পৃথিবীর সব ফুল একদিন শুকিয়ে যাবে। এই সত্য জেনে গেছি আমি। তবু বাড়ন্ত আকাশের দিকে হাত বাড়াই। এইটা স্বপ্ন না কি ইত্যাবসরে আমার দেখা হয় না কোনো ফুলের সাথেই। কাগজের ঠোঙা ভরিয়ে ফেললাম খড়কুটো দিয়ে। সন্ধ্যার গায়ে কালোজামা দিয়ে আকাশ নিজেকে গোটাচ্ছে। পৃথিবীর সব হরিণ একদিন শিকারীর দিকে প্রেম নিয়ে ধেয়ে যাবে। যে প্রেমগুলো আমার দিকে ছুঁড়ে মেরেছিলো, তার স্মৃতিচিহ্ন আজও পাঁজরে লেগে আছে।

হারানোর উপাখ্যান বেশি থাকে যাবতীয় পুস্তকের পাতায়। আর গাছের পাতায় লেখা থাকে প্রাপ্তির প্রণালী; তাতে ভার বেশি হলে সরবে বা নীরবে চোখের জলের মতো ঝরে যায় শীতের শেষে।

একদা হরিণীর খোঁজে শিকারী সেজেছিলাম, বুমেরাং গুলি পাঁজরের ভাঁজে এখনো নিখোঁজ!

ভাই ও বোনেরা আমার, নিজের সম্পর্কে বলি আমি এক আততায়ী, অরণ্যের জ্ঞাতি।

(অরণ্যের জ্ঞাতি)

বিবাহিত মোরগের হাতে বাজারের ব্যাগ ধরিয়ে এক সকালে বিনয় চলে গেল। তারপর নগর থেকে লাল পাহাড়ের দিকে নাতিদীর্ঘ ভ্রমণ। এই লাল পাহাড়ের যেন কী নাম! ধিয়াং বলছেন, হোয়াট মাই নেইম ইজ! আমি তার জানি না কিছু। সময়ের জামা খুলে নিস্তরঙ্গ সকালে আমি সূর্যের বাড়ি পাহাড়া দিই। আমার প্রেম শুধু এক জোনাকীর সাথে। ওর, আলো নিয়ে, ভালো হয়ে, ধিয়াং ছোঁয়াব আর জীবনবাবুর শঙ্খ দেখাব; অথবা উড়ে যাওয়া চিল…

আমার ভ্রমণ মানে সঞ্চিত ছুটিতে পাহাড়ে পিকনিক আর নতুন শার্টের বিমোহিত ঘ্রাণ যেখানে প্রতিদিন জমা হয় সময় ও সুযোগ হারানোর নাতিদীর্ঘ গল্প।

(নাতিদীর্ঘ ভ্রমণ)

শুকনো গাছের মাথায় টোপর পড়াল কে সবুজ আর হলুদরঙা টোপর থেকে বেরিয়ে আসা ঘাসের কম্পণ শোনা যায়। নিস্ফল হ্রেষা আর অজ¯্র কম্পণের পাশে দাঁড়িয়ে একটা দূরন্ত বিকেল আকাশের কতা ভেবে যাচ্ছে। চারপাশে অজ¯্র অস্তিত্ব রক্ষার সুতো বাঁধা গাছ নির্বিকার। আপনি কিছু বলুন মহামান্য; কাউকে কিছু বলুন।

সেলাই মেশিনে কত ‘যুক্ত’ হবো আর, ‘মুক্ত’ কর”ন এবার। হৃদয় ঝাপসা হয়ে আসছে দিনদিন; ঠিকঠাক ‘অনুভব’ করি না। শীতার্ত অনুভূতি বুঝি ভোতা হয়ে এলো। টাইপরাইটারে বর্ণ পরার মতো ঠকঠক শীত পড়ছে তবুÑ কুয়াশা ঢেকেছে হৃদয়, তোমাকে হাতড়ে পাচ্ছি না!

গত শীতে আমার সই ছিল; এই বছর শীত কই! দূর্বাঘাসের সাথে শিশির বিন্দুর যৌথজীবনের মতো রৌদ্রযাপন কালে দেহে তরঙ্গ তুলেছিল তাপ, মনোমিটারের লাফালাফি তখনও থামেনি; তারপরের পরিণাম জেনে গেলে চোখে কুয়াশা প্রাচীর।

শীত মানে সই কাল; যুথবদ্ধ প্রণয়ে লেপের ওম।

(শীতের সই কাল)

তীরবর্তী যতো প্রাণ, দেখছে নদী থেকে মাত্রই উঠে এলো এক শব্দ। এরপর ক্রমিক সংখ্যার মতো একের পর এক শব্দ উঠে আসছে তীরে; শব্দপ্রবাহ তৈরি হচ্ছে। ¯œান সেরে উঠে আসা শব্দের দেহ থেকে ফোঁটাফোঁটা জল পড়ছে; ছড়িয়ে পড়ছে ঘ্রাণ। কবিতারও পূর্ণদেহে লেগে যাচ্ছে নদীর নিজস্ব ঘ্রাণ। ঝড়াক্রান্ত জলতরঙ্গে ভাসে জরাক্রান্ত মানুষ। প্রস্ফুটিত শীতের সকালে সে নিজেকে আত্মহন্তারক ভাবে। মনভূমি জুড়ে এমন ভাবনা বুনে সে ফিরে আসে হাওয়া বাগানের দিকে। হাওয়া বাগান জুড়ে শুধু নীলকান্ত এক, আমাদের রাণী-মা।

কারা সঙ্গ দিতে আসে রাতে নদীর বুকে তারা, সংসার বৈরাগী, ঘরভাঙা মানুষ না কি আত্মহন্তারক যে যার মতো সময়ের বিন্যাসে আসে, জলতরঙ্গে ভাসে; কাঁদে বা হাসে! তার পরের হিসাব নদীও মনে রাখে না।

রাতের সঙ্গম-শেষে শীতের ভোরে যারা মাতামুহুরীর জলে ¯œান সেরেছেন তাদের শরীরে অনুভূত তাপই সাক্ষ্য দেবে নদী ও নারীর ঘ্রাণ সম্পূর্ণ মৌলিক।

(নদীর নিজস্ব ঘ্রাণ)

দেয়ালভর্তি শুধু শুভবার্তা লেখা। শুভর শুভাগমনে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন। কেউ পড়ে না সেসব তীব্র অভিমানে। শুভ, চলে যাও! যাদের চোখের দিকে তাকালে সন্ধ্যা নামে তারা স্বপ্ন দ্যাখাতে পারে ফুরিয়ে যাওয়া গন্তব্যের। চারদিন চারদিকে হেঁটে গেলে শুধু ধূ ধূ প্রান্তর। নিঃশব্দে প্রাচীর ভেঙে পড়ছে, বাঁশীর শব্দে। নিরো, স্বপ্নসুর বাঁধো; রাঁধারমন গীত হবে। খসে যাওয়া ডানা, ভুলে সে বেদনা, ঘোড়া হাকিয়ে পাখি, স্বপ্নে ঘুম হবে, ঘুমালে স্বপ্ন হবে।

ক্ষণস্থায়ী ঘুমের স্বপ্নগুলো নিরাপদ অথচ বিভ্রান্তিময়..

সেডিল ঘুমে স্বপ্নরা হর্সপাওয়ার নিয়ে বাতাসের তাড়া খায় আর হিমালয় দেকার বাসনায় যাত্রা করে উত্তর-দক্ষিণ রেখা বরাবর…

(স্বপ্নঘুম কিংবা ঘুমের স্বপ্ন)

বিন্যস্ত গ্রামোফোনের মায়াপাশে শুয়ে আছে ছাইরঙা ড্রামা। পোশাক বদলের বেগে আবেগ বদল হচ্ছে, সাথে বদলে যাচ্ছে স্মৃতি, বিলীন প্রেমিকার মুখ! ভ্রমণব্যাগে শুধু মুখোশ; মুখোশে ভরা। নিতাশা পাখিটি আর আসে না টমেটো ক্ষেতে। আশ্চর্য বদলে গেছে দিন, কালের হিসেবে। পাখিরও মেটে না দেনা ঘর বদলের। অবসাদে অবশিষ্ট পাতারা ঝরে যায়। বিস্তীর্ণ বেলাভূমিজুড়ে, পঞ্জিকার প্রতিটি তারিখজুড়ে রয়ে যায় গান। যে গানের ছায়াপথ ধরে ভ্রান্তি সেন কাপড় শুকাতে দেয়।

কতটুকু বদলে গেলে কেউ চেনে না পথ, পূর্বেকার আস্তানা হিসেবের খাতায় চলতে থাকে মনোমিতি পাঠ; মিলে কখনো অথবা পৌনঃপুনিক আয়োজন।

সারাক্ষণ অদল-বদল খেলা আহ্নিক গতির ধারায়…

(অদল-বদল খেলা)

একটা প্লাস্টিকের পাখি নাচিয়ে নেচে নেচে যাচ্ছেন জীবন্ত বাবা। শরীরের বিভিন্ন প্রান্ত দিয়ে তার বেরিয়ে পড়ছে লুকানো ঘাসফুল; শার্টের পকেট থেকে প্রজাপতিছানা… কতো বা আটকাবেন তিনি পকেটে হাত দিয়ে আটকাতে চান প্রজাপতি, ঘাসফুল আর ছেলের জন্য সদ্য কেনা খেলার সরঞ্জাম। দশ হাতে যখন আসে ভাটার টান, দু’হাতে তখন ক’টা আটকাও বাজান গুচ্ছ গুচ্ছ বেলুন, পাখি বাবার মাথার উপরে উঠে যাচ্ছে আর বাবা তার দুই হাত ছুঁড়ছেন শূন্যে…

বাবা প্রায় বলতো বাজান, সবকিছু কিনে দেব বছরের শেষে; নতুন জামা, বাটা জুটা, ফুলপ্যান্ট, সানগøাস আর ফনিক্স সাইকেল। কিন্তু দিয়ে যেতে পারেননি সব। তার আগে আমি বাবাকে দখিনের গোরে নতুন মাটিতে শুয়ে দিয়ে এসেছি নভেম্বরের শীতের সন্ধ্যায়।

(ফনিক্স সাইকেলের স্মৃতি)

হাহাকার জমা আছে মনে। কতোটা চাই, ফিরে পেতে। পাওয়া হয় না। কতো স্মৃতি জমিয়ে রেখেছি মায়াপাশে। এই বৃথাবাক্সে জমিয়ে রাখা স্মৃতিচিহ্ন। হুমায়ুন আজাদ লিখেছিলেন, ‘তোমার অভাব বড় বোধ করে এ শহর … আজও তোমার অভাবে কেউ কেউ ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে।…’ বলুন, এতোটা অভাব বোধ নিয়ে কী করে গান গাইবে পাখি আমি তবু কিছু সুর বাক্সবন্দী করে রাখি। কিছু হাহাকার মাটিতে গেঁথে প্রতিদিন জল দিই, আলো-বাতাস দিই; কোনো একদিন, যদি তুমি আসো

খালি হাতে ফিরে আয় ঘরে, রানু
তোরে আমি মন দেব ধন দেব
বুক জুড়ে ভরে দেব আরাধ্য স্বপন
ফিরে যদি এসো তবে ফুল দেব হাতে
পরম সোহাগ দেব তারা ভরা রাতে।

(ফিরে আয় ঘরে, রানু)

 

নোট উদ্ধৃত কবিতা ও কবিতাংশগুলো কবি ভাগ্যধন বড়–য়ার কবিতাবই ‘নদীর নিজস্ব ঘ্রাণ’ থেকে নেয়া।

Share.

জন্ম ও বেড়ে ওঠা বাঙলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলায়৷ জন্মতারিখ: ৩০ ডিসেম্বর সম্পাদিত লিটলম্যাগ: বিন্দু (২০০৬ থেকে চলমান) প্রকাশিত পুস্তিকা: সুবিমল মিশ্র প্রসঙ্গে কতিপয় নোট (গদ্য), বিগত রাইফেলের প্রতি সমবেদনা (কবিতা), মার্কস যদি জানতেন (কবিতা), হলুদ পাহাড় (কবিতা) প্রকাশিত কবিতার বই: চোখের ভেতরে হামিং বার্ড

Exit mobile version