কবিতা কখনো স্থানিক বিষয় নয়। একজন  নিভৃতচারী কবির লেখা কবিতাও  আন্তর্জাতিক মানের হয়ে উঠে। যাপনের  চারপাশটা  তখন হয়ে উঠে বৈশ্বিক। সৌহার্য্য ওসমানের ‘জলঘুমে অথরা’ কাব্য গ্রন্থে বিষাদ ও দুঃখবোধ আছে । সেই দিক দিয়ে  ওসমানের কবিতায় বেদনার শিল্পরূপ বিষাদের রেশ ধরে কিছু কিছু জায়গায় হৃদয় খুঁড়ে খায়:
‘গারদের ভেতর লোহার খাঁচা ধরে থাকে
যে লোকটা
সে-ও আকাশের পায় না স্বাধীনতা!’
কবিতো ভাষার মাস্তান। আবার ভাবি  সে তো ভাষার গাছ-
সেই মর্মর পাতাদের সুর! কখন, কোথায় টুপটাপ
ঝরে যায়…
সেই অর্থে কবি সৌহার্য্য ওসমানের ভাষা ও ভঙ্গি
দূর কোন প্রান্তরের হুল্লোর। আহা কী চিত্ররূপময়:
‘নালিখালি একটা গ্রাম
দূরে ভেঙে পড়ে পাতার বিমান’
বরং ওসমানের কবিতায় ‘আমি’ র স্বয়ংপ্রকাশ যেন আমাদের হৃদ্যতার কাছাকাছি থেকে যায়। এই থেকে যাওয়াটা হয়তো অনেক প্রকারের। মানুষ যা সারাজীবন, টানতে চায়।
‘অথরা এমন তো আর সম্ভব নয় যে
প্রদীপ্ত দুপুরে তোমার লাজুকতার
অনন্ত পুচ্ছ নাকে এসে ছড়ায়
আর আমি বিস্মিত হই
সেই গন্ধের অপেক্ষায়-‘
সমকালীন অনুষঙ্গ সময়ের অভিঘাতে কীভাবে ‘জ্যান্ত’ হয়ে উঠেছে কবির ভাষায় তা দেখা যাক:
‘রোদ সিগন্যালে টুপি পরা ট্রাফিক জ্যাম
যেন কন্ট্রোল রুম পেরিয়ে মধ্যবেলা
নির্ভরতার একদিন ফেরি হয়ে যায়’
আবার নির্জন রাতের পথে পথে কবি নিজেও যেন ঘনিষ্ট জীবনযাপন  করেছেন- কবিতার বাঁকে বাঁকে।  সেই ইমোশন বা অনুভূতি কবিতায় খুঁজতে গিয়ে আমি পেয়েছি বিষাদ_
‘শূন্য এ শহর চোখ মেলে ঝিমায়
ঝিমিয়ে জ্বলে সিরাজুলের চায়ের চুলা
শত চোখে রাতের তারা ফোটে ভোরের আশায়
ক্ষুধার থালায় হাত মেলে ধরে বাজারের সবচেয়ে
প্রবীণ পুরুষ-‘
কবি জাদুকর, শব্দের। তাই শব্দ দিয়েই কবিতায় হয়ে উঠেন পারঙ্গম। এইসব কথামালার মধ্যে থেকেও কবিতায় উপাদানের ভেল্কি দেখান। নাড়িয়ে চাড়িয়ে অতীত আর বর্তমানের পটভূমি আঁকেন। কবিতার বুকে কান পেতে শোনেন-  গুপ্ত কোন কলরব। খুঁজে ফেরেন কতদূরে স্মৃতিরা হয়ে আছে উন্মুখ। ঠিক তখনিতো কবিতাও হাঁটে কবির ঘোরের ভেতর । ফলে প্রকৃতির গুঞ্জন কবি কখন, কিভাবে শোনবেন-  সেকথা বলা যায় না। তবে হ্যাঁ কবিতা জ্ঞাত-অজ্ঞাত একটা পথ_
‘তোমাকেই মনে মনে
মনে ধরে; মনে হলো
বৃষ্টির চেয়ে ভালো কিছু
যেন নেই পৃথিবীতে’
‘জলঘুমে অথরা’ কাব্যগ্রন্থের নামকরণের দিকে তাকালে, অথরা তার কল্পনা প্রসূত মনে হয়। অথচ পাঠকের ভুবনে অথরা নামের কোন অর্থ দাঁড়ায় না। তবে আমি মনেকরি অথরা  কবির মনের গহনে একটি নারীর ছায়াপাত এবং  তা উন্মোচনের মধ্যেই  পর্যবসিত।
‘জলঘুমে অথরা’ এমন একটি বই যেখানে পাঠক  মূলত পাঠের ভ্রমণ থেকে  উপলব্ধির স্পর্শ পায়। এখানে একটা পৌনঃপুনিক সম্পর্কও দৃশ্যমান। যদিও ‘জলঘুমে অথরা’ নান্দনিক আনন্দে আমার মননকে আলোড়িত  করতে পারেনি।  তাই এখানে বলে রাখা ভালো নান্দনিক আনন্দ বলতে আমি বুঝাতে চাচ্ছি, সুন্দরের সঙ্গে শুধু কবিতার বসবাস এমনটি নয়।
ওসমানের একান্ত অনুভবের জগৎ থেকে উঠে আসা দৃশ্যপট, বেদনা ও পবিত্রতায় মিশে আছে  নীরবতার পালক।
তার যাপনের আয়নায় ব্রহ্মপুত্র, পানের বরজ, মরা গাঙ, মাইনকার চর, শাপলার বিল, ঋষিপাড়া হয়ে অতঃপর মেইনরোড নিবেদনের কথায় এই যে সতেজ ভঙ্গিমার প্রকাশ,সেখানে  আমাদের শিল্পের স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের কথাই যেন মনে করিয়ে দেয়।
‘শব্দেরা মিশে যায়
মানুষ যতদূর না যায়
তার অধিক প্যারালাল পথ’
Share.

কবি ও সম্পাদক জন্ম ৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৯, ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছায়। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থঃ বিষণ্ণ স্নায়ুবন (২০২০), "দূরে, হে হাওয়াগান" (২০২১) সস্পাদিত ছোট কাগজ : মেরুদণ্ড।

Exit mobile version