কবিতায় মূলত মননের নান্দনিকতায় ভিন্ন ভিন্ন চিত্রকল্পে পাঠকের মন তার নিজের মন করবার চেষ্টাই হয়ত থাকে, সাথে আঙ্গিকের মেটাফোর চিন্তাকে আরও আরও নৈর্ব্যক্তিক করে তোলে। সৌহার্য্য ওসমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোতে তিনি বৈশ্বিক হবার চাইতেও, বেশি স্থানিক হয়ে উঠেছিলেন। সময়ের স্বরের সাথে সাথে পরিপার্শ্বের দেখবার চোখকে পাঠকের কাছে হাজির করেছেন, পরিচিত জায়গা, নন্দনতত্ত্ব ও ভাবনাকে। পাঠক সরলভাবে কবিতায় যে চিত্রকল্প খুঁজেন, কবি যেন সমস্বরকে সমসুরে রুপান্তর করেছেন তার কাব্যিক বয়ানে। পাঠক কবিতায় আলাদা করে ফিলোসোফিকে খুঁজতে গিয়ে হোচট খেতে পারেন। এটি একান্তই আমার ভাবনা, এটি অতিক্রম করে পাঠকের ভিন্নতর বয়ান হাজির হলেও আমার আশ্চর্যের কিছু নাই বরং আমার দেখবার সীমাবদ্ধতা টের পাব।
পড়ছিলাম সৌহার্য্য ওসমানের কবিতা। একের পর এক কবিতা, ক্লান্তিহীন পড়ে যাচ্ছি। কি খুঁজতে চাচ্ছি, তা মনে নেই, শুধু কবিতা পড়ছি আর কবিতা পড়ার আনন্দে পড়ে যাচ্ছি। কবিতায় যে সরল কাব্যময়তায় গভীর এক জীবনানুরণন তুলে আনা যায়, তা কেবলি আমাদের আশপাশকে এক ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপনের স্পর্ধা এখানে। কবি কি তার সময়ের গভীর নিঃশ্বাস টের পান?
“মধ্যরাতে শহর লুটিয়ে পড়ে ব্যস্ত পাড়ায়
নিশাচর দরিচারআনী বাজারের ওপর
মলম গাড়ির পেছনে দৌড়ায় জমাওয়ালার
লাল বাহিনী-
ঝােড়াে বৃষ্টির রাতে সব, সব তার উড়ে যায় গলিটার মুখে
ছুটে চলে ঢাকার জীবন”
হ্যাঁ, পান। আমরা আমাদের পরিপার্শ্বকে যেভাবে অবহেলায় দেখি, কবি দেখেন এক চিত্রকল্প হিসেবে। তিনি বাজার অর্থনীতি, সংসার,যাপনের অসংলগ্নতাকে পরম পুলকে হাজির করেছেন। সৌহার্য্য ওসমান তার স্বভাব সুলভ প্রতিবাদ অক্ষরে বন্দি করেন, এভাবে—
“সে রাত কেবলি আহত করে
তখন ধবংসের নৌকা দেখতে দেখতেই
নাফের সব জল রক্ত হয়ে যায়”
বৃক্ষের সাথে আমাদের আত্মিক সম্পর্ককে আমরা যেভাবেই দেখি, কবি দেখেন পাতায় পাতায়। পাতাদের কথা কিংবা নিঃশ্বাস দূরত্বে অথরার ঠোঁট। কবির কবিতায় যেভাবে একটি বাঁক, একটি মোড় যাদুবাস্তবতায় ধরা দেয়,সেভাবে নতুন বাজার এক কাব্যিক ধ্যানমগ্নতা নিয়ে দাঁড়িয়েছে।
“অথরা তোমার ভেতর খুলে দাও
ঢেলে দাও সবুজ নতুন বাজার”
কবি তার ‘আয়োজন’ কবিতায় স্থির বিরহী অথরার আত্মায় যেন কল্পনার বেদনার ক্ষত অ-সুখ হয়ে পোড়ে।
“পড়শির পৃথিবীতে আজ আলোক আয়োজন
বিভাজনে বাগান বিলাসী ফোটা বিড়াল দেহটা
ঘুরতে থাকল, ধোঁয়া আর মিষ্টি
পানের সুপারি বাতাস ঘিরে-”
ধোঁয়া আর মিষ্টির আদলে নিজেকে নিশ্চয়ই পাঠক সেই অনুক্ষণ পাবেন, যেখানে জড় বস্তুর উচ্চতা নিজের সমান হয়ে উঠে।
“যে জল শুষে ঢলুয়াবিল মরে যায়
সে জলে আমি ভাসাব না গা আমার
যে কোন বর্ষার শব্দ নেমে এলে
মনে হয়
প্রতিটা বিল মানেই একটা গল্প।”
দেশীয় বিশ্রী শ্লোগান আর মেট্রোপলিটান পুঁজির অসহায় সমর্পন একেকটা বিলকে একেকটা অধ্যায়ের সাথে মিশিয়ে ফেলা যায়। সকলের অব্যক্ত কথাই তার কবিতার নতুন চিহ্নায়ন।
“অথরা তোমার স্পর্শে স্পর্শে ফুটুক
পোড়া চাঁদ, পোড়া ঘর
পোড়া গোয়ালের সব কটি গরু”
‘জেগে ওঠো’ কবিতায় কবি হালকা ঢঙে কোথাও কোথাও যে অনুতাপ পাঠককেও ভাবিয়ে তোলতে বাধ্য করবে।
‘রবিবার’ কবিতাটি পড়ি —-
“হর্ষ-বিষাদে ভরা রবিবার
বিষন্ন স্পর্শে নয়া গ্রাম থেকে
বউয়েরা নাইয়র আসে গতর ভিজায়ে
পোড়া মরিচের গন্ধে ভূত পালিয়ে যায়
পালায় সেসব প্রাচীন হিসাবের খাতা থেকে
জীবন যেখানে মুন্সিগিরি আবার কখনো
লাল মলাটে হারায়”
কবিতাটি পড়ে পাঠক হিসেবে আমারও খুব করে সেই কবেকার কথা, গ্লোবালাইজেশনের থাবায় হারাতে বসা সময়, যখন কবিকে আচ্ছন্ন করে তার বিন্দুকণাও যেন ভিন্ন চিত্রকল্প দেখায়।
কবির বিভিন্ন কবিতায় মফস্বলের ছাপ স্পষ্ট, সেটা ভালোলাগার মাপকাঠিতে না মেপে কবি বরং নন্দন আর ফিলোসোফির উচ্চতায় স্থাপন করবেন বলে আশার বিন্দুকে একটা আলোক সম্ভারে আনয়ন করবেন।
পুরো কবিতার বইটিতে এইরকম স্থানিক চিন্তাকে কবি পৌঁছাতে চেয়েছেন সীমার বাইরে। তিনি চিন্তার ভেতর ফোটাতে চেয়েছেন একটা নান্দনিক গল্পের আখ্যান। তবে শুধু নন্দনের বিবেচনা আর পরিপার্শ্বের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাঞ্জন কবিতাকে উচ্চতার ব্যাসে আরও ব্যাপ্তি আশা করে, সেক্ষেত্রে কবি তার পরবর্তী কবিতাগুলোতে নিজস্ব দর্শনের সাথে সাথে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রক্ষেপনের দিকে দৃষ্টিপাত করবেন বলে আশা রাখি।
যাপন যদি শুদ্ধতা খুঁজে তবে কবিতা কেন নয়! তেমনি আলোর মিছিলে সামিল হয় প্রান্তিক দৌড় বা ঢলুয়াবিল। কবির কবিতায় পরিপার্শ্ব জ্বলজ্বলে উপস্থাপিত হলেও,সর্বজনীন পৃথিবী আরো উদারভাবে আসতে পারতো। তবে কবির মুন্সিয়ানা মানুষের ভেতরের বৈকল্যকে নিপূনভাবে হাজির করেছেন বিভিন্ন কবিতায়।
কবি সৌহার্য্য ওসমান, আরো আরো উজ্জ্বল স্পর্ধা নিয়ে হাজির থাকবেন আগামীর সকালে।