ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করি। ২০০১ সালের নভেম্বরে রমজান মাসে আমার আব্বা মারা যায়। ইফতারের সময় স্ট্রোক করেছিলেন। দ্রুতই হাসপাতালে নিয়ে গেলেও পরের দিন দুপুরে মারা যান তিনি। তখন তার বয়স ছিলো ৭৬। কিন্তু প্রচণ্ড ভারি শরীর নিয়ে দিব্যি তিনি সব ধরনের পরিশ্রমের কাজ করে বেড়াতেন। তিনি যদি চাইতেন তাহলে দাঁড়িয়ে থাকলে আমরা ধাক্কা দিয়েও নড়াতে পারতাম না। আব্বা মারা যাবার পর, একদিন পারাতো এক মহিলা দুম করে আম্মাকে বলে বসলেন, কি শক্ত মানুষ আপনি ভাবি! একটু কান্নাকাটি করলেন না! দিলডা পাত্থর কইরা সব করছুইন। বিষণ্ন আম্মা নিজেকে শান্তনা দেয়ার মতো করে বললেন, যা হইছে ভাই ভালোই হইছে। খুশি আছি। চিন্তা করেন, এই রকম হাতির মতো শরীর নিয়ে লোকটা যদি বিছানায় পইরা যাইতো, তাইলে আমরার কি হইতো!

এইটা হইলো সমাজের একটা রূঢ় অবস্থা। আমাদের যে অর্থনৈতিক সামাজিক অবস্থা, ওই ঘটনা ঘটলে তা আমাদের ওপর বড় ধরনের ধাক্কা হইতো নির্ঘাৎ। এই যে পরিস্থিতি, এর মুখোমুখি আমরা হইতে চাই না। চাই না পৃথিবীর কেউই পড়ুক। কিন্তু ওই বৃদ্ধ বা বয়সী মানুষটার শেষ বয়সটায় তাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তার চিকিৎসা ও পারিবারিক সংস্পর্শ। এই বিষয়ে তো আমাদের দক্ষিণ এশিয়ান সমাজে বেশ কিছু ট্যাবু আছে। ‘দ্যা ফাদার’ ছবিটায় সেইসব ট্যাবু নাই, কিন্তু ওই শেষ বয়সী বাবার যে গল্পটা আছে তা অনেক রূঢ় এবং মানবিক যাতনার গল্প।

ফরাসী নাট্যকার ফ্লোরিয়ান জেলের এর নাটক ‘লে পেরে’ (এর মানেও দ্যা ফাদার)- ২০১২ সালে প্রথম মঞ্চস্থ হয়। বিপুল জনপ্রিয়তা পায় নাটকটি। ২০১৪ সালে মলিয়ের অ্যাওয়ার্ডের মতো গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারও জিতে। তারপর থেকে দেশ (ফ্রান্স)-বিদেশে বিভিন্ন জায়গা থেকেই পুরস্কার অর্জন করে নাটকটি। সেই সাথে প্রশংসায়ে ভেসে গিয়েছিলো নাট্যকার ও নাটকের কলাকুশলীরা। পরের বছর এই নাটক অবলম্বনেই ফিলিপ লু গুয় নির্মাণ করেন ‘ফ্লোরাইড’। ছবিটাতে তিনি নাটকের যে একাঙ্কিকা ধরণ তাকে কিছুটা পরিবর্তন করে অন্যসব সিনেমার মতো ড্রামাটাইজ করেন। গল্পটাকে নিয়ে তিনি খোলা রোদে ছেড়ে দেন। ফলে সিনেমাটা নাটক থেকে হলেও এইটা ঠিক ‘লে পেরে’র মতো হয়ে উঠে নি। রীতিমত আলাদা একটা সিনেমায় রূপান্তরিত হয়েছিলো। দর্শক-সমালোচক কোনও মহলেই তেমন প্রভাব ফেলতে পারে নি সিনেমাটি।

এই কথাগুলো বললাম, কারণ সিনেমাটা যে সেরা রূপান্তরিত চিত্রনাট্যের অস্কার জিতলো এর অনুসঙ্গ হিসেবে। একটা বিষয় কি, একটা মানুষকে যখন আপনি আরেকটা মানুষে রূপান্তর করার চেষ্টা করবেন তখন শত পরিবর্তনের পরও সেই মানুষটা তার পুরনো মানুষ থেকে বের হয়ে যেতে পারে না। মানে শেকড় অতিক্রম করার যে বিষয়টা সেইটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় না। দ্যা ফাদার চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যে এই চেষ্টাটা করাই হয় নি। তারা মূলতঃ শেকড়কেই আকরে ধরেছেন। বলা যায় নাটক থেকে দূরে যেতে চান নি চিত্রনাট্যকার ক্রিস্টোফার হ্যাম্পটন। বিভিন্ন বই থেকে চিত্রনাট্য রচনায় তারও যে মুন্সিয়ানা আছে সেটাই মনে করিয়ে দিলেন তিনি। কারণ এর আগেও এই চিত্রনাট্যকার ১৯৮৮ সালে রূপান্তরিত চিত্রনাট্যের জন্য অস্কার জিতেছিলেন ‘ডেঞ্জারাস লিয়াজোস’ ছবির চিত্রনাট্য লিখে।

একটা ঘরেই একজন বুড়ো মানুষ বারবার নিজেকে আর তার কন্যাকে নিয়ে বিভ্রান্ত হচ্ছে আর সেই বিভ্রান্তির ভেতর থেকে আমরা কেউ বের হতে পারছি না।

এবার আসি সিনেমার মূল প্রসঙ্গে। ছবিটা শুরুই হয় প্রধান চরিত্র অ্যান্টনির মেয়ের তার বাবার বাসায় যাওয়া দিয়ে। তারপর শুরু হয় পিতা-কন্যার গল্প। অসুস্থ পিতার সাথে কন্যার সম্পর্কের যে টানাপোড়েন, তা পুরো ছবি জুড়েই ছিলো উপভোগ্য। কিন্তু এর চেয়ে উপভোগ্য হয়ে উঠেছেন অ্যান্থনি হফকিন্স। মূলতঃ ছবি জুড়ে আছেই দুইটা জিনিস এক চিত্রনাট্য আর এক হফকিন্স এর অভিনয়। ৮২ বছর বয়সেও যে কী দুর্দান্ত তিনি। গেলো বছর ‘টু পোপস’-এ একাই রীতিমত টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন সিনেমাটা। এবারও তাই করলেন। একবার ভাবলেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়, যে একটা ঘরেই একজন বুড়ো মানুষ বারবার নিজেকে আর তার কন্যাকে নিয়ে বিভ্রান্ত হচ্ছে আর সেই বিভ্রান্তির ভেতর থেকে আমরা কেউ বের হতে পারছি না।

সেদিনও বলছিলাম, ভালো সিনেমার জন্য (যদি আপনি দর্শকের কথা বিবেচনা করতে চান) তাহলে সবার আগে প্রয়োজন ভালো চিত্রনাট্য। দ্যা ফাদার সিনেমাটাও যে সেরা এডাপ্টেড চিত্রনাট্য জিতছে এইটা গুরুত্ব দেই নাই কাল। আজ যখন দেখতে বসলাম, তখন মনে হলো আরে এর স্ক্রিপ্ট তো দুর্দান্ত! বসছি আর উঠা যায় না। দর্শককে ধরে রাখে! পরে ছবি শেষ করে দেখলাম, আসলেই এইটা সেরা চিত্রনাট্যের পুরস্কার পাওয়া ছবি।

অ্যান্থনি হফকিন্স এর সেরা অভিনয় প্রথম দিকে ঠিক তার মাপেরই মনে হয়। কিন্তু আস্তে আস্তে তার চরিত্র যত বেশি উপস্থিত হইতে থাকে আর দেখাতে থাকে তার কারিশমা। শেষ দৃশ্যে এসে যখন সে বলে I feel as if I’m losing all my leaves. The branches and the wind and the rain তখন মন খারাপ হয়। ভীষণ। ১৮ বছর আগে আব্বাকে হারানোর কথা মনে পড়ে। যেন এই বয়সে এসে আমার আব্বাও এমন হতে পারতেন।

Share.

ইলিয়াস কমল এর জন্ম ৯ মার্চ, ময়মনসিংহ। শিক্ষা : স্নাতকোত্তর। পেশা : সাংবাদিকতা।

Exit mobile version