো সেটাই যখন তা গল্পটির ভেতর দিয়ে সত্যিকার ভাবে উঠে আসে। তার গল্পে গ্রামীণ মানুষের নানা চাওয়া পাওয়া,  আশা – নিরাশা, দুঃখ – বেদনা প্রাধান্য পেয়েছে। এজন্যই তাকে মাঝে মাঝে বলতে শুনি- ‘আহা বড় ধূসর আমাদের সময়’

‘কংকনের পূর্বা – পর’ একটি গল্প গড়ে ওঠার সমস্ত পরিবেশ পাই এখানে। কেবল কিছু নাম ধরে ডাক দেওয়া চরিত্রগুলোর মধ্য থেকে কংকন একটা অর্থ নিয়ে নারী চরিত্র হয়। তিনি হয়তো সচেতন ভাবেই চিন্তা করেছেন পুরুষের প্রণোদনা হয় যে নারী তার গল্পটা তিনি এভাবেই করবেন।

‘আরজ আলীদের ক্ষুধা ও জীবন’ এই গল্পটিতে সংবেদনশীল মননশীলতার পরিচয় সুস্পষ্ট। যেখানে তিনি দেখিয়েছেন ক্ষুধার কাছে দেহের মূল্য কিছুই না। ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের দেহে অবক্ষয়ের বিষাক্ত স্রোত। যখন নৈঃশব্দ্যের বিস্ময় তাকে দিয়ে লেখিয়ে নেয় এমনটিই:

“শীতের তীব্রতা কমে ঘৃণার সমস্ত শরীর তেতিয়ে উঠে।

লোকগুলো কিছু একটা দেখিয়ে মেয়েটিকে ইশারা করে।

“শীতের তীব্রতা কমে ঘৃণার সমস্ত শরীর তেতিয়ে উঠে।

লোকগুলো কিছু একটা দেখিয়ে মেয়েটিকে ইশারা করে।

আরজ আলী দেখতে পায়নি, মেয়েটি তার বাবাকে বলে ‘ আমি আইতাছি তুমি এইখানে খাড়াও’।

বলেই মেয়েটি উধাও হয়। অনেকক্ষণ পর মেয়েটি ফিরে আসে।  অনেকক্ষণ লোকটি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। মেয়েটি এসে থালার মধ্যে কয়েকটি পাঁচ টাকার পয়সা ফেলে দেয়, ঝন ঝন করে শব্দ করে রাতের নিরবতা ভাঙে আর মেয়েটি ডুকরে কেঁদে উঠে।

বাবা প্রশ্ন করে ‘আমরা ক্যান বাইচ্চা আছি’?

মেয়েটি বলে ‘এহনো মইরা যাই নাই বইল্যা’….”

এ যেন সিনেমার পর্দায় কোন দূরবর্তী দৃশ্য বৃহদকার হয়ে দর্শকের সামনে এগিয়ে আসার মতো। অথচ আমার কাছে মনে হয়েছে কয়েনগুলো ঝন ঝন শব্দ নিয়ে জমায়েত হচ্ছে, আর মেয়েটির দেহাবয়ব ক্রমশ ছোট থেকে ছোট হয়ে যাচ্ছে।শেষ পর্যন্ত জীবন ঘনিষ্ঠতা, সমাজ-সত্য ও বহুমাত্রিক জীবনের ছবি খুঁজে পাওয়া যায় তার গল্পে।

আবার ‘চিরকুট’ গল্পে গল্পকারের বর্ণনাকে আমার কাছে মনে হয়ছে বিবৃতিমূলক। চিঠির কথাগুলো নিয়ে বিভিন্নভাবে বৈচিত্র আনবার চেষ্টা থাকলেও আকর্ষণ করার মতো পালাবদল ঘটাতে সমর্থ হন নি। যা কেবল শিল্প মননের দিক থেকে  দুর্বল মনে হয়েছে।

এইবার একটু ঘুরে দাঁড়াই।  ‘অর্গল ভাঙার সে রাত’ গল্পে উপমা ও অলঙ্কারবহুল ভাষাই   চমৎকারভাবে প্রকাশ পেয়েছে। এই গল্পে যৌনতাকে তিনি নন্দিত ও নিন্দিত দুইভাবেই দেখিয়েছেন। এখানে গল্প বলার  একটি নিজস্ব ঢঙ রপ্ত করেছেন শাখাওয়াত বকুল। যেন তা চিবিয়ে চিবিয়ে জাবর কাটার মতো নয়। যদি লক্ষ্য করি গল্পের সম্পর্কটা অত্যন্ত নিকটে নিয়ে তবে ‘ফাঁসির দূরত্বে থাকা মানুষ’ গল্পটিতে ক্ষয় ও বিনাশের ত্রাস বাজিয়ে অবলীলায় বলে দিতে পেরেছেন:

‘লোকটি আগ্রহ আর অনাগ্রহের দোলাচলে কমলার কোয়া ছড়াতে ছড়াতে ভাবে-

কমলাটি সুন্দর ও এর কোষগুলো বিন্যস্ত’।

আবার সেই গল্প থেকেই তুলে ধরা যেতে পারে:

‘কনডেম সেলে কোন আলো বাতাস নেই, একটি ফ্যান ঘুরে কিন্তু বাতাস হয় না’।

সেখানে সাজাপ্রাপ্ত লোকটার আর্তনাদ নাই কোন। কেমন সুস্থির। অথচ আমি পাই ভেন্টিলেটরের ফাঁক দিয়ে ফিরে আসা বাতাসের বিলাপ। গল্পের পাঠক যেন তখন তন্ময় হয়ে পড়ে গল্পের ভেতর।

সকল শিল্পই মহাকালের বস্তু।  সেখানেই চূড়ান্ত বিচার। তবুও এ কথা বলা অমূলক নয় যে, তার গল্প একদিন সত্যিকারের স্বীকৃতি পাবে। এবং গল্পকার হিসেবে তিনিও উঠে দাঁড়াবেন নিজস্ব ভঙ্গীমায়।

Share.

কবি ও সম্পাদক জন্ম ৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৯, ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছায়। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থঃ বিষণ্ণ স্নায়ুবন (২০২০), "দূরে, হে হাওয়াগান" (২০২১) সস্পাদিত ছোট কাগজ : মেরুদণ্ড।

Exit mobile version