লখিন্দরের গান,কবি কাজী নাসির মামুন এর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। বইটি প্রকাশ করেছে লোক প্রকাশনা, একুশে বইমেলা ২০০৬ সালে।বইটির সুন্দর একটি প্রচ্ছদ করেছেন তৌহিন হাসান।৮০ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য ৭০ টাকা

লেখক মাত্রই মহৎপ্রাণ। জগতের প্রতিটি বিষয়ই লেখককে স্পর্শ করে। দীর্ঘকবিতা পাঠ করা ভীষণ কষ্টসাধ্য-ধৈর্যের পরীক্ষা, অথচ কবিতাটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠককের মনযোগ স্থির রাখতে পেরেছে। দুইশো আঠারো লাইনে পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজের নানাবিধ অসংগতি, অনাচার, পরাবাস্তবতা ইত্যাদির বাস্তব চিত্র উপমা ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মাধ্যমে উঠে এসেছে কবিতার পরতে পরতে। সমগ্র পৃথিবীজুড়ে মানুষের অগ্রহ-অকাঙ্খার সাথে প্রত্যাশার বিস্তর ব্যবধান এবং পৌরাণিক কাল, নিকট অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতকে স্পর্শ করেছে কাজী নাসির মামুনের লখিন্দরের গান। কবিতায় এত বাঁক, এত উপমা জড়িয়েও আপন গতিতে অগ্রসর হওয়া অবশ্যই সাংঘাতিক ব্যাপার।

 

বিশেষ কয়েকটি পৌরাণিক  শব্দের প্রয়োগ কবিতাটিকে অধিক মাধুর্য্যমন্ডিত করেছে। যেমন- লখিন্দর, নীলকণ্ঠ, বেহুলা, ময়ূরপঙ্খিনী, মথুরা, কৃষ্ণ, বিনোদিনী, কংস মামা, কানু, সনকা, দেরাদুন, গৌতম, মীনাক্ষী, রাম, সীতা, রাবন, যূথিকা, থিবিস, ইডিপাস, যীশু, জিন প্রভৃতি।

 

কতিপয় উপমা ও অলংকারের প্রয়োগও লক্ষণীয় – করুণা সঞ্জীবনী, পাতার বাহার, গমদানি, পানাফুল, তুফানবাহু, নদীর বিছা, ষোড়শী কুনেব্যাঙ, সাঁতালি পর্বত, চিন্তামণিঘর, কুলাকারিগর, অন্নের চিঠি, রোদের মাসি, সতীরা চাল, টিয়ার ঠোঁট, ভাতের বাজনা, বেকুব কপাল, সূর্যের তীলক, রৌণাক ফণা, কাঁকই বাসনা, পালঙ্কেমসন্ন্যাসী, তীর্থমৃতযোগ, শুল্কের বৈকুন্ঠ, স্কন্ধের শিলায়, সোনার রেকাব, গুপ্ত পুলসেরাত প্রভৃতি।

 

লখিন্দরের গান  কবিতার ভিতর দিয়ে সমগ্র মানবজাতিকে জাগরণের আহবান করা হয়েছে। কবিমন শান্তিকামী। ধরণীর মঙ্গলকামনা কবির অন্যতম আরাধনা। অশান্ত সময়কে কবি রিখেছেন- বোধিরা মরেছে আজ।

পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে আধুনিক সময়কেও কবি নিবিরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। সৃষ্টির আদিতে পৃথিবী ছিল বন্ধ্যা, অবিরাম বর্ষণে মাটির বুকে প্রাণের সঞ্চার হয়। পরিবর্তন ঘটতে থাকে পৃথিবীর পরতে পরতে। যেখানে প্রাণ আছে, প্রাণি আছে সেখানেই রয়েছে মমতা-ভালবাসা; সেখানেই রয়েছে দ্বন্দ-হানাহানি। অমরত্বের মোহ সবার মনেই কেউটের মতো অবিরাম ছোবল দিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। আপন মত প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের ইতিহাস পৃথিবীর বুকে চিরন্তন। সুন্দর পৃথিবীতে নিজের ভালবাসাকে জয় করতেই কালে কালে এত ভাঙা-গড়া।

রাজনীতি সচেতন কবি একজন লখিন্দরের আকাঙ্খায় বিভোর। যিনি একজন প্রেমিক, যে নেতার শূণ্যতা, নেতৃত্বের হাহাকার বিশ্বময়। চারপাশে ‘তুমি’ নামক ভালবাসার সঙ্গীর আকাল; জর্দা ছাড়া পান যেমন স্বাদহীন তেমনি তেজি পুরুষ ছাড়া লড়াইও নিষ্প্রাণ। কোন কালেই মানুষ জ্ঞান চাপিয়ে দেয়াকে সহ্য করেনি এবং পৃথিবী হটাৎ করেই অশান্ত হয়নি। সবাই কেবল মণি চায় অথচ উপদেশ গ্রহণের ক্ষেত্রেও আভিজাত্য ও কূল-মান নিয়েই মানবসমাজ বেশি চিন্তিত।

মানবতার মুক্তিকামী কবি নাসির মামুন এর ভাষ্যে- মানুষের কাছে সময়ও পর হয়ে যায়!  হাজার বছর আগেও পৃথিবী যেমন অশান্ত ছিল এবং ক্রমান্বয়ে অশান্তি বেড়ে শান্তি এখনও যেন মৃতপ্রায়। লোভের কাছে মৃত্যুও এক প্রহসন, এত এত হানাহানি দেখে স্বয়ং স্রষ্টাও বাকরুদ্ধ, অথচ প্রেম দিয়ে মৃত্যুকেও জয় করা যায়।

প্রেমের পূজারী কবির মনে- পৃথিবীতে কেবল প্রেমের শূণ্যতা, শান্তির উৎস প্রেম। প্রেমের কাছে সবকিছুই হার মানতে বাধ্য। অনন্তকাল বেঁচে থাকার বাসনা প্রতিটি জীবের মাঝেই বিরাজমান।

শ্রেণি-সংঘাতে আহত কবি হৃদয় উপলব্ধি করেন, আর্য অনার্যের ভেদাভেদ চিরকালের মতো আজও চরমভাবে দৃশ্যমান। সর্বত্র কেবল সম্পদ ও শক্তি কুক্ষিগত করার খেলা।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার কবি মনে করেন, স্বার্থের টানে সবাই যেন ইচ্ছার বিরূদ্ধে উল্টো দিকে মুখ করে হলেও বাম হাতে সম্মতি দিয়ে থাকেন। সেই চর্যার আমল থেকে আজও যেন যে বধুটি দিনের বেলায় কাকের ভয়ে ভীতু ভাণ করে, রাতের বেলায় সবার অগোচরে সে কামরূপ চলে যায়। সাধুরাও যেন দিনের পবিত্র দায়িত্ব রাতের আধারেই সম্পাদন করেন। ঈশ্বরও কেমন জানি অন্যায়গুলো দেখেও দেখেনা। শান্তি প্রিয় মানুষেরা যেন চিরকাল যাযাবর হয়েই চলতে থাকবে। শান্তিকামীদের রক্তের সাথে প্রহসন যেন নিয়ম হয়ে দাড়িয়েছে। শান্তিকামী আত্মাগুলোও খুব পরিশ্রান্ত, হতাশ। অদৃষ্টের দিকে তাকিয়ে হতাশ মুখগুলো।

তরুণ নেতৃত্বে আশাবাদী কবি কামনা করেন, কখনও ঐশ্বরিকভাবেও বৃষ্টির মতো মুক্তি আসতে থাকে, রোদে পোড়া দেহগুলো অবারও নতুনে স্বপ্ন দেখে সংগ্রামের সাথে করে আলিঙ্গন। সবার মুখে হাসি ফোঁটানো বিরামহীন লড়াইয়ে মগ্ন শোষিত হৃদয়।  পথে-প্রান্তরে, নগরে-বন্দরে সদা জাগ্রত প্রেমিক হৃদয়। লাখো নিরিহ-নিরপরাদ মানুষের হত্যার বিচার পায়নি শোষিতের পরিজন। শান্তির দূতেরা প্রান্তরে প্রান্তরে জেগে উঠেছে বিশ্বময়। তারা আবার সুখি পৃথিবী গড়তে আহ্বাবন করছে।

পৃথিবী চিরকাল লড়াই-সংগ্রামের স্বাক্ষ বহন করে, রে রে তুফান আওয়াজে সুসংবাদ আসতে থাকে। অশুভ শক্তি যতই ক্ষমতাবান হোক না কেন পরাজয় তাকে মানতেই হবে। শান্তিপ্রিয় সভ্যতার কাকুতি হাস্যকরভাবে উড়িয়ে দিলেও সাঁওতালি ঝড় শোষিতের বিজয়ে উল্লাসিত। আবার ক্ষমতা কখনও কখনও গৌরবময় অতীতকেও বিস্মৃত করে দেয়, যেমন- চর্যাপদ আমরা হেলায় ভুলে গেছি। গ্রামের শান্তিপ্রিয় মানুষের মাধ্যমে সমগ্র পৃথিবী জেগে উঠার কথা অথচ সাধারণ মানুষের মতামতকে তোয়াক্কা না করেই প্রতিনিধি বিজয়ী হয়। চোরেরা চেয়ারে বসেই তৈরি করে অসাম্য, পরিণত হয় ঘৃণায়।

অতীতের গৌরবময় অধ্যায় কবির মানসপটে এসে দাঁড়ায়, সবাই নিজের চাহিদা আর সম্মান নিয়েই মগ্ন, অর্থের পাহাড়ের চেয়ে বাৎসল্যের হাহাকার সাগরের চেয়েও গভীর। আপন কিঞ্চিৎ ধনের কাছে নত পৃথিবীর সকল ঐশ্বর্য। প্রেমকে বিজয়ী করতে শান্ত নারীকেও ঝড়ের সতো সংগ্রাম করতে হয়। মানুষ জানে সম্পদ চিরকাল এক হাতে থাকে না, সওদাগরের ধনের মতো সম্পদও দেশ-বিদেশে চোর-ডাকাতের মতো গুপ্ত-প্রকাশ্য সংগ্রামী।

 

একটি রোদের মাসি মায়ের পতাকা’র ন্যায় মায়ের চেয়েও বেশি দরদ নিয়ে ভোটের অগে হাজির হয় পেটুয়ার দল। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে কেউ কারও খবর রাখে না । দেশপ্রেমিক সেজে  বুর্জোয়া বাহিনী দেশীয় উদীয়মান প্রযুক্তি শিল্পগুলো ধ্বংস করছে অথচ বিদেশী কোম্পানীগুলোর মূলধন দিনেদিনে বেড়েই চলেছে। যেমন ধরাযাক, পশুর চামড়ার কোন দামই নেই অথচ চামড়ার তৈরী জিনিসের দাম কত বেশি? চোর গেলে বুদ্ধি বাড়ে ঠিকই কিন্তু লখিন্দরেরা ঘুমিয়েই যৌবন কাটায় ফলে নেমে আসে- নির্ঝরে অন্ধের হা-হুতাশ; শতশত জনবান্ধব প্রকল্প অথচ জনগণ পায় না সুফল। মুষ্টিমেয় কতক ষন্ডারাই ভোগ করছে লাখো লোকের অধিকার।সেখানে চতুর ধনী রাষ্ট্রগুলো মিডিয়ার বাহবা কুড়ায়।

 

বিশ্বরাজনীতি পর্যবেক্ষণকারী কবি আহত হৃদয়ে উপলব্ধি করেন, বিদেশীদের ভিক্ষার টাকার প্রলোভনে একে একে বন্ধ হতে থাকে দেশিয় শিল্প। নতুন অরেক ভেলকি সামনে হাজির করে দেশিয় ক্ষমতা হ্রাস করে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে বিনদেশি হায়ানা। মৌলিক অধিকার আর সহায়তার নামে জনগণকে বানরের মতো অবিরাম নাচায়, সর্বস্বলুটে বাহবা কুড়ায় বিদেশি দুষ্টুচক্র। সাগরের লোনা জল দিয়ে তৃষ্ণা মেটাতে বলে চতুরের দল। করের উপর কর আরও কর দেশিয় অর্থনীতিকে বার বার গুড়িয়ে দিচ্ছে যেমনটি করেছিল নীল চাষিদের সাথে। তারপরও সকল ঔপনিবেশিক শক্তিকে হার মানিয়ে জয়ী হয়েছিল শান্তিপ্রিয় কৃষক জনতা। তালগাছ নীরবে বেড়ে উঠে এবং ঝড়ের সাথে লড়াই করেই বীরের মতো টিকে থাকে, মুক্তিকামী জনতাকেও সমূলে বিনষ্ট করা যায় না।

 

ইতিহাসের অলোকে কবিও একমত- পৃথিবীর সভ্যতার বিকাশ কৃষির মাধ্যমেই। নারী ও পুরুষের যৌথ সংগ্রামের মাধ্যমে শুষ্ক মাটির বুকেও ফসল ফলেছে। সূউচ্চ পর্বত থেকে মেরু পর্যন্ত কৃষির বিকাশ। নারী ও পুরুষের সমন্বয়েই সমাজ। শুধু পুরুষ সংগ্রামী হলে সমাজ অগ্রসর হবে না, নারীকেও সমান ভূমিকা রাখতে হবে।

 

রাক্ষসী সভ্যতার ক্ষুধা গিলেছে সবুজ-শ্যামল প্রকৃতি আর জীবন দানকারী নদীগুলোকে। যতোই উচ্চাকাঙ্খা মানুষকে তাড়িত করুক না কেন শেষ পর্যন্ত মাতৃভূমিই স্বর্গের সুখ দিয়ে থাকে। নিজস্ব ঐতিহ্য হারিয়ে অপসংস্কৃতিকে লালনের মাধ্যমে শান্তি বিনষ্ট করে দেশকে।

সেই স্বপ্ন দেখার সাহস কি কাজী নাসির মামুন  ফিরে পাবেন?

সুপ্রাচীন কাল থেকে শুরু করে আধুনিক কাল পর্যন্ত মানুষের খাদ্যের যোগান হয় কৃষি থেকে। মাছে-ভাতে বাঙালির সরল জীবন ক্রমেই পুলসেরাতের মতো দূরত্ব ও কঠিনতর হয়ে উঠছে।

তাইতো কবিকে বলতে শুনি‘সমুদ্র কখনও লিখবে না লবন প্রার্থনার দিনলিপি’।

Share.

ফোকলোর গবেষক, জন্ম ও শৈশব মুক্তাগাছায় পড়ালেখা: বিএ (সম্মান), এমএ (ফোকলোর বিভাগ), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

Exit mobile version