চীন যুক্তরাষ্ট্রকে হারিয়ে বিশ্বের ১ নম্বর অর্থনীতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।  এর পিছনের কথা কম-বেশি আমরা সকলেই জানি।  দেশটিতে টানা বারো বছর উচ্চ শিক্ষা বন্ধ ছিলো।নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন।  অনেকের মনে হয়তো প্রশ্ন চীনের মতো দেশে তাও আবার বারো বছর? উওর পেতে পড়ে শেষ করুন পুরো লেখাটি।

অবাক হলেও সত্য যে বারো বছর উচ্চ শিক্ষা বন্ধ রেখে সরকার দেশটিতে কারিগরি শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদেরকে উৎসাহিত করেছে প্রয়োগ মুখী শিক্ষা গ্রহণ করতে এবং উদ্যোক্তা হতে।  ফলশ্রুতিতে, ঘরে ঘরে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট কারখানা।  হয়েছে বেকার সমস্যার সমাধান, বেড়েছে উৎপাদন,বেড়েছে রপ্তানি এবং সমৃদ্ধ হয়েছে দেশের অর্থনীতি।

চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে  ছাত্র-ছাত্রীরা যখন গাড়ি তৈরিসহ বিভিন্ন গবেষণামূলক কাজে সময় পার করে তখন আমরা অন্যের লেখা এ্যাসাইনমেন্ট কপি করে জমা দেওয়াতে ব্যস্ত কিংবা শীটের পর শীট মুখস্থ করে সিজিপিএ বৃদ্ধি করতেই ব্যস্ত। এটা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ভয়াবহ চিত্রের একটা অংশ। ছাএ-ছাএীদেরকে দোষ দিয়েই কি লাভ?

আমাদের পরিবেশ, পরিস্থিতি, চাকরির বাজার, উদ্যোক্তা হওয়ার পরিবেশ সবকিছু আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে এমন হতে বাধ্য করে। এদেশে সৃজনশীল কাজের মূল্য পাওয়া খুবই কষ্টকর একটা ব্যপার।

ছোটবেলা থেকেই আমাদেরকে বলা হয়, পড়াশোনা শেষ করে তোমাকে ভালো একটা চাকরি করতে হবে। এর বাইরে গিয়ে উদ্যোক্তা হবেন বা অন্য কিছু করবেন বা করার কথা চিন্তা  করবেন এটাকে এ দেশে এক ধরনের অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। আপনি যদি কাউকে বলেন, পড়াশোনা শেষ করে ব্যবসা করবো কিংবা উদ্যোক্তা হবো, তাহলে তাঁরা আপনার দিকে এমন চোখে তাঁকাবে যেনো এসব কথা বলে ভয়ংকর কোনো অপরাধ করে ফেলেছেন।

এখানে ছোটবেলা থেকেই অন্যের চাকর হওয়ার দীক্ষা দেওয়া হয়।  ছোটবেলা থেকেই অন্যের অধীন হয়ে কাজ করার প্রোগ্রাম আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়।  খুব সহজভাবে বোঝানো হয়, তুমি পড়াশোনা শেষ করে যত বড় চাকর হতে পারবে, তুমি তত বেশি মযার্দার অধিকারী হবে।

এই প্রোগ্রাম আমাদের মাথায় ক্রমাগত ঘুরতে থাকে এবং প্রোগ্রামের নির্দেশনা অনুযায়ীই সারাজীবন পড়াশোনা করি।  ফলশ্রুতিতে, চাকর হওয়ার জন্য যতটুকু পড়াশোনা করা দরকার ততটুকুর বেশি খুব কম মানুষই পড়াশোনা করে থাকে।  এবং চাকর হওয়ার এপয়েন্টমেন্ট পাওয়ার সাথে সাথেই আমাদের পড়াশোনার পর্ব চুকে যায়।

আমরাও স্যুট-টাই পরে অন্যের অধীনে কাজ করতে পারটাকেই সফলতা হিসেবে ধরে নেই। এটা আসলে জাতি হিসেবে আমাদের ব্যর্থতা।  যা আমরা কেউ স্বীকার করছি না।

আমরা সবাই “Safety & Security” নামক এক মরীচিকার পিছনে দৌড়াচ্ছি।  যেখানে আপনি যেকোন সময়ে পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম মৃত্যুর শিকার (চক বাজার ট্র্যাজেডি) হতে পারেন, সেখানে নিরাপদ চাকরি মরীচিকা ছাড়া আর কি।

আমরা সবাই উন্নত জীবন চাই অথচ পরিশ্রম করতে চাই না।  আরাম-আয়েশে ভরপুর cool একটা লাইফ চাই। ব্যপারটা অনেকটা এরকম “আমি বেশি সুবিধা নিবো কিন্তু আমি কম দিবো”।  এই মানসিকতা নিয়ে আমরা অধিকাংশ মানুষ সমাজে বেড়ে উঠছি বা বসবাস করছি৷ ব্যপারগুলো পারষ্পরিক সাংঘর্ষিক। তাই নয় কি?

এদেশের বিপুল একটা জনগোষ্ঠী একাডেমিক পড়াশোনা শেষ করে, চাকরির নিরাপত্তা আছে এমন একটি চাকরির জন্য ক্ষেএভেদে ৫/৭ বছর পর্যন্তও অপেক্ষা করে। আমরা এত বেশি নিরাপত্তা খুঁজি যে, এখন নিরাপদ চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার জন্য কেউ কেউ নাকি অত্যন্ত যৌক্তিক দাবি জানাচ্ছে।  কিন্তু এই মানুষটি  ৫/৭ বছর অপেক্ষা না করে চেষ্টা করে, তাহলে সে হয়তো এমন কিছু করতে পারতো যেখানে নিজের পাশাপাশি অন্যদের জন্যও  কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারতো।

এদেশে কর্মসংস্থান তৈরির উদ্যোগ না নেওয়া হলেও বেকার তৈরির কারখানা নামে খ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় বরাদ্দে কতৃপক্ষ খুবই তৎপর। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাড়লেও, ক্রমাগত কমছে শিক্ষার মান।

পৃথিবীর প্রথম সারির ১০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় আমাদের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। কিভাবে থাকবে? যেখানে আমাদের শিক্ষরা নিজেরাই পড়াশোনা করেন না, ছাএদের কিভাবে পড়াবেন? পড়াশোনা করতে কিভাবে অনুপ্রাণিত করবেন?

প্রাইমারি / হাইস্কুল থেকে মাএ পাশ করে বের হওয়া একজন ছাএকে যদি ঐ স্কুলের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় অথবা মাএ কলেজ পাশ করা একজনকে যদি কলেজে পড়ানোর জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়  ব্যপারটা কতখানি যৌক্তিক হবে?? কিন্তু এদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে পরের দিনই কোন প্রকার প্রশিক্ষণ, গবেষণা, স্যান্ডার্ড ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার বস্তায় বস্তায় উদাহরণ আছে।এভাবেই চলছি আমরা এবং  আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা।

কিছু মানুষ আবার দেশের সেবা করার নামে নিরাপদ চাকরিতে প্রবেশ করে।  এর অল্প কিছুদিন পরে এই দেশপ্রেমিক মানুষগুলোই দূর্নীতি নামক মহৎ কাজে লিপ্ত হয়ে দেশকে দূর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন বানিয়ে দেয়।

এভাবে আর কত দিন? এভাবেই কি আমরা চলতে থাকবো?

পাঞ্জেরি রাত পোহাবার কত দেরি?

আমি জানি এত বড় পোস্ট লিখেও কিছুই হবে না, সবকিছু আগের মতোই চলবে।  তবুও আমি হতাশ নই। এই পোস্ট পড়ার পর  দশ জন মানুষ যদি চিন্তা করে যে, সত্যিই তো আমাদের মানসিকতা ও শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যপক সংস্কার দরকার এবং আরও দশ জনকে জানায় সেটাই আমার পরিশ্রমকে স্বার্থক করবে।

Share.
Exit mobile version