আমাদের সুনামগঞ্জ এমন এক জনপদ, যারে হাওর বাওড় নদী নালা আঁকড়ে ধইরা আছে মায়ের মতন। ভাটি বাংলাকে যেরূপে আমরা দেখি, গানে ছবিতে মানুষের জীবনযাপনে। যেখানে দৈনন্দিন জীবনে একটু ফাঁকা সময়রে খুঁজে বেড়ায় এই হাওর পাড়ের উত্তরসূরিরা।

 

তখন ১৯৯০ সাল। সাদাকালো টেলিভিশনের যুগ ধীরে ধীরে অস্ত যাইতেছে। পাড়াঘরে হঠাৎ দেখা মিলে এই আজব বাক্সের। বাঁশের মাথায় এন্টিনা বাধানো বাড়িগুলোতে শনিবার আর শুক্রবারের দিনগুলো হৈ-হুল্লোড়ে জমে উঠতো। পাড়ার মেয়েরা বাংলা সিনেমার পাগল আর ছেলেরা দেখতো রেস্লিং । মায়েরা কাজ করতো ঘরে বাইরে, বাবাদের বিবাদে সুযোগ হতো না সবকাজ ফেলে রেখে একটু সিনেমা দেখার। তাদের প্রিয় শাবানা কিংবা ববিতার।

এই আনন্দের দিনগুলোতে চারদিকে তখন রব উঠে গেছে বাংলা সিনেমার। দুপুর গুলোর দৃশ্য ভুলে যাবার পথ নেই। আজ আমাদের তাড়িত জীবন কোথাও বসতে দেয় না, শুধু ফেলে আসা সময়কে উস্কে দেয়।

সেই সময়ের গল্প তুলতে গেলে উঠে আসে হাওর জনপদের একটি এলাকার নাম। লোককথিত, হাওরের রাজধানী খ্যাত ধর্মপাশা। আর এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে সিনেমাপাগল মানুষের আখড়া ‘বন্ধন’ নামে এক সিনেমাহলের নাম। আমি তখন ছোট। বয়স চার কি পাঁচ হবে। সেই ২০০০ সালে প্রথম সিনেমা দেখি এখানে। । তবে বন্ধন সিনেমাহল চালু হয় ১৯৯০ সালের প্রথম দিকে। প্রদর্শিত প্রথম সিনেমার নাম ছিলো ‘আলিফ লায়লা’

বিশেষ করে সিনেমা তৈরি হবার আগে এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান বিনোদনের উপকরণ ছিলো যাত্রা ‘ গ্রামে গ্রামে যাত্রাদল গড়ে উঠেছিলো। আর গ্রাম গুলো ছিলো গুচ্ছ গুচ্ছ। হাওরের এই বিপন্ন জীবনের ফাঁকে সুকৌশলে মানুষ গড়ে ফেলেছিলো তাদের আত্মবিলাসিতা’র মঞ্চ। জ্যোৎস্নার রাতে মালজোড়া গানে পাগল হইয়া শুনতো তাদের মন। রাতভর গাওয়া হইতো শাহ আব্দুল করিম, ক্বারী আমির উদ্দিন, রাধারমণ আর হাসন রাজার গান।সকাল হইতে হইতে হাওরে আবার শুরু হইতো নৌকা ও মাঝির কাজ, জল আর জালের বিস্তার।

পুরো হাওরে রটে গেছে এই সিনেমাহলের খবর। আলিফ লায়লা সিনেমায় সিনেমাহল ভর্তি মানুষ হয়েছিলো। উচ্ছ্বসিত মানুষেরা। এক অন্যরকম জগত তারা পেয়েছে। বাস্তবের চেয়েও আরো বাস্তবতার ভেতর বিশাল এক কালো পর্দায় ভেসে উঠলো “বিসমিল্লাহ রহমানের রাহিম” সাথে সাথে বাজতে শুরু করলো ‘জাতীয় সংগীত- আমার সোনার বাংলা ‘ হল ভর্তি সবাই উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। অনেকেই গলা মিলায়ে গায়ছে সেই গান।

সেই প্রথম সিনেমা দেখবার পর থেকে এই অঞ্চলে সিনেমার প্রবেশ বাড়তে থাকে। নব্বই দশক পরবর্তী মাস্টারক্লাস সব সিনেমা এই সিনেমাহলে মানুষ দেখেছে।

‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’ সিনেমা বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও ব্যাবসা সফল। হাওরে তখন বেদে পল্লী দেখা মিলতো অহরহ। এই দুই জনপল্লীতে একটা সম্পর্ক দৃশ্যমান, জলে ভেসে জীবন পাড়ি দেবার। সেই অর্থে সিনেমার মানুষ, দৃশ্য, জল, নৌকা, সাপ সবকিছুই পরিচিত। যেনো নিজেদের জীবনের সিনেমা। আনুমানিক তিনমাস প্রদর্শিত হয়েছিলো সেই সিনেমা।

নব্বই পরবর্তী সময়ে এখানে সিনেমা নিয়া মানুষের জীবনযাত্রায় বাস্তবিক অর্থে আলাদা প্রভাব সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি করেছিলো৷

ঠিক আজকে সেই বলয় ভেঙে আমরা কোথায় ঠেকছি তার এখনো হদিস মিলানো বড়ই কঠিন। সিনেমা দেখতে অতো মানুষ আসতো, যাতে করে বড় বড় জননেতাদের জনসভাও পন্ড হয়ে যাবার উপক্রম হতো।

আমার দেখা প্রথম সিনেমা ‘ছুটির ঘন্টা’ তখন টিকিটের দাম ছিলো আট টাকা। হলের ভেতর ‘ডিসি ও নরমাল’ নামে দুইটা শ্রেণী। লোহার চেয়ার আর কাঠের ব্রেঞ্চ। শো চালু হবে দুপুর বারোটায়। সবাই সেজেগুজে হাজির সিনেমাহলের গেইটে। যতোদূর মনে পড়ে পাড়ার সবাই, ধীরে ধীরে এলাকার সকলে মিলে একটা ঘরের মধ্যে ঢুকতেছি। আমি গেছিলাম মায়ের সাথে, সাথে ছিলো আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী। প্রায় সবাই পরিবার নিয়েই এসেছে হলে। বাহ!! দেখি পরিচিতদের আড্ডাখানা। ১০০ ওয়াটের লাইট জ্বলে আছে। বিশাল বড় একটা কাল পর্দা। আমরা যার যার সিট নিয়ে বসে গেলাম। সিনেমা শুরু। ছুটির ঘন্টা।

সেই সিনেমা দেখে হলভর্তি কান্নাকাটি ছড়িয়ে গেলো। যখন খোকন স্কুলের টয়লেটে আটকে, চিৎকার করে, খেতে না পেয়ে কাগজ ছিড়েখুঁড়ে খায় । কি নির্মম দৃশ্য!!! কেউ তার খবর জানে না। অথচ হলভর্তি সবাই জানে খোকন কোথায়। খোকনের মরণ, সিনেমা রেখে আমাদের জীবনে হারানোর বেদনাকে জন্ম দিয়েছে নতুন করে। সবাই চোখের জল মুছছে, সিনেমা শেষে আমাদের হৃদয় মলিন করে ঘরে ফিরলাম। সেই কান্নার শব্দ এখন সিনেমাহলে আছে কিনা আন্দাজ করতে পারবো না। তবে বিরলতর ঘটনা হল, এই সিনেমা দেখবার পরে আমাদের স্কুল গুলো আরো সতর্ক হয়ে উঠলো, বড় বড় ছুটির বিকালে স্কুল সার্চ করে সব তালা মারা হতো। আমাদের স্কুলে পোলাপান ভয়ে স্কুলের টয়লেটে যেতো না। আমাকেও ঘর থেকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলো।

প্রহেলা বৈশাখ, ঈদ ও পূজায় সিনেমাহল সাজানো হতো রঙিন কাগজ দিয়ে, বড় বড় ঝাড়বাতিতে আয়োজন করা হতো মুক্তি পাওয়া নতুন সিনেমার। পুরো হাওর অঞ্চল জুড়ে মাইক মারা হতো মুক্তি পাওয়া নতুন সিনেমা নামে। পোস্টারে পোস্টারে সব জায়গা ছেপে যেতো। সেইসব উৎসবের দিন কোথায় হারিয়ে গেছে মানুষের? সেই খোঁজ মানুষ আর রাখে না। বাংলাদেশের সেরা সেরা সিনেমাগুলো প্রদর্শন করা এই সিনেমাহল আমাদের বিনোদনের আখড়া, শৈশব মাতানো বড় পর্দা ঢেকে গেছে এই নতুন যুগে।

সবশেষ ২০০৮ সাল সিনেমাহল চালু থাকবার পর, এদেশ থেকে ক্রমে ক্রমে সিনেমাহলগুলো ধবংস করা হয়েছে। তার রেশে ধর্মপাশায় এই একমাত্র সিনেমার পর্দা সরিয়ে ফেলা হয়। হাওরের মানুষ এখন ছোট পর্দায়, মোবাইলের স্ক্রিনে সিনেমা দেখবার প্রযুক্তিতে প্রবেশ করেছে। আর ঐ দিকে বন্ধন সিনেমাহলের ভেতর থেকে উধাও হয়ে গেছে একসময়ের মনমাতানো কালোপর্দা। এখন হলে ঢুকে দেখা যায়, মাথার উপরে পুরোনো টিনের চাল নাই। খোলা আকাশ। যে খোপ গুলো দিয়ে লেজারের আলো এসে দৃশ্য নিয়ে পর্দায় পড়তো, সেই খোপ দিয়ে প্রবেশ করছে অস্তমিত সূর্যের আলো। পা তুলে বসে থাকবার লোহার চেয়ারগুলোর অস্তিত্বও নেই। সিড়িগুলো এখনো আছে স্মৃতির মতন। আর সমগ্র হল ভর্তি জেগে উঠেছে সবুজ গাছপালা। কিভাবে পরিত্যক্ত হয়ে যায় একটি জনবহুল জায়গা, তার নিখুঁত চিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হলের ভেতর। হাওর পাড়ের মানুষ হয়তো ভুলেই গেছে, এই অঞ্চলে একটা জাদুর বক্স ছিলো।

আমরা বোধহয় আর ফিরে পাবো না সেই দিন, সেই সময়। এই শংকা আরো ঘিরে ধরেছে,যখন বাংলাদেশের প্রায় সকল সিনেমাহল গুলো ধবংসের পথে। ধর্মপাশার বন্ধন সিনেমাহল এখন পুরোপুরি পরিত্যক্ত এক স্থাপনা। হয়তো এই পরিত্যাক্ততা নিয়ে আমরা ভাবছি না, এইভাবে কতো অস্তিত্বকে যে আমরা হারাচ্ছি, তা কি পুনরায় নির্মাণ করে এই হাওরাঞ্চলে মানুষকে সিনেমা দেখানোর স্বাদ ও সাংস্কৃতিক জীবনের শূন্যতা পূরণ করা যাবে?

Share.

জন্ম ১৯৯৫ সালে, হাওরভূমি সুনামগঞ্জের ধর্মপাশায়। আদিস্থানে ঘুরে বেড়াতে, গান গাইতে ও কবিতা লিখতে আর মানুষের সঙ্গ ভালো লাগে।

Exit mobile version