এক

 

নতুন চাকরি৷ চমৎকার জায়গা। গনগনে দুপুরও এখানে অসহনীয় হয়ে ওঠে না। নিকটবর্তী অপেক্ষাকৃত উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় প্রচুর মেঘ জমে। কয়েকটা ছোট ঝরণা বয় আশপাশেই। এদিকটায় প্রায়ই বৃষ্টি হয়। সারাদিন ভোরের বাতাস। রাতভর শীত শীত। প্রায় এগার তলা ভবনেরর সমান উচ্চতার এই পাহাড়ের উপর পুরো কম্পাউন্ডটা প্রায় একটা ফুটবল মাঠের সমান। ঢাল বেয়ে উঠবার জন্য সিঁড়ি কাটা আছে। বাঁশের রেলিংও। তবু ছেলে-বুড়ো কারও ক্লান্তিই বিধাতার ক্ষমা পায় না এখানে উঠতে গেলে। কষ্টেসৃষ্টে একবার উঠে এলেই, যে কোনও পর্যটকের বিস্ময় ক্লান্তিকে ছাপিয়ে যাবে। কিন্তু এখানে পর্যটন নিষিদ্ধ। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল প্রোগ্রাম চলে এই একই চত্ত্বরে, পাশাপাশি। মাধ্যমিক স্কুল কার্যক্রম শুধু ছেলেদের জন্য। প্রাথমিকে প্রায় দু’শো আর মাধ্যমিকে এবছর মোট সাতাশি জন শিক্ষার্থি। বাঁশের বেড়া আর সবুজ টিনে ছাওয়া পরিপাটি দু’টি দীর্ঘ স্কুলঘর। সামান্য দূরে, একটা আশ্রমের পাশে শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দ বাড়ি। জাপান সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত এই টিএসএইচ (টিচ দ্য স্টারস অব দ্য হিলস) প্রজেক্ট ইতোমধ্যেই দেশব্যাপী ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। যেখানে সুযোগের অভাবে ক্লাস ফাইভে ওঠার আগেই পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যেত বহু শিশুর, সেখান থেকে শিক্ষার্থিরা দুর্দান্ত রেজাল্ট করে এখন দেশের বিভিন্ন কলেজে ইউনিভার্সিতে পড়ছে গিয়ে। এসএসসিতে জাতীয় মেধা তালিকায় এই স্কুলের কেউ নেই—এমন ঘটেনি গত সাত বছরে একবারও। শিক্ষকদেরও সম্মানী যথেষ্ট আকর্ষণীয়। কিন্তু আধুনিক সুবিধা তেমন নেই, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকার মতো নয়। তাই এখানে কাজ করতে অনেকেই আসতে চায় না। এলেও কেউ টেকে না বেশিদিন। ‘প্রাগৈতিহাসিক’, ‘পশ্চাৎপদ’ ইত্যাদি অভিধা ছাড়া শহুরে শিক্ষিতের কাছে সদর্থক কিছু জুটে না এ অঞ্চল প্রসঙ্গে৷ কিন্তু আমার কাছে তেমন লাগলো না এসে। বরং মনে হলো, ভাঙনের পর নাকখত দিয়ে আমার এই হিজরত যথার্থ বৈ কিছু নয়। শান্তি শান্তি শান্তি।

 

কিন্তু সিদ্দিক সাহেব এসে আমার শান্তি নষ্ট করতে থাকলেন। দৈনিক কাজশেষে ঘরে ফিরে নিজের মতো থাকতে চাই। কিন্তু এ লোকটা প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় গায়ে পড়ে আলাপ করতে এসে ঘণ্টা তিনেক খেয়ে ফেলতে শুরু করলেন। আর আলাপজুড়ে এমন সব অস্বস্তিকর শব্দ ব্যবহার করেন যে, তার প্রমিত বাংলার সঙ্গে সেসব খুবই বেমানান আর শ্রুতিকটু। প্রথম দিন এসেই বললেন,

‘আতিক স্যার, অদ্ভুত ব্যাপার কি জানেন, আমার সেকেন্ডারি স্কুলেও আপনার সেইম নামে ইংরেজি স্যার ছিলেন একজন। জাঁদরেল। কী কাকতাল!’ আমি বললাম, ‘আমি জাঁদরেল নই।‘

‘আরে কী যে বলেন! অজাঁদরেল কেউ নিয়োগ পেয়েছে এখানে আজ অবধি? অবশ্য নিজেকে জাঁদরেল ভাবা ভদ্র নহে।’

এরপর হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে শুরু করলেন বাংলা-ইংরেজি গালি বিষয়ে তার বয়ান। ইংরেজির টিচারের কাছে ঢালার মতো এর থেকে ভালো আলাপ যেন হতেই পারে না। জানালেন, গালি দেওয়ার ক্ষেত্রে ইংরেজি যে বাংলার চেয়ে বেশি শক্তিশালি মনে করা হয়, তা তিনি মানেন না।

বললাম, ‘কেন?’

‘তার আগে বলুন Whore মানে তো বেশ্যা, তাই না?

‘হ্যাঁ’

‘বেশ্যাকে তো খানকি মাগিও বলা হয়, তাই না?

‘হ্যাঁ’

‘এখন আপনিই বলুন, একদিকে হোর আরেকদিকে খানকিমাগি। কোনটা বেশি শক্তিশালি?’

আমি অসহায়। নির্বাক। ব্যাপক বিরক্তি আর বিস্ময় নিয়ে তাকালাম তার দিকে। সিদ্দিক সাহেব হাসলেন। সে হাসিতে আবিষ্কারের আনন্দ তার। বিশ্রি বেশুমার। অবাক লাগে। এই রকম লোক এখানে নিয়োগ পেলো কী করে?


দুই

 

স্কুলের একপাশে অপরাজিতার ঝোপ। বেশ স্বাস্থ্যবান, বড়সড়। নীল আর সাদা ফুল। কয়েকটা তুলে নিয়ে এসেছিলাম রুমে। সিদ্দিক সাহেব এলেন যথারীতি মাগরিবের আজানের পরপরই। টেবিলে রাখা অপরাজিতা নজর এড়ালো না তার। বললেন, এই ফুল দিয়ে কী করবেন?

‘কিছু করবো না। ভালোবেসে ছিঁড়ে আনলাম।’

‘হেহেহেহ। ভালোবাসলে ছিঁড়ে আনতে হয় না। ছিঁড়ে ফেলতে হয়।’

‘আরে, কী বলেন এসব!’

‘ঠিকই বলি। আই হেইট দিস ফ্লাওয়ার। সো আই নেভার গো ক্লোউস অ্যান্ড এভার ফিল লাইক টাচিং’

‘কেন?’

‘বিকজ দে লুক লাইক দ্য ফাকিং ভেজাইনা। জাস্ট টেইক আ লুক! সি, জাস্ট এজ আই সেড। দ্য ক্লিটোরিস ইনক্লুডেড।’

‘তো কী হয়েছে তাতে? ভ্যাজাইনা ছাড়া আপনার চলতো?’

‘অফ কোর্স! চলতো মানে? চলছেই তো…আই অ্যাম হ্যাপিলি ইমপোটেন্ট ডিভোর্সি’

কী আশ্চর্য! কী ভয়ানক সরল স্বীকারোক্তি! এরকম আত্মস্বীকৃত সুখী নপুংসক আমার জীবনে দেখিনি। কিন্তু আঙ্গুরফল টক হলে কি তাকে ঘৃণা করতে হবে? বললাম, ‘আমি বলতে চাচ্ছি, আপনার জন্মের কথা।’

‘সেখানে আমার কোনও পছন্দ অপছন্দের সুযোগ তো ছিলো না রে ভাই।’ সাফ জবাব তার।

রাতের খাবার দেওয়া হয়েছে ডাইনিং-এ। আমরা খেতে গেলাম। আমরা পাশাপাশি বসে নিঃশব্দে খেলাম। তারপর যার যার ঘরের দিকে পা বাড়ালাম।

সিদ্দিক সাহেব নিজের ঘর থেকে টেক্সট করেছেন—Don’t mind plz. The scientific name of the flower is Clitoria Ternatea। তার বিদ্বেষপূর্ণ বাজে কথাবার্তার যৌক্তিকতা অনুমান করে আমার বড় মায়া হলো। মানুষের এমন হয়। অক্ষমতা থেকে  গ্রিভেন্স তৈরি হয়। ফিরতি মেসেজে আমি লিখলাম, থ্যাংক ইউ। আই ডিড নট নো দিস। প্লিজ টেইক ইট ইজি। ন’টায় আলো নিভে গেলে আমি শুয়ে পড়লাম। বৃষ্টি এলো। টিনের চালে পাহাড়ি বৃষ্টির মূর্ছনায় আমার খুব ঘুম পেলো। কিন্তু মাটির ঘ্রাণে সেই ঘুমের যাত্রা তন্দ্রায় আটকে রইলো অনেক্ষণ। ততক্ষণে কয়েক কোটি দৃশ্যের কোলাজ বয়ে গেলো চোখের সামনে দিয়ে। অন্ধকারে জ্বলে ওঠেই নিভে যাওয়া ক্রমাগত অজস্র বৃষ্টিফোঁটার মতো।


তিন

 

আমাকে নিয়োগ দেওয়ার সময় বলা হয়েছিলো, এখানকার অতিসাধারণ যাপনপদ্ধতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে একটু কষ্ট হবে। অন্তত মাস খানেক তো লাগবেই। সেই একমাস আমার কাটলো সফলভাবেই। এখানকার সজীব বাতাস, ঝরণার ধারা, ঝুম বৃষ্টি, টাটকা সবজি, আর অপূর্ব রাত আমায় ভালো রাখছে। রীতার কথা আমার মনে পড়ছে না। কোনও বন্ধুর সঙ্গ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠছে না। দেশ দুনিয়ার কোনও খবর নিতে ইচ্ছে করছে না। এসব অনিচ্ছা, অনাকাঙ্ক্ষা আমার যত ক্ষত, তার উপশমের মনের মতো দাওয়াই বটে।

 

কিছু অদ্ভুত কাণ্ড ঘটেছে। আসার সময় এক কার্টন সিগারেট এনেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, এগুলো শেষ হওয়ার আগেই ধূমপানের অভ্যাসের ইতি ঘটবে। আপাতত তিনবেলা তিনটা হলেই চলছে। ইতোমধ্যেই ক্যামেরাটা ক্লাস টেস্টের টপারকে পুরস্কার হিসেবে দিয়ে দিয়েছি। অথচ সুন্দর দৃশ্য পেলে ছবি তুলবার প্রচণ্ড নেশা পেয়ে বসতো আমার। আমার মনে হলো, এই অপরূপ দৃশ্যরাজির মধ্যে আমি তো পর্যটক হয়ে আসিনি। এখানেই আমার আবাস। ছবি তুলে নিয়ে আমি কী করবো? এ স্থান ত্যাগ করছি না যে, স্মৃতি বয়ে নিয়ে যাবার আকাঙ্ক্ষা হবে।

 

এত দ্রুত সব ঘটছে যে, আমাকে ঘিরেই আমার নব নব বিস্ময় আমাকে বিভোর করে রাখছে। রীতার প্রতি আমার অনুভূতির যে বিষটুকু জমেছিলো, দিনে দিনে এখানকার বৃষ্টি, বাতাস আর জ্যোৎস্নায় ধুয়ে গেছে। ইচ্ছে করে জানাই ওকে আমার কৃতজ্ঞতা । ওর ঠিকানা জানি না। ফোন নম্বর কোথাও লেখা নেই। এখানে এই নতুন পৃথিবীতে অল্প প্রতিবেশী আর অনেক প্রাণ প্রাচুর্য নিয়ে নির্বিবাদ যাপনের উৎসবে জীবন ঈর্ষণীরকম মুখর হয়েছে আমার। এ সংবাদ গোপন থাকুক।

 

মা বেঁচে থাকলে, এ অবস্থায় আমি যে ভালো আছি, তা বিশ্বাস করতেন না। বউ ছাড়া ছেলে কী করে ভালো থাকে—এসব ভেবে আকুল হতেন তিনি। পাত্রী দেখাও শুরু করে দিতে পারতেন। আমার প্রত্যেক করুণ অতীতকে কল্যাণকর হিসেবে দেখতে পেলাম। স্কুল ভালো লাগে। শিশুরাও স্কুলের সময়টা উপভোগ করে। এবং সবাই খুব উৎসুক। প্রচুর প্রশ্ন করে। স্থানীয় মুসলিম কমিউনিটির ছাড়াও আরও চারটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ছেলেমেয়ে মিলেমিশে ক্লাস করে। দেখতে ভারি সুন্দর লাগে। ওদের লয়াল্টি মুগ্ধকর। প্রত্যেক ক্লাসে অডিওভিজুয়াল আয়োজন। সুপ্রশিক্ষিত দক্ষ শিক্ষকের সাহচর্য। পাহাড়ের শ্লথ জীবনযাত্রায় এ যেন এক অবিশ্বাস্য আলোর মাত্রা; অনন্য আসমানী আশির্বাদ।


চার

 

দিনের বেলায় ছাত্রছাত্রীদের কলকাকলি ছাড়া আর যা যা শব্দ মেলে তা মূলত পাখির কিচিরমিচির। রাতে ঝিঁঝিঁর ডাক। থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক। কোনও কোনও রাতে দূর থেকে বাঁশির সুর আসে। বেদনার সুর রাতের স্তব্ধতা ভেঙে অদ্ভুত এক দ্যোতনায় অন্ধকারের সঙ্গী হয়ে বাতাসে ভেসে বেড়ায়। শব্দ দূষণ কিছু ছিলো শুরুর দিকে কারণ অদূরেই এক চাতালের তলে ডিজেল জেনারেটর চলতো। সন্ধ্যার পর থেকে রাত নয়টা অবধি। সে ব্যবস্থা এখনও আছে। তবে মাস কয়েক আগে ওই চাতাল সংস্কার করে এবং বিশেষ ধরণের সাইলেন্সার ব্যবহার করে জেনারেটরের শব্দ নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। আশ্রমের ভিক্ষুদের অনুরোধে কতৃপক্ষ এ ব্যবস্থা করেছে। এখানে রাত নয়টা মানে নিঝুম ঘুমের পাড়া। গাঢ় অন্ধকার। কী চমৎকার ঘুম হয় আমার এখন।

 

আজ রাতটা অন্যরকম। আসমানজোড়া জ্যোৎস্নার প্লাবন, ছেঁড়া মেঘের ঝাঁক এসে মাঝে মাঝে কিছুক্ষণের জন্য চাঁদটাকে ঢেকে দিচ্ছে যদিও। ঝিরঝিরে বাতাসে হিম। আরামে শুয়ে আছি ঘাসের পরে। গ্রামের উঠোনে পাটি পেতে ঠিক এইভাবে জ্যোৎস্না দেখার স্মরণ নেওয়া যাচ্ছে। করুণ বাঁশির সুর ভেসে আসছে। সিদ্দিক স্যারকে মিস করছি। তিনি এক মাসের ছুটি নিয়ে সিঙ্গাপুর গিয়েছেন। অফিসকে জানিয়েছেন হার্টের চিকিৎসা। আমাকে বলেছেন, টুনটুনির ট্রিটম্যান্ট। এ কী কথা! তারমানে তিনি মুখে মুখে হ্যাপিলি ইমপোটেন্ট হলেও মনে মনে আনহ্যাপি। এটা জেনে এই অপূর্ব রাতেও আমার মন খারাপ। আমি ঘাসের ডগা ছিঁড়ে কুটুস কুটুস করে কাটছি দাঁত দিয়ে। পুরনো বদভ্যাস। মন খারাপ হলেই বাড়ির কোণায়, বাশঝাঁড়ে চলে যেতাম। কচি অস্ফুট বাঁশপাতার রোল দাঁতের ফাঁকে কেটে কেটে আমার মন ভালো হয়ে যেত। বিদীর্ণ বাঁশপাতার সতেজ ঘ্রাণে বুঝিবা কোনও সম্মোহন? অমন হঠাৎ করেই কষ্ট টুটে আনন্দমন হতো কেমন করে? কিন্তু এখন এই পাহাড়ি ঘাস দিয়ে কোনও উপকার পাচ্ছি না। মনে পড়ছে, ঘাস কুটুস কুটুস করা দেখে রীতা একদিন বলেছিলো, ‘তোমার মধ্যে গরুর ইন্সটিংট আছে। শান্ত সুবোধ।’ বিয়ের পরে ওর বয়ানে গরুর জায়গায় ঘোড়া কুকুর ইত্যাদির নাম এসেছে যদিও, এনিমেল ইন্সটিংটের দায় ঘুচেনি। ওর ভাবনার রূপান্তরের ইতিহাস স্মরণ করে করে,  টর্চ হাতে সাবধানে নামছি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। আজ বাঁশিটার কাছে যেতেই হবে। সিদ্দিক ভাইও যেতে চেয়েছিলেন। আহা! বেচারা! চোখ, কিডনি, রক্তের মতো মানুষের লিবিডোও দান করা যেত যদি!

Share.

কাজী শহীদ। জন্ম: ১৯৭৯ইং শেরপুর জেলার নকলা উপজেলার এক গ্রামে। পেশায় ইংরেজি ভাষা প্রশিক্ষক।

Exit mobile version