মৈত্রেয়ী দেবীর ‘ন হন্যতে’ – উপন্যাসটিকে বলা হয়েছে, অকাদেমী পুরস্কার প্রাপ্ত এ কালের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। বাংলা করলে ‘ন হন্যতে’-এর অর্থ দাঁড়ায় হত্যা করা যায় না বা নিহত হয় না এমন কিছু। মানবত্মার আধার যে মানব শরীর তাকে হত্যা করা যায় কিন্তু আত্মাকে যায় না। উপন্যাসটিতে আসলে লেখিকা আত্মার অমরত্বের পাশাপাশি প্রেমের অমরত্বের কথা বলেছেন। ‘ন হন্যতে’ বাংলা ভাষায় (উভয় বাংলায়) বহুল পঠিত স্মৃতিচারণ মূলক এক অসামান্য উপন্যাস।

উপন্যাসের স্মৃতিচারণ শুরু ১লা সেপ্টম্বর ১৯৭২, অমৃতার জন্মদিনের উৎসব থেকে। এরপর সে তার সবটা দাম্পত্য জীবন পার করে দেয় স্মৃতি চারণ করে। স্মৃতিগুলো আসে একটার পর একটা দৃশ্যের আকারে নানা ঘটনার পরম্পরায়।

‘ন হন্যতে’ সম্পর্কে একটি গল্প প্রচলিত আছে। উপন্যাসটির আলাদা যে আকর্ষণ তা ওই আসলে গল্পটার কারণে, যা এখন কিংবদন্তি । গল্পটা হলো, ভারতীয় একটি মেয়ে বিদেশি এক সাহেবের প্রেমে পড়ে। এরপর প্রেমে ব্যর্থ হয়ে সাহেব দেশে গিয়ে ‘লা নুই বেঙ্গলী বা বাংলার রাত’ নামে একটি বই লিখেন – কিন্তু বইটিতে সাহেব যা লেখেন সব সত্য নয়। সাহেব লিখেন, তাদের প্রেমের এক পর্যায়ে, রাতে রাতে তার প্রেমিকা তার ঘরে চলে আসত… তাদের মধ্যে স্থাপিত হতো শারীরিক সম্পর্ক। সাহেবের এই দাবী মিথ্যে, এই সত্য প্রতিষ্ঠা করতেই পাল্টা আরেকটি বই লেখেন ভারতীয় মেয়েটি। সে বইটিই হলো ‘ন হন্যতে’, এক অসামান্য প্রেমের কাহিনী।” প্রচলিত এ গল্পটা শুনে নামের অর্থ না বোঝেও অনেকেই বইটা কিনেন। লেখিকার অসামান্য দক্ষতা এবং মুন্সিয়ানার কারণে ব্যক্তিগত প্রেমের কাহিনী উপন্যাসে উপস্থাপিত হয়ে, হয়ে গেছে সার্বজনীন।

বাক্য বিন্যাস অতি সাধারণ, শব্দ চয়ন শাদামাটা অথচ বক্তব্যে উপস্থাপন কত গভীর, হৃদয় গ্রাহী। ফলে পাঠক ‘ন হন্যতে’ পড়তে শুরু করলে সব কিছু ভুলে যায় এর আকর্ষণ ক্ষমতার জন্য।

মির্চা ইউক্লিড চাকরি করতে (Noel & Noel কোম্পানির প্রতিনিধি হয়ে) ভারতবর্ষে এসে অনেকটা লজিং-এর মতো আশ্রয় পায় তারই ভারতীয় বস (বা শিক্ষক) বিজ্ঞানী নরেন্দ্র সেনের ভবানীপুরের বাসায়। সেটা ১৯২৯ সাল (লা নুই বেঙ্গলী, মির্চা এলিয়াদ), সে সময় ভারতীয় কোনো পরিবারে কোনো খ্রিশ্চান অর্থাৎ যবনের আশ্রয় ছিল খুবই অকল্পনীয় ব্যাপার। কিন্তু বিজ্ঞানী নরেন্দ্র সেন কুসংস্কার মুক্ত মানুষ, তাঁর কাছে জাত-পাতের চেয়ে মানুষ আর কর্তব্য বড়। তাই তিনি নিঃশঙ্ক চিত্তে আশ্রয় দিলেন মির্চাকে। বিজ্ঞানীর মেয়ে অমৃতা কলেজ ছাত্রী, ভাবুক, কবি। তার কথা-বার্তায়, চাল-চলনে কিছুটা দার্শনিকতা প্রকাশ পায়। অল্প বয়স্ক মেয়ের এমন আচরণ মির্চার মধ্যে যার পর নেই বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। একদিন সেই মেয়েটিকেই ফ্রে ভাষা শেখানোর দায়িত্ব পড়ল মির্চার ওপর। আর মেয়েটিকে দেওয়া হল মির্চাকে বাংলা শেখানোর দায়িত্ব। এভাবেই দু’টি ভিন্ন সংস্কৃতির, ভিন্ন সভ্যতার যুবক-যবতীর পরস্পর কাছে আসার সুযাগ ঘটে। আর তাদের চেহারার গড়ন, শারীরিক মানসিক বিশেষ বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি কারণে পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ হয়ে উঠে দুর্ণিবার। যদিও প্রথমাবস্থায় দু’জনেই নিজেদের সভ্যতা, সংস্কৃতিকেই বড় মনে করত। কিন্তু একে অপরের প্রতিটি আচরণে গভীর টানও অনুভব করত। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, অমৃতা একটি বদ্ধ সংস্কৃতির যুবতি আর মির্চা উন্মুক্ত সংস্কৃতির যুবক, ফলে সুযোগ পেলেই মির্চা তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে দ্বিধাহীন আর বিপরীতক্রমে অমৃতা নিজেকে নিয়েছে গুটিয়ে। ফলে আকর্ষণ বহুগুণে বেড়েছে, আর কাছাকাছি অবস্থানের ফলে আকর্ষণ রূপ নিয়েছে কামনায়। আবার তাদের সাংস্কৃতিক বৈপরীত্যগুলোই হয়ে উঠে উভয়ের কাছে প্রিয় প্রসঙ্গ। যেমন অমৃতা প্রথম ভালোবেসেছে একটি গাছকে। ‘ফাস্ট শী লাভদ এ ট্রি (First she loved a tree)’। পরবর্তী সময়ে এ কথা বলে মির্চা প্রায়ই অমৃতাকে ঠাট্টা করত। আসলে বড় প্রেমের ক্ষেত্রে প্রেমিক- প্রেমিকার কোন আচরণটি মধুর-স্মৃতি হয়ে থাকবে প্রথমেই কেউ বলতে পারে না। কখনো ছোট্ট একটি আচরণ অনেক বড় হয়ে হৃদয় জুড়ে বসে থাকে। মৈত্রেয়ী দেবীর লেখায় ছোট-খাটো বিষয়গুলোর উস্থাপন সাধারণ হয়েও এত শৈল্পিক যে, এর তুলনা পাওয়া ভার। যেমন ইউক্লিডের দেশ থেকে যখন সেরগেই সেবাস্টিন এলো তার সঙ্গে দেখা করতে, সাধারণ মেয়ের মত সে কিছুটা সাজগোজ করল। তার তখন মনে হচ্ছিল, চেহারাটা আমার পুরানো হয়ে গেছে বটে, কিন্তু মন? মন যে মির্চার কথা জানতে চাচ্ছে। সাক্ষাতের পর সেরগেই যখন বলল, তোমার প্রথম কবিতার বইটা আমার কাছে আছে,…

অমৃতা জানতে চাইল, ওটা যে আমার বই কি করে জানলে?
সেরগেই বলল, তুমি বইটার শেষ পৃষ্ঠায় তেরছাভাবে লিখেছিলে, Mircea, Mircea, Mircea  I have told my mother that you have only kissed me on my forehead.

এই বইয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। কখনও অমৃতার বাবা, অমৃতা আর মির্চা গেছে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে। কখনও অমৃতা একাই। রবীন্দ্রনাথের প্রতি অমৃতার ভালোবাসা মির্চাকে ঈর্ষান্বিত করেছে। গাছের প্রতি ভালোবাসাও তাকে ঈর্ষান্বিত করেছে। একবার তো মির্চা বলেই ফেলল, একজন সত্তর বছরের বৃদ্ধকে তুমি এতটুকু মেয়ে এত ভালোবাসো কী করে? মির্চা ভেতরে ভেতরে অমৃতার এ ভালোবাসাকে মনে করত ন্যাকামি।

বইটার একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর গানের, কবিতার উদ্ধৃতি। যেমন আমার মনে গুনগুনিয়ে গান আসছে, ‘চক্ষে আমার তৃষ্ণা, তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে’ রবিঠাকুরের মত সুন্দর করে আর কোথাও কোনো লেখক মনের কথা বলতে পারেন না। অমৃতার মূল্যায়ন। বইটিতে লেখিকা ইংরেজি এবং সংস্কৃত ভাষার (যেমন- মেঘদূত) বহু কবিতা ও শেষাংশ ব্যবহার করেছেন, যার জন্য কাহিনী হয়ে উঠেছে গতিময় এবং বিশ্বস্ত। যেমন-

“মোতিম হাওে বেশ বনাদে, সিঁথি লগাদে ভালে
উরহি বিলম্বিত লোল চিকুর মম বাঁধহ চম্পক মালে।”

বইটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথাও আছে। সীমান্তের অপর পাড়ে শরনার্থী শিবিরে কলেরায় শতশত লোক মারা পড়েছিল তাদের কথা আছে।

উপন্যাসটির ডিটেলস খুবই চমৎকার, অমৃতার দার্শনিক সূলভ ধীর স্থির আচরণ সবারই মন কাড়ে। অর্থাৎ নারী চরিত্র হিসেবে অমৃতা অনন্য। অপরদিকে, মির্চা ডানপিঠে, সে বরাবরই চেয়েছে যেভাবেই হোক অমৃতাকে নিজের করে পেতে। প্রথম দিকে অমৃতা তার বাবার কথা ভেবে রাজি হয়নি। সে তার বাবার উঁচু মাথা নিচু করতে চায়নি। মির্চার বাড়াবাড়ির কারণে এক পর্যায়ে মি. সেন মির্চাকে অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। এরপর দূর থেকে তাদের মধ্যে পত্র বিনিময় চলতে থাকল। শেষমেশ যখন সে মির্চার জন্য সবকিছু ত্যাগ করতে রাজি হলো মির্চা গেল বদলে। অনেক চেষ্টা করেও মির্চাকে সে সঠিক পথে ফেরাতে পারল না, ফলে তার সঙ্গে তার পক্ষে আর যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। উপায়হীন হয়েই রক্ষণশীল স্বভাবের অমৃতা নিজের লেখা চিঠি ইজ্জত-সম্মনের কথা না ভেবে তুলে দিয়েছে এক ফুফাত ভাইয়ের কাছে। এই সুযোগে সে ভাইটি করেছে বেঈমানি। তার একটা চিঠিও পৌঁছে দেয়নি মির্চার কাছে। কিংবা মির্চার চিঠি তার কাছে। এভাবেই শেষ পর্যন্ত চিরকাক্সিক্ষত প্রেমের পরিণতি হলো চিরবিচ্ছেদে।

মির্চা দেশে ফিরে গেল এবং সেখানে সে পড়াশোনা করে মস্ত বড় প-িত হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক হলো। তার খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। আর শেষ জীবনে অমৃতা তার সঙ্গে দেখা করতে গেল ইউরোপে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিন্তু মির্চা ততদিনে অন্ধ হয়ে গেছে। তাদের সে সাক্ষাতের দৃশ্য আমাদের চিত্তকে এত আলোড়িত করে যে, সারা জীবন তা ভোলার নয়। অমৃতা বলছে “জান, লোকে আমায় জিজ্ঞাসা করে কতদিন তুমি আমাদের বাড়িতে ছিলে- আমার মনে পড়ে না – কতদিন ছিলে বল তো?”
“হাজার বছর-”।

“তবে?… আমি তো সেই তোমাকেই দেখতে এসেছি যাকে Weapon cannot pierce, fire cannot burn
ও সংস্কৃততে বললে,“ ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে-”…..

“একটু দাঁড়াও অমৃতা-… এতদিন এত সাহস দেখিয়ে এখন তুমি ভেঙে পড়লে কেন? আমি বলছি, আমি যাব তোমার কাছে, এখানে নয়, সেখানে গঙ্গার তীরে আমার সত্যরূপ তোমাকে দেখাব…।”

মৈত্রেয়ী দেবী তাঁর উপন্যাসটির শেষ বাক্যটি পর্যন্ত পাঠকদের ধরে রাখেন, ‘‘যেদিন ছায়াপথে তোমাদের দেখা হবে, তার তো আর বেশি দেরি নেই।”

এখানেই লেখিকার সার্থকতা।

Share.

কবি, ঔপন্যাসিক ও অনুবাদক। জন্ম ০৭ জানুয়ারি ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর। অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর। সরকারি চাকুরি কে তিনি ২০১৭ সালে ইস্তফা দেন। দর্শন ও বিশ্বসাহিত্য তাঁর আগ্রহের প্রধান বিষয়। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১১ টি। 

Exit mobile version