জীবদ্দশায় মুরাদ নীল ৫০টির বেশি জেন গল্প অনুবাদ
করে গেছেন। কিংবদন্তি সেখান থেকে মাত্র ৫টি জেন
গল্প প্রকাশ করলো।

 

আমি হয়তো মুরাদকে বুঝতাম, হয়তোবা বুঝতাম না।

অশনি সংকেত সিনেমায় একটা সীনে মানুষের মৃত্যুর
পাশাপাশি একটা বেড়ে ওঠা লিকলিকে চারাগাছরে জুম
করে দেখায় সত্যজিৎ রায়।
এই জায়গায় এসে মুরাদ বললো,
এই কারনেই সত্যজিৎ গ্রেট।

“অথবা করেছো ত্যাগ অবৈধ পুত্রের মতো পথে”

বিনয় মজুমদারের এই লাইনটা হুট করে এক মাঝরাতে
আমাকে এলোমেলো করে দিলো, আমি মুরাদ কে ফোন
দিয়ে বললাম যারা ছেড়ে গেছে ওরা আসলেই আমাদের
অবৈধ সন্তান মনে করেন?
মুরাদ হো হো করে হাসলেন আর বললেন, আপনি
এখনো বাচ্চা থেকে গেলেন মিয়া!

আমি আব্বাস কিয়ারোস্তামিকে, কিম কি দুক কে,
মৃণাল সেন কে চিনতাম না।  মুরাদ চিনাইছিলেন।
মুখতিয়ার আলীর গলায় শন্তুর ভজন আমি প্রথম
শুনছি মুরাদের সাথে বসে।

একসাথে হাঁটতে বের হলেই সে বলতো ঐডাকটা
কোন পাখির বলেন দেখি?
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খাইতাম, অনেক ভেবে উত্তর
দিতাম। মিলে গেলে মুরাদ হাততালি দিতো।
যেন আমি দুনিয়ার সব থেকে বড় কোনো
প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ান হয়ে গেছি!

নতুন কিছু লিখলেই প্রথম মুরাদ রে পাঠাইতাম।
লেখা পড়া হলেই মুরাদ ফোন করে বলবে,
অমুক লাইনে একটা বানান ভুল আছে।
লেখাটা একমাস পর ইডিট কইরেন আবার।

লাস্ট একটা গল্প লিখতেছিলাম।
ফোনে বলছিলাম মুরাদরে।
সে পড়েই ফোন করে বললো,
কতদিন ধরে বলি গল্প লেখেন।
আপনি তো আমার কথাই শোনেন না,
দারুণ হইতেছে গল্প। শেষ করেন।
দেখা হলে আপনারে জিলাপি খাওয়াবো।
গল্পটা আর শেষ হলোনা আমার।

নিঃসঙ্গতার একশ বছর উপন্যাসে
হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া তারই হাতে খুন
হওয়া প্রুদেনসিও আগিলারের সাথে যখন
একা একা কথা বলে যাচ্ছিলো বিষয়টা
আমারে অদ্ভুত এক ধাক্কা দিয়ে যায়।
মুরাদরে আলাপের ফাঁকে একদিন বললাম,
এটা কি আদৌ সম্ভব?
মুরাদ বললো ঐ লোকের গিল্টি ফিলিং এমন
পর্যায়ে পৌছে গেছিলো যে, সে আগিলাররে
কল্পনায় জীবন্ত করে ফেলছিলো এবঙ তার
নিঃসঙ্গ সময়গুলি একমাত্র আগিলারকেই
দিতে চাইছে।

মানসিক ভাবে অসুস্থ্য বুয়েন্দিয়া নিজেরেই সুস্থ্য
ভাবতো আর জগতের সবকিছুই তার কাছে ছিলো
অসুস্থ্য, অস্বাভাবিক।

ছোটলোকদের সাহিত্য নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছিলো মুরাদ।
গ্রামীন মানুষের রসবোধের জায়গা, শ্রমকে সহজ
আর আনন্দদায়ক করে তোলার  পিছনে
ছোটলোকদের সাহিত্য কতটা অবদান রাখে সেই
ব্যাপারে আমরা রাতের পর রাত আলাপ করে গেছি।

আঞ্চলিক গীত, মিথ, মুখে মুখে ছড়িয়ে থাকা
প্রবাদগুলি নিয়ে আমাদের যৌথ একটা বই করার
ব্যাপারে সিন্ধান্ত নিয়ে ফেলছিলাম।
ঐ বইয়ের জন্য আমি চারটা লেখাও রেডি করি।
মুরাদ ঝুনু মামার গীতের উপরে একটা ইন্টারভিউ
করবেন এরকম কথা ছিলো।
এক শুক্রবার আমরা গাইবান্ধা যাব ঝুনু মামার কাছে,
ডেট কনফার্ম করার পর খোঁজ নিয়ে জানা গেল
ঝুনু মামা ঐদিন গীতের খ্যাপ মারতে ময়মনসিং যাবেন।
ইন্টারভিউ আর করা হলো না।

দেশী মাছ, বাপ দাদাদের আমলের ধান, শাক সবজি সব
বিলুপ্ত হয়ে যাইতেছে ভেবে মুরাদ প্রায় দুঃখ করতেন।
হাইব্রিড জাতের ফসলের উপর আমাদের বিরক্তি
ছিলো। আমরা একসাথে বাজার করলে হাইব্রিড
জাতের সবজি কিনতাম না।

আমি ভাবতাম, আমি যা জানিনা মুরাদ তা জানে।
যে কোনো টপিক ধরায় দিলে সে ঘন্টাখানেক
অনর্গল কথা বলতে পারতো।
গান, সিনেমা, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, বাঁশি, সানাই,
সেতারের সব রাগ যেন সে মগজে গেথে রাখতে পারতো।

রুমে কয়েল জ্বালালেই সে বলবে মশাগুলারে
খুন করবেন আপনি?

এত সেনসিটিভ একটা মানুষ! যে চারাগাছের বেড়ে ওঠা
দেখলেই বলবে, এইভাবে বাঁচতে হবে রওশন।

এত এত বোধ, বোঝাপড়া নিয়ে যে বেঁচে ছিলো তাকেও
বিষন্নতা খেয়ে ফেলেছিলো!

মুরাদ কে বোঝানোর মত বিদ্যা আমার ছিলোনা,
আমি কেবল দাবি করতাম আমি মুরাদ কে বুঝি।
এখন মনে হয় মুরাদকে আমি বুঝতে পারি নাই।
ভুল বুঝতাম হয়তো।

হোসেন রওশন

 

পাঁচটি জেন গল্প
অনুবাদ: মুরাদ নীল

চার জেন ছাত্র। তারা সবাই মিলে একদিন সিদ্ধান্ত নিলো,
নিজেদের ধ্যানের সুবিধার জন্য নীরব থাকার অভ্যাস
করবে। এজন্য সাত দিন সময় নিলো।

প্রথম দিন-দিনটা ভালো ভাবেই কাটলো।

রাতে যখন হারিকেনটা নিভু নিভু প্রায়, একজন খুব
বিরক্ত হয়ে বললো, এটা জ্বালাইছে কে?

আরেকজন বিস্মিত, আমাদেও তো কথা
বলা মানা ছিলো!

তৃতীয়জন, দু’জনকে উদ্দেশ্য করে বললো,
বোকার দল। চুপ একদম।

চতুর্থজন, হাসতে হাসতে বললো, হে হে,
আমি কোন কথা বলি নাই।


জাওজের শিষ্য জাওজেকে জিজ্ঞেস করলো,
‘আচ্ছা গুরু, আপনি স্বর্গে যাবেন নাকি নরকে?’

-আমি তো নরকেই আছি। উত্তর দিলেন জাওজে।

শিষ্য অবাক হয়ে জানতে চাইলো,
‘নরকে গেলেন কেন?’

জাওজের উত্তর,
‘নরকে না আসলে তোদের শিক্ষা দিতো কে?’


জাপানে সেবার শীতকালে প্রচন্ড শীত। মাঠ, ঘাট,
পাইন বন সবখানে বরফ। এমনকি পাইন বনের
ওপারের পাহাড়টিও বরফে ঢেকে আছে।
পাহাড়ের এক গরিব কৃষক। পরিবারের সবাইকে
নিয়ে শীতে তার চরম কষ্টে দিন কাটছিল। ঘরে কাঠ নেই,
ঠান্ডায় জমে যাবার মতো অবস্থা।
কৃষকটি ভালুকের চামড়ার পোশাক গায়ে চাপিয়ে বের
হলো ঘর থেকে। তুষারের মধ্যে দাঁড়ানোর হাঁটা শুরু
করলো পাহাড়ের দিকে, যেখানে জেন সাধুরা থাকেন।
সাধুদের কাছ থেকে কাঠ নেবেন কিছু। তারা তো দয়ালু।
বুদ্ধের অনুসারী। নিশ্চয়ই খালি হাতে ফেরাবেন না তাকে।
অনেক কষ্টে পাইন বনের তুষার পার হয়ে সাধুদের কাছে
এলো কৃষক। এক জেন সাধু তুষারে ঢাকা পাথরের
উঠানে দাঁড়িয়েছিলেন। কৃষককে অভিবাদন জানালেন
তিনি। কৃষক জেন সাধুকে বললো, ‘আমার কাঠ ফুরিয়ে
গেছে। আপনার সাহায্য চাই।
দয়া করে আমাকে কিছু কাঠ দিন।’
কৃষককে অপেক্ষা করতে বলে জেন সাধু ভেতরে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর দুই হাতে বড় একটা কাঠের টুকরা নিয়ে
ফিরলেন। কাঠের টুকরাটা কৃষকের হাতে দিলেন।
বললেন, ‘এই নাও তোমার কাঠ।’
কৃষকটি কেঁদে ফেললো। এ তো সাধারণ কাঠ নয়,
বুদ্ধমূর্তি।
জেন সাধু বললেন, ‘হ্যাঁ, এটা বুদ্ধমূর্তি।’

-আপনি আমাকে বুদ্ধের ম‚র্তি দিলেন পোড়ানোর জন্য?
-এছাড়া, আমাদের আর কাঠ নেই।
-বুদ্ধের ম‚র্তি পোড়ালে পাপ হবে না আমার?
কৃষকের প্রশ্নে জেন সাধু উত্তর দিলেন, ‘পাপ হবে কেন?
তোমার তো কাঠের প্রয়োজন। বাড়ি ফিরে যাও। এই কাঠ
পুড়িয়ে অন্তত শীতের কষ্ট থেকে বাঁচো।’


কেইচু। মেইজি যুগের একজন বিখ্যাত জেন সাধক।
তিনি ছিলেন কিয়াতো শহরের তোফুকু মঠের প্রধান।
একদিন কিয়াতোর গভর্নর তার সাথে দেখা করতে এলেন।
গভর্নরের ভিজিটিং কার্ডটি নিয়ে এক শিষ্য কেইচুর কাছে
এলেন। ভিজিটিং কার্ডে লেখা-কিতাগাকি, কিয়োতোর
গভর্নর।
ভিজিটিং কার্ডটি দেখে কেইচু শিষ্যকে বললেন,
‘এমন মানুষের সাথে আমার কাজ নাই।
তাঁকে চলে যেতে বলো।’
শিষ্য গভর্নরকে কার্ডটি ফেরত দিয়ে ক্ষমা চাইলো।
গভর্নর শিষ্যকে বললো, ‘ভুল তো আমারই।’
পেন্সিল বের করে তিনি কার্ডটির ওপরে লেখা
‘কিয়োতোর গভর্নর’ অংশটুকু কেটে দিলেন।
তারপর শিষ্যটিকে বললেন,
‘আরেকবার তোমার গুরুকে বলো।’
এবার কার্ডের দিকে চেয়ে গুরু কেইচু
উৎফুল্ল হয়ে বললেন, ‘আরে, এ তো কিতাগাকি!
তাঁকে ভেতরে আসতে বলো।’


এক জেন শিষ্য তার গুরুর কাছে আসলো।
মনে বেজায় দুঃখ তার। গুরুকে বললো,
‘গুরু, আমি মানুষের উপর হুট করেই প্রচন্ড রকম
রেগে যাই। এ জন্য পরে মন খারাপ হয় খুব।
কী করবো এখন?’
গুরু ছাত্রকে একটা কাঠের বেড়া দেখিয়ে দিয়ে বললেন,
‘যখনই রেগে যাবে, ঐ কাঠটাতে গিয়ে পেরেক মারবে।’
শিষ্যের রাগ উঠলে সে ঐ কাঠের গায়ে পেরেক মারে।
একসময় কাঠে আর পেরেক মারার জায়গা থাকে না।
সে আবার গেল গুরুর কাছে, ‘গুরু এখন কী করবো?’
গুরু বললেন, ‘যাও, পেরেক তোলো। যখনই রাগ উঠবে,
পেরেক তুলবে।’
শিষ্যের রাগ উঠলেই পেরেক তোলে।
পেরেক তুলতে তুলতে ক্লান্ত। আবার গেল গুরুর কাছে,
‘গুরু রাগ তো কমে না।’
গুরু বললেন, ‘পেরেক তোলার পর কাঠটার দিকে চেয়ে
দেখেছো একবারও? কেমন দেখায়?’
শিষ্য বললো, ‘শুধু ছিদ্র আর ছিদ্র।’
গুরু বললেন, ‘মনে রাখো, যার উপর রাগ করো, তার
মনেও দাগ পড়ে। ঠিক কাঠের মতোই। ক্ষমা চাইলেও
দাগ থেকে যায়। যাও, পেরেক তোলো।’

Share.

মুরাদ নীল জন্ম: ১৯৯২ সালের ২রা জানুয়ারি। আদিতমারি, লালমনিরহাট। ক্রিটিক ও অনুবাদক। মৃত্যু: ৩০শে মে, ২০২৩

Exit mobile version